ক্ষুদ্র নয়, মাঝারি ও বৃহৎ মালিকানার দখলে বরিশাল বিসিক

সদানন্দ সরকার

Sharing is caring!

ক্ষুদ্র নয়, মাঝারি ও বৃহৎ মালিকানার দখলে বরিশাল বিসিক 

মাটি ভরাট আর সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের মধ্যেই আটকে আছে বরিশালে বিসিককে দেশের বৃহৎ ক্ষুদ্র শিল্পনগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজ। এখানের বরাদ্দ প্রাপ্ত প্লটের বেশিরভাগই দখল করেছে মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প মালিকরা। একই গ্রুপ অব কোম্পানি বিভিন্ন নামে প্লট বরাদ্দ নিয়ে বঞ্চিত করছে ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের। আর এ কাজে সাহায্য করছে বিসিক প্রশাসন কর্তৃপক্ষ। এমনটাই অভিযোগ উদ্যোক্তা হতে আসা অনেক ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান মালিকদের। এমনকি বরিশালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) এর নিজস্ব ভবনটিও এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি বলে জানান স্থানীয় মরকখোলার বাসিন্দারা।

যদিও জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন হায়দার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিসিককে শক্তিশালী করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি এজন্য ক্ষুদ্র কুটির শিল্প উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসারও আহ্বান জানিয়েছেন বেশ কয়েকটি সভা সেমিনারে। কিন্তু কার্যত বিসিকে কোনো উন্নয়নই দৃশ্যমান হয়নি আজ পর্যন্ত। আর এজন্য বিসিক কর্মকর্তাদের উদাসীনতাকেই দায়ী করেন নাগরিকদের অনেকে।

সরজমিন ১১ মে বৃহস্পতিবার বিসিক নগরীতে ঘুরে দেখা গেল,  ভিতরটা এখন গত বছরের তুলনায় অনেক পরিচ্ছন্ন ও সড়কগুলো পাকা হয়েছে। তবে বিসিক এর নিজস্ব দূর্বল ভবনটি এখনো অবহেলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আগের জায়গাতেই। এটি ভেঙে ছয়তলা ভবন তৈরি হবার কথা প্রচলিত আছে গত একবছর ধরে। আর প্রায় ছয়মাস ধরে ভাড়া করা বাড়িতে বিসিক কর্মকর্তাদের অফিসিয়াল কার্যক্রম চলছে। যা সরকারের তথা জনগণের টাকার অপচয় ছাড়া আর কিছু নয় বলে মনে করেন নগর চিন্তাবিদ এনায়েত হোসেন শিবলু। শিবলু বলেন, শুধু নীচু জমি ভরাট করে সীমানা বাড়ালেই হবেনা। প্লট তৈরি করে সত্যিকারের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের হাতে দিয়ে প্রমাণ করতে হবে এটা। এখন পর্যন্ত যাদের দেয়া হয়েছে তাদের বড় একটা অংশ আগে থেকেই শিল্পপতি। বিসিকে তাদের প্লট বরাদ্দ দেওয়াটা অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ।বিসিক নগরীতে আসা-যাওয়ার প্রধান আরেকটি সমস্যা যোগাযোগ ব্যবস্থা। এখানের প্রবেশের প্রধান ফটক সংলগ্ন সড়কটি বরিশাল সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের। আর বারবার অভিযোগ করার পরও আশেপাশের সড়ক সংস্কার করলেও অজ্ঞাত কারণে তারা এই সড়কের উন্নয়নে কোনো আগ্রহ দেখাননি। ভাঙাচুরো, খানাখন্দভরা  এ সড়কটির আরেকনাম মড়কখোলা রোড। তাই শ্মশান এলাকায় সন্ধ্যার পর আসা-যাওয়া সাধারণ কর্মী ও মালিকদের জন্য কিছুটা ভিতীকর বলেই মনে করেন ফরচুন সুজ এর কর্মী হাসিবুর রহমান। তিনি বলেন, সন্ধ্যা হলেই ভিতরে উঠতি মাস্তানদের ও বখাটেদের উৎপাত শুরু হয়। বিভিন্ন কোনায়, পুকুরের পাড়ে বসে নেশার আখড়া। তাই চলাচলে ভয় হয়। বিশেষ করে এখানে কর্মরত মেয়েদের তাই সন্ধ্যার আগেই চলে যাওয়ার তাড়া থাকে। 

যতদূর জানা যায়,  বরিশালে বিসিক শিল্পনগর প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয় ১৯৬১ সালে। প্রায় ১৩১ একর জমির ওই শিল্পনগরে ঐ সময়ে প্লটের সংখ্যা ছিলো ৪৪৬টি। এর মধ্যে ৩৭৮টি প্লট বরাদ্দ দিতে পেরেছিলো বিসিক কর্তৃপক্ষ। বরাদ্দ করা প্লটে শিল্প ইউনিট সংখ্যা ছিলো ১৭৩টি ও যার মধ্যে ৭২টি উৎপাদনে ছিলো। বর্তমানে উৎপাদনে আছে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। যার সংখ্যা ৩০টির বেশি নয় বলে জানান স্থানীয় নিরাপত্তারক্ষীদের একজন। পরবর্তীতে জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করে ২৩০ একর জমিতে দেশের সবচেয়ে বড় বিসিক শিল্পনগরী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা এখনো আটকে আছে বিভিন্ন প্রশাসনিক জনিত সংকটে। বর্তমানে এখানে ১৩৮টি ছোট-বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে দাবী বিসিক কর্মকর্তাদের। তবে আশেপাশের বাসিন্দারা বলছেন, এই ১৩৮টি প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই একই মালিকের চার থেকে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেমন প্রিমিয়ার এর তিনটি প্লটই কিন্তু ফরচুন গ্রুপের। কারণ ওটি আসলে ফরচুন গ্রুপেরই অংশ। এভাবে ইত্যাদি, বেঙ্গল বিস্কুট সহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানেরই একাধিক প্লট রয়েছে যা আসলে একই মালিকের। তবে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে সড়ক ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা,  বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারণে বলে জানান ক্ষুদ্র কুটির শিল্প উদ্যোক্তা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এগ্রো ফুডসের ব্যাবস্হাপক ইব্রাহিম খান। তিনি বলেন, নিজস্ব বিদ্যুৎ সুবিধা চালু হলে কাজের গতি বাড়বে। তবে গ্যাসের অভাবে আমাদের অনেক কাজ ব্যহত হচ্ছে। আমরা এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছিনা ঐ গ্যাসের অভাবেই। ইব্রাহিম খান আরো বলেন, বরিশালে, ডক ইয়ার্ড, মটর পার্টস তৈরি, গার্মেন্টস শিল্পসহ বিভিন্ন বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হবে গ্যাস সমস্যার সমাধান হলে।

বিসিক উপমহাব্যবস্থাপক জালিস মাহমুদও বলেন, বরিশাল বিসিকের প্রধান সমস্যা হচ্ছে বহিরাগতরা এখানে আচমকা ঢুকে পড়ে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের ওপর হামলা করছে। এর প্রতিবাদে এখানের ব্যবসায়ীরা নগরীতে মানববন্ধনও করেছে। গ্যাস বা জ্বালানি সুবিধা পেলেই বরিশাল বিসিক সয়ংসম্পূর্ণ বলা যাবে।জালিস মাহমুদ আরো জানান, বিসিকের উন্নয়নের জন্য ২০১৮ সালে ৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। ঐ টাকায় সড়ক, নালা ও সীমানাপ্রাচীর নির্মাণসহ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম এখনো চলমান আছে। 

সুজন বরিশালের সদস্য সচিব রফিকুল আলম বলেন,  আমি বেশ কয়েকজন ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তার সাথে কথা বলে জেনেছি, উদ্যোক্তা হতে এসে কাগজপত্র জটিলতা ও ঋণ সুবিধা বঞ্চিত হয়ে তারা আবার ফিরে গেছেন। এটা যাতে না হয়, কাগজপত্র সংক্রান্ত জটিলতা সহজ  করা ও সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার বিষয়টি প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে। সবাইতো সরাসরি জেলা প্রশাসকের কাছে যেতে পারেননা। তাই বিসিক কর্মকর্তাদের তা সহজ করতে হবে।রফিকুল আলম আরো বলেন,  প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের শীতলপাটি ও মৃৎশিল্পসহ নানা ধরনের উপকরণ নিয়ে বিসিক সাজানোর। যদিও বিসিক এলাকায় কেবল, কয়েল, প্যাকেজিং ও পলিথিন কারখানা পেলেও অলিগলি ঘুরে কোথাও দেখা যায়নি এধরণের কোনো শিল্প উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান।

জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন হায়দার

বরিশালের জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন হায়দার বলেন, আমি বরিশালে আসার পর থেকে বিসিককে শক্তিশালী করতে যা যা করনীয় তা করার জন্য সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি।  নীচু এলাকা ও ডোবা ভরাট করে জমির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে।  বিসিক কর্মকর্তা ও উদ্যোক্তা মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ যখন যা চাচ্ছে  তা দেয়ার চেষ্টা করছি। বিদুৎ ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়েছে। এখন শুধু চালু হবার অপেক্ষা। আর ভোলা থেকে গ্যাস আনার বিষয়টি যেহেতু আমার একক বিষয় নয়, তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে কথাবার্তা চলছে।  আমরা আশাবাদী হয়তো একটু দেরীতে হলে গ্যাস সমস্যার সমাধান হবে। তিনি আরো বলেন,  আমি বরিশালকে একটি বাণিজ্যিক নগরীর হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। আর এজন্য রাজনৈতিক,  সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দসহ সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। বৃহৎ শিল্প উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসলে বরিশালে পৃথক একটি শিল্প নগরী বা ইপিজেড স্থাপন হতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন হায়দার।

 

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!