৩৩৩ নিয়ে ভয়ে থাকেন অসহায়: চাকুরীচ্যূতরা ও সাংবাদিক থাকেন লজ্জায়!

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাহিত্য বাজার

Sharing is caring!

বিগত দুই বছরে বাংলাদেশে করোনার প্রভাবে চাকুরী হারিয়ে বেকার হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। শুধু বরিশাল জেলাতেই এমন বিপর্যস্ত জীবনে আছেন সর্বনিম্ন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। সারাদেশের পরিসংখ্যান অগুনিত। একইসাথে দেশের প্রত্যেকটি জেলা শহরের সাংবাদিকতার পেশায় যুক্ত আছেন আরো প্রায় ৩৩ হাজার মানুষ। যাদের মধ্যে বরিশালে আছেন প্রায় ৫০০ সাংবাদিক। এই সাংবাদিকদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া বাকী সবাই আসলে বেকারত্বের জীবনযাপন করছেন। চাকুরী হারানো মানুষগুলোর সাথে তাদের পার্থক্য এইটুকু যে তারা তথ্য সংগ্রহের নেশায় ভুলে থাকেন ঘর সংসার। ঘরে কিন্তু তাদেরও খাদ্যহীন জীবন। ঠিকমতো খাবারটাও জোটেনা বরিশালে চোখের সামনেই রয়েছে এমন বেশকিছু প্রমাণ।

লোকাল কাগজের একজন সাংবাদিক জসিম জিয়া বলেন, প্রতিমাসে সংসারের খরচ আছে সর্বনিম্ন ১৫হাজার টাকা। কোনো লোকাল পত্রিকা বরিশালে নিয়মিত বেতন দেয়না। বলতে পারেন বিভিন্ন উপায়ে খরচ জোগার করি আমরা। ধারদেনায় ডুবে আছি বেশিরভাগ সাংবাদিক।

ঢাকার একটি বায়িংহাউজের কোয়ালিটি ইনচার্জ রফিকুল ইসলাম বলেন, করোনার প্রথম বছরেই ২০২০ এর এপ্রিলে চাকুরীচ্যূত হয়ে বরিশালে চলে এসেছি। কর্ণকাঠী গ্রামের বাড়িতে বড়ভাইয়ের উপর বোঝা হয়ে আছি আজ দুইবছর, কোনো কাজ নেই, বড় মেয়েটি টেনে পড়ে, ছোট ছেলে ফাইভে। মাঝে মধ্যে বের হয়ে স্যানেটারির কাজ করতাম, লকডাউনের জন্য সেটাও বন্ধ।

করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে সরকারের গৃহীত কঠিন লকডাউন যত বাড়ছে ততই দুর্বিষহ হয়ে উঠছে এই চাকুরীচ্যুত এবং স্বকার সাংবাদিকদের জীবন।
২০১৯ এর ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম যখন ‘অজানা’ একটি ভাইরাস সংক্রমণের খবর প্রকাশিত হয়, তখন মানুষ ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারেনি যে সেই ভাইরাসটি পরের ৬ মাসের মধ্যে পুরো পৃথিবীকে ওলট পালট করে দেবে।
তারপর বিগত দুই বছরে বিশ্বজুড়ে এর প্রভাব ক্রমশ বেড়েই চলছে। বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়েছে বলে গত এপ্রিলে জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি। এ পরিসংখ্যান ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
তাদের দেয়া তথ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। তারপর ব্রাজিল, মেক্সিকো এবং ভারতে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে সব মিলিয়ে দেশে এ পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৯১৭। মোট মৃত্যু হয়েছে ১৫ হাজার ৬৫ জনের। মৃত্যু সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে সরকার প্রথমে সীমিত পরে কঠিন লকডাউনের আওতায় এনেছেন সারাদেশ।
সমস্যা হচ্ছে মানুষকে ঘরে বন্দী রাখা। শ্রমিক শ্রেণির মানুষের দাবী আমাদের খাদ্য নিশ্চয়তা দিন আমরা ঘরে থাকবো।

আমাদের খাদ্য দিন আমরা ঘরে থাকি

কীর্তনখোলা পাড়ের এই মানুষগুলো নাজমা, জামাল ও অন্যরা চা দোকান করে জীবীকা চালায়। এরা জানেনা ৩৩৩ নম্বর কি? লকডাউনে সব বন্ধ। রাতের ঘাট বন্ধ। দিনেও লোকসমাগম নেই তেমন। দিনে আর চা দোকান খুলতে পারেন না এরা। ফাঁকফোকরে একটু খুললেই পুলিশ এসে ভেঙে দেয়। জরিমানা করে। গত ৭দিন অনেক কষ্টে খাবার জুটেছে কপালে। যেদিন কড়াকড়ি বেশি হয় সেদিন অনিশ্চিত দুপুর ও রাতের খাবার। এরা জানেনা এখন কি খাবে? জানেনা ৩৩৩ নম্বরের কথা। সরকারের খাদ্য সহয়তা কীভাবে পেতে হয় তাও জানেনা এরা?
আমাদের খাদ্য দিন, ৭ দিন কেন ৩০ দিন ঘরে বসে থাকবো – বলে অনুযোগ এই মানুষগুলোর।

সরকার এদের কথা ভেবেই ৩৩৩ নম্বরের ব্যবস্থা করে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তা সেল চালু করেছেন। গত ৫ জুলাই দেশের প্রতিটি সিটি কর্পোরেশনকে নগদ ২৫ লাখ টাকা ও ৫০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দও পাঠান। প্রতিটি জেলায় গড়ে দেড় লাখ হতদরিদ্র পরিবারের জন্য কি এই বরাদ্দ যথেষ্ট? এ প্রশ্ন সুশীল সমাজের নেতাদের। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা কর্মচারীদের পরিবার আত্মীয় পরিজনদের রেখে এটা কতটুকু পৌছবে সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্ন আরো অনেকের?

বরিশালের সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সাধারণ সম্পাদক রণজিৎ দত্ত যা বলেন –

রণজিৎ দত্ত

করোনাকালীন সংকটে গৃহবন্দী হওয়াটা যেমন জরুরী তেমনি জরুরী মানুষের খাদ্যের নিশ্চয়তা। আর এই জায়গায় দাঁড়িয়ে সবার আগে প্রয়োজন বাস্তবিক অর্থে সংকটাপন্ন মানুষের তালিকা তৈরি করা। এক শ্রেণীর মানুষ আছেন শিক্ষিত এবং একসময়ের সম্ভ্রান্ত পরিবার। করোনাকালীন সংকটে চাকুরী হারিয়ে বেকার জীবন এখন। ঘরে ঠিক মতো খাবার নেই। এদিকওদিক ফাইফরমাশ খেটে যা টাকা আয় হয়, তা চলে যায় সন্তানের পড়াশুনার পিছনে। এমন অসহায় পরিবারের সংখ্যা শুধু বরিশালেই ৫ হাজারের কম নয় বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর বরিশাল সাধারণ সম্পাদক রনজিৎ দত্ত। তিনি বলেন, ৩৩৩ একটি ভালো উদ্যোগ সরকারের। কিন্তু এটির ভুল ব্যবহার হচ্ছে। চাকুরীচ্যুত অসহায় মানুষ হোক কিম্বা ভুমিহীন কৃষকদের তালিকা হোক। উপকূলের জেলেদের তালিকা যেখানে নয় ছয় হচ্ছে। সরকার কি তা থেকেও শিক্ষা নিচ্ছেন না। ৩৩৩ নম্বর একটা আছে বটে। বরিশালে এই নম্বরের কোনো ব্যবহার হয়েছে কি আদৌ। প্রয়োজনই পরেনি কারণ, বরিশালের জেলা প্রশাসক সুযোগ পেলেই ত্রাণ বিতরণ করছেন নিয়মিতই বলা চলে। মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ নিজেও এদিকে ওদিকে ঘুরে অসহায়দের সহযোগিতা দিচ্ছেন। তারপরও বরাদ্দ তুলনায় লোকসংখ্যা বেশি হলে সংকট থেকেই যায়। সরকারের এই খাতে বরাদ্দ আরো বাড়াতে হবে।

রণজিৎ দত্ত আরো বলেন, এখানে সাংবাদিকদের দিকেও প্রসাশনের দৃষ্টি দেয়া জরুরী। মফস্বল সাংবাদিকদের কেউই এই শহরে ভালো নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাংবাদিকরা সাধারণ মানুষের তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেন, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো থেকে শুরু করে যাবতীয় সংবাদ তারা পরিবেশন করেন বলেই সরকার বা প্রশাসন অবগত হয়। সেই তাদের জীবন নিয়ে ভাবনাটা আড়ালেই থেকে গেছে সবসময়।

সাংবাদিক ও একসময়ের স্বাচ্ছন্দ জীবনের মানুষ কি লাজ লজ্জা মুছে দিয়ে ৩৩৩ এ ফোন করে সাহায্য পেতে চাইবে। মাসের পর মাস বেতন না পাওয়া সাংবাদিক বন্ধুদের প্রতি তাদের নিজ পেশার মানুষেরই সহমর্মিতা খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। সাংবাদিক শুনলে বাসা ভাড়া দিতে রাজী নয় সয়ং সাংবাদিক নিজেই। আর সংস্থা আর ইউনিয়নের নামে দলীয়করণ তো আছেই। কোনো সরকারি অনুদান এলেই তা আগে চলে যায় ঐ সাংবাদিক সংস্থা বা ইউনিয়ন নেতাদের কাছে। তারা তাদের সদস্য ছাড়া অন্যদের প্রতি তাকাবার সুযোগ কোথায়?

বরিশাল প্রেসক্লাবের সাবেক সহসভাপতি অধ্যাপক তপংকর চক্রবর্তী যা বলেন –
বরিশালের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অতি পরিচিত নাম অধ্যাপক তপংকর চক্রবর্তী। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি প্রথমেই ভুটান এর উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, ভুটান ছোট্ট দেশ- সেখানে গত দুই বছরে কোভিড – ১৯ এ মারা গেছে মাত্র ১ জন। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেই একজন ডাক্তার, তিনি হেলিকপ্টার নিয়ে ঘুরেছেন আর মানুষকে ঘরে থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন । সবাইকে ঘরে খাদ্য পৌঁছে দিয়েছেন। এটা সম্ভব হয়েছে কারণ চেষ্টা ছিল তাদের। ছিলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা। আমাদের যা নেই। এই ৩৩৩ এর জন্য একটা শক্তিশালী কমিটি গঠন খুবই জরুরী। যেখানে সব শ্রেণী পেশার মানুষের সম্পৃক্ততা থাকবে। সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও প্রশাসন মিলে একটা কমিটি না হলে সংকট কাটবেনা।
একটু অবস্থাপন্ন যারা তাদের জন্য ডিসি অফিসে একটা সরাসরি সংযোগ থাকবে। ডিসি নিজে তাদের সহযোগিতা করলে বিষয়টি সম্মানজনক হবে। তবে আমি মনে করি, এগুলোর কিছুই প্রয়োজন হবেনা যদি রেশনিং ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে রেশনিং পদ্ধতি সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হোক।
আমাদের দেশের কিছু আইন আছে যা সুন্দর কিন্তু বাস্তবায়ন নাই। বয়স্ক ও বিধবা ভাতার প্রচলন আছে। ৬৫ বছর বয়স হলেই সচ্ছল বা অসচ্ছল সবাইকে এই ভাতা দিতে হবে। কেউ যদি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করতে না চায় সেটা আলাদা কথা। কিন্তু রাষ্ট্র সবাইকে দেবে। একটি বিভাগীয় জেলা শহরের এই সব বিষয় নিয়ে সাধারণত বিভাগ বা জেলা উন্নয়ন সংস্থা বা কমিটি এগুলো ভাববে। কিন্তু গত ২৭ বছরে বরিশালে এসব কিছুই হয়নি। তাই এগুলো নিয়ে জেলা প্রশাসন কে ভাবতে হবে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এতোদিন বরিশালে হয়তো কর্মসংস্থান সৃষ্টির অন্তরায় ছিলো। আগামী পাঁচ বছর এ চিত্র বদলে যাবে, অনেক উন্নত হবে বরিশালের এটা বলতে পারি।। নির্ভর করে আমাদের চিন্তা চেতনার উন্নয়ন কতটা তারউপর। নদীবেষ্টিত এই জেলায় ইস্পাত কারখানা, পাট, মৎসশিল্প, নারিকেল, পেয়ারা ইত্যাদি যেকোনো কারখানা তৈরি সম্ভব। যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করে দিয়েছেন, গ্যাসও হয়তো চলে আসবে শীঘ্রই। ভোলা থেকে পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস আসাটা কেন হলোনা তা সাংবাদিক বন্ধুরা ভালো বলতে পারবেন।
তপংকর চক্রবর্তী বলেন, তবে বরিশালে সাংবাদিক পেশার প্রতি খুব একটা সমীহ কারো নেই। এখানে জেলায় প্রায় ৫০০ সাংবাদিক আছেন বটে। তবে মুলধারার সাংবাদিক কতজন তা নিয়ে বিতর্ক আছে। ৪০ /৪৫টি পত্রিকা এই জেলা থেকে ডিক্লেয়ারেশন। কয়টা নিয়মিত প্রকাশিত হয় প্রশাসনের তা নজরদারি প্রয়োজন। বেশিরভাগ সাংবাদিক এখানে হতদরিদ্র অবস্থায় আছেন।বরিশাল প্রেসক্লাব, সাংবাদিক ইউনিয়ন, রিপোর্টাস ইউনিটি। এভাবে সংগঠন ভুক্ত যারা তারা কিছুটা ভালো থাকলেও অন্যদের অবস্থা এতোটাই শোচনীয় যে নিজেরাই নিজেদের কাউকে টাকা ধার দেবেনা। অভাবে স্বভাব নষ্ট, ফলে না হয় ভালো সাংবাদিকতা না হয় ভাগ্যের উন্নয়ন। এই ক্ষেত্রে সরকারের ডিকলারেশন দেয়ার আগে ভাবা উচিত। এই আধুনিক ডিজিটাল যুগে এসে মফস্বল শব্দ নয়, জেলা সাংবাদিকদের মানসম্পন্ন বেতন নিয়ে রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। জেলা প্রশাসন ইচ্ছে করলেই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে পারেন । সাংবাদিকদের সহয়তাও দিতে পারেন। তার বিভিন্ন ফাণ্ড আছে। তবে সেক্ষেত্রে সংগঠন বা সংস্থা বিচার না করার অনুরোধ জানাবো। যাচাই বাছাইয়ের পর একজন ভালো সাংবাদিকই যেন অনুদানটা পান এ অনুরোধ থাকবে।

সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ৩৩৩ নম্বর প্রসঙ্গে এখানে কথা উঠেই যায়। এখানে ফোন করে সংযোগ পাওয়া কি খুব সহজ? যদি ভাগ্যবান কেউ সংযোগ পেয়েও যান নিরাপত্তা জনিত প্রশ্ন শুনেই ভড়কে যাবেন সাধারণ মানুষ। আপনি যে এলাকার ভোটার সে এলাকা থেকে নিতে হবে সাহায্য! অথচ ভুক্তভুগী আছেন ভোলার চরে। ভোটার তিনি বরিশাল সদরের। তাহলে এই লকডাউনে কীভাবে চলাচল হবে তার? সে সুযোগই যদি থাকে তবে কি ৩৩৩ এ ফোন করে কেউ?
তারপরও তথ্য ও সমস্যা শুনে এখান থেকে ফোন করে জানানো হবে সংশ্লিষ্ট জেলায়। সেখান থেকে ইউএনও বা চেয়ারম্যান হয়ে কাউন্সিলর বা মেম্বর। সাথে থাকতে হবে উপজেলা বা ইউনিয়ন দলীয় নেতার সুপারিশ! পছন্দমতো না হলে শাস্তি বা মারধরের প্রমাণতো পত্রিকার পাতাজুড়ে রয়েছে।তাহলে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করার দুঃসাহস দেখাবে কে বলতে পারেন?
আর এসব কারণেই সরকারী জরুরী ত্রাণ সহায়তা পেতে ৩৩৩ এ ফোন করতে ভয় পান বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ। আবার এমন অনেকে আছেন, যাদের কষ্টের জীবন তবুও লোক লজ্জায় ফোন করতে পারেন না এই নম্বরে।
জেলা শহরের গণমানুষের সাথে কথা বলে দেখা গেছে, বেশিরভাগ মানুষের মনেই এখানে ফোন করা নিয়ে বিভিন্ন রকমের শঙ্কা ও আতঙ্ক কাজ করছে। কি বলবে, কাকে বলবে, কীভাবে বলতে হয়? বললে, ওপ্রান্তের উত্তর কি হবে? এসব ভাবনায় গুছিয়ে কথা বলতে না পারার ভয়ও কম নয়। অন্যদিকে ঘরবাড়ি ‍আছে ‍একসময় অবস্থাপন্ন পরিবার এখন করানাকালীন সংকটে পড়ে ঠিকমতো খাবার জোগার হচ্ছেনা তাদের মধ্যে কাজ করছে লজ্জা ও শঙ্কা। তাদের বিষয়ে যতক্ষণ তথ্য পাওয়া যাবেনা, ততক্ষণ আসলে কিছুই করার নেই। তবে তার প্রতিবেশী বা শুভানুধ্যায়ী কেউ এ ধরণের সংকটে থাকা মানুষের তথ্য জেলা প্রশাসন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন। জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে তখন সাহায্য করার চেষ্টা হতেও পারে বলে জানান বরিশালের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ দুলাল
তিান এ বিষয়ে সরাসরি বরিশালের জেলা প্রশাসক জসিম উদদীন হায়দার এর সাথে কথা বলে তার বক্তব্য বেশি বেশি প্রচারের পরামর্শ দেন।
কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে গত একসপ্তাহ ধরে তার সাথে য্গোযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েই তার বক্তব্য ছাড়াই এ প্রতিবেদন ছাপতে হলো।

প্রতিবেদকের সাথে সাংবাদিক সালেহ টিটু

এবিষয়ে কীর্তনখোলা পত্রিকার সম্পাদক ও বরিশালের এস এ টিভি প্রতিনিধি সাংবাদিক সালেহ টিটু বলেন, অসহায় হতদরিদ্র মানুষের জন্য ৩৩৩ নম্বরে ফোন করাটা খুব সোজা নয়। তারপরও তাদের হয়ে অন্য কেউ ফোন করছে এবং জেলা প্রশাসন থেকে সাহায্যও করা হচ্ছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের কারো জন্য বা অসহায় সাংবাদিকদের জন্য ৩৩৩ নম্বরে ফোন করা আরো কঠিন কারণ, চক্ষু লজ্জা বা লোক লজ্জার ভয় তাদের বেশি। এ ক্ষেত্রেও তার নিকটতম প্রতিবেশী যদি জেলা প্রশাসনে বা ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে তথ্য দেন, আর জেলা প্রশাসক নিজে তদন্ত করে ঐ পরিবারের নিকট বিকাশ বা অন্য কোনো মাধ্যমে অর্থ সাহায্য দেয়। সেটাই হবে সু ব্যবস্থা।

এবার আসুন জানা যাক বরিশালের সাংবাদিক নেতারা কি ভাবছেন ?

কাজী মিরাজ মাহমুদ ( সাধারণ সম্পাদক বরিশাল প্রেসক্লাব)

বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক আজকের পরিবর্তন পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক কাজী মিরাজ মাহমুদ মফস্বল সাংবাদিক ও ৩৩৩ এর সমস্যা তুলে ধরে বলেন, মুলধারার সাংবাদিকতার বাইরে এখন অনলাইন সাংবাদিকতা যুক্ত হয়েছে। এখানে অনেকে যেমন ভালো সাংবাদিকতা করছেন তেমনি খারাপ বা দুর্নীতির অভিযোগও কম নয়। এখন এই জায়গাটা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা খুব জরুরী হয়ে গেছে। সরকার মফস্বল সাংবাদিকদের একটা তালিকা প্রকাশ করার কথা, সেটা কতদূর কি হয়েছে জানা নেই। হলে সঠিক সাংবাদিকদের বাছাই করে তাদের জন্য অনুদান প্রদান সহজ হতো। প্রধানমন্ত্রী গত বছর বরিশালের সাংবাদিকদের একটা অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। গত ঈদের আগেই সেটা পাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তা এখনো আসেনি। জেলা প্রশাসক থেকে জেলার কিছু দুঃস্থ সাংবাদিককে সহায়তা করার কথা রয়েছে। প্রেসক্লাবের জন্যও হয়তো একটা অনুদান তিনি দেবেন বলে আশা করছি। আমাদের প্রেসক্লাবে মোট কার্যকরী সদস্য ৮২ জন, এছাড়া সহয়ক সদস্য আছেন ৬০ জন।
আর জেলায় মোট সাংবাদিক পরিসংখ্যান এখন আর বের করা সহজ নয় ঐ অনলাইন সাংবাদিকতার কারণে।
অসহায় দুঃস্থ সাংবাদিক কিম্বা সাধারণ মানুষ কিম্বা অভিজাত পরিবার যারা করোনাকালীন দারিদ্র্যের শিকার তাদের সকলের জন্যই ৩৩৩ নম্বরটি। তবে এটির সমস্যা হচ্ছে সহজে এ নম্বরের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া যায়না। আবার যদি যায়ও ওপ্রান্ত থেকে নিরাপত্তামূলক প্রশ্ন শুনে ভড়কে যান সাধারণ মানুষ। এটির বিকল্প চিন্তা জরুরী। জেলা প্রশাসনের নিজস্ব নম্বর থাকা উচিত। যেমনটি রয়েছে বরিশাল RAB ৮ এর।

স্বপন খন্দকার (সভাপতি, বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়ন )

বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়ন (জেইউবি) সভাপতি স্বপন খন্দকার এর সাথ আমাদের কথা হয় – করোনাকালিন সংকটে মফস্বল সাংবাদিকদের অবস্থা ও সরকারের সহযোগিতা, ৩৩৩ নম্বরের ব্যবহার এবং করোনাকালীন সময়ে চাকুরীচ্যুত হয়ে বরিশালে ফিরে আসা অসহায় মানুষদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
স্বপন খন্দকার জানান, করোনাকালীন সময়ে চাকুরীচ্যুত হয়ে বরিশালে ফিরে আসা অসহায় মানুষদের তালিকা জেলা প্রশাসন থেকে তৈরি হতে পারে। তবে এ জন্য শ্রমদপ্তর রয়েছে। জেলা প্রশাসন পারে প্রশাসন ও রাজনৈতিক সমন্বয় তৈরি করে একটা সুষ্ঠু বন্টন নীতিমালা করতে। ৩৩৩ এ ফোন করলেই সংশ্লিষ্ট এলাকায় প্রশাসন কোনো মাধ্যম ব্যবহার না করে নিজেই সাহায্য পৌঁছে দিলে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম হবে।
মফস্বল সাংবাদিকদের একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরে স্বপন খন্দকার জানান,
বরিশাল সিটিতে জেইউবি, প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংস্থায় প্রায়
২০০/২৫০ জন সাংবাদিক কাজ করছেন। এছাড়া অনলাইন ও স্থানীয় পত্রিকায় ৫০/৭০ জন হবে হয়তো। গড়ে এটা ৩০০ এর বেশী নয়। আর দশটি উপজেলায় গড়ে দশজন করে ১০০ জন নিয়ে মোট ৪০০ সাংবাদিক বরিশাল জেলায় কাজ করছেন। বরিশাল জেলায় সর্বমোট ৪২ টা পত্রিকা আছে। অথচ রিপোর্টার আছে ২৫/৩০জন। এদের অধিকাংশই নিয়মিত বেতন বা সম্মানী পান না। আমরা আমাদের সংস্থার সদস্যদের যেভাবে হোক যতটুকু হোক সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করি। গতবছর করোনাকালীন পরিস্থিতিতে সরকার থেকে সারাদেশে ৪০০০ এর মতো সাংবাদিককে অনুদান দেয়া হয়েছে। যার একটা অংশ বরিশালের ইউনিয়ন পেয়েছে।
চলতি বছর ইউনিয়নের বাইরেও কিছু সাংবাদিক কে সহায়তা প্রদানের জন্য বলেছি। করোনাকালীন দুর্যোগ মোকাবেলায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে পরষ্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। এর বিকল্প কিছু নেই বলে মনে করেন জেইউবি সভাপতি।

মিথুন সাহা (সাধারণ সম্পাদক, বরিশাল রিপোর্টারস ইউনিটি)

বরিশাল রিপোর্টারস ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক বৈশাখী টেলিভিশন এর বরিশাল প্রতিনিধি মিথুন সাহার সাথে ৩৩৩ নম্বরের সহায়তা, চাকুরীচ্যুত ঘরে ফেরা মানুষের দূর্দশা ও মফস্বল সাংবাদিকদের অবস্থা নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি প্রথমেই ভারতের রেশনিং পদ্ধতির উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, আমাদের এখানে এই ত্রাণ শব্দটাকে রেশনিং এ বদলে দেয়ার বিনীত অনুরোধ জানাবো সরকারের কাছে। সেইসাথে রেশনিং ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র বা ভোটার আইডি বা জন্মনিবন্ধন পত্র হতে পারে রেশনিং বন্টনের উপায়।
মিথুন সাহা বলেন, ২৭ বছরের একটি বিভাগীয় শহরের অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়ন আপনি খুঁজে পাবেন না। নেই কোনো উন্নয়ন কমিটি। নাগরিকদের সংগটিত হওয়ার কোনো সংগঠনও এখানে নেই। নেই কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন। অথচ সুযোগ আছে। বিশেষ করে আমাদের বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ এই শহরটি সাজাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তার সাধ্য মতো। প্রয়াত মেয়র হীরন এর উন্নয়ন নক্সায় বিগত সময়ে কোনো কাজ হয়নি, এখন সেটা হচ্ছে। শহরের অবকাঠামো ঠিক করতে বর্তমান মেয়র ২৩শত কোটি টাকার বাজেট দিয়েছেন। সরকার তা দেয়নি বলেই তিনি অল্প অনুদান গ্রহণ করছেন না। নিজের পকেটের টাকায় কাজ করে চলেছেন। এখানে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন ঢাকার একটি শাখা পাবেন। যার তেমন ভূমিকা নেই বললেই চলে।
করোনাকালী সংকটে সারাদেশে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়েছেন। বরিশালেও ফিরে এসেছেন এমন অনেকেই। পুরো জেলায় আনুমানিক ১০ হাজারতো হবেই। শ্রমদপ্তরে দাপ্তরিকভাবেই এই তথ্য থাকা উচিত। স্থানীয় প্রশাসনের তাদের সম্পর্কে খোঁজ নেয়াটাও সহজ। ৩৩৩ এর আওতায় তারাও সাহায্য পেতে পারেন। তবে রেশনিং ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক হলে এ নিয়ে কথা বলারই প্রয়োজন হতো না।
আর সবশেষে মফস্বল সাংবাদিকতা বিষয়ে মিথুন বলেন – আমরা আজীবন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো একটা দল বা গোষ্ঠী। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বড় পত্রিকা ও মিডিয়া ছাড়া কেউই এখানে সঠিক মূল্যায়ন মূল্য পাননা। নতুন নতুন অনলাইন হচ্ছে। সঠিকদের মূল্যায়ন না হওয়ার কারণে সেখানে অযোগ্য লোক এসে ভরে যাচ্ছে। মূলধারার সাংবাদিকতা এখন বিলুপ্ত বলা যায়।
আমাদের সংগঠন রিপোর্টার্স ইউনিটির ৫২ জন সদস্যদের জীবনমান নিয়ে আমরা সেভাবে কিছু করতে এখনো পারিনি, তবে নিজরা নিজেদের মতো করে পরষ্পরকে সাহায্য করার চেষ্টা করি, যা সাহায্য গ্রহণকারী নিজেও জানতে পারেন না। তাই সংগঠনের বাইরের সাংবাদিক বন্ধুদের জন্য তেমন ভাবতে পারিনা। আগে নিজের ঘর ঠিক রেখে তবেইতো বাইরের কথা ভাবতে হবে।

পরিশেষে, সংগঠন বা সংস্থা নয়, নয় কোনো রাজনৈতিক বিভাজন। ‍আমরা মানুষ, ‍আমরা বাংলাদেশী মানুষ ‍এই পরিচয়ে হোক ত্রাণ নয়, সকল শ্রেনীপেশার মানুষের জন্য রেশনিং বন্টন।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!