শুধু দৃষ্টিহীনদের নয়ঃ একজন মানবতার মা মঞ্জুু সমদ্দার

সদানন্দ সরকার

Sharing is caring!

শুধু দৃষ্টিহীনদের নয়, একজন মানবতার মা মঞ্জুু সমদ্দার

সন্তানের বড় হয়ে ওঠা ও প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার প্রথম ও প্রধান কৃতিত্ব একজন মায়ের। মা যদি ভালো আর শিক্ষিত হন তাহলে তার সন্তান সুসন্তান হতে বাধ্য। একজন আদর্শ মা সবসময় তার সন্তানকে পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে রেখে বড় করার চেষ্টা করেন। কারণ, এতে করে সন্তানের মানবিক গুণাবলী বিকশিত হয়। তা না হলে ওরা বখে যায় নয়তো আবেগ অনুভূতিহীন হয়ে ওঠে। আলাপের শুরুতেই কথাগুলো বলেন এ সময়ের একজন আদর্শ মা এবং দৃষ্টিহীনদের মা বলে খ্যাত অধ্যাপিকা ও সমাজ সেবক মঞ্জুু সমদ্দার। শুধু নিজ গর্ভের পাঁচ সন্তান নয়, শত শত দৃষ্টিহীন সন্তানের মা তিনি এখন। তার এই দৃষ্টিহীন সন্তানদের অনেকেই এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তাদের কেউ ব্যাংকার, কেউ সমাজসেবক বা এনজিও কর্মকর্তা, আবার কেউ কেউ সরকারী উচ্চপদস্থ অফিসার। তাদের দেখে গর্বিত হন এই মানবিক মা মঞ্জুু সমদ্দার।
দৃষ্টিহীনদের বেইল পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদান, হাতে কলমে তাদের প্রশিক্ষিত ও স্বাবলম্বী করে তোলার পাশাপাশি তাদের এই মা সবসময় মানবিকতার আবেদনগুলোতে দৃষ্টি দিতেন সবার আগে। হোস্টেলে তাদের সুবিধা অসুবিধার বিষয়গুলো আগে সুরাহা করতেন। মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য তার ছিল আরো গভীর মনযোগ। তাই তিনি একজন মানবতার মা বলেও পরিচিত কারো কারো কাছে। তবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে তাঁর পরিচয় তিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মা। সরকারী চাকুরী, বিদেশের হাতছানি আরো শত লোভনীয় আকর্ষণ ত্যাগ করে জীবনের প্রায় পুরো সময়টাই তিনি ব্যায় করে চলেছেন প্রতিবন্ধী আশ্রয়হীন মানুষদের মনে বিশ্বাসের আলো জ্বালাতে। বলা যায়, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এই সন্তানরা পৃথিবীকে দেখতেন তাদের এই মায়ের চোখ দিয়ে।
এছাড়াও অবসর প্রাপ্ত ও বিধবা মায়েদের নিয়ে তিনি দাঁড় করিয়েছেন শুকতারা নামের একটি সংগঠন। এর সাথে সম্পৃক্ত মায়েরা তাদের একাকীত্বের যন্ত্রণা কাটিয়ে উঠে শুকতারা সংগঠনটিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। এ সংগঠনটি আর্তমানবতার সেবায় বিশেষ করে, বিধবাদের নিয়ে কাজ করছে।
তার ঐকান্তিক চেষ্টায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন দৃষ্টিহীন পুনর্বাসন কেন্দ্র বা রিহ্যাবিলিটেশন হোম ফর ব্লাইন্ড ওমেন। যদিও সম্প্রতি ফা- সংকট দেখিয়ে ঐ আশ্রয় প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের পথে ঘটে, আনাচে কানাচে এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নারী। তাদের একটু আশ্রয় বা আবাসন ব্যবস্থার জন্য মঞ্জুু সমদ্দার করুন আকুতী জানিয়েছেন মানবতার জননী খ্যাত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি। তিনি বলেন, যাদের দৃষ্টি আছে তাদের জীবনই যেখানে সুরক্ষিত নয়, সেখানে দৃষ্টিহীনদের অবস্থা কি? তা সমাজের সকলেরই ভাবা উচিত। আমরা শুধু মুখেই মানবিকতার কথা বলি। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। সকলের উচিত মানবিকতার জন্যেই আশ্রয়হীন প্রতিবন্ধীদেও পাশে দাঁড়ানো।
একজন মানবতার মা বা মানবিক মা কিম্বা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মা যে নামেই ডাকুন। তিনি মা। আর মায়ের বিকল্প কিছুই হয়না। তাইতো সয়ং ঈশ্বর বা আল্লাহ বলেছেন, “তোমার মায়ের প্রতি যতœশীল থাকো। মা কে সেইভাবে যতœ করো, যেভাবে মা শিশুবেলায় তোমার যতœ করেছেন”।
আত্মপরিচয়ে মঞ্জুু সমদ্দার
মঞ্জুু সমদ্দার, পিতা রমজান আলি মুন্সী ও মাতা রত্মাময়ী মুন্সী এবং তাঁর স্বামী উইলিয়াম বিপ্লব সমদ্দার। সম্পর্কের এই মুন্সি ও সমদ্দার রহস্যের উত্তরে তিনি জানান, ধর্ম নয়, মানবিক বিবেচনায় ভালো মানুষটিই আমার প্রথম পছন্দের বিষয়। তাই মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা নিয়ে কাজ করি আমি, বিনিময়ে মানুষও আমাকে ভালোবাসেন অকৃত্রিমভাবে।
বাবা মায়ের আদর্শিক চেতনায় পড়াশুনা চলাকালেই শিক্ষকতার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন তিনি। বিনামূল্যে পথশিশুদের শিক্ষা দান ছিল ছোট থেকেই নেশার মতো। তার এই গুনটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েই হয়তো প্রেমে পরে যান উইলিয়াম বিপ্লব সমদ্দার।
এসএসসি অধ্যায়ন সময়োই কলেজ পড়ুয়া বিপ্লব সমদ্দার এর সাথে প্রণয় ও বিয়ে। বিপ্লব সমদ্দার তখন তরুণ সংগঠক ও সমাজসেবক হিসেবে খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। এই ব্যক্তিত্ববান মানুষটিকে নিজ হাতেই গড়ে তোলেন তিনি। প্রচ- ধৈর্য ও পরিশ্রমে স্বামীকে একজন দক্ষ প্রকৌশলী হিসেবে পরিচিত করে তুলেন সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে।
কলেজ জীবন শেষ হতে না হতেই মহাখালী সরকারী আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ের সহ শিক্ষিকা ও স্পোর্টস টিচার হিসেবে সরকারী চাকুরিতে যোগদান করেন মঞ্জুু সমদ্দার। টানা ১৩ বছর এখানে শিক্ষকতা করার পর হঠাৎ তার আলাপ হয় মিশনারি মিস ক্যাম্পবেল এর সাথে। মিস ক্যাম্পবেল ব্যাপ্টিস্ট মিশন অন্ধ বালিকা বিদ্যালয় এর প্রতিষ্ঠাতা। তারই সহযোগিতার জন্যে মঞ্জুু সমদ্দার ১৯৮০ সালে সহ প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কাজ শুরু করেন ব্যাপ্টিস্ট মিশন অন্ধ বালিকা বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালের ১৭ মে মিস ক্যাম্পবেল বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান এবং মঞ্জুু সমদ্দার এই প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন। ঐ সময় মাত্র ১৭ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নিয়ে ২য় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল। পরবর্তীতে প ম শ্রেণিতে উন্নিত হয়। মঞ্জুু সমদ্দারের ঐকান্তিক চেষ্টা ও ভালোবাসায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়েরা খুঁজে পান একজন বন্ধু ও একজন মা’কে। তারই তত্বাবধানে বর্তমান এই অত্যাধুনিক ভবনটি নির্মিত হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নিত হয়েছে এসএসসি পর্যন্ত এবং এইচএসসি বদরুন্নেসায় পড়াশুনার ব্যবস্থা করেন তিনি। ২০১২ সালে তিনি এ বিদ্যালয়ের কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করলেও এখনো তিনি ছুটে যান যে কোনো প্রয়োজনে।

স্বামীর কবরের পাশে

রাজনীতির পারিবারিক ধারা অব্যাহত রাখতে তিনি সক্রিয় ছিলেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও। ১৯৮৫ সালের মার্চে মিরপুর ১৩ নং ওয়ার্ডের মহিলা সম্পাদিকা নিযুক্ত হন তিনি। এছাড়াও জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরাম এর প্রতিষ্ঠাতা ও কোযাধ্যক্ষ ছিলেন। এ পদে ছিলেন দীর্ঘ সময়। এ সময় তিনি বিভিন্ন প্রতিবন্ধী সংগঠনের কার্যকরী সদস্য হিসেবেও অবদান রাখেন। আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী সংস্থার( ওঈঊঠও) আইসিইভিআই এর দেশীয় দূত ছিলেন। এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাপ্টিস্ট চার্চ সংঘের চারশটি ম-লীর মহিলা মর্ডারেটরের দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘ দিন। আর এ সুবাধে ধর্মতত্ত্বের উপরও ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
তিনি বলেন, আমার বড়ছেলে প্রলয় সমদ্দার বাপ্পী রাজনীতিতে প্রবেশ করলে, আমি রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও সেবার কোনো কাজ থেকে এখন পর্যন্ত অবসর নেই নাই।
তিনছেলে ও দুই মেয়ে ও নয়জন নাতি নাতনি নিয়ে সাজানো সংসার তার। কিছুটা স্থবিরতা নেমে আসে উইলিয়াম বিপ্লব সমদ্দারের অকাল প্রয়াণে। ৬ ডিসেম্বর ১৯১৬ তে পরলোকে যান তিনি। দীর্ঘদিনের বন্ধুকে হারিয়ে নিঃসঙ্গ জীবনকে সামলাতে আরো বেশি কর্মব্যস্ত এই মানবিক মা ছুটে বেড়ান তার সন্তানদের সুশিক্ষা বিলাতে। আজ হাজারো শত সন্তান তার ছড়িয়ে আছে দেশ তথা বিশ্বের আনাচে কানাচে।
তার বড়মেয়ে মেরী সূর্য্যানী যেন তারই ছায়া। মায়ের দেয়া শিক্ষা কাজে লাগাতেই যোগ দিয়েছিলেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী স্কুলটিতে। মেয়েকে নিজের মতোই একজন সেবিকা গড়ে তোলার চেষ্টা ছিল তার। এখানে তিনি কিছুটা সার্খকও বটে। কাবণ, মেয়ে তার অনেকটা সুনামের সাথেই সহ শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন তার পাশে পাশে। পরবর্তীতে দক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়ে মেরী সূর্য্যানী বরিশাল ব্যাপ্টিস্ট মিশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। বর্তমানে তিনি সন্তান নিয়ে আমেরিকায় বসবাস করছেন।
মঞ্জু সমদ্দার এর ছোটো ছেলে উইলিয়াম প্রবাল সমদ্দার আমেরিকায় ও সর্বকনিষ্ঠ এলিসা মৌসুমী শিক্ষকতা পোশায় ইংল্যান্ড বসবাস করেন।
বড়ছেলে সমাজসেক ও রাজনীতিবিদ উইলিয়াম প্রলয় সমদ্দার বাপ্পী ও মেঝছেলে সুকণ্ঠ গায়ক উইলিয়াম পিয়াল সমাদ্দার জোয়েল এই বৃদ্ধ বয়সে তাঁর সহায়ক শক্তি। মেয়েরাও সবসময় তার কাজে উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছেন সূদুর প্রবাস থেকে। আর তিনি তার শুকতারা সংগঠন নিয়ে এ বয়সেও আনন্দে মেতে আছেন ।। তিনি বলেন, মৃত্যুকে কে এড়াতে পারে বাবা? কেউ পারেনা, তবে মানুষ তার ভালোবাসা আর কর্ম দিয়ে মৃত্যুকে জয় করে নিতে পারে। নিজ কর্ম ও ভালবাসার বিনিময়ে তিনি অর্জন করে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক নারী দিবস পুরুষ্কার সহ অসংখ্য পুরুষ্কার ও সম্মাননা।

পরিশেষে তাঁর মেয়ে মেরী সূর্য্যানী এর লেখা ও সুরে প্রতিবন্ধী সংগীতটি দিয়েই শেষ করবো এ প্রতিবেদন।
‘প্রতিবন্ধকতা ছিন্ন করে,
চলার পথ দেও সহজ করে,
দেও অধিকার করুণা নয়..
ভালবাসা দেও… তোমার আমার।’

সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের মানুষের কাছে এটাই মঞ্জুু সমদ্দারের একমাত্র চাওয়া। আর তাইতো এই বয়সেও ছুটে যান মানবিকতার ডাকে। যখনই কেনো প্রতিবন্ধীর কোন মানবিক সাহায্যের প্রয়োজন হয় ছুটে যান তাদের পাশে। হাতে হাত রেখে বলেন কি করতে পারি তোমাদের জন্য?

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!