রাজশাহীতে বিএনপিঃ কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব চরমে

ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি

Sharing is caring!

রাজশাহীতে বিএনপির নতুন কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বঃ বঞ্চিত ত্যাগী নেতারা
বিএনপির নতুন কমিটি ঘোষণা নিয়ে রাজশাহী জেলা ও মহানগর নেতৃবৃন্দের দ্বন্দ্ব এখন চরম আকার ধারণ করেছে। নতুন কমিটির উপর অনাস্থা ও পদত্যাগের ঘোষণা বেশিরভাগ নেতাকর্মীদের।
গত ৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার রাজশাহী  মহানগর বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত করে কেন্দ্র থেকে ৯ সদস্যের নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। দীর্ঘদিন পর মিজানুর রহমান মিনু, মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ও শফিকুল হক মিলন ছাড়াই গঠিত হয়েছে নতুন এই কমিটি।
এ খবর ওইদিন রাতে রাজশাহীতে পৌঁছলে দলীয় নেতাকর্মীদের অনেকেই হতাশা ব্যক্ত করেন। তবে প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলতে রাজি না হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা করেন অনেকেই।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী মহানগর বিএনপির কমিটিতে অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ঈসাকে আহ্বায়ক এবং নজরুল হুদাকে সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক করা হয়েছে। যুগ্ম-আহ্বায়ক করা হয়েছে দেলোয়ার হোসেন, ওয়ালিউল হক রানা, আসলাম সরকার, শাফিকুল ইসলাম শফিক, বজলুর রহমান মন্টু ও জয়নাল আবেদিন শিবলীকে। মামুনুর রশিদকে সদস্য সচিব করা হয়েছে।
এর মাধ্যমে ২০১৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে সভাপতি ও শফিকুল হক মিলনকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি বিলুপ্ত করা হলো।
বিএনপির একাধিক নেতাকর্মীর অভিযোগ, এই আহ্বায়ক কমিটি গঠনের আগে কাউকে কিছু জানানোও হয়নি। আকস্মিকভাবেই দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরে দলীয় প্যাডে নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের কোনো মতামতই নেওয়া হয়নি। তারা এই কমিটিতে আওয়ামী লীগের এজেন্ট রয়েছে বলেও দাবী করেন।
এ বিষয়ে বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির ত্রাণ এবং পুনর্বাসনবিষয়ক সহ-সম্পাদক শফিকুল হক মিলন বলেন, ওয়ার্ড ও থানা কমিটিগুলো পুনর্গঠন করে সম্মেলনের মাধ্যমে মহানগর বিএনপির নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্যই নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে বলে শুনেছি। তারা চাইলে বা না চাইলেও আমরা আহ্বায়ক কমিটিকে সাংগঠনিক সব কাজে সহযোগিতা করব। নতুন আহ্বায়ক কমিটি কী করতে পারবেন-সেটা অবশ্য সময়ই বলে দেবে। এখনই এ নিয়ে মন্তব্য করার কিছু নেই।
জেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান মার্কনি বলেন, রাজশাহীতে এতো যোগ্য নেতা থাকতে কেন্দ্রের চোখে তারা কেন পড়েন না? এ প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বারবার একই ঘটনা ঘটছে। নেতাকর্মীদের পছন্দের ব্যক্তিকেই নেতৃত্ব দেওয়া উচিত। বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। জাতীয়তাবাদী আদর্শের এ দলের রাজশাহীতে লাখো ত্যাগী নেতাকর্মী রয়েছেন।
রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর দলে বিভেদ ছড়িয়ে পড়েছে। একাংশের নেতা-কর্মীরা এই কমিটি প্রত্যাখ্যান করে দল থেকে পদত্যাগ করার হুমকি দিয়েছেন। তাদের দাবি, এই কমিটিতে যারা জায়গা পেয়েছেন তাদের একাংশ রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়, আরেক অংশ আওয়ামী লীগের এজেন্ট।
রাজশাহী নগরীর শাহ্ মখদুম থানা কার্যালয়ে গত ১১ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে করেন বিএনপির বড় একটি অংশ। এতে মহানগর বিএনপির আওতাধীন বিভিন্ন থানা এবং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন।
সম্মিলনে লিখিত বক্তব্যে বোয়ালিয়া থানা বিএনপির সভাপতি সাইদুর রহমান পিন্টু বলেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং বিএনপির মহাসচিবের কাছে আবেদন করছি, দ্রুত রাজশাহী মহানগর বিএনপির বিতর্কিত কমিটি বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে বিএনপির বৃহত্তর স্বার্থে নিষ্ক্রিয় ও আওয়ামী লীগের এজেন্টদের বাদ দিয়ে ত্যাগী জনপ্রিয় পরীক্ষিত নেতাদের দিয়ে নতুন মহানগর কমিটি গঠনের জোর দাবি জানাচ্ছি। অন্যথায় আমরা সব থানা ও ওয়ার্ডের নেতারা গণপদত্যাগ করতে বাধ্য হব বলেও হুমকী দেন তারা।
তাদের দাবি, যাকে আহ্বায়ক করা হয়েছে তাকে বিএনপির রাজনীতিতে আগে দেখা যায়নি। তিনি কীভাবে এ পদ পেলেন?
আর আহ্বায়ক কমিটির নেতারা বলছেন, যাদের পদ নেই তাদের পদত্যাগের হুমকি কোনো প্রভাব রাখে না। এরা বেশিরভাগ মিনু মিলন গ্রুপের বলে দাবী তাদের।
বিরোধী পক্ষের নেতারা দাবি করেন, দলের চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার যখন দিন দিন অবনতি হচ্ছে, ঠিক তখন রাজশাহী মহানগর বিএনপির ৯ সদস্যবিশিষ্ট অচল কমিটি গঠিত হলো। যারা কর্মীবিচ্ছিন্ন, দীর্ঘদিন কর্মসূচিবিমুখ, আওয়ামী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়েই এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও  রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিতে স্থান পাওয়া সদস্যদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে।
১/১১ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী দুঃশাসনবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে রাজশাহীতে শত শত নেতা-কর্মী ডজন ডজন মামলার আসামি হলেও নবগঠিত কমিটির আহ্বায়কের নামে কোনো মামলা হয়নি, কারণ তিনি রাজনীতি করতেন না বলে উল্লেখ করেন নেতারা।
অভিযোগের বিষয়ে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ আলী ইসা বলেন, ‘তাদের তো পদই নেই, কীভাবে পদত্যাগ করবে? আমরা গত রাতেই সব কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেছি। তাদের পদত্যাগ হয়েই গেছে। থানা কমিটির ব্যানারে তারা কোনো কিছুই করতে পারবে না। আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা মানেই তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা সবাইকে ডেকেছি। আমরা কোনো দায়দায়িত্বে না। আমরা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হব না। আমরা তো শুধু সম্মেলন করে ছেড়ে দেব। আমরা প্রতিটা ওয়ার্ডে যাব। গণতান্ত্রিকভাবে সম্মেলন হবে। যারা আসবে তারা আসবে, না আসলে না আসল। তারা যদি বিকল্প বিএনপি করতে পারে, তো করবে। আমরা যত দ্রুত পারি সম্মেলেন করব।’
সংগঠন গোছাতে কী পদক্ষেপ নেবেন, জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এরশাদ আলী ইসা বলেন, ওয়ার্ড ও থানা কমিটিগুলোকে পুনর্গঠন করে মহানগর বিএনপিতে একটি শক্তিশালী নেতৃত্ব উপহার দেওয়াই হবে প্রথম লক্ষ্য। রাজশাহীতে দলের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে কাজ করব। এ ছাড়া দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি আন্দোলনকে আরও বেগবান করাবো।
রাজশাহীর কমিটি নিয়ে একাংশের অসন্তোষ স্বীকার করে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ইমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারিনা এটা বিভাগীয় সাংগঠনিক বিষয়। আপনি বিভাগীয় করো সাথে কথা বলুন।
এখানে বলা প্রয়োজন যে রাজশাহীতে এর আগে ২০০৯ সালে মিজানুর রহমান মিনুকে সভাপতি ও শফিকুল হক মিলনকে সাধারণ সম্পাদক করে বিএনপির কমিটি হয়েছিল সম্মেলনের মাধ্যমে। একইভাবে নাদিম মোস্তফাকে সভাপতি ও প্রয়াত অ্যাডভোকেট কামরুল মুনীরকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা কমিটি গঠন করা হয়। সাধারণ নেতাকর্মীদের মতে, এই দুটি কমিটির নেতৃত্বে রাজশাহী জেলা ও মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী ছিলেন। কিন্তু ২০১৪ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনে মিনু-নাদিম যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখাতে পারেননি, এমন অজুহাতে তুলে ২০১৬ সালে শীর্ষ দুই পদ থেকে তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়। বিএনপির অনেক নেতাকর্মী মনে করেন, মিনু-নাদিমকে মাইনাস করার ফলে রাজশাহী বিএনপিতে শৃঙ্খলা ও ঐক্য পুরোপুরি ভেঙে পড়ে, যা আজও বহাল আছে।
অন্যদিকে বুলবুল-মিলনের নেতৃত্বে গত কয়েক বছরেও মহানগরে বিএনপি ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। দলের শক্তিও বাড়েনি। বরং দল ছেড়ে গেছেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা। অতি সম্প্রতি নগরীর শাহমখদুম থানা বিএনপির সভাপতি মনিরুজ্জামান শরীফ পদ ও দল ছেড়েছেন। নেতাকর্মীদের মতে, মনিরুজ্জামান শরীফ একজন ত্যাগী নেতা। এতো বছর বিএনপি করার পর দল ছাড়া প্রসঙ্গে শরীফ বলেছেন, ‘রাজশাহী মহানগর বিএনপিতে চেইন অব কমান্ড ও দলীয় শৃঙ্খলা অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে।’ নগর বিএনপির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘সংগঠনে বিভেদ সৃষ্টি করে দলকে দুর্বল করা কোনো নেতার কাজ নয়। অথচ যা আমাদের একজন শীর্ষ নেতা করছেন। আমি মৌখিকভাবে প্রতিবাদ করেও ফল পাইনি। ফলে পদ ও দল ছেড়ে দেওয়াকে ঠিক মনে করেছি।’
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই রাজশাহী সিটি নির্বাচনের আগেই বিএনপির ১৫ কাউন্সিলর দল ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড বিএনপির কয়েক হাজার নেতাকর্মী দল ছেড়ে আওয়ামী লীগে চলে যান। যারা নিজ নিজ এলাকায় বিএনপির ভালো সংগঠক ছিলেন। এরপর থেকেই নগরীর থানা পর্যায়ে ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করে দলটি।
স্থানীয় বিএনপি নেতাদের ক্ষোভ, ‘মিজানুর রহমান মিনু একজন কিংবদন্তি নেতা। বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অপছন্দের নেতা মিনুকে সরিয়ে তার বলয়ের নেতাদের রাজশাহী বিএনপির দায়িত্বে বসান।
কয়েকবারই এমন করা হয়েছে। কিন্তু তাতে ফল উল্টো হয়েছে। বরং মিনুবিহীন রাজশাহী বিএনপি এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।’
রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু বিএনপির নতুন কমিটির ও বিপক্ষের নেতাদের পদত্যাগ বিষয়ে জানান, ‘সংগঠনের বিরুদ্ধে কথা বলা কখনো শিখিনি। যেহেতু এই শিক্ষা নিইনি, তাই দলের বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাই না। শুধু এতটুকু বলতে পারি, সন্তান ভুল করলে অভিভাবক কখনো সন্তানকে ফেলে যান না। আমার শিরা-উপশিরায় বিএনপির আদর্শ প্রবাহিত। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যত বাধা আসুক না কেন, আমি আমার প্রিয় দলের আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত হতে পারি না। আমি চাই, ভুলের ঊর্ধ্বে কেউ নন। কিন্তু দল সবার আগে। তাই ত্যাগী নেতাকর্মীদের বলব, সবাই যেন মান-অভিমান ভুলে সব সময় ঐক্যবদ্ধ থাকেন। মনে রাখতে হবে, কর্মীরাই সব সময় নেতাদের বাঁচিয়ে রাখেন। কর্মীরাই নেতা বানান। সময় যখন আসবে, ত্যাগী কর্মীরা তার যোগ্য আসন নিশ্চয় ফিরে পাবেন।
Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!