রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব : পঙ্গু হচ্ছে পটুয়াখালী জেলার সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা

ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি

Sharing is caring!

রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব : পঙ্গু হচ্ছে পটুয়াখালী জেলার সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা 

ইন্টারনেটে বা স্যাটেলাইট দুনিয়া নয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই ক্্রমশ পঙ্গু হচ্ছে পটুয়াখালী সহ বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা। আশির দশকের পরে হাতে গোনা কিছু কার্যক্রম খুঁঁজে পাওয়া গেলেও বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে এ বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় নাই। তরুণদের কিছু অংশ এখনো সংগীত থিয়েটারকে আঁকড়ে থাকলেও তাদের মধ্যে চরম বৈষম্য লক্ষ্যনীয়। বিশেষ করে প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলতার লড়াই বিভাগীয় শহর বরিশালের মতো এখানেও চরমে। আর এ জন্যও দায়ী আমাদের রাজনীতিক অস্থিরতা। 

সাগরকন্যা খ্যাত পটুয়াখালী জেলার সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনের প্রতিবেদন তুলে ধরতে চেয়ে এই চিত্রই উঠে এসেছে এই জেলার সার্বিক পরিস্থিতি ও  বির্শিষ্টজনদের বক্তব্যে।

প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নির্মল কুমার দাশগুপ্ত, গাজী মঈনউদ্দীন টারজান, রাধেশ্যাম দেবনাথ, অশোক কুমার দাস, জাহাংগীর হোসাইন মানিক, আনোয়ার হোসেন বাদল এবং মাসুদ আলম বাবুলসহ স্থানীয় সাংবাদিক ও সংগঠনের কার্যক্রম চিত্র বিশ্লেষণ করে এ জেলার এই চিত্র পাওয়া গেছে।

জেলার রবীন্দ্র সংগীত সম্মেলন পরিষদ সভাপতি ও প্রবীণ সংগীতজ্ঞ শ্রী নির্মল কুমার দাশগুপ্ত বলেন : পটুয়াখালী জেলার সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চার ইতিহাস যথেষ্ট সমৃদ্ধ হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিছুই উল্লেখযোগ্য নেই। ৫২ ভাষা আন্দোলন পূর্ব সময়ে বরিশাল শিল্পী সংঘের সাথে কাঁধ মিলিয়ে চলতো এখানের সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গন। বরিশাল শিল্পী সংঘ ও মালেক খানের সাথে বিএম কলেজে আমার সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা। পটুয়াখালী ফিরে এসে সে সময় ড্রামাটিক ক্লাবের সাথে যুক্ত হই। জেলা শিল্পকলা ও শিশু একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আমি। অসুস্থ হয়ে এখন আর সময় দিতে পারিনা। তখনকার সময়ে ধীরেন দত্ত, খন্দকার খালেক, মোশাররফ রিশ্বাস, হাবলু বিশ্বাস, ইয়াকুব আলী প্রমূখ ৭০ দশকের সাহিত্য অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত নাম। বর্তমান সময়ের সাহিত্য সংস্কৃতির অবস্থা মোটেও ভালো নয়। তরুণদের মধ্যে কিছু কবিতার চর্চা পাওয়া গেলেও প্রকৃত সাহিত্য সেখানে অনুপস্থিত। দখিনের কবিয়াল আর জাহাংগীর হোসাইন মানিক এর কবি ও সাহিত্যিক গ্রন্থের বাইরে হাতে গোনা কয়েকজন রয়েছেন যারা সাহিত্য চর্চা করেন। তবে তাদেও বেশিরভাগই অন্যত্র থাকেন।

নির্মল কুমার আরো বলেন, পটুয়াখালী জেলার সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চার ইতিহাস যথেষ্ট সমৃদ্ধ হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিছুই উল্লেখযোগ্য নেই। তবে ঐতিহ্যবাহী শহীদ স্মৃতি পাঠাগার, দখিনের কবিয়াল, খেলাঘর ও সুন্দরম থিয়েটারের কিছু সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এখনো টিকে আছে। সমসাময়িক রাজনৈতিক অস্থিরতা তরুণ প্রজন্মকে সাহিত্য সংস্কৃতি বিমুখ করে তুলছে বলতে পারো।

প্রায় একই কথা বললেন ঐতিহ্যবাহী শহীদ স্মৃতি পাঠাগারের সভাপতি কবি রাধেশ্যাম দেবনাথ। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা  আমাদের তরুণ প্রজন্মকে সাহিত্য সংস্কৃতির বিমুখ করে তুলছে। সংগঠনগুলোতেও তাই রাজনীতির প্রভাব। চারিদিকের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, লেখক সংগঠকদের মধ্যে  দলাদলি, এ  সব দেখে এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা আর এ মুখো হতে চায়না। ওরা বরং ফেসবুক বা ইন্টারনেট দুনিয়ায় ভালো আছে বলে ভাবছে। আর যারা সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে কাজ করতে এসেছে, তাদের মধ্যে বিভক্তি চরমে। আসলে নাটক থিয়েটারের চর্চা বা সাহিত্য চর্চার জন্য যে ধৈর্য প্রয়োজন সেটা এখন আধুনিক ইন্টারনেট দুনিয়া খেয়ে নিয়েছে। মানবিক মূল্যবোধহীন হয়ে বেড়ে উঠছে বর্তমান প্রজন্ম। তিনি  আরও বলেন,, এখানে শিল্প – সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব দারুণ ভাবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সমূহ পরিবেশনের মঞ্চ বা স্থানের অভাব ব্যাপক। শহরের প্রাচীন কেন্দ্র টাউন হল বর্তমানে বন্ধ। ফলে নাটক বা বৃহৎ কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভব হয় না। এটি অনুষ্ঠান আয়োজনের নিমিত্ত খোলা রাখার জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানান।

জেলা ললিতকলা একাডেমির পরিচালক সাংস্কৃতিক জন অশোক কুমার দাস বলেন, জাহাংগীর হোসাইন মানিক, আসমা চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন বাদল, পটুয়াখালী আক্কেল আলী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মাসুদ আলম বাবুল পর্যন্ত শেষ এখানের তরুণদের সাহিত্য। সংগীতের অবস্থাটা এখানে ভালো। রুমা দে ও আরো কয়েকজন তরুণ রয়েছে বটে তবে নৃত্য ও নাটকের অবস্থান এখন শূন্য বলা যায়।

বরগুনা  জেলার কৃতি সন্তান পটুয়াখালীতে বসবাসরত এবং 

সম্প্রতি মধুসূদন দত্ত পুরুষ্কার প্রাপ্ত কবি ও কথা সাহিত্যিক অধ্যক্ষ মাসুদ আলম বাবুল বলেন, এখানের সাহিত্য সংস্কৃতির বেশিরভাগ কাজটাই জাহাংগীর হোসাইন মানিক, আনোয়ার হোসেন বাদল, সুন্দরম থিয়েটার আর ঐ শহীদ স্মৃতি পাঠাগারকে ঘীরে। তবে এখানের সাংস্কৃতিক কর্মীদের সমধ্যে একতার অভাব প্রচণ্ড। এরা কলকাতার বা ভারতের নামি লেখক বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে নিজেদের মানুষ বলে দাবি করতে পারে, কিন্তু নিজেদের মাঝে বেড়ে ওঠা লেখক বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে এই জেলার নয় বলে অবজ্ঞা করতে দ্বিধা করেনা।

দেখা থেকে লেখা (পটুয়াখালী সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তিনদিন)

সাহিত্য বাজার এর প্রধান সম্পাদক এবং প্রকাশক ও সম্পাদক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জেলায় জেলায় সাহিত্য বিভাগের এবারের বিষয় পটুয়াখালী জেলার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নিয়ে প্রতিবেদন যাবে। প্রতিবেদকের যথারীতি দায়িত্ব পালনের জন্য আমার উপর দায়িত্ব টাপলো। খুশী মনে ছুটলাম। প্রথমেই ফোন দিলাম উঠতি যুব বয়সের পটুয়াখালী জেলার স্থানীয় বন্ধু সদ্য মধুসূদন দত্ত পুরুষ্কার প্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক কবি ও অধ্যক্ষ মাসুদ আলম বাবুলকে। জানালাম আমাদের আগ্রহের বিষয়। ভাবলেশহীন আমন্ত্রণ বন্ধুর। আসেন, তারপর দেখা যাবে।
ঢাকা থেকে বরিশাল। বরিশালের কবি ও ছড়াকার তপংকর চক্রবর্তী বেশ আন্তরিকতার সাথেই সহযোগিতার হাত বাড়ালেন। তিনিও মাসুদ আলম বাবুলকে সাহিত্য বাজার এর প্রতিবেদন বিষয়ে জানালেন। এবার বন্ধুর টনক লড়লো। বেশ আন্তরিক হলেন তিনি। নম্বর দিলেন দক্ষিণের কবিয়াল খ্যাত জাহাংগীর হোসাইন মানিক নামের একজন সংগঠকের। প্রথম ফোন আলাপেই বুঝতে পারলাম স্পষ্টবাদী একজন মানুষের সাক্ষাৎ পেতে যাচ্ছি আমি।
কথানুযায়ী, যথারীতি শুক্রবার কবিয়ালের সাথে একসাথেই জুম্মার নামাজ আদায় করলাম পটুয়াখালী শহরে। চমৎকার সুহৃদ একজন কবি ও গবেষক এই জাহাংগীর হোসাইন মানিক। নদীর তীর ঘেঁষে কৃষি বিভাগের রেস্ট হাউজে আমার থাকার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। নিজেই বাইকের পিছনে বসিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন চার বর্গমাইল এলাকার পুরো পটুয়াখালী শহর। শহীদ স্মৃতি পাঠাগার এবং আলাউদ্দিন শিশুপার্ক।
স্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গাজী মঈনউদ্দীন টারজন, খেলাঘর কর্মিসহ আরো অনেকের সাথেই আলাপ করালেন। জানালেন, এখানকার সাহিত্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের বর্তমান চিত্র।
তার গবেষণা গ্রন্থ পটুয়াখালী জেলার কবি ও সাহিত্যিক তুলে দিলেন হাতে। বইটি হাতে নিয়েই চমকে গেলাম। বিশাল মাপের একটি কাজ এটি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই এই গ্রন্থ সম্পাদনা সম্ভব হয়েছ। পটুয়াখালী জেলার সাহিত্যের অঙ্গনের প্রায় ১৫০ জন কবি ও সাহিত্যিককে সংরক্ষণ করার এই নিঃস্বার্থ মহতী প্রয়াসের জন্য পটুয়াখালীবাসীতো বটেই পুরো বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে কৃতজ্ঞতা জনাব জাহাংগীর হোসাইন মানিকের প্রতি। একইসাথে এই মানুষটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা বন্ধু কথাসাহিত্যিক ও কবি মাসুদ আলম বাবুলের প্রতি।
অল্পসময়ের অবস্থান থেকে পটুয়াখালী জেলার সাহিত্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের যে চিত্র স্পষ্ট হয় তার সিংহভাগই এই ত্যাগী মানুষটির দক্ষিণের কবিয়াল সংগঠনকে ঘীরে। নবান্ন উৎসব বা কোনো স্থানীয় সাংস্কৃতিক আয়োজন সবটাতেই ঘুওে ফিরে এই কবিয়ালকেই দেখা যায়।

২য়দিন সকালে সাহিত্য বাজার সম্পাদক ও প্রকাশকের ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙলো। কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানালাম তাকে। বললেন, রাখাইন সাহিত্যের খোঁজ নিও। দক্ষিণের কবিয়াল খ্যাত জাহাংগীর এলেন সকাল আটটায়। তাকে রাখ্ইান সাহিত্য ও সংস্কৃতির কথা বলতেই তিনি আনমনা হলেন। বললেন, এ জেলায় ওদের শুধু আ লিক নৃত্যটুকুই টিকে আছে, আর কিছুই অবণিষ্ট নেই। দু’জনে নাস্তাার পর্ব শেষ করে বের হয়ে পরলাম তথ্য সন্ধানে। প্রথমে গেলাম স্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গাজী মঈনউদ্দীন টারজান এর বাসায়। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পরও তার কোনো সাড়া শব্দ পেলাম না। অথচ ফোন করে তবেই এসেছিলাম আমরা। কিছুটা বিষন্নতা নিয়েই আমরা চলে এলাম পটুয়াখালী জেলার সাহিত্য সংস্কৃতির অগ্রপথিক বাবু নির্মল কুমার দাশগুপ্ত মন্টু দা এর কাছে। ( তখন তিনি জীবীত ছিলেন। ঈশ্বর তাঁকে শান্তিতে রাখুন।)   জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত পরিষদের সভাপতি তিনি, প্রচণ্ড অসুস্থতা নিয়ে বিছানায় পরে আছেন। চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা নেই তার। অথচ একসময়ের লড়াকু সাংস্কৃতিক যোদ্ধা তিনি।
দুপুরের খাবারের পরে মানিক আমাকে নিয়ে গেলেন স্খানীয় রাখাইন নেতা মং খে হাং এর কাছে। মং খে হাং পটুয়াখালী বৌদ্ধ বিহার এর সভাপতি। তিনি জানালেন, পটুয়াখালী ও বরগুনার দুইজেলা মিলে বর্তমানে সাড়ে তিন হাজার রাখাইন সম্প্রদায় বসবাস করছেন। তবে সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চায় তরুণদেও মধ্যে খুব একটা আগ্রহী কাউকেই আমার জানা হয়নি। কুয়াকাটা সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, ওরা উপজাতীয় নৃত্য ও গান নিয়ে কাজ করে।

ফিরে যাচ্ছিলাম রেষ্টরুমে কিন্তু থমকে দাঁড়ালাম আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যডভোকেট আফজাল হোসেন এর ব্যাণার দেখে। কবিয়াল বললেন, এটাই তার বাড়ি।

আফজাল ভাই আমার টিনেজ বয়সের সাংস্কৃতিক সময়ের হিরো। টিএসসিতে বহুবার তার ও আবৃত্তিকার শিমুল মুস্তফা ভাইয়ের দেয়া চা খেয়েছি। আমার প্রতিটি কবিতার বই তার কাছে বিক্রি করেছি কিশোর বয়সে। আমাদের ইউনিভার্সেল থিয়েটারের নাটক তার খুব পছন্দের ছিল। সাহিত্য বাজার সম্পর্কেও তার ভালোবাসা আছে। তাই ঢুকে গেলাম তার ঘরে এবং বহুদিন পর জড়িয়ে ধরলাম প্রবল আন্তরিকতায়। সেলফিও নিলাম একসাথে। জানালাম আমার আগমন উদ্দেশ্য। তার থেকে বিদায় নিতেই বন্ধু কবি কথাসাহিত্যিক মাসুদ আলম বাবুল এলেন। বন্ধুকে সাথে নিয়ে রেস্টরুমে এসে মানিকের অপেক্ষায় থাকলাম। ঠিক সোয়া পাঁচটায় এলেন মানিক। আমাদেও নিয়ে গেলেন ঐতিহ্যবাহী শহীদ স্মৃতি পাঠাগারের সভাপতি রাধেশ্যাম দেবনাথ এর বাসায়।

পটুয়াখালী তৃতীয় দিন
৩য়দিন সকালে বন্ধু মাসুদ আলম আসার অপেক্ষায় ছিলাম। সে ফোনে জানালেন, একটি মানবিক বিরোধী হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে ও ভুক্তভোগীকে সহায়তা দিতে মানববন্ধন ও অন্যান্য দায়িত্বে ব্যাস্ততা তার, তাই আসতে পারবেন না। একাই বের হয়ে পড়লাম তখন। সাহিত্য বাজারের প্রকাশক ও সম্পাদক এ সময় ফোনে কিছু বিষয়ে তথ্য চাইলেন। বিশেষ করে শিশুশিল্পী বিষয়ে। খোঁজ নিতেই উঠে এল একটি নাম দিবামনি। সাহিত্য, আবৃত্তি, নাটক সবকিছুই নখদর্পনে এই শিশুটির। জেলা শিশু একাডেমি গর্বিত নাম। এই শিশুটির বাবা জাহাংগীর হোসাইন মানিক এসে আমাকে নিয়ে গেলেন শহীদ স্মৃতি পাঠাগারে। সেখানে দখিনা খেলাঘর আসরের নাটকের রিহার্সাল চলছিল। আসরের পরিচালক দীপু সময় দিতে না পারায় আমরা চলে গেলাম জেলা প্রেসক্লাবে সুন্দরম থিয়েটারের কর্ণধার ও সিনিয়র সাংবাদিক মুজাহিদুল ইসলাম প্রিন্স, এনায়েত ও জালাল ভাইদের সাথে কিচ্ছুটা সুন্দর সময় কাটলো। পটুয়াখালীর একশ বছরের সাংস্কৃতিক চর্চা বিষয়ে প্রিন্সের লেখা দেয়া এবং বিকালে থিয়েটারে আড্ডার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমরা এবার চলে এলাম সাংস্কৃতিক জন অশোক কুমার দাস এর কাছে। বেশকিছু নতুন নাম যুক্ত হলো সাহিত্য ভান্ডারে। সংগীতে পেলাম রুমা দে, পলাশ ও আরো কিছু নাম। বিকালে দিবামনি ও সুন্দরম থিয়েটার আড্ডায় শেষ হবে পটুয়াখালীর সাহিত্য সংস্কৃতির প্রাথমিক কাজ।
কিন্তু আচমকা ঝরো হাওয়ার মতোই আমার কক্ষে এসে প্রচণ্ড জ্বরে কেঁপে উঠলেন কবিয়াল জাহাংগীর হোসাইন মানিক। তার মেয়ের সাক্ষাৎকার আর নেয়া হলোনা। সুন্দরম থিয়েটারের আড্ডাও ভেস্তে গেল। মাসুদ আলম বাবুল ও আমি ব্যস্ত হলাম মানিকের সেবায়।

বিদায় মূহুর্তে পটুয়াখালী
চতুর্থ দিন সকালে পটুয়াখালী থেকে বিদায় মুহুর্তে কবিয়াল মানিক থেকে জেনে নিলাম তার মেয়ে সম্পর্কে কিছু তথ্য।

নাম দিবামনি। ভালো নাম মায়িশা ফাহিমিদা বিনতে জাহাংগীর। সপ্তম শ্রেনীতে পড়ুয়া এই শিশু শিল্পী গান, আবৃত্তি ও নাটকে অসাধারণ অবদানের জন্য পটুয়াখালীর গর্ব বলা যায় তাকে। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে সে শিশু একাডেমির জাতীয় শিশু পুরষ্কার এ গল্প বলা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ও ধারাবাহিক গল্প বলায় প্রথম স্থান অর্জন করে রাষ্টপতির হাত থেকে স্বর্ণপদক গ্রহন করে। পরের বছর একই বিষয়ে ২য় স্থান অধিকার করে সে।

২০১৬ সালে এই শিশু শিল্পী আবৃতি ও অভিনয়ে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় পুরুষ্কার অর্জন করে। শিশু একাডেমি আয়োজিত বঙ্গবন্ধুকে লেখা চিঠি প্রতিযোগিতায় ২০১৯ এ জাতীয়ভাবে প্রথম স্থান অর্জন কওে দিবামনি। তার বাবা দখিনের কবিয়াল খ্যাত জাহাংগীর হোসাইন মানিক ব্যাস্ত সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। তার সংগঠন দখিনের কবিয়াল প্রতিষ্ঠিত হয় আজ থেকে ১০ বছর আগে অর্থাৎ ২০১০ সালে। গত ২০১৭তে জেলার চারজন গুনী সাহিত্যিককে সম্বর্ধনা দেয় এ সংগঠনটি। সম্বর্ধিত গুনীজনরা হচ্ছেন – নুর জাহান বোস, নির্মল কুমার দাশগুপ্ত, রাধেশ্যাম দেবনাথ ও মমতাজ বেগম। পাশাপাশি দখিনের কবিয়াল এর রয়েছে নিয়মিত প্রকাশনা।
জাহাংগীর হোসাইন মানিক নিজেও একজন কবি, গবেষক এবং সম্পাদক । তার সম্পাদিত পটুয়াখালী জেলার কবি ও সাহিত্যিক গ্রন্থটি জাতীয়ভাবে সমাদৃত।

পটুয়াখালী সাহিত্য সংস্কৃতিঃ লেখক পর্যালোচনা

খ্যাতনামা কোনো এক সাংবাদিক এর লেখায় পড়েছিলাম – কোনো জেলা সম্পর্কে যদি জানতে চাও তবে সবার আগে সেই জেলার স্থানীয় সাংবাদিকদের সাহায্য নাও, আর সেই জেলার রাজনীতি ও সংস্কৃতিকে বুঝতে চায়ের দোকানগুলোতে কিছুটা সময় কাটাও। জেলা শহর বা স্বপ্নের শহর পটুয়াখালী ভ্রমণে এসে আমিও তাই সবারআগে স্থানীয় সাংবাদিক বন্ধু জাহাংগীর েহোসাইন মানকি এর স্মরণাপন্ন হলাম। তারই পরিচয়ের সুত্র ধরে একে একে পরিচিত হলাম সুভাষ দাস, নিখিল দত্ত, জালাল আহমেদ, মুজাহিদুল ইসলাম প্রিন্স প্রমূখ সাংবাদিকদের সাথে।
ফলে কাজও হলো বেশ খুব অল্পসময়ের মধ্যে আমার হাতে চলে এল পটুয়াখালী গেজেটারী।

জানতে পারলাম, ১৪০০ শতক থেকে ১৬০০ শতক পর্যন্ত বর্তমান বাকেরগঞ্জ ও পটুয়াখালী নিয়ে ইতিহাস বিখ্যাত চন্দ্রদ্বীপ-বাকলা রাজ্য গঠিত হয়েছিল। চন্দ্রদ্বীপের রাজারা প্রায় স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছেন। ১৬১১ সনে চন্দ্রদ্বীপের রাজা রামচন্দ্র মোগলদের কাছে পরাজিত হলে এ অঞ্চল মোঘলদের অধীনতা মেনে নেয়।১৭০০ শতাব্দীতে মগ-পূর্তগীজদের আক্রমণের ফলে চন্দ্রদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চল সম্পূর্ণরুপে জনশূণ্য হয়ে পরে। ১৭৮৪ শতাব্দীতে দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবন অংশে ১৫০টি রাখাইন পরিবার আরাকান থেকে এসে বসতি স্থাপন করে। এটাই প্রথম জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপনের সুত্রপাত।
১৮০০ শতকে আগা বাকের খান ও তার পুত্র আগা সাদেক এর চেষ্টায় বাউফল-গলাচিপা অঞ্চলে সবতি স্থাপন শুরু হয়। এই আগা খান পরিবার ছিলেন বাংলার শেষ নবাব সিরাজুদ্দৌলার ঘনিষ্ঠজন। ১৭৯৭ সনে বাকেরগঞ্জ জেলা ঘোষিত হয় এবং ১৮০১ সনে জেলা দপ্তর বরিশালে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে বরিশালের নাম ছিল গীরদে বন্দর।১৮৭১ সনে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে ইংরেজ প্রশাসন পটুয়াখালী মহাকুমার সৃষ্টি করে। ১৪১০ বর্গমাইলের পটুয়াখালী মহাকুমার তখনকার জনসংখ্যা ছিলো চার লক্ষ পচিশ হাজার এবং এরমধ্যে পঞ্চাশ হাজারই ছিলো রাখাইন পরিবার।
১৯০০ শতকের প্রথমার্ধেই আসলে পটুয়াখালীর সুন্দরবন অংশে আবাদ শুরু হয়। বর্তমনের পাথরঘাটা, বামনা, খেপুপাড়া আসলে সুন্দরবনেরই প্রধান অংশ। ইতহিাসের বইয়ে এভাবেই লেখা আছে বর্তমান পটুয়াখালীর পরিচয়। ১৮০০ শতকেও এ জেলার তিনভাগের দুইভাগই ছিল সুন্দরবন। ১৯৩৭ সনের মধ্যে প্রায় সম্পূর্ন বন অঞ্চল আবাদ হয়ে যায়। ঝড় আর জলোচ্ছাস এখানের নিত্যসাথী। ১৮২২, ১৮৭৬, ১৯৬১, ১৯৬৫, ১৯৭০ সনের ঝড়ে প্রান হারিয়েছেন অগনিত মানুষ। ১৮৮৯সনে বরিশালে বিএম করেজ ও পটুয়াখালীতে জুবলী স্কুলের প্রতিষ্ঠা হলে শিক্ষার দিকে অগ্রসর শুরু হয় এখানে।

বিপ্লবী কমরেড হীরা লাল সেন গুপ্ত, সত্তীন সেন এবং সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ হিসেবে খান বাহাদুর আকরাম খান, খান সাহেব এমদাদ আলী প্রমূখরা ১৯০৬ থেকে ১৯৪৩ সময়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন বরে ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। এরপর জনমেন দাগ কেটেছেন কবি খন্দকার খালেক, সৈয়দ আশরাফ হোসেন, গাজী আজহারউদ্দিন লালুয়ার মোশাররফ বিশ্বাস ও হাবলু বিশ্বাস প্রমূখ বরেণ্যজন।
১৮৯২ সনের পহেলা এপ্রিল পটুয়াখালী পৌরসভার জন্ম হলেও এটি প্রথম ম্রেণীতে উন্নিত হয়েছে ১৯৮৮ সালে।২৬ বর্গমাইলের পৌরএলাকার প্রধান বাহন রিক্সা। ইজিবাইকের এতোটাই দাপট যে, পায়ে হেঁটে পথচলা কঠিন। বেশিরভাগ রাস্তা সরু তবে বেশ পরিচ্ছন্ন। গর্বিত অংশিদার হয়ে কালের সাক্ষ্য বহন করছে, শহীদ স্মৃতি পাঠাগার ও ড্রামাটিক ক্লাবের সাইনবোর্ড । পরিত্যক্ত টাউনহল ভবন। তবে শহীদ মণিার ও জুবলী স্কুল আঙ্গিনার সৌন্দর‌্য দৃষ্টি কাড়ে।

১৯৬৯ সালে পটুয়াখালী মহাকুমাকে জেলায় উন্নিত করা হয়। জেলাসদর হিসেবে পরিচয় ফোঁটার আগেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। ৭১ সালের ২৬ এপ্রিল রাতে পটুয়াখালী মহরের উপর অতর্কিত হামলা চালায় পাকিস্তানী সেনারা। তাই শহরের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে খুজে পেলাম পাঁচটি গণকবর স্পট। ৯ নং সেক্টরের অধীনে এখানের মুক্তিযোদ্দারা ৫টি ইউনিটে সংঘঠিত হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। তখন ৯নং সেক্টর সাব সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল বামনা থানার বুকারবুনিয়ায়। পটুয়াখালী ও গলাচিপা ইউনিটের দায়িত্বে ছিলেন কমাণ্ডার নুরুল হুদা, ডেপুটি কমাণ্ডার ছিরেন হাবিবুর রহমান শওকত। পটুয়াখালী জেলার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মুক্তিযুদ্ধটি সংঘাটত হয় মির্জাগঞ্জের পানপট্টিতে। এখানেই সর্বপ্রথম হানাদার বাহিনী কে পরাজিত করা হয়। ১৯৭১ এর ৮ই ডিসেম্বর বরিশাল ও পটুয়াখালী একযোগে হানাদার মুক্ত হয়।
যুদ্ধের পর বিধ্বস্ত শহরটিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মগ্ন মানুষগুলোর ক্লান্তি জুড়াতে না জুড়াতেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গরন্ধু শেখ মুজিরুর রহমানকে স্ব পরিবারে হত্যা করা হলো। দেশজুড়ে পুনরায় শুরু হরো অরাজগতা। এতোদিন যারা পাকবাহিনীর ভয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছিল, এরবার তারা আবার আত্মগোপনে ব্যস্ত হলো। শহর পুন:গঠন আর হলোনা।
পটুয়াখালীর রাজনীতিতে তখন সৈয়দ আশরাফ হোসেন (ন্যাপ), শাহাদাত হোসেন মৃধা, মোশাররফ হোসেন খান প্রমূখরা তখন মাত্রই এগিয়ে এসেছিলেন , তারাও আবার পিছিয়ে গেলেন সহিংসতার ভয়ে।
১৯৮৩ সালে পটুয়াখালী শহরকে পুরাতন ও নতুন অংশ হিসেবে বর্ধিত করা হলো। এক অংশ অভিজাত এরাকা, অন্যঅংশ পুরাতন শহর নামেই পরিচয় ছিল। শহরের তিনটি প্রসিদ্ধ বাজার কিন্তু ঐ পুরাতন অংশেই থেকে গেল। তবে পৌরসভা ও জের পরিষদ ভবন সহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক উপাদানে অভিজাত অংশের সম্মান আরো বৃদ্ধি হয়েছে।
সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চায এ জেলায় সবচেয়ে এগিয়ে জেলা শিশু একাডেমি। এর বাইরে শহীদ স্মৃতি পাঠাগার, কবি সাংবাদিক জাহাংগীর হোসাইন মানিকের দখিনের কবিয়াল এবং সাংবাদিক মুজাহিদুল ইসলাম প্রিন্সের সুন্দরম নাট্য নংপঠনের কার্য়ক্রমই বর্তমানে উল্লেখযোগ্য।

শহীদ স্মৃতি পাঠাগারটির রয়েছে গর্বিত ইতিহাস। ৫২ এর ভাষা শহীদেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৫৪ সালে এই পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন এখানকার কতিপয় সাংস্কৃতিকজন।

এখানে উল্লেখ্য: পটুয়াখালী কিম্বা বলা যায় বরিশালের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র এখানের কলাপাড়ার লালুয়া গ্রাম। লালুয়ার বিশ্বাস বাড়ি এবং মরহুম সৈয়দুল গাফফার এর লালুয়া সাহিত্য পরিষদ থেকেই মুলত পটুয়াখালীর সাহিত্য সংস্কৃতির চেতনা।
যদিও বর্তমান প্রজন্ম এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ বলা যায়। অবশ্যই এটা সত্য যে, সাহিত্যের বীজ লুকানো খাকে লোক সাহিথ্যের ঊধরে এবং সেখান থেকেই গর্ভপাতের মাধ্যমে এর বেড়ে ওঠা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পটুয়াখালীর রোকসাহিত্যের মালেক মুনশী ও তার রচিত পুথি সাহিত্য- তাজুল আলম – সম্পর্কে কিছুই জানা গেলনা বর্তমান প্রজন্ম বা কাদের পূর্বসূরীর কাছে। অথচ এটি ছিল পটুয়াখালী সাহিত্যের নিজস্ব সম্পদ। কবিয়াল জাহাংগীর হোসাইন মানিকও পূথি লেখেন, তাই তার কাছে খুব প্রত্যাশা ছিল পুখিয়াল মালেক মুনশী সম্পর্কে জানার। যাইহোত, ঐ যে লালুয়া সাহিত্য পরিষদ, এখানে তখন ভারতীয় সব গুরুত্বপূর্ণ পত্রপত্রিকা সরাসরি চরে আসতো। কারণ, উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও লেখকদের আড্ডা হকো এখানে। হীরালাল দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, অশ্বীনী কুমার দত্ত, বিডি হাবিবুল্লাহ, সরদার ফজলুল করিম প্রমূখদের আত্মগোপন স্থান ছিল এই লালুয়া সাহিত্য পরিষদ। এখান থেকেই পটুয়াখালী জেলার সাহিত্যাঙ্গনে উঠে আসেন কবি খন্দকার খালেক, আসগর আলী, ইয়াকুর আলী, নির্মল কুমার দাসগুপ্ত সহ বর্তমান সময়ের অনেক কবি সাহিত্যিক।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!