মুক্তিযুদ্ধঃ সহযোদ্ধাদের গল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাহিত্য বাজার

Sharing is caring!

মুক্তিযুদ্ধঃ সহযোদ্ধাদের গল্প

ত্রিশ গোডাউন বধ্যভূমি

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার গল্প আমরা অনেক শুনেছি।  বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সরকারের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অফুরান।  তাই তারা এখন সম্মানজনক ভাবে সমাজে বসবাস করছেন, তাদের সন্তান ও পরিবার পরিজনও পাচ্ছেন সরকারি সব সুযোগ সুবিধা। 

কিন্তু যাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে, যাদের সাহায্য ও সহযোগিতা নিয়ে সমাজে তারা আজ প্রতিষ্ঠিত সেই মানুষদের কথা আমরা কি জানি? জানি কি কেমন আছেন তারা? যুদ্ধ শেষে কোনো মুক্তিযোদ্ধা কি আজ পর্যন্ত কখনো তাদের কাছে গিয়ে জানিয়েছেন এতটুকু কৃতজ্ঞতা?

আহঞ্জী বা তালুকদার বাড়ির দরজায়

বরিশালের চাঁদপুরা ইউনিয়ন এর তালুকদার হাট এলাকার আকঞ্জীবাড়ি বা তালুকদার বাড়িতে যুদ্ধকালিন সময়ে হাড়ি হাড়ি ভাত রান্না হতো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। এখানের ছাড়াবাড়ি ( ঘন জঙ্গল এলাকা) ও কাচারী ঘরে যুদ্ধকালিন সময়ে ঘন ঘন এসে আশ্রয় নিতেন মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই।  কারণ এ বাড়ির বেশ কয়েকজন যুবকও ছিলেন তাদের দলে। ঐ সময়ের সাহায্যকারীদের কথা জানতে আমরা ছুটে যাই বরিশালের চাঁদপুরা ইউনিয়নের তালুকদার হাটের তালুকদার বাড়ি, মের্ধাবাড়ি, ও চৌধুরী বাড়িতে। যেখানে আশ্রয়  ও সহযোগিতা পাওয়ার কথা স্বীকার করে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন ৯ নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার আবদুল মান্নান এর অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধা মান্নান গাজী (গাজী আব্দুল মান্নান) নিজেই।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই আহঞ্জী বা তালুকদার বাড়ির প্রধান কর্তৃত্বকারী ইসমাইল তালুকদার, আব্দুল মালেক আহঞ্জী,  মকবুল আহঞ্জী ও মোবারক আহঞ্জী এদের নির্দেশ ছিলো প্রতিদিন ৩/৪ জনের বেশী ভাত রান্নার। এমনকি তরকারি রান্না করলে তাতে যেন ঝোল বেশী থাকে। একই সাথে পানি ডাল রান্না বাধ্যতামূলক ছিল। নির্দেশ দেয়ার পর আমরা বাড়ির মহিলারা জিজ্ঞাসা করি কেন? সাথে সাথে কর্তারা কইতেন –  দেশের জন্য যারা লড়াইতে নামছে, হেরা মোগো বাড়িতে ঢুকলে যেন কিছুতেই  খাবারের সমস্যা না হয়। এমনকি তাদের থাকার জন্য কাচারিঘর ও ছারাবাড়িতে ব্যবস্থাও করে রাখা হয়। —

 

দাদু চানবরু আকন

কথাগুলো বলছিলেন বরিশাল সদর উপজেলার চাঁনপুরা ইউনিয়নের তালুকদার হাট গ্রামের আকন্দ (আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় আহঞ্জী) বাড়ির গৃহবধূ চান বরু। বয়সের ভারে নূরে পড়া চান বরু (৮০) এখনো সুস্থ সুন্দর ছুটে বেড়ান এ বাড়ি ওবাড়ি। লাকড়ি কুড়িয়ে এনে রান্নাও করেন নিজেই। 

দাদু রওশন আরা

আর মের্ধা বাড়ির বউ রওশান আরা বলেন, আহঞ্জী বাড়ি আর মের্ধাবাড়ি আসলে একইবাড়ি। এ বাড়িতে ১৪টি ঘরে তখন বসবাস করতো ১৪টি পরিবার। প্রতিটি পরিবারে ভোরে এবং একই সাথে দুপুর ও রাতের খাবার রান্না হতো। সবাই ঘরের পিছনে পৃথক রান্না ঘরে জ্বালানী কাঠ দিয়ে রান্না করতো। এ জন্য সন্ধ্যার পর আর চুলা জ্বলতো না তখন। আর এই বাড়িটির চারিদিক গাছপালা থাকায় বাহির থেকে বাড়ি বোঝা যেতো না। তাছাড়া বাড়ির ৬ জনই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত। এ কারনে সপ্তাহের ৪/৫ দিন প্রতিরাতে ২০/৩০ জনের দল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়িতে আসতো। এরপর কাচারী ও পার্শ্ববর্তী একটি জঙ্গলে রাখার ব্যবস্থা করা হতো। এ সময় ঘরের গৃহকর্তারা তাদের পাহাড়া দিতেন। রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের জন্য প্রতিটি ঘর থেকে ভাত ও তরকারি সংগ্রহ করে তাদের খাবার দেয়া হতো। মুক্তিযোদ্ধারা কাচারীতে বসে খাবার খেতো। এরপর জঙ্গলে গিয়ে বিশ্রাম নিতো। এভাবে যুদ্ধকালীন সময় বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এসে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বিশেষ করে যে সকল বাড়ির ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাদের বাড়ি তারা নিরাপদ মনে করতেন। এ কারনেই ওই সময় আমাদের বাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল গড়ে ওঠে।

নকীব আকঞ্জী বা আকন

ওই বাড়ির আরেক ব্যক্তি নকীব আকঞ্জী  যুদ্ধকালীন সময় যার বয়স ছিল ১৪ বছর। তিনি বলেন, শুধু খাবার নয়, এ বাড়ি থেকে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য সহযোগিতাও করা হতো মুক্তিযোদ্ধাদের। বিশেষ করে পোশাক থেকে শুরু করে পায়ের জুতা পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। যুদ্ধকালীন সময় এক দল মুক্তিযোদ্ধা এসে ২শ’জোড়া জুতা দেয়ার অনুরোধ করেন। তখন বাড়ির সকলে মিলে টাকা সংগ্রহ করে ওই টাকা দিয়ে জুতা কিনতে বরিশাল শহরে যান আমার বাবা চাচারা। ৫০ জোড়া জুতার দাম ছিল একশ’টাকা। প্রতিজোড়া ছিল ২ টাকা করে। কিন্তু হঠাৎ করে দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ওই জুতার মূল্য দাড়ায় ৫টাকা করে। এ কারনে ২৫ জোড়া জুতা কেনা সম্ভব হয়েছিলো।

নকীব আকঞ্জী আরো জানালেন, ওই জুতা কোনভাবে পাকিস্তানীরা দেখে ফেললে তারা বুঝে যেতে পারে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এ জুতা ক্রয় করা হয়েছে। এ জন্য পেয়াজ কিনে তার মধ্যে জুতা লুকিয়ে তারপর বাড়িতে এনে মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া হয়। এতে তারা বেশ আনন্দিত হয়। কারন খালি পায়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বেশীরভাগ মুক্তিযোদ্ধাদের পায়ের গোড়ালি ফেটে গেছে। তার মধ্যে মাটি ঢুকেছে। কিন্তু দেশ স্বাধীনের উম্মাদনায় তারা তা কোনভাবে অনুভব করছেন না। এভাবে একটি দল যেতো আরেকটি দল প্রবেশ করতো ওই বাড়িতে। বাড়ির সব বউয়েরা যারা এখন আমাগো দাদু ও চাচী তারা খাবার রান্না করতেন ।

এ বাড়ির ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা সরোয়ার আলম মন্টু,  নুরুল হক আহঞ্জী, খালেক, ফারুক এরা সবাই তখন মুক্তিযুদ্ধের অংশিদার। এদের বন্ধুরা বা পরিচিতজনই রাত বিরাতে খাবারের জন্য চলে আসতেন নির্দ্বিধায়। আসতেন গাজী মান্নানের সঙ্গে অনেকে।  বর্তমানে তারা কেউ ই জীবীত নেই। তবে একজন ঐ গাজী আব্দুল মান্নান এখনো আছেন। সে এসে থাকতেন তার মামাতো বোনে রওশন আরার ঘরে।

কিন্তু যুদ্ধ শেষে তিনি আর আসেননি কখনো অভিযোগ বোন রওশন আরার।  

মুক্তিযোদ্ধা গাজী আব্দুল মান্নান

অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে মুক্তিযোদ্ধা  গাজী আব্দুল মান্নান বলেন, আসলে যুদ্ধকালিন ঐ সময়ে আমাদের সাব-সেক্টর কমান্ডার আবদুল মান্নান এর নির্দেশে আমরা গজনীর দিঘির পাড় ও পাড় সংলগ্ন মৃধা বাড়িতে ঘাটি স্তাপন করি। আমরা তখন চরকাউয়া ও সাইবের হাট নদীবন্দর নিয়ন্ত্রণ রাখার ও ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনীকে আতঙ্কিত করার চেষ্টা করতাম।  তখন কখনো কখনো আমরা বাদশা বাড়ি বা ছারাবাড়ির জঙ্গলেও অস্থায়ী ক্যাম্প করেছি। ঐ সময় আশেপাশের অনেকবাড়ি থেকেই আমাদের খাবারসহ এটাওটা সাহায্য করতো। তালুকদার বাড়ি বা আহঞ্জী বাড়ি থেকেই বেশি সাহায্য আসতো কারণ ঐ সময়ে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধশালী বাড়ি ছিল ওটি। আমি কখনো কখনো আমার বোন রওশনের বাড়িতেও থেকেছি। এই মুক্তিযোদ্ধা  আরো বলেন, যুদ্ধ চলাকালে যারা আমাদের সাহায্য করেছেন তারা সবাই আসলে সহ মুক্তিযোদ্ধা।  তাদের সাহায্য ছাড়া এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ সফল হওয়া অসম্ভব ছিলো।

বাদশা তালুকদার

ওই বাড়ির আরেক বাসিন্দা বীরমুক্তিযোদ্ধা সরোয়ার আলমের ভাই প্রত্যক্ষদর্শী সফিকুল আলম বাদশা তালুকদার (৬৬) বলেন, আকন্দ বাড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হতো। খাবার থেকে শুরু করে পোশাক ও জুতা পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। যুদ্ধ শেষে বরিশাল সার্কিট হাউসে ডেকে আমাকেসহ (বাদশা) বহু মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট দেন তৎকালীন কমান্ডার শাহজাহান ওমর। সার্টিফিকেটের সাথে সম্মানীস্বরূপ ৫০ টাকাও দেন। কিন্তু এরপর আমি মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নেয়ার জন্য কোন ধরনের চেষ্টা করিনি। তার মতে, ওই সময় বাংলাদেশে বসবাসরত ৭ কোটি মানুষের মধ্যে রাজাকার বাদে সকলেই মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছে। সকলকেই মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। আকন্দ বাড়ির স্বিকৃতিপ্রাপ্ত বীরমুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন : নুরুর ইসলাম আকন্দ, এবিএম ফারুক হোসেন, সরোয়ার আলম মন্টু তালুকদার ও এবিএম খালেকুজ্জামান।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন মানিক বীরপ্রতীক 

বরিশাল জেলা মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার কেএসএ মহিউদ্দিন মানিক (বীর প্রতীক) বলেন, ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর দখলদার পাক বাহিনী অগ্রসরমান মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে এ শহর থেকে ডেরা গুটিয়ে পালিয়ে যায়। ৭ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা থেকে বরিশালে কারফিউ জারী করেছিল পাকবাহিনী। সীমান্তে মিত্র বাহিনী আক্রমণ শুরু করার পর ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকেই পাক সেনারা বরিশাল ত্যাগের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।বরিশাল শহর কেন্দ্রীক বিভিন্ন সড়ক পথ চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় হানাদাররা নৌ-পথে পালাবার পরিকল্পনা করে। এ উদ্দেশ্য যাত্রীবাহী স্টিমার ইরানী, কিউইসহ লঞ্চ ও কার্গো বরিশাল স্টিমার ঘাটে প্রস্তুত রাখা হয়। এসব নৌযানে করেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, পাক মিলিশিয়াসহ শহরের দালাল ও রাজাকার কমান্ডাররা বরিশাল ত্যাগ করে। পাক সেনাবাহিনীর নৌযানগুলো একাংশ চাঁদপুরের কাছে মেঘনা মোহনায় ভারতীয় মিত্র বাহিনীর বিমান হামলার কবলে পড়ে এবং কিউই জাহাজসহ গানবোড ও কার্গো ধ্বংস হয়।অপর অংশ বরিশালের কদমতলা নদীতে ভারতীয় বিমানের বোমার আঘাতে পাকবাহিনীসহ নৌযানগুলো নিমজ্জিত হয়। ফলে এসব জাহাজে পলায়নরত সকল পাক সেনা, মিলিশিয়া, রাজাকার কমান্ডার ও দালালরা নিহত হয়। পাক বাহিনীর শহর ত্যাগের খবরে ৮ মাস ধরে অবরুদ্ধ বরিশালের মুক্তিকামী মানুষ বিজয়ের আনন্দে শ্লে¬াগান দিয়ে দলে দলে রাস্তায় নেমে আসে।

তবে দেশ স্বাধীন হলেও বধ্যভূমিগুলো আজো সংরক্ষন করা হয়নি। এমনকি ওই বধ্যভূমিতে যারা নিহত হয়েছেন তাদেরও মেলেনি স্বিকৃতি। জেলার ৯ উপজেলার ৩৩টি বধ্যভূমির মধ্যে ৩০টিই অরক্ষিত। অথচ ওই ৩৩টি বধ্যভূমিতে ৫০ হাজারের অধিক লোক গণহত্যার শিকার হয় বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে।

বরিশাল জেলা সদরে তিনটি, গৌরনদীতে চারটি, আগৈলঝাড়ায় ছয়টি, বাকেরগঞ্জে তিনটি, বানারীপাড়ায় পাঁচটি, বাবুগঞ্জে দুটি, উজিরপুরে পাঁচটি, মুলাদীতে দুটি, মেহেন্দীগঞ্জে তিনটিসহ ৩৩ বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে।

এর মধ্যে বরিশাল সদরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের এলাকার ভেতরে থাকা বধ্যভূমিটি আধুনিকায়ন করা হয়েছে। গৌরনদী উপজেলার কেতনার বিল এবং উজিরপুর উপজেলার দরগাহবাড়ি বধ্যভূমিতে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। বাকীগুলো রয়েছে অরক্ষিত।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!