বরিশালের একটি হত্যা মামলাকে ঘীরে বিপাকে বাদীঃ নেপথ্যে গভীর ষড়যন্ত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাহিত্য বাজার

Sharing is caring!

একবছর আগে প্রতিপক্ষের ঘুষিতে আহত ও পাঁচদিন পর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ছালাম মল্লিক নামের এক ব্যক্তি। এ ঘটনায় অজ্ঞাত কারণে মুল আসামীদের পাশাপাশি আরো কয়েকটি নাম যুক্ত করে গত দেড় বছর ধরে হত্যার মামলা চালিয়ে আসছিল মৃতের ছেলে ফারুক মল্লিক। আর এ মামলা চালাতে যেয়ে তাকে হারাতে হয়েছে শেষ অবলম্বন ১৫ শতক জমিও। যা মামলার খরচ হিসেবে দিতে হয়েছে তারই চাচাতো ভাই সিআইডি কনস্টেবল সিদ্দিকুর রহমানকে বলে জানান তিনি।

গত কয়েকদিন ধরে এই মামলাটি নতুন করে বরিশালে আলোচনার ঝড় তুলেছে। কারণ এই মামলার একজন আসামি জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি মিন্টু মেম্বার। আগামী ১১ নভেম্বর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এবারও তিনি ভূমিকা রাখতে পারেন আশঙ্কা থেকে তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয়ভাবে আপোষ মিমাংসা হওয়ার পরও সে যেন জামিন না পায় সেজন্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাকে সন্ত্রাসী ও সর্বহারা নেতা প্রমাণিত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে একটি মহল। অথচ পরপর পাঁচবারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এই মিন্টু মেম্বার কিন্তু ঐ মামলার ছয় নম্বর আসামি। অজ্ঞাত কারণে ১-৫ বাদ দিয় ছয় নম্বর আসামি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের বাড়াবাড়ি দেখে ঘটনার প্রকৃত সত্য জানাতে আমাদের এই প্রতিবেদন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে আলোচনা

সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে সরলসোজা দরিদ্র ফারুক মল্লিক এলাকার প্রভাবশালী নেতা ও লোভী আত্মীয়ের গভীর চক্রান্তের শিকারে পরিণত হয়েছেন। এটা যখন সে বুঝতে পেরেছেন ততদিন শেষ সম্বল জমিটুকুও হাতছাড়া হয়েছে ফারুকের। এখন সে অপরের জমিতে চুক্তি ধরে কাজ করে সংসার চালান।

ঘটনার বিবরণে জানা যায়,
গত বছরের ১৮ জানুয়ারী নিহত ছালাম মল্লিকের ছেলে ফারুক মল্লিক বাদী হয়ে কাওছার হাওলাদার, খলিলুর রহমান, রাব্বি হাসান, জলিল হাওলাদার, রহিম হাওলাদার ও মিন্টু মেম্বারকে আসামী করে মামলা দায়ের করেন। গ্রামবাসী জানান, এই মামলা চালাতে ফারুককে ঐ সময় সাহায্য ও উৎসাহ জোগান ওই ইউনিয়নের জাকির চৌধুরী ও তার ভাই রফিক চৌধুরী,সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন এবং ফারুক মল্লিকের চাচাতো ভাই পুলিশ কনস্টেবল সিদ্দিকুর রহমান মল্লিক।
বরিশালের সদর উপজেলার রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়নের উত্তর কড়াপুর গ্রামের হতদরিদ্র ফারুক মল্লিককে দিয়ে তার ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের পরপর পাঁচবারের নির্বাচিত ইউপি সদস্য হাবিবুর রহমান মিন্টুকে জব্দ করতেই এই হত্যা মামলা দায়ের ও মামলা জড়িয়ে মিন্টু মেম্বারকে সিআইডি দিয়ে কয়েক বার গ্রেফতার করা হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচন সময় এলেই কোনো না কোনো মামলায় ফাঁসিয়ে মিন্টু মেম্বারকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানান এলাকাবাসী অনেকেই।
বাসিন্দারা বলেন, মিন্টু মেম্বার এক দুইবার নয় গত পাঁচ বার এই ইউনিয়নের মেম্বার হইছেন। আসলে তাকে ফাঁসাতেই এর পিছনে কলকাঠী নাড়ছেন ওই ইউনিয়নের কিছু লোক। যাদের কারো সাথে মিন্টু মেম্বারের জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব, কেউ আবার নির্বাচনী প্রতিপক্ষ ভাবছেন তাকে। বিশেষ করে বিএনপি নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন ও ফারুকের চাচাতো ভাই সিআইডির কনস্টেবল সিদ্দিক এরা দুজনে ফুসলিয়ে মামলায় জড়ানোর পর বাদী ফারুকের থেকে মামলা পরিচালনার জন্য নগদ অর্থ নেয়ার পাশাপাশি ১৫ শতাংশ জমিও লিখিয়ে নিয়েছে বলে দাবী করেন এলাকার প্রবীণ ও মামলার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী সিরাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, বাদী কোনভাবে মামলা চালাতে না চাইলেও ওই দুইজন তাকে দিয়ে জোরপূর্বক মামলা চালাচ্ছে। ওই দুইজনের শত্রুতার কারনে দীর্ঘ দেড় বছরের অধিক সময় ধরে মেম্বার মিন্টুসহ ৩ জনকে নানাভাবে হয়রানি হতে হচ্ছে।

প্রত্যক্ষ সাক্ষী সিরাজুল

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সিরাজুল ইসলাম ঐদিন কী ঘটেছিলো তা তুলে ধরেন – জানান,
আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি ছালাম মল্লিক কাওসারের দোকানের সামনে বসে আছে। আমি জানতে চাই ‘চাচা কি হইছে। তিনি (ছালাম) জানান ‘বাবা আমারে ওরা মারছে’। কেন মারা হলো জানতে চাইলে দোকানদার কাওসার জানায়, ছালাম এর আগে তার দোকান থেকে বিস্কুট খেয়ে টাকা দেয়নি। আজকে আবার না বলে আমার দোকানের বিস্কুট খাইছে। আমি বাধা দিলে আমাকে মারতে আসে। এনিয়ে বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে আমি ছালামকে দুটি ঘুষি মারছি। পরে বিষয়টি ওখানেই নিষ্পত্তি হয়। এরপর ফরিদ মেম্বার নামের এক ব্যক্তি ছালামকে বাড়ীতে দিয়ে আসে। ঘটনার আশেপাশে বা দূরেও মিন্টু মেম্বার ছিলোনা।

ঐ ঘটনার ৫দিন পর ছালাম মল্লিককে অসুস্থ হওয়ার কারণে শের-ই বাংলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সিরাজুল ইসলাম আরো জানান, নিহত ছালাম একজন মানসিক প্রতিবন্ধী। তার হাতে সব সময় লাঠিসোটা থাকতো। এর আগে সে বাজারের স্থানীয় ব্যবসায়ী রহিম এবং তার (ছালাম) আপন ভাইকে কুপিয়ে জখম করে। কাওসারের সাথে ছালামের টুকটাক মারামারি হইছে। কিন্তু মারাতো গেছে ঘটনার ৫/৬ দিন পরে। ঘটনার পরের দিনও মারা যায়নি। তাহলে এটা হত্যা হয় কি করে?
(এখানে লক্ষ্যনীয় হচ্ছে নিহত সালাম মল্লিকের ভাই। যাকে রাত হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা খুঁজে পাইনি।)
স্থানীয় গ্রামবাসী আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ, বিএনপি কর্মী সাজেদ ও পথপ্রদর্শক সাংবাদিক জসিম জিয়া বলেন, মেম্বর মিন্টু এলাকায় জনপ্রিয় হওয়ায় তার শত্রুও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে বিএনপির সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিনের ধারণা মিন্টু চেয়ারম্যান নির্বাচনে অংশ নিলে তিনি (আমিন) আর কখনো নির্বাচিত হতে পারবে না। এ কারনে মিন্টুর প্রধান শত্রু হচ্ছেন নুরুল আমিন। তার মদদেই এ মামলা দায়ের হয়। যেখানে ঘটনার সাথে জড়িত না হয়েও মিন্টুসহ আরো তিনজনকে এ মামলায় জড়ানো হয়। এছাড়াও ফারুক কে সাহায্য করার নামে ওর চাচাত ভাই সিদ্দিকও জমি লিখিয়ে নিয়েছে বলে জানান গ্রামবাসী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা শহিদ ও মামুন। পাশে বসা ফারুক তখন নিরবতা পালন করেন।
এলাকাবাসী জানান, ফারুক আর এই মামলা আর চালাবেন না, তুলে নেবেন, তাই মামলা নিয়ে আপোষ মিমাংসাও হয়ে গেছে।
সাংবাদিকরা তখন প্রশ্ন করেন মিন্টু মেম্বার এর ভয়ে নাকি টাকার বিনিময়ে আপোষ? উত্তরে ফারুক কেঁদে ফেলেন ও বলেন, রোজ কামলা খাটি, তারপর সংসার চালাই। যা গেছে গেছে। আমি ভুল করেছিলাম। আমি এই মামলা আর চালাবোনা।

ফারুকের এই ঘোষণা দেয়ার দশ মিনিটের মাথায় গোয়েন্দা পুলিশ এসে মিন্টু মেম্বারকে তার এলাকা থেকে পুনরায় গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
পরদিন প্রতিবেদককে ঐ এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলেন, এটা ফারুকের চাচাতো ভাই সিদ্দিকুর রহমানের কারসাজি হবে। সে সিআইডির প্রভাব খাটিয়ে ফারুককে এই মামলাটি ঝুলিয়ে রাখাতে বাধ্য করছে। কৌশল হিসেবে তদন্তকারী কর্মকর্তাদেরও নানাভাবে বিভ্রান্ত করছেন তিনি। এই সিদ্দিক এক সময় বেশ কয়েকজন ডিআইজির বাসায় দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই ক্ষমতা বলে এবং তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে প্রচুর টাকার মালিকও বনে গেছেন। নামে-বেনামে তার রয়েছে অনেক সম্পদ। তারউপর শোনা যায়, অবসর নিয়েই সে ইউপি নির্বাচনে অংশ নেয়ার চিন্তাভাবনা করছে। তাই মিন্টু মেম্বারকে সরাতে চান

বাদী ফারুক মল্লিক

মামলার বাদী ফারুক মল্লিক বলেন, ‘মিন্টু মেম্বারসহ আরও অনেককে অন্তর্ভূক্ত করে ভুল করেছি। একটি পক্ষ আমাকে দিয়ে জোর করে ওই সব নিরীহ ব্যক্তিদের আসামী করাতে বাধ্য করেন। আমি এখন মামলাটি চালাবো না, আপোষে যাবো। কিন্তু ওই পক্ষ সেই আপোষ মীমাংসার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন,‘ গত ৯ সেপ্টেম্বর স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান খোকনের উপস্থিতিতে আপোষনামায় আমি স্বাক্ষর করেছি। আপোষনামায় এতে বাদী উল্লেখ করেন ‘একটি কুচক্রি মহল তাকে দিয়ে মামলাটি করিয়েছেন। ঘটনার সাথে মিন্টু জড়িত ছিলেন না’।

মেম্বার মিন্টু

মেম্বর হাবিবুর রহমান মিন্টু বলেন, ‘রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি নুরুল আমিনের সাথে আমার রাজনৈকিতসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধ চলছে। এছাড়া স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী আমি। জাকির চৌধুরী ও তার ভাই রফিক চৌধুরীর সাথে আমার অনেক বছর ধরে জমি সংক্রান্ত বিরোধ রয়েছে। মূলত তারা একাট্টা হয়ে বাদীকে দিয়ে জোর করে আমাকে হত্যা মামলার ৬ নম্বর আসামী করেছেন।
মিন্টু অভিযোগ করেন, সিআইডিতে চাকরী করে হাকিম মল্লিকের ছেলে সিদ্দিক মল্লিক। এই সিদ্দিক এক সময় প্রেম করে একটি মেয়েকে বিয়ে করেন। তখন সে বরগুনা থাকতো। স্থানীয় থানায় সিদ্দিকের নামে মামলাও হয়। সিদ্দিকের বাবা এত মামলাবাজ ছিল তাকে মানুষ বলতো কেস মল্লিক। এক পর্যায় সিদ্দিক তার স্ত্রীকে ঘরে উঠাতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে (সিদ্দিক) একটু গালমন্দও করি। এর জের ধরে সিদ্দিকও পেছনে বসে কলকাঠি নাড়ছে। তার এখন অনেক টাকা, শোনা যায় সেও এলাকায় নির্বাচন করবে ।

বিষয়টি নিয়ে কনস্টেবল সিদ্দিকুর রহমান মল্লিকের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি ফোনে বলেন, নিহত ছালাম মল্লিক আমার চাচা। তার কাছ থেকে যদি আমি জমি নিয়ে থাকি তারতো প্রমান থাকবে। যারা এ ধরণের অভিযোগ করে তারা পারলে প্রমাণ হাজির করুক। এ ধরণের অভিযোগ আসলে ভিত্তিহীন।

এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আবুল কালাম আজাদ বলেন, মামলা প্রত্যাহার করতে হলে কোর্ট থেকে করতে হবে। এখানে পুলিশের কোন হস্তক্ষেপ নেই। আর বাদী আপোষ মীমাংসা করেছে কিনা আমি জানিনা।

সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপির সহ সভাপতি নুরুল আমিন বলেন, হত্যা মামলা সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই। এমনকি মেম্বর মিন্টুর সাথেও আমার কোন শত্রুতা নেই। তাদের অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারী সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে উত্তর কড়াপুর বাড়ুখায়ের দিঘিরপার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় কাওসার হাওলাদারের মালিকানাধীন চায়ের দোকানে গিয়ে চা ও বিস্কুট চাইলে নিহত ছালামকে অকথ্য ভাষায় তিনি (কাওসার) গালিগালাজ এবং মারধর করেন। মারামারি শেষে ঘটনাস্থলে এসে সাক্ষী হন সিরাজুল ইসলাম। ঘটনার ৫ দিন পর আহত ছালাম পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৭ জানুয়ারী তাকে শেরই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে দুপুর ২টায় চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!