জল প্রেমিকের গল্প

আরিফ আহমেদ

Sharing is caring!

images-02হঠাৎ তুফান এলো নদীতে। প্রচন্ড ঢেউয়ের আঘাতে দুলে উঠলো বিশাল বড় জলযানটি। ঢেউতো নয় যেন বিশালাকার পাহাড় আছড়ে পরছে নদীর জলে। আচমকা নদীর এই ক্ষেঁপে উঠার কারণ ভাবার সময় কারো নেই। প্রায় পাঁচশত যাত্রী বোঝাই এম ভি পর্বত নামের জলযানের ভিতর ভয়ার্ত আর্তনাদ আর মানুষের ছুটোছুটি ঠেকাতে ব্যস্ত লঞ্চের কর্মীরা। দীর্ঘ বছরের অভিজ্ঞ চালক নজীর আলী তার বয়সে কখনো এমন তুফান দেখেননি। পদ্মা-মেঘনার লড়াইয়ে পরেছেন বহুবার, সে অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগাবার চেষ্টা করছেন তিনি। লঞ্চের গতি সমান রাখছেন ঢেউয়ের তালে তাল মিলিয়ে, বারবার ঘুরাচ্ছেন তার স্টিয়ারিং হুইল। নীচের মানুষের ভয়ার্ত চিৎকার আর নিয়ন্ত্রকদের চেঁচামেচি তার কানে আসছে। এই উত্তাল পানিবাহী বাতাসের ঝাঁপটাতেও রিতিমত ঘেমে উঠেছেন নজীর আলী। চেষ্টা করছেন লঞ্চটিকে কাছাকাছি কোনো পাড়ে নিতে। কিন্তু ঢেউয়ের দাপটে কোথাও পাড় খুঁজে পাচ্ছেন না। বহুদিনের অভিজ্ঞতায় যে পথে তিনি চোখ বুঝে লঞ্চটি চালাতেন, সে পথ আজ হঠাৎ যেন তার অচেনা।
নদী পথে ঢাকা থেকে ভোলা যেতে পদ্মা পাড়ি দেয়ার পর কালাভোদর ও আগুনমুখা নদী দুটি একটু ভিতিকর। কিন্তু এই ছোট তেতুলিয়া নদীতে হঠাৎ তুফানের কবলে পরবেন তা স্বপ্নেও ভাবেননি নজীর আলী। মনের ভিতর প্রচন্ড আতংক পাশের সহকারী হাসমতকে বুঝতে না দিয়ে একের পর এক নির্দেশনা দিচ্ছেন। হাসমত নির্দেশনা অনুযায়ী একটা শিকলে কখনো একসাথে দু’বার, কখনো পরপর তিনবার, আবার কখনো চারবার টান দিচ্ছেন। নীচে ইঞ্জিনকক্ষে একটি ঘণ্টি বেঁজে উঠছে এরফলে, এ নির্দেশনা ধরে জাহাজের গতি কমছে, বাড়ছে, স্থির হচ্ছে। ঢেউয়ের ধাক্কায় একবার কাত হচ্ছে লঞ্চ, একবার সোজা হচ্ছে আবার উঠে যাচ্ছে অনেক উপড়ে, ধপাস শব্দে আছড়ে পরছে জলে।
তিনতলা এই লঞ্চের তৃতীয় তলা পুরোটা ও দ্বিতীয় তলার অর্ধেক কেবিনে পূর্ণ। নীচতলা ও দ্বিতীয় তলার বাকী অর্ধেকে যাত্রীরা বিছানা পেতে যাতায়াত করেন। কেবিনে যারা আছেন, তারা প্রথম দুলনীতে বেশ মজা পেয়ে আরো আয়েস করে ঘুমাবার আয়োজন করছিলেন, এমন সময়  লঞ্চটি এতোটাই কাত হল যে, অনেকেই বিছানা থেকে পরে গেলেন, কারো কারো মালপত্র পরে গেল। ভয়ে আতংকে মূহুর্তে টনক লড়লো তাদের। বাইরে উঁকি দিয়ে তাজ্জব বনে গেলেন সবাই। একইসঙ্গে নীচে নামার ও ছাদে যাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করলেন তারা। উচ্চশিক্ষিত ও ধনীরাই বেশিরভাগ কেবিনের যাত্রী হন। তাদের বাঁধা দেওয়া কেবিন বয়দের সাধ্য নয়, তাদের হুড়োহুড়িতে  লঞ্চটি আরো বেশি বিপদে পরার আশংকা তৈরি হল।
এদিকে ডেকের যাত্রীদের কাছে মোটা দড়ি ছুড়ে দিলে, তারা নিজেরাই লঞ্চের রেলিং এর সাথে আড়াআড়ি দড়ি বেঁধে তা ধরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন সবাই। আল্লাহ বাঁচান, খোদা বাঁচান, লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নিকুনতু মিনাজ জোয়ালেমীন- এ রকম যে- যা দোয়া জানেন, যাত্রীরা তা পড়ছেন চিৎকার করে। কেউ কেউ মানত করতে শুরু করেছেন বিভিন্ন পীর আউলিয়ার নাম ধরে। হিন্দু ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের যাত্রীরা কেউ কেউ তাদের ভগবানকে ডাকছেন, কেউ নিরবে ধ্যানে বসেছেন, তারা ছুটোছুটি করছেন না, যেটা মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা করছেন।  প্রচন্ড ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে নীচের ডেকে, পানি গড়িয়ে যাচ্ছে এ মাথা থেকে ও মাথায়। চারজন শ্রমিক পালা করে জাহাজের চাপকল চাঁপতে ব্যস্ত। যে করে হোক ভিতরে পানি জমতে দেবেনা তারা। হঠাৎই ঢেউটা এলো, জাহাজের সামনের দিক থেকে পাহাড়ের সমান উচ্চতা নিয়ে ঢেউটা এলো। চুকানী নজীর আলী ঢেউটিকে আসতে দেখে আতঙ্কে দোয়া পড়তে শুরু করলেন, তার ইচ্ছে হচ্ছে লাইফবয়া নিয়ে এখনি ঝাঁপ দিয়ে নদীতে পরেন, কিন্তু এতোগুলো মানুষকে রেখে তিনি এটা করতে পারেন না। দ্রুত মাউথপিস হাতে নিয়ে লঞ্চের সব যাত্রীকে সাবধান করলেন, সবাইকে লাইফবয়া আঁকড়ে ধরার পরামর্শ দিলেন। এমনসময় তার চোখ আটকে গেল নীচে ডেকের সম্মুখভাগে। জাহাজের সম্মুখপ্রান্তে সূচালো ডগার উপর উঠে দাঁড়িয়েছে এক যুবক। একহাতে আঁকড়ে ধরেছে জাহাজের নিশান লাগানো রডটি, অন্যহাতে কাউকে ইশারা করার ভঙ্গিতে ঢেউটিকেই যেন সে টা টা দিচ্ছে। চিৎকার করে যুবকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলো নজীর আলী। কিন্তু বাতাস আর ঝড়ের দাপটে তার কণ্ঠ নিজের কাছেই অস্পষ্ট মনে হল। হাসমতকে বলল, এই পাগলটা কে? সরাও ওকে, ও তো মারা পরবে।
অনেকক্ষণ যাবৎ এরফান মোহাম্মদ নামের এই যুবক ঢেউয়ের সাথে লঞ্চটির যুদ্ধ আর মানুষের আর্তনাদ দেখছিল। প্রথমদিকে কেবিনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করছিল তেতুলিয়া নদীর মাতাল হওয়ার দৃশ্য। শান্ত ছোট্ট এ নদীটি হঠাৎ কেন এতো ক্ষেঁপেছে তা বোঝার চেষ্টা করছে রেলিংএ ভর দিয়ে। ঢেউয়ের উচ্চতা ও বাতাসের দাপটে পানি এসে ওর চোখে মুখে ঝাঁপটা দিচ্ছে। মানুষের ছুটোছুটি আর ঢেউয়ের প্রবল আক্রমণ দেখে সে নিজেও মনে মনে বেশ আতঙ্কিত হল। ঘুরে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার ছাড়লো – থামুন আপনারা। মুর্খদের মতো ছুটলে কি বিপদ কমবে?
তার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যে সবাই থমকে গেলেন।
এরফান বলছে – এভাবে ছুটলে যে লঞ্চটি কাত হয়ে পরবে। আপনারা সমান ভাগে ভাগ হয়ে লঞ্চের দুপাশে শক্ত কিছু আঁকড়ে ধরে চুপচাপ বসুন বা দাঁড়িয়ে থাকুন।
কেবিনের প্রায় শ’দুয়েক যাত্রী মূহুর্তে তার কথা শুনলো। কেবিনের লোকদের শান্ত করে তাদের দু’ভাগে ভাগ করে নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে দিল সে। তারপর দ্রুত ছুটে গেল নীচের মানুষগুলোকে শান্ত করতে। দড়ি দিয়ে জাহাজের দু’পাশে বেষ্টনী তৈরির বুদ্ধিটা দিয়ে, সে ছুটল সম্মুখ ডেকের দিকে। দরজা লাগানো, অনেক কষ্টে, ক্রুদের ধমকে দরজা খুলতে বাধ্য করল, তারপর বড় পাহাড়সম ঢেউটিকে আসতে দেখে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো লঞ্চের সূচালো মাথার উপর। ওর বিশ্বাস ঢেউ ওর শরীরে আঘাত করবে না। তার আগেই ভেঙ্গে মিলিয়ে যাবে। আর যদি আঘাত করে, তাহলে সব যাত্রীর আগে ওর জীবনই যেন যায়।
এটাকে দ্বৈব ঘটনা বলবো, নাকি প্রচন্ড বিশ্বাসের পরিণতি বলবো? নাকি এখানে অন্য কিছু লুকানো আছে, যা আমাদের জানা নেই। নজীর আলী আর হাসমত আতংকে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল, ওরা দেখলো প্রচন্ড ঢেউটি এসে সাপের ফণার ছোবলের মতোই আছড়ে পরছে জাহাজের উপর, আর এটা পরামাত্র এ জাহাজের সব শেষ হয়ে যাবে নিমিশেই। ডুবে যাওয়ার হাত থেকে এ জাহাজটিকে বুঝি আর বাঁচানো গেল না। এতগুলো যাত্রীর নিশ্চিত মৃত্যু বুঝি আর ঠেকানোর উপায় নেই।
কিন্তু একী, ঐ যুবকের সামনে এসেই যেন নতজানু হয়ে গেল ঢেউটি। যেন এ আয়োজন সবটাই ঐ যুবককে একটু গোসল করাবার জন্য। যুবকের মাথার উপর এমনভাবে ঢেউটা ভেঙ্গে পরল যে হালকা ঝাঁপটা এসে গোসল করাল তাকে।
পরমূহুর্তে একেবারে শান্ত হয়ে গেল নদী। যেন কখনোই কিছু ঘটেনি এ নদীতে।
কাকতালীয় এ ঘটনাটি দেখলো শুধু নজীর আলী আর হাসমত। ব্যস্ত হাতে নজীর আলী লঞ্চটিকে একটি ঘাটে নোঙর দিতে দিতে হাসমতকে বলল, ঐ যুবকের কাছে যাও, সে কোথায়, কোন কেবিনে দেখ, আমি তার কাছে যাব।
হাসমত ছুটে নীচে যেতে যেতে অদৃশ্য হয়েছে যুবক। তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। পাবে কি করে। হাসমত আর নজীর আলী যে যুবককে দেখেছে, সে তখন ভেজা কাপড় পাল্টে নিয়ে কেবিনের একটি কক্ষে নাক ডাকিয়ে ঘুমে ব্যস্ত। তার পাশে একটি গীটার কোলবালিশের ভূমিকা পালন করছে।

দুই
images-03ভোলা বন্দরে লঞ্চটি ভিড়েছে বেলা ১১ টায়। জাহাজের সব যাত্রীর চোখে মুখে কান্তি। তারা সবাই ঐ যুবককে খুঁজছে, যে রাতে তাদের নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু যুবকটিকে কোথাও আর দেখা গেল না। যাবে কি করে জলযানটি জেটিতে ভিড়তে না ভিড়তেই লঞ্চের পিছনভাগ দিয়ে ভাড়াটে ইঞ্জিন নৌকায় চেঁপে হাওয়া হয়েছে যুবক। ওর গন্তব্য যে শহর থেকে আরো অনেক অনেক দূরে, চরদুয়ারের বাথান পাড়ায়। তাই রহস্যময় যুবকের এই নিখোঁজ হওয়ার গল্পে তখন নানান রকম কল্পকাহিনী যুক্ত হতে থাকলো। হাত দিয়ে ঢেউকে থামিয়ে দিয়েছে, এ মানুষ ছিলনা, কোনো ফেরেশতা এসে এটা করে গেছে, তাইতো আর খুঁজে পাইনি তাকে। আবার কেউ বলছে, আমার পীর তার হাত দিয়ে এটা থামিয়ে গেছে। পীরগুরু চরজামাই এসেছিলেন এই যুবকের বেশে। ইত্যাদি নানান রসময় মালাই যুক্ত হতে থাকলো ঐ ঘটনার সাথে।
এদিকে আগুনমুখা নদীর জল চিড়ে ছুটে চলা ইঞ্জিন নাওয়ের মাথায় বসে গীটারে টুং টাং শব্দে গান ধরেছে তখন এরফান মোহাম্মদ। তার সুরেলা কণ্ঠে ধ্বণিত হলো …
ও আমার দেশ ও আমার নদী
ও আমার সুজলা সুফলা বাংলারে
তোর কোলে মাথা রেখে
আমি চিরসুখি… নিরবদি।।
এই তো নদী চলছে ছুটে… দূর কোনো গাঁয়
ঐ যে সবুজী কণ্যা সাঁজে … কাকে সে জানায় বিদায়।।
তোর রুপের ঐ ¯িœগ্ধতায়
আমি চিরসুখি…. নিরবদি।। ঐ
যদি বাসো ভালো তারে….
সে যে বাসবে ভালো উজাড় করে
ঐ আকাশ বাতাসের মিতালী যেমন
ঢেউয়ের তালে… দূর পাড়া গায়ে।।
হো হো হা হা
নদীর এই ছুটে চলা পথ ধরে
ভালোবাসা ফেরী করে
আমি চিরসুখী… নিরবদি
ও আমার দেশ ও আমার নদী। ঐ
কেউ যদি খুব মনোযোগে লক্ষ্য রাখতো নদীর জলে, তাহলে সে দেখতে পেত, এরফানের গান শেষ হতেই ট্রলারের দুপাশের জলে মাছের লেজের ঝাপটার হাততালি। শুধু এরফান দেখলো দু’জোড়া করে চার জোড়া মাছের লেজ এরফানকে গার্ড অব অনার প্রদর্শন করছে। মৃদু হাসিতে ওদের প্রতি সম্মান জানালো এরফান। ব্যাগে হাত দিয়ে চারটে কমলা বের করে দুপাশের জলে ছুড়ে দিল খুবই নিরবে, মাঝি মাল্লা দু’জনের কেউই তা টের পেল না। প্রচন্ড রোদে ট্রলারের টিনের ছাদ তেতে আছে। সেই তাতানো ছাদের উপর দাঁড়িয়েই দুই রাকাত শুকরিয়া নামাজ পড়ল এরফান। এ সব কিছুই যে মহান ¯্রষ্টার অপরিসীম দয়া ও রহমত ওর প্রতি তা ওর চেয়ে ভালো আর কে জানে।
আগুনমুখা নদী পার হয়ে আবারো মেঘনায় পরেছে ট্রলারটি। চরফ্যাশন শহরটিকে পাশ কাটিয়ে চর কটিয়া, তারপর চরমানিক পার হয়ে আরো দূরে চরদুয়ার বাথান পাড়ায় এরফান মোহাম্মদের গন্তব্য। চরদুয়ার মূলত মেঘনা নদী দিয়ে সাগরে প্রবেশের পথ। এই চরদুয়ার থেকে মাত্র ১৫/২০ মিনিটের পথ এগোলেই সাগরে পৌঁছবে যেকোনো নৌকা বা জাহাজ। এই অংশের মেঘনা নদী সরাসরি গিয়ে সাগরে মিশেছে। এখানে নদীর পানিও তাই খুব নোনা। চরদুয়ার এলাকায় তাই মিষ্টি পানির খুব অভাব। লোকবসতিও সবচেয়ে কম। এখানে যারা থাকেন তাদের মধ্যে কয়েকঘর অস্থায়ী জেলে পরিবার, সাগরে মাছ ধরাই যাদের একমাত্র পেশা, শুধু মাছ ধরার সময়টাতেই তারা এসে এখানে থাকেন। স্থায়ী বাসিন্দা বলে আসলে এখানে কেউ নেই। মহিষের তিনটি বাথান বা খামারের ৩০/৪০ জন শ্রমিক বা রাখাল এখানে স্থায়ীভাবে থাকেন বটে তবে তাদেও পরিবার পরিজন কেউ এখানে থাকেন না। সব মিলিয়ে একশত লোকও হবে না। ঝড় বন্যার আভাস পাওয়া মাত্র সবাই ছুটে যায় পাশের চরকটিয়া বা চরসোহাগ অথবা চরমানিকএলাকায়। ওখানে সরকারী আশ্রয় কেন্দ্র রযেছে। রয়েছে মিষ্টি পানির সুব্যবস্থা।
চরদুয়ারে ইতিপূর্বে মাত্র একবার এসেছে এরফান। বাবার হাত ধরে এখানে এসেছিল মাত্র ৯ বছর বয়সে। বাবা ইউসুফ মোহাম্মদ উত্তরাধিকার সুত্রে এখানের একটি মহিষ বাথানের মালিক হয়েছেন। এখানের সবচেয়ে বড় বাথানটি বাবার। বাবা মারা যাওয়ার পর এ বাথানটি এখন এরফানের দায়িত্বে এসেছে। যদিও বাবা জীবীত থাকলে এরফানকে কখনোই এখানে আসতে দিতেন না। ঐ একবারের পর এরফান বহুবার এখানে আসার চেষ্টা করলেও বাবা ওকে আসতে দেয়নি। কিন্তু বাবাতো আর জানেন না, যে ভয়ে বাবা তাকে আসতে দিতেন না, সে ভয়কেই জয় করে তাদের চমৎকার বন্ধু হয়েছে এরফান। আর তা ঘটেছে ঐ ৯ বছর বয়সেই।
এখনো সেই ঘটনাটি ভাসা ভাসা মনে আছে এরফানের।
12চরদুয়ারের বাথানে বাবার পাশে শুয়েছিল ছোট্ট এরফান । হঠাৎ শুণ্যে ভেসে উঠলো ওর শরীর। তারপর নিমেশেই হাওয়ার বেগে কেউ ওকে নিয়ে ছুটেছে। ভয়ে, আতংকে বাবা বলে চিৎকার দেয় এরফান। কিন্তু সে চিৎকার হয়ত বাবা শুনেননি। বাতাসের গতি আর শীতল হাতের ছোঁয়ায় ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় এরফান। যখন জ্ঞান ফিরে আসে ও দেখে, বালুচরে ওর সামনে অনেকরকম খাবার, ফুল আর সামনে বিশাল বড় নদী। শিশুবেলায়, হামাগুড়ি দেয়ার বয়সেই নদী আর পানির সাথে চমৎকার দোস্তি এরফানের। ও কাঁদলেই মা ওকে নিয়ে পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে দোলাতেন। নদীর ঢেউ দেখাতেন। তাহলেই শান্ত হয়ে হাসতে শুরু করতো এরফান। একবার নাকি মামা বাড়ি যাবার পথে ঝড়ে পরেছিল নৌকা, সেকি ঢেউ নদীতে। মা আর মামারা তখন ভয়ে হাহাাকার করছিলেন আর তখনও নাকি এরফান হামাগুড়ি দিয়ে নদীর ঢেউকে ছুঁয়ে দেয়, ওর হাতের ছোঁয়া পেয়ে সাথে সাথে শান্ত হয়ে যায় নদী। এটা কেন , কিভাবে হল এ নিয়ে মা আর বাবা অনেক ভেবেও কোনো উত্তর পাননি। শুধু নানাভাই বলেছিলেন, এ নিয়ে খুব বেশি আলোচনা করো না। আমাদের এরফান হয়তো সেইসব ভাগ্যবান মুসলিমদের একজন, যাদের জন্য আল্লাহ নিজ হাতে পুরস্কার দেবেন এবং যারা নবীজীর কাছাকাছি থাকবেন। শুনেছি এসব দ্বৈব ঘটনা শুধু তাদের জীবনেই সম্ভব হবে।
যাইহোক, এরফান আর নদীর মিতালী যেন শিশুবেলা থেকেই। তাই নদী দেখলেই খুশি হয়ে ওঠে ও। ওর সামনে বিশাল বঙ্গোপসাগরের একাংশ, ছোট্ট এরফান সাগরটাকেই এখন নদী ভাবছে, সেই নদীটিতে অনেক মাছের খেলা চলছে। খাবার আর নদীতে মাছের খেলা দেখে ভয় ভুলে যায় ছোট্ট এরফান। দু’জন অপূর্ব সুন্দর মা সেই মাছেদের সাথে সাঁতার কাটছিল। মা – বলতে এরফানদের পরিবার তখন সব মেয়েদের মা বলে চিনাতো। এমনকি বড়বোনকেও ১২ বছর বয়স পর্যন্ত এরফান ‘মা’ বলেই ডেকেছে।  ওদের পরিবার থেকে এভাবেই শিশুবেলা মহিলাদের চেনানো হয়। হাইস্কুল পাস করার পর ওরা মা, ফুফু ও বোনকে আলাদা করে চিনতে শেখে। যে কারণে মাছের সাথে খেলারত মহিলা দু’জনকেও এরফান ‘মা’ বলে ডাকে। আর এ ডাকেই চমকে ওঠে দুই মৎস মা। ওরা এরফানকে বুকে জড়িয়ে নিতে বালুয়ারীতে ওঠে এলে, এরফান ওদের শরীরের অর্ধেক মাছের মতোই দেখে নাকি খুব হেসেছিল। লেজে ভর দিয়ে হাঁটছে ওরা। এরফানকে বুকে জড়িয়ে সে-কী আদর। ছোট্ট এরফান তখনতো আর জানেনা যে এরা আসলে মাছও নয় এরা জ্বীন সম্প্রদায়ের অভিশপ্ত দুই পরী। আল্লাহর একজন নেক বান্দার সাথে মৎসকন্যা সেঁজে দুষ্টামী করার শাস্তিতে এরা সারা জীবনের জন্য মৎসকন্যা হয়ে গেছেন। এদিকে শয়তান একজন দরবেশের রুপ ধারণ করে এদের কাছে এসে বলেছে, কোনো নিষ্পাপ ৯ বছরের শিশুকে হত্যা করে তার তাজা রক্ত পান করলে এরা আবার পরী হতে পারবে ও ফিরে যেতে পারবে জ্বীন রাজ্যে। সেই থেকে এরা অপেক্ষা করছিল একজন ৯ বছরের শিশুর জন্য। কিন্তু এই চরদুয়ারে কোনো শিশু আসে না। যারা আসে তারা বয়স্ক লোক। এই প্রথম ওরা এরফানকে পেয়েছে, জেনেছে, এরফানের বয়স ৯ বছর হতে আর তিনদিন মাত্র বাকি। দীর্ঘ বছরের ওদের এই অপেক্ষায় ওরা এখানে সন্তান জন্ম দিয়েছে। আল্লাহর এ আরেক রহমত বা উদারতা বলতে হবে যে, কোনো পুরুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই ওরা যে সন্তান জন্ম দিচ্ছে তারাও হচ্ছে মেয়ে সন্তান। এভাবেই বেড়েছে বংশ। ওদের বংশধররা এখন মৎসকুমারী নামে পরিচিত।
শিশু এরফানের মুখের ‘মা’ শব্দটির উচ্চারণে দুই মায়ের মধ্যে একটি ছেলে সন্তানের জন্য প্রচন্ড আকুতী তৈরি হল। মা ডাকের প্রভাব এতোটাই যে এরফানকে হত্যা করে ওর রক্ত পান করার সিদ্ধান্ত সাথে সাথে বাতিল করে দিলেন দুই মা। না এই মায়েরা কিছুতেই ওকে মারতে পারবে না। দু’জনে যেই মাত্র এ সিদ্ধান্ত নিল, সাথে সাথে ওদের শরীরের মাছের খোলস ঝড়ে গেল এবং পরীদের পাখা ও পা জেগে উঠলো। দুই মা মুহুর্তে বুঝতে পারলেন যে, এই ছেলেটির জন্যই আজ, এই মাত্র তারা অভিশাপ মুক্ত হয়েছেন। খুশীতে উল্লসিত দুই মা আকাশের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত শব্দ করলেন। এরফান শুধু আল্লাহ শব্দটি বুঝতে পারলো। ও নিজেও তখন বলল – আল্লাহ।
সঙ্গে সঙ্গে মায়েরা ওকে জড়িয়ে ধরল। আর তখনি অনেক অনেক মৎস নারী এসে ছোট্ট এরফানের চারপাশে জড়ো হলো। আলোয় আলোকিত হয়েগেল সমুদ্র এলাকা। অনেক অনেক সুন্দর যুবকেরা ছুটে এলো জড়িয়ে ধরলো দুই পরী মা কে। সেকী উল্লাস। ছোট্ট এরফান বোঝেনি যে ঐ আলোকিত যুবকরা আসলে জ্বীনদের একটি দল। যাদেও কেউ কেউ এরফানকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু খেলেন। সবচেয়ে ছোট্ট মৎস মেয়েটি যার বয়স মাত্র তিনমাস, সে ওকে পিঠে নিয়ে সাগরে ছুটে বেড়ালো বেশ কিছুসময়। এভাবে পরী মা, মৎসকন্যা আর জ্বীনদের সাথে তিনদিন পার হলো। এরফান ৯ বছরে পা দিল। পরী মা দু’জন এরফানকে আবার রেখে এলেন সেই বাথানে। তিনদিন পর এরফানকে ফিরে পেয়ে বাবা যেন প্রাণ ফিরে পেলেন। এরফানের কপালে হাত রেখেই বাবা বুঝে গেলেন অনেক কিছু। মুহুর্তে দেরি না কওে সেইদিনই চরদুয়ার ত্যাগ করেন বাবা। এরপর বাবা বহুবার চরদুয়ারে এসেছেন, কিন্তু আর কখনো এরফানকে এখানে আসতে দেননি বাবা।
সন্তান হারানোর ভয়ে ভীত বাবা তো জানেন না, যে ঐ ঘটনার পর থেকে পরী মা মাঝে মাঝেই এশার নামাজের পর এসে এরফানকে উড়িয়ে নিয়ে যেতো তার মেয়েদের কাছে, আবার ঘণ্টা দ’ুয়েকের ভিতরেই তাকে রেখে যেত বাড়ির ছাদে। মাঝে মাঝেই এরফান মৎসকন্যাদের পিঠে শওয়ার হয়ে ঘুরে বেড়াতো সাগরে। এতে করে মৎসকুমারী আর এরফানের মধ্যে তৈরি হয় চমৎকার বন্ধুত্ব। সাধারণত মাছদেরতো আর মানুষের মতো প্রবল অনুভুতি থাকেনা। কিন্তু ছোট্ট মৎসকুমারী জানবী ব্যতিক্রম ছিল। ওর অনুভুতি ছিল প্রবল। মিষ্টি পানিতে ওদের যাতায়াত নিষেধ হলেও জান্বী এরফানের জন্য ছুটে যেত মিষ্টি পানিতেও। এরফানকে দেখার জন্য ওর সঙ্গ পেতে জানবীর মতো ব্যকুল না হলেও ওর অন্য বোনেরাও ছুটে যায় যখন তখন। এরফান যখন সূরায় ইয়াছিন আবৃত্তি করে, ওরা তখন গভীর মনোযোগে শোনে। ঐ সময় বুঝতে না পারলেও এরফান এখন বোঝে যে, মৎসনারীরা পবিত্র কোরআনের প্রতিটি শব্দের অর্থ বুঝতে পারে, যা ও নিজে এখনো পারেনা। জানবী-ই প্রথম এরফানকে সূরা ইয়াছীনের ভাবার্থ ব্যাখ্যা করে শুনায়। এরপর থেকে এরফান যখন যে সূরাটি পড়েছে, তার অর্থটা আগে বুঝে নিয়েছে। খুব অবাক বিষয় হচ্ছে, এরফান শুধু জানবী আর পরী মা দু’জনের কথা বুঝতে পারে, অন্য মৎসকন্যাদের ভাষা সে বোঝে না।
এরফানকে পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে না পারলে জানবী স্বস্তি পেত না। মাঝে কিছু বছর এরফান বিদেশে পড়তে গেলে ঐ সময়টা খুব কষ্টে কেটেছে এরফানেরও। কারণ, ঐ সময়টায় সাগরে ঘুরে বেড়াতে পারেনি এরফান। গলা ছেড়ে গান করতে পারেনি। মৎসকন্যাদেরকে সুরা ইয়াছীন আর সূরা রাহমান শুনিয়ে হাততালি নিতে পারেনি। নিজের লেখা কবিতাগুলো জানবীকে শোনাতে পারেনি। এদিকে অনেকদিন পরী মা’দের কেউ আসেনা ওর কাছে। আসলে এটা ঘটেছে বাবার কারণে। পরী মা যে আসেন এটা বুঝি বাবা টের পেয়েছিলেন। আর তাইতো কি সব দোয়া পড়ে এরফানকে পড়াপানি খাইয়ে, মাথায় ফুঁক দিয়েছেন বিদেশে যাওয়ার আগ মুহুর্তে। সেই থেকে মা দু’জনের কেউই আর আসে না।
বিদেশে বসেই বাবার মৃত্যুর আগাম সংবাদ জানতে পেরেছে এরফান মৎসকন্যা জান্বীর সুবাদে। লন্ডনের টেমস নদীতে এসে এ খবর পৌঁছে দিয়ে যায় জান্বী। জান্বীই হচ্ছে সে, যে প্রথম এরফানকে পিঠে চাপিয়ে সাগরে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। জান্বীই ওকে শিক্ষা দেয় কিভাবে নামাজ সহী করে পড়তে হয়। কীভাবে পবিত্র কোরআন পড়লে আল্লাহ সাথে সাথে সাড়া দেন। এরফান বলেছিল, তুমি এতো জানো কিভাবে? আর জানোই যখন তাহলে তুমি কেন অভিশাপ মুক্ত হচ্ছোনা?
হেসে ওঠে জান্বী, দুর বোকা, আমিতো অভিশপ্ত নই। মা অভিশপ্ত ছিলেন। আমি জন্ম থেকেই মৎসকন্যা। আর আমাদের শিক্ষাগুরু সয়ং পানির বাদশা নিজে। যার আদেশে জ্বীনদের একটি দল আমাদের পবিত্র কোরআন শিক্ষা দেন। তুমি কি জানো পৃথিবীর যত পশুপাখি আর মাছ আছে, ওরা সবাই জন্ম থেকেই মুসলমান। এক আল্লাহর ইবাদত করে আসছে। শুধু জ্বীন আর মানুষেরা বিভিন্ন ধর্মে বিভক্ত হয়ে নিজেরা লড়াই করে।
এরফান এ সব জানে না। সে মাথা নাড়ে। ওর মন খুব খারাপ হয়ে যায়, বলে: তাহলে তুমি মানুষ বা পরী হতে পারবে না?
এবার খুব হেসে ওঠে জানবী : কেন, আমি মানুষ হলে তোমার কি লাভ হবে? তখন যে আমার এতো রুপ থাকবে না, আমি এতো সুন্দরও থাকবো না। হাজার বছর আয়ু থাকবে না। তাহলে মানুষ হয়ে কী করবো বলো। এখনতো আমি হাজার বছর আল্লাহর গুনকীর্তন করতে পারবো, তোমরা মানুষেরা যা পারো না।
এবার এরফান বলল : তাহলে আমিও তোমার মতো মাছ হবো। হাজার বছর আল্লাহকে ডাকবো আর তার গুণকীর্তন করবো, আর তোমার সাথে থাকবো।
কিশোর এরফানের এ কথা শুনে কিশোরী জান্বী খুব গম্ভীর হয়ে চলে যায় সেদিন। অনেকদিন আর দেখা হয়নি ওদের।
বিদেশে প্রায় পাঁচবছর অবস্থান করেছে এরফান। ফাইনাল পরীক্ষার ঠিক আগ মূহুর্তে বাবার মৃত্যুর আগাম সংবাদ জানাতে এলো জান্বী। এখন এরফান পরিপূর্ণ যুবক। আগের চেয়েও অনেক বেশি সুদর্শন আর ধার্মিক। এই বিদেশের মাটিতে এসেও কখনো নামাজ কাঁযা করেনি, রোজা রাখায় অনিহা দেখায়নি। মৎসকুমারীদেরও কিছু অলৌকিক গুন থাকে, ওরা মানুষের মুখ দেখে তার ভিতরটা পড়তে পারে, আর যখন তখন অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। এরফানকে দেখেই জান্বী যেন ওর ভিতরটা সব পড়ে নেয়। গভীর শ্রদ্ধায় মাথা নত করে জানবী।
পাঁচ বছর পর গভীর রাতে জান্বীকে দেখে এরফান খুব খুশী হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে, বলে : তুমি আগের চেয়ে আরো সুন্দর হয়েছো জান্বী।
এই বিদেশে শুধু মাত্র কলম্বাস নামের এক যুবকই এতোদিনে ওর কিছুটা ঘনিষ্ট হয়েছে। খ্রিস্টান এই যুবকের পরদাদা কলম্বাস আমেরিকা আবিস্কার করে বিশ্বখ্যাত হয়েছেন। এই যুবকের বিশ্বাস তার পরদাদা করম্বাস পবিত্র বাইবেল ও কোরআন নিয়মিত পড়তেন এবং ঐ গ্রন্থে উল্লেখিত বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো পরীক্ষা করতেন। আর সে কারণেই তিনি আমেরিকা আবিস্কার করতে পেরেছেন।
এরফান তখন জানতে চেয়েছিল, তোমার এ ধারণা কি করে হলো?
কলম্বাস তখন হেসে বলল, আমাদের বাড়িতে একটি পুরাতন লাইব্রেরী রয়েছে, যেখানে আমার পরদাদার অনেক স্মৃতি আজো সাঁজানো আছে। তারমধ্যে অনেকগুলো ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। হাতে লেখা কোরআনের কপিও আছে।
যুবক কলম্বাসের এ কথা শুনে এরফান ওকে আসল বাইবেল, যেটা হিব্রু ভাষায় লেখা এবং ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রয়েছে, সেটি পড়ার পরামর্শ দেয়। যুবক নিজেও হিব্রু ভাষা খুব ভালো জানে, আর তাই সে প্রতিজ্ঞা করে যে আগামি তিনমাসের মধ্যে আসল বাইবেলটি সংগ্রহ করে পড়ে ফেলবে ও এরফানকে তার ব্যাখ্যা শুনাবে। সেই থেকে যুবকের সাথে এরফানের একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যা গত চার বছরে অনেক ঘনিষ্ঠ হয়েছে, এবং মজার বিষয় হচ্ছে কলম্বাস এখন একজন নব মুসলিম। কারণ সে হিব্রু ভাষায় লেখা আসল বাইবেল পড়েছে ও সেটা মেনে চলতে যেয়ে তাকে মুসলমান হতে হয়েছে বলে কলম্বাসের দাবি। আর এটা যে ঘটবে, তা এরফানও জানতো।
এরফান খুব দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করে যে, হিন্দুরা তাদের ধর্মগ্রন্থ বেদ এবং খ্রিস্টানরা তাদের বাইবেল যদি গভীর মনোযোগে অর্থ বুঝে পড়েন, তাহলে তারা নিজে থেকেই মুসলমান ধর্মে ফিরে আসবে। কারণ, তাহলেই তারা বুঝতে পারবেন যে, তারা আসলে সবাই মুসলমান হয়েই পৃথিবীতে এসেছিলেন।
এই মুহুর্তে জানবীকে পেয়ে এরফান কলম্বাসের কথা একবারে ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু জান্বী হঠাৎ বলল, তোমার বন্ধু কলম্বাস তোমাকে অনুসরণ করে এদিকে আসছে। এই লন্ডনের নদী এলাকা আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। এরা আমাদের ধরার জন্য বিভিন্ন ফাঁদ পাতছে। শোনো এরফান তুমি মা’কে অভিশাপ মুক্ত করায় মায়েদের স্বামী দুই জ্বীন তোমার উপর ভীষণ খুশি। তারাও তোমাকে সাহায্য করতে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু কোনো কারণে তোমার কাছে তারা আসতে পারছেন না। জ্বীনেরা অনেক কিছু আগাম বলতে পারেন। তোমার বাবার মৃত্যু সংবাদ নিয়ে তারাই মায়েদের সাথে আলাপ করছিলেন, শুনে মা আমাকে বললেন তোমাকে জানাতে। ঐ জ্বীনদের একজন থেকে জানতে পারলাম, তোমরা মানুষেরা একবার সেজদা দিলে আল্লাহ যে খুশী হন, আমরা হাজার বছর সেজদা করলেও নাকি তিনি ততো খুশি হন না। আমার তাই তোমার মতো মানুষ হতে ইচ্ছে করে।
কথাটি বলেই জান্বী অদৃশ্য হয়ে গেল। মিনিট দু’য়েক পরেই কলম্বাস এসে পাশে বসল – কী বন্ধু, তোমার কি মন খারাপ? এখানে একা কী করছো?
তিন
images-04বিদেশের পাঠ চুকিয়ে এরফান দেশে ফিরে আসায় বাবা খুব রাগ করেছিলেন। এরফান বাবাকে বলতে পারেনি, ও কেন ফিরে এসেছে। বলেছে, তোমাদের জন্য মন খুব খারাপ হচ্ছিল বারবার, তাই চলে এলাম। বাবা হয়ত আসল বিষয়টা টের পেয়েছিলেন, তাই মৃদু হেসেছিলেন তিনি। এরফান ফিরে আসার তৃতীয়দিন মধ্যরাতে বাবা তাহাজ্জুতের নামাজ পড়ছিলেন। এমনসময় এরফানকে ডাকলেন। এরফান কাছে এলে বললেন – শোনো বাবা, আমি কিছুক্ষণের মধ্যে তোমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তুমি আমার একমাত্র ছেলে সন্তান। তোমার যদি কখনো নামাজ আর রোজা কাযা হয়, আমি খুব কষ্ট পাব। কখনো মিথ্যে বলবে না, তুমি মিথ্যে বলা মাত্র তোমার উপর থেকে আল্লাহর দয়া ও রহমত সরে যাবে। পরিবারের সকলের দায়িত্ব এখন তোমার। চরদুয়ারের বাথানটি আমাদের প্রধান আয়ের উৎস, ওটির যত্ন কর। আর সাগরের সাথে বন্ধুত্ব করবে খুব সতর্কের সাথে। শয়তানও ওখানেই বাস করে। এর কিছু পরই সেজদারত অবস্থায় বাবা চলে যান তার দেহ ছেড়ে।
মা, বোন, চাচা-চাচীদের এরফানই ডেকে আনেন। তিনটি মাস পার হয়েছে শোকার্ত পরিবারের সাথে। শোক কাটিয়ে এরফান প্রথমেই চরদুয়ারের বাথানে চলেছে। ছোটবেলা থেকেই নামাজী এরফান প্রচন্ড ধর্মভীরু। মিথ্যে বলা বা মিথ্যের সাথে চলা ওর কখনোই হয়নি। বাবা ওকে এভাবেই তৈরি করেছেন। যে কারণে বন্ধু মহলেও ওর উপাধী সত্যবাণ বলে। যদিও বন্ধু সংখ্যা খুবই কম এরফানের। কারণ পরিচিতজনের মধ্যে মিথ্যেবাদীর সংখ্যা বেশি হওয়ায়, স্কুল-কলেজে ওর বন্ধু কাউকে খুঁজে পায়নি ও । দু’জন মাত্র যুবককে কিছুটা পছন্দ করে এরফান, কারণ ওরা মিথ্যেটা বললেও খুব কম বলে। আর তাই হিন্দু ধর্মের অনুসারী ও মন্দিরের পুরোহীতের ছেলে সমীর ব্রাহ্মণ আর বৌদ্ধ ধর্মের প্রসাদ বড়–য়াকে ও বন্ধু মনে করে। এরা দু’জনেই মুলত পাড়ার বন্ধু। স্কুল কলেজের নয়। সমীরকে এখন আধা মুসলমান বলা যেতে পারে। কারণ, এরফানের পরামর্শে সমীর সংস্কৃত ভাষা রপ্ত করেছে। এখন সে সংস্কৃতে লেখা বেদ নিয়মিত পড়ছে এবং তা ব্যাখ্যা করে শুনাচ্ছে মন্দিরের ধর্মসভায়। ওর বাবাকে ও অন্যন্য হিন্দু পরিবারকে বুঝাতে পেরেছে যে, বেদে মূর্তিপূজা করতে নিষেধ করা হয়েছে। সকলের অনুমতি নিয়ে তাই ওদের মন্দিরের মূর্তিপূজা বন্ধ করে দিয়েছে সমীর। আর বড়–য়া বন্ধুটি অবশ্য একেবারে সাদামাঠা আর সরল। নিজের ভালোটাও সে ভালো বোঝেনা। কারো সাথে প্যাঁচে থাকেনা। পারিবারিক অবস্থা ভালো তাই কোনো ভোগান্তিও ওর নেই। এই বন্ধুটাকে মুসলমান হিসেবেই বেশি মানাতো। কারণ, একজন সত্যিকারের মুসলমানের মধ্যে যেসব গুণ থাকা দরকার, যেমন সত্যবাদী, ধৈর্যশীল, নির্লোভ ও পরপোকারী – এর সবটাই ওর মধ্যে রয়েছে। শুধু গৌতম বুদ্ধের মূর্তিটাই বাঁধা। চরদুযার থেকে ফিরে এই বন্ধুটাকে নিয়ে বসতে হবে ভাবলো এরফান।
এই দুই বন্ধুই এরফানের জন্য জান দিতে প্রস্তুত। বাবা মারা যাওয়ার পর এই তিনটি মাস ওরা ছায়া হয়ে এরফানকে সঙ্গ দিয়েছে। ওদের থেকে অনেক বিষয়ের জ্ঞান পেয়েছে এরফান। যেমন বাবা বলেছেন চরের বাথানটি ওদের প্রধান আয়ের উৎস? বিষয়টি এরফানের মাথায় প্রশ্ন তৈরি করেছিল, কারণ এরফান জানে ওদের প্রধান ব্যবসা আবাসিক ও খাবারের হোটেল। তাহলে চরের বাথানটির কথা বাবা কেন বলল?
উত্তরটি দিয়েছে প্রসাদ বড়–য়া। বাবাকে ও জ্যাঠামশাই বলে ডাকতো। বলল, একবার জ্যাঠামশাই ঐ বাথানের গল্প করেছিলেন। তখন তোমাদের পরপিতামহ ঐ বাথানটি দিয়েই প্রথম জীবীকা শুরু করেছেন। ওখানেই থাকতেন তিনি। একবার দুধ ক্রেতা চওে না যাওয়ায় তিনি নিজেই দুধ বিক্রি করতে শহরে আসেন। শহওে তখন দুধের চেয়ে দধি আর ছানার খুব চাহিদা ছিল। লোকজন এতো তার কাছে এতো দুধ দেখে পরামর্শ দেন যে – তুমি ছানা তৈরি কেন করছো না। মহিষের দুধের দই তো করতে পারো? তখন তোমাদের ঐ মিষ্টির দোকানটি তৈরি করেন তিনি। দুধের ছানা দিয়ে মিষ্টি আর মহিষের দুধের দই শুধু এ অঞ্চলে তোমরাই তৈরি করতে শুরু করো। ধীরে ধীরে তোমাদের ব্যবসা বাড়তে থাকে। লক্ষ কওে দেখ তোমাদের চারটি খাবার হোটেলের সবটিতেই মিষ্টি রয়েছেই। এমনকি ঐ যে আবাসিক হোটেলটি করেছো শহরে, সেখানেও নীচে এক কোনায় মিষ্টির দোকান করেছে তোমার বাবা। তোমাদের কারখানায় তৈরি মিষ্টি শুধু এই শহরে নয়, সারা দেশে প্রসিদ্ধ। এ মিষ্টি তৈরি হচ্ছে দুধ ও ছানা থেকে। আর দুধ আসছে তোমাদের ঐ বাথান থেকে।
চরদুয়ারের বাথান পাড়ায় এসে ট্রলারটি ভিড়তেই লাফিয়ে বালুচরে নামলো এরফান। ঘাটে আরো তিন’চারটে ইঞ্জিন চালিত নৌকা, (যাকে স্থানীয়রা ট্রলার বলে ডাকে) বাধা আছে। স্প্রীট বোটের মতো দেখতে একটি নৌকাও রয়েছে। তবে ইঞ্জিনটি নেই। খুলে নিয়ে গেছে হয়তো। বাথানের শ্রমিক মন্টু কাকা ওকে নেয়ার জন্য ঘাটে দাঁড়িয়ে আছেন। কাকাকে সালাম জানিয়ে কুশল বিনিময় করতে করতে বাথানের দিকে চলল এরফান। ওর পিছনে অনেক দূরে নদীতে একসাথে চারটি মানুষের মাথা তাকিয়ে ওর অদৃশ্য হওয়াটা দেখল, তারপর ওরা ডুব দিয়ে অদৃশ্য হল নদীর জলে। এরফান জানতেও পারলো না শয়তানের তোলা ঐ প্রচ- ঝড়টি থামাতেই মৎসকন্যারা ঝড়ের আগে আগে ছুটেছিল। মেয়েদেও বিপদ দেখতে পেয়ে ছুটে এসেছিল পরী মা দু’জন আর পরী মা’দেও রক্ষা করতে ছুটে এসেছিল তাদেও জ্বীন স্বামী দুজন। তারা যেয়ে আল্লাহর কাছে সেজদায় পড়েছিল পানির নীচে বাদশাহের সামনে থাকা স্বর্ণমসজিদটিতে। পানির বাদশাহ হযরত খিজির (আঃ)  সব দেখলেন। একদম শেষ মূহুর্তে প্রচন্ড ধমক দিলেন নদীর জলকে। সেই ধমকে শুধু নদী নয়, ভড়কে গেল সয়ং ইবলিশ শয়তান। আর এভাবেই এম ভি পর্বত লঞ্চের শত শত যাত্রীর সাথে বেঁচে গেল এরফান নিজেও। (চলবে)

বিঃদ্রঃ : ছবিগুলো গ্রিকপূরাণ তেকে সংগ্রহিত। গল্পটি সম্পর্কে আপনার মতামত খুবই উপকার আসবে। তাই দয়া করে মন্তব্য লিখুন।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!

About the author

ডিসেম্বর ৭১! কৃত্তনখোলার জলে সাঁতার কেটে বেড়ে ওঠা জীবন। ইছামতির তীরঘেষা ভালবাসা ছুঁয়ে যায় গঙ্গার আহ্বানে। সেই টানে কলকাতার বিরাটিতে তিনটি বছর। এদিকে পিতা প্রয়াত আলাউদ্দিন আহমেদ-এর উৎকণ্ঠা আর মা জিন্নাত আরা বেগম-এর চোখের জল, গঙ্গার সম্মোহনী কাটিয়ে তাই ফিরে আসা ঘরে। কিন্তু কৈশরী প্রেম আবার তাড়া করে, তের বছর বয়সে তের বার হারিয়ে যাওয়ার রেকর্ডে যেন বিদ্রোহী কবি নজরুলের অনুসরণ। জীবনানন্দ আর সুকান্তে প্রভাবিত যৌবন আটকে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় পদার্পন মাত্রই। এখানে আধুনিক হবার চেষ্টায় বড় তারাতারি বদলে যায় জীবন। প্রতিবাদে দেবী আর নিগার নামের দুটি কাব্য সংকলন প্রশ্ন তোলে বিবেকবানের মনে। তার কবিতায়, উচ্চারণ শুদ্ধতা আর কবিত্বের আধুনিকায়নের দাবী তুলে তুলে নেন দীক্ষার ভার প্রয়াত নরেণ বিশ্বাস স্যার। স্যারের পরামর্শে প্রথম আলাপ কবি আসাদ চৌধুরী, মুহাম্মদ নুরুল হুদা এবং তৎকালিন ভাষাতত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রাজীব হুমায়ুন ডেকে পাঠান তাকে। অভিনেতা রাজনীতিবিদ আসাদুজ্জামান নূর, সাংকৃতজন আলী যাকের আর সারা যাকের-এর উৎসাহ উদ্দিপনায় শুরু হয় নতুন পথ চলা। ঢাকা সুবচন, থিয়েটার ইউনিট হয়ে মাযহারুল হক পিন্টুর সাথে নাট্যাভিনয় ইউনিভার্সেল থিয়েটারে। শংকর শাওজাল হাত ধরে শিখান মঞ্চনাটবের রিপোটিংটা। তারই সূত্র ধরে তৈরি হয় দৈনিক ভোরের কাগজের প্রথম মঞ্চপাতা। একইসমেয় দর্শন চাষা সরদার ফজলুল করিম- হাত ধরে নিযে চলেন জীবনদত্তের পাঠশালায়। বলেন- মানুষ হও দাদু ভাই, প্রকৃত মানুষ। সরদার ফজলুল করিমের এ উক্তি ছুঁয়ে যায় হৃদয়। সত্যিকারের মানুষ হবার চেষ্টায় তাই জাতীয় দৈনিক রুপালী, বাংলার বাণী, জনকণ্ঠ, ইত্তেফাক, মুক্তকণ্ঠের প্রদায়ক হয়ে এবং অবশেষে ভোরেরকাগজের প্রতিনিধি নিযুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়ান ৬৫টি জেলায়। ছুটে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। ২০০২ সালে প্রথম চ্যানেল আই-্র সংবাদ বিভাগে স্থির হন বটে, তবে অস্থির চিত্ত এরপর ঘনবদল বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, আমাদের সময়, মানবজমিন ও দৈনিক যায়যায়দিন হয়ে এখন আবার বেকার। প্রথম আলো ও চ্যানেল আই আর অভিনেত্রী, নির্দেশক সারা যাকের এর প্রশ্রয়ে ও স্নেহ ছায়ায় আজও বিচরণ তার। একইসাথে চলছে সাহিত্য বাজার নামের পত্রিকা সম্পাদনার কাজ।