ক্রমাগত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া ‘মিছিলের সমান বয়সী’ সেই কবি ঃ মিনার মনসুর 

অতিথি লেখক

Sharing is caring!

ক্রমাগত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া
‘মিছিলের সমান বয়সী’
সেই কবি

মিনার মনসুর 

‘অন্যমনস্ক অনুপ্রাস’ নিয়ে বিশদ আলোচনায় আমি যাবো না। সেই প্রস্তুতিও আমার নেই। এক ধরনের তাড়াহুড়োর মধ্যে কবিতাগুলো আমাকে পড়তে হয়েছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে পড়তে পড়তে আমি বারবার ‘অন্যমনস্ক’ হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার অবাধ্য মন অস্থির হয়ে খুঁজে ফিরছিল সেই কামাল চৌধুরীকে– যার সঙ্গে আমার পথচলা প্রায় সাড়ে চার দশকের।

কবিতা আমরা প্রত্যেকেই নিজের মতো করে পাঠ করি এবং অনিবার্যভাবে নিজের পছন্দের বিষয়-অনুষঙ্গগুলো খুঁজি। কারো অনুসন্ধানী চোখ থাকে কবিতার বহিরঙ্গে–শব্দে, ছন্দে, উপমায়, চিত্রকল্পে এবং অনিবার্যভাবে বাকভঙ্গি ও কল্পনার অভিনবত্বে। আবার কেউ-বা আলো ফেলেন অন্তরঙ্গে। খোঁজেন কবির অন্তর্সত্তাকে–তার আদর্শ ও বিশ্বাসকে, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের দীর্ঘশ্বাসকে। আমি যখন থেকে কবিতা পড়তে শিখেছি, তখন থেকেই কবিতায় কবিকে খুঁজি। অনিবার্যভাবে ‘অন্যমনস্ক অনুপ্রাস’-এও আমি কবি কামাল চৌধুরীকেই খুঁজেছি। এবং অবশ্যই চারদশক আগের ‘মিছিলের সমান বয়সী’ সেই কবির সঙ্গে এই কবির মিল-অমিলগুলো শনাক্ত করার চেষ্টা করেছি আমার নিজের মতো করে।


সৌভাগ্যই বলতে হবে যে, কামাল চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার আগেই সেই কবিতাগুলো যখন নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছিল বিভিন্ন লিটলম্যাগ ও পত্র-পত্রিকায়, তখন থেকেই আমি তাঁর কবিতার একজন নিয়মিত পাঠক। মাঝখানে জীবন-জীবিকার তীব্র লোনা স্রোত সেখানে বিচ্ছেদ ঘটালেও সম্প্রতি কবির মুখ থেকেই তাঁর কবিতা-দর্শন এবং পছন্দের কবিতাগুলো শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে সম্প্রতি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত সিলেট বিভাগীয় বইমেলায় তাঁকে উদ্বোধক ও প্রধান অতিথি হিসেবে পেয়েছিলাম আমরা। সেখানে স্থানীয় প্রকাশনা সংস্থা ‘চৈতন্য’ ও সিলেট বিভাগীয় প্রশাসন আয়োজিত পৃথক দুটি অনুষ্ঠানে ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি কবিতা পাঠ করেছেন। একইসঙ্গে তুলে ধরেছেন তাঁর কবিতাভাবনা এবং ক্লান্তিহীনভাবে উত্তর দিয়েছেন দর্শকশ্রোতাদের বহু প্রশ্নের। পিনপতন স্তব্ধতার মধ্যে দর্শকশ্রোতারা তাঁর কবিতা ও বক্তব্য শুনেছেন মধ্যরাত অবধি।) সত্যি বলতে কী আমি অভিভূত হয়েছি ক্রমাগত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া ‘মিছিলের সমান বয়সী’ সেই কবির বিস্ময়কর উত্তরণ দেখে। সেটি কী কবিতায় কী তাঁর কাব্য-ভাবনায়।
আমাদের একটি আশঙ্কা ছিল এবং সেই আশঙ্কার জোরালো ভিত্তিও রয়েছে যে, কামাল চৌধুরী যেহেতু প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে ও গুরু দায়িত্বে ন্যস্ত ছিলেন এবং আছেন দীর্ঘকাল যাবৎ, সেহেতু অনিবার্যভাবে তাঁর কবিতা ও কাব্যভাবনা বড় ধরনের উপেক্ষার শিকার হয়েছে বা হতে বাধ্য। অনস্বীকার্য যে আমাদের জানাশোনা বেশিরভাগ লেখকের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। বিস্ময়করভাবে, এক্ষেত্রে কামাল চৌধুরী নিঃসন্দেহে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।


সত্তরের কবিদের (যাঁরা সত্তরের দশকের বিভিন্ন সময়ে কবিতা লিখতে শুরু করেছেন) গায়ে ঢালাওভাবে (এবং কিছুটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গেও বটে) একটি বারোয়ারি তকমা সেঁটে দেওয়ার একটি একচোখা ও জবরদস্তিমূলক প্রবণতা আমি লক্ষ করে আসছি গত কয়েক দশক ধরে। সেই তকমাটি হলো, সত্তরের কবিমাত্রই (প্রকাশ্যে) ‘প্রেম ও দ্রোহের কবি’; আর আড়ালে-আবডালে-আড্ডায় ‘স্লোগানসর্বস্ব কবি’! কী রুদ্র কী কামাল কী মিনার মনসুর– সবার ক্ষেত্রে সেই অভিন্ন তকমা। (বিশ্ববিদ্যালয়ের নোট মুখস্ত করা এক পণ্ডিত শিক্ষক-কবিকে আমি জানি যিনি জীবনে একটিও ভালো কবিতা লিখতে পারেননি, তিনিও সত্তরের সুপ্রতিষ্ঠিত এক কবি সম্পর্কে অবলীলায় বলছিলেন, ‘ওঁর কবিতায় তো সব ধুলোবালি’!)
অস্বীকার করবো না যে কাব্যযাত্রার শুরুতে কামাল চৌধুরীর মধ্যে প্রেম ও দ্রোহ প্রবলভাবে দৃশ্যমান ছিল। (সেই সময়ে ছিল না কার মধ্যে!) তবে এখন, এই ২০২০ সালের মধ্যলগ্নে, আমরা যে কামাল চৌধুরীকে নিয়ে আলোচনা করছি তাকে অত সহজে প্রেম ও দ্রোহের সেই খোপে ঢোকানো যাবে বলে মনে হয় না। ‘অন্যমনস্ক অনুপ্রাস’-এ ‘প্যারিস’ শিরোনামের একটি কবিতা আছে যেখানে কবি লিখেছেন, ‘এ শহর কখনো শেষ হয় না’, একইভাবে আমি বলতে চাই, কামাল চৌধুরীর কবিতাও শেষ হয় না। এই কবির অন্যতম একটি প্রিয় শব্দ হলো ‘অসমাপ্ত’। আমার বলতে ভালো লাগছে যে তাঁর অধিকাংশ কবিতাই উৎকৃষ্ট ছোটগল্পের মতো অসমাপ্তই থেকে যায়। তিনি কথা বলেন ইঙ্গিতে-ইশারায়-সংকেতে। আর সেই সংকেতও খুব সহজবোধ্য বলা যাবে না।


কামাল চৌধুরীর সমকালের উল্লেখযোগ্য কবিদের ভেতর থেকে যা এই কবিকে সহজে পৃথক করে দেয় তা হলো তাঁর পরিমিতিবোধ। তাঁর শব্দ, ছন্দ, উপমা, চিত্রকল্প ও বাকভঙ্গি সর্বত্রই তা দৃশ্যমান। সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, বিষয়ভিত্তিক কবিতা তিনিও লিখেছেন এবং তার মধ্যে উৎকৃষ্টমানের কবিতার সংখ্যাও একেবারে কম নয়। প্রসঙ্গত ‘অন্যমনস্ক অনুপ্রাস’-এর (প্রথম কবিতা) ‘বত্রিশ নম্বর সড়কের বাড়ি’ কবিতাটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি তুচ্ছ বিষয়কে শুধু নয়, বিষয়হীনতাকেও কবিতা করে তুলতে পারেন। মুগ্ধ হওয়ার মতোই তাঁর সংযম ও নিয়ন্ত্রণ।


এ প্রসঙ্গে যে-কথাটি না বললে নয় তা হলো, কামাল চৌধুরীর ছন্দজ্ঞান ও তাঁর কবিতায় ছন্দের ঈর্ষণীয় ব্যবহার। বিশেষ করে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে তিনি এতটাই সচ্ছন্দ যে মনে হতে পারে এটি তাঁর পোষা প্রিয় সারমেয় শাবক! (তিতলির ছবিটি ভেসে ওঠে মানসপটে। প্রিয় কবি সিকদার আমিনুল হকের ‘তিতলি’ নামে বরফশুভ্র ছোট্ট একটি তিব্বতি কুকুরশাবক ছিল। মৃত্যুর আগের রাতেও দেখেছি শাবকটি কবির বক্ষলগ্ন হয়ে আছে মহাসুখে!) শুধু ছন্দ নয়, কামাল চৌধুরী জানেন, কবিতা কী এবং কোনটি কবিতা নয়। প্রসঙ্গত বলি, সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র কামাল চৌধুরীকে সিলেটে যেভাবে বিভাগীয় প্রশাসনের পরিপক্ক আমলাদের দীর্ঘক্ষণ বাংলা কবিতার ছন্দ শিখাতে দেখেছি, কবুল করতে কুণ্ঠা নেই যে, বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত ভালো ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও আমি তা পারতাম বলে মনে হয় না।

পুনশ্চ: বন্ধুদের নিয়ে লেখার ইচ্ছে আমার প্রবল। কিন্তু জীবিকার যন্ত্রণা আমাকে জীবনব্যাপী এতটাই দৌড়ের মধ্যে রেখেছে যে আজকাল প্রায় মনে হয়, এভাবেই হয়ত আচমকা থেমে যাবে দৌড় । তাই যখন যা মনে আসে লিখে ফেলি। এটিও সে ধরনেরই তাড়াহুড়োর একটি লেখা। আশা করি, আমার বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে কামাল চৌধুরী আমার এ অযত্নটুকু মার্জনা করবেন।

ঢাকা: ৪ সেপ্টেম্বর ২০২০

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!