করোনায় সন্তানের মানসিকতাঃ প্রয়োজন বাবা মায়ের সচেতনতা

সদানন্দ সরকার

Sharing is caring!

করোনায় সন্তানের মানসিকতা ঠিক রাখতেঃ প্রয়োজন বাব মায়ের সচেতনতা

করোনা মহামারীর প্রভাব থেকে আপনার শিশুকে রক্ষা করতে হলে সবার আগে বাবা-মা এর সচেতনতা খুবই জরুরী। এসময় বাবা মাই সন্তানের প্রধান শিক্ষক। বাবা-মা যা করেন তার প্রভাবই সন্তানের উপর সবচেয়ে বেশি পরবে। তাই বাবা-মা – আপনি নিয়মিত বই পড়ুন, সন্তানের সাথে খেলা করুন।

একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাবে হয়তো।

আবীর। মাত্রই ষষ্ঠ শ্রেনীতে উঠেছে। গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে ঘরবন্দি সে। অনলাইন ক্লাস করতে হয় মাঝেমধ্যে। বাকী সময়টা তার কাটছে মোবাইল বা ল্যাপটপে গেইম খেলে ও কার্টুন দেখে। অবস্থা এমন হয়েছে যে তার খাওয়া গোসলও এখন মোবাইল দেখার শর্ত নির্ভর। গেম খেলতে না দিলে খাওয়া বন্ধ।  বন্ধ গোসল। করোনা শেষে স্কুল খোলার পরও মোবাইল আসক্তি থেকে সরানো যায়নি আবীরকে। একপা হাটাহাটিও করতে রাজী নয় সে। কারণ একটাই তার বাবা-মা দুজনেই চাকুরীজীবি। আবীরের সাথে তাদের সময় কাটে খুবই কম। 

শুধু আবীর একা নয়, এমন সংকটে ঢাকাসহ সারাদেশের অসংখ্য বাবা-মা। গেম আর ভিডিও দেখে অনেক শিশুই হারিয়েছে চোখের জ্যোতি।  পাওয়ারফুল চশমা এখন তাদের সাথী।

গত বছরের পুরো সময়টা শিশু-কিশোর ও তরুণেরা বাসায় বসে অনলাইনে ক্লাস করেছে। এখনো করছে। অনলাইন ক্লাসে তেমনভাবে মন বসাতে না পারলেও বাবা-মায়ের চাপে এই শিশুরা জুম ক্লাসে বসে কাটিয়েছে দিন। বাকি সময় টিভি বা বাবার ল্যাপটপে অথবা মোবাইল ফোনে হয় বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাটিং, নয়তো গেম অথবা ভিডিও দেখে সময় কাটায়। বইপড়া বলতে ক্লাসের বই উলটেপালটে দেখে শুধু। প্রথম শ্রেনী থেকে একাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের প্রায় সবাই একধরনের মানসিক চাপে রয়েছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। শহরের জীবনে এই চাপ খুব বেশি প্রভাব ফেললেও গ্রামের শিশুটি কিন্তু ছুটোছুটি করে দিন কাটাতে পেরেছে। করোনা গ্রামের জীবনে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি বটে। তবে স্কুল বন্ধ থাকার প্রভাবমুক্ত নয় শিশুটি।

ঢাকার রামপুরার বাসিন্দা সূচী রহমান জানান, স্কুল বাধ্যতামূলক বন্ধ হয়ে গেলে সাড়ে ১০ বছরের ছেলেকে নিয়ে বাসায়ই অবস্থান করেন। ছেলেকে নিয়ে আগে স্কুলে গেলে সেখানে সে দৌড়াদৌড়ি করত, হেঁটে বেড়াত, খেলত। কিন্তু ঘরবন্দি হওয়ার পর থেকে ছেলেটির জীবনযাপন পুরো বদলে যায়। আগে মায়ের সঙ্গে ভোরে ঘুম থেকে উঠত। এখন ঘুমায় দেরি করে। অনেক বেলা করে ওঠে। ওঠার পর কান্নাকাটি করে। খেতে চায় না। গল্পও শুনতে চায় না। প্রথম দিকে টেলিভিশন ছেড়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করে কিছুটা সফল হলেও পরে মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে পড়ে। কিছুতেই ফোন তার হাত থেকে নেওয়া যায় না। এমনকি কোনো কোনো সময় টিভি রিমোটও তার দখলে রাখে। সারাক্ষণ বিরক্ত করে। খেলাধুলাও আর আগের মতো করতে চায় না। মাঝে মধ্যে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কাউকে দেখলে সে ছুটে এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। বাইরে খেলতে বা ঘুরে বেড়াতে চায়না আর। জোড় করে বাইরে নিয়ে গেলে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। এমন অভিযোগ আরো অনেক বাবা মায়ের। করোনা মহামারীর প্রভাবে লণ্ডভণ্ড তাদের শান্তির জীবন।

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস এক আতঙ্কের নাম। তবে পৃথিবীব অন্যান্য দেশ ও অঞ্চল থেকে আমাদের দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার কম হলেও এ ভাইরাসের ভয়াল থাবা থেকে আমরা এখনো পুরোপুরি কেউ ঝুঁকিমুক্ত নই। এমনকি শিশুরাও। তাই পরিবারকে বিশেষ করে শিশুদের অধিকতর নিরাপদে রাখতে ঘরবন্দি রাখতে হচ্ছে গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত। আর এতে ব্যাহত হয়ে পড়ছে শিশুর স্বাভাবিক জীবনযাপন; বেড়ে ওঠাও।

শহুরে জীবনের প্রতিটি ঘরে শিশুসন্তান নিয়ে সবার সমস্যা প্রায় একই। গ্রামাঞ্চলের শিশুরা বাড়ির আঙিনায় খেলাধুলার সুযোগ পেলেও শহুরে শিশুদের এই করোনাকালে স্কুলে বা বাইরে যাওয়ার তাড়না না থাকায় বদলে গেছে জীবনযাপনের ধরন। দিন-রাত মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ কিংবা টেলিভিশন দেখে বেশি রাতে ঘুমানো এবং বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা; সর্বোপরি ঢিমেতালে জীবনযাপন, অলসতা মানবজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব খুবই মারাত্মক। ঘুম থেকে ওঠার পর হাতে বই ধরিয়ে দেওয়া, জোর করে খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা, বকাঝকা অথবা কঠোর শাসনে রাখা; সর্বোপরি দীর্ঘদিন বন্ধু বা সঙ্গহীন থাকায় শিশুমনে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। অথচ শিশুর বড় হওয়ার জন্য সুস্থ পারিপার্শ্বিক পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ।

স্বভাবতই শিশুরা যে কোনো ধরনের মানসিক চাপে পড়লে তার প্রতিক্রিয়া দেখায় ভিন্নভাবে। তারা বাবা-মাকে আঁকড়ে ধরে, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, নিজেকে গুঁটিয়ে রাখে, রাগ করে, এমনকি অস্থিরও হয়ে ওঠে। শিশুর মানসিক চাপজনিত এ প্রতিক্রিয়াগুলোর প্রতি পরিবারের অন্যদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। পাশাপাশি শিশুর প্রতিটি কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে, আন্তরিকতার সঙ্গে শুনতে হবে। একটু বেশি ভালোবাসা দিয়ে রাখতে হবে এ সময়। বিরূপ পরিস্থিতিতে শিশুরা বড়োদের ভালোবাসা ও মনোযোগ একটু বেশিই প্রত্যাশা করে। এ সময় শিশুদের যতটা সম্ভব চাপমুক্ত রাখতে হবে এবং খেলাধুলার সুযোগ দিতে হবে। ব্যায়ামের অভ্যাস করাতে পারলে খুবই ভালো হয় । তাদের আচার-আচরণের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মোটকথা, শিশুর আবেগ, অনুভূতি এবং তাদের যে কোনো সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখাতে হবে।

শিশুদের দীর্ঘদিন ধরে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা নেই। বিদ্যালয়ে পড়া দিতে হয় না, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা নেই, খেলাধুলা, ঘোরাঘুরির আনন্দ থেকে বঞ্চিত তারা। অর্থাৎ জীবনের হঠাৎ এই ছন্দপতন তাদের মনে ও শরীরে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এ অবস্থায় প্রয়োজন তাদের জন্য আনন্দময় পরিবেশ। কারণ মনোবিকাশের গুরুত্বপূর্ণ সময় শৈশব ও কৈশোর। এ সময় সবকিছু নতুনভাবে, নতুন আলোকে তাদের কাছে হাজির হয়। তাই প্রত্যেক শিশুর কাছে এ সময়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বেশিরভাগ শিশু যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। হাঁপিয়ে উঠেছে ঘরবন্দি থেকে। এ থেকে উত্তরণের পথ আঁকতে হবে বাবা-মাকেই। মনোবিদ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামালের মতে, ‘শিশুদের সঙ্গে যত বেশি সুন্দর সময় কাটানো যাবে, তাদের উদ্বেগ তত বেশি কমবে। পাশাপাশি তাদের জন্য বাসায়ই খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের হাতে তুলে দিতে হবে শিশুতোষ সাহিত্যের বই।

শিশুসাহিত্যিক এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত মাসিক শিশুর নির্বাহী সম্পাদক ফারুক নওয়াজ বলেন, ‘এই করোনাকালে শিশুকে হাসিখুশি ও আনন্দময় কাজের মধ্যে রাখা ছাড়া উপায় নেই। প্রথমত, শিশুর মন দিনভর চার দেয়ালের মধ্যে থাকতে চায় না। দ্বিতীয়ত, খেলাধুলায় কিছুটা সময় কাটাতে চায় তারা। চায় সঙ্গী। এ দুটি বিষয় বিবেচনায় এনে শিশুকে সম্ভব হলে ছাদে অথবা মুক্ত জায়গায় সকাল-বিকাল নিয়ে গিয়ে ঘোরা এবং তার খেলায় অংশী হতে হবে। শিশুর পড়াশোনা হতে হবে আনন্দের মধ্য দিয়ে। রঙিন ছবিওয়ালা ছড়া-গল্পের বই ওদের মন আকর্ষণ করে। যারা বর্ণ শেখেনি, পড়ে শোনাতে হবে তাদের। এতে তার ভালো সময় কাটবে, মেধারও বিকাশ ঘটবে। অবশ্য এ সময় শিশুর ব্যায়ামের প্রয়োজন। বড়রা খেলার ছলে শিশুদের ব্যায়াম শিখানো হবে খুবই উত্তম।

আর জনপ্রিয় উপন্যাস এবং অভিনয় ও জলপ্রেমিকের গল্প এর লেখক আরিফ আহমেদ বলেন, অনেকদিন পড়াশুনা থেকে দূরে থাকার কারণে শিশু- কিশোরদের মাঝে পড়াশুনার প্রতি অনিহা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। এটা বাবা মা কেই আগে দূর করতে হবে। তাদের স্যাটেলাইট নির্ভরতা, ভারতীয় টিভি চ্যানেল এর ধারাবাহিক নাটক দেখার মানসিকতা দূর করে বই তুলে নিতে হবে হাতে। এটা যদি বাবা-মা নিয়মিত করেন, বাবা-মাকে দেখে সন্তানও তা করবে। আপনি মোবাইল বা টিভিতে ব্যস্ত থাকলে সন্তানকে কি করে নিষেধ করবেন বলুন। মনে রাখবেন,  সন্তানের প্রথম ও প্রধান শিক্ষক আপনি। বাবা-মা এর অনুসরণ ও অনুকরণ সন্তান সবার আগে করবে।

আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের একদল মনোবিদের মতে, শিশুদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে খেলাধুলা অত্যন্ত কার্যকরী। এ ক্ষেত্রে ইনডোর গেম (লুডু, দাবা, ক্যারম, ভারসাম্য দৌড়, বল নিক্ষেপ ইত্যাদি), জ্ঞানানুশীলনমূলক খেলা (শব্দজট, কোনো বিষয় নির্ধারণ করে বলা, কুইজ, রাইমিং শব্দ তৈরি, যোগ-বিয়োগের খেলা ইত্যাদি)। ৩ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের নিয়ে এসো নিজে করি এর আওতায় খেলার ছলে নানা শিক্ষণীয় বিষয় শেখানো। এ ক্ষেত্রে শিক্ষামূলক অনলাইনভিত্তিক টিউটরিয়াল থেকে পেতে পারেন বয়স উপযোগী ইনোভেটিভ আইডিয়া।

 

এই মহামারী বা অতিমারি প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে বিশ্বের ১৬ কোটি শিশু স্কুলজীবন শুরু করতে পারেনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খেলাধুলার মাঠ, পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র, পারিবারিক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে ছেলেমেয়েরা মানসিক চাপের ঝুঁকিতে পড়েছে। তরুণ শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া, শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহের মতো ঘটনা দেখা দিচ্ছে সারা বিশ্বে; বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশসমূহে বেড়েছে বাল্যবিবাহ। পত্রিকার পাতায় যার প্রমাণ অহরহ।

করোনাকালে জার্মানির এক গবেষণায় মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুদের ৬০ ভাগ মানসিক চাপ, একাকিত্ব ও চরম বিরক্তিতে ভুগছে বলে তথ্য উঠে আসে। তারা বলেছে বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে না পারা, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে না থাকা, পছন্দের খেলাধুলা ও শখের কোনো কাজে অংশ নিতে না পারা, পারিবারিক কলহে জড়িয়ে পড়া, মা-বাবার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে দ্বন্দ্ব, ঘরের বাইরে বের হতে না পারা, প্রাত্যহিক রুটিন অনুসরণ ও স্কুলের হোমওয়ার্ক না করা, করোনা আক্রান্তের ভয়, স্ক্রিন টাইম বাড়াতে বকাবকির স্বীকার হওয়া ইত্যাদি কারণে সব সময় শিশুরা মানসিক চাপে থাকছে। আর অপেক্ষাকৃত তরুণ ছেলেমেয়েদের মধ্যে রুক্ষ ব্যবহার, নিদ্রাহীনতা, মানসিক চাপ, হতাশা, দুঃখবোধ, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতা, করোনা আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের থেকে পৃথক থাকার কষ্ট বা মানসিক দুঃখবোধ ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়। উঠতি বয়সি তরুণদের মধ্যে মূলত হতাশা, সহজে নার্ভাস হয়ে পড়া, স্মৃতিকাতরতা লক্ষ করা যায়। আগে থেকে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ছেলেমেয়েদের মধ্যে করোনাকালে বিভিন্ন কারণে পারিবারিক অবহেলার জন্য হতাশা, দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ আরো ঝেঁকে বসে। কোভিড-১৯ সন্দেহে কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনে থাকা ছেলেমেয়েদের মধ্যে দুশ্চিন্তা, অহেতুক ভীতি, সামাজিক কুসংস্কার ও হতাশা প্রভৃতি মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের এক জরিপে তরুণদের অর্ধেক করোনাকালে শারীরিক নির্যাতন এবং আটজনে একজন মানসিক অত্যাচারের স্বীকার হয়েছে। বাংলাদেশে এক গবেষণায় প্রায় ৩০ শতাংশ ছেলেমেয়ে হতাশা, দুশ্চিন্তা কিংবা মানসিক চাপে ভোগার তথ্য পাওয়া গেছে।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!