কবি দিলওয়ার গণমানুষের কবি – সাঈদ চৌধুরী, লন্ডন থেকে

অতিথি লেখক

Sharing is caring!

কবি দিলওয়ার স্মরণেঃ গণমানুষের কবি
সাঈদ চৌধুরী, লন্ডন থেকে

বাংলা সাহিত্যের এক প্রবাদ পুরুষ কবি দিলওয়ার। তার মন ছিল গভীর ঐশ্বর্যময়। স্বভাব ছিল বহতা নদীর মতো, সতত বহমান। আর মানুষ হিসেবে এবং কবি হিসেবে ছিলেন অনেক বড় মাপের অনন্য একজন। তিনি গণমানুষের কবি। মুক্তিকামী মানুষের কবি। তার নিজের ভাষায়-
‘পৃথিবী স্বদেশ যার, আমি তার সঙ্গী চিরদিন’।
কাব্যের সুদূর প্রসারী আবেদন সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন বলেই কবি বলতে পেরেছেন-
‘এবার এলো শক্তিহীনের
শক্তি লাভের দিন
নবীন ভুবন সৃষ্টি হবে
ঐক্যে অমলিন।‘
২০০১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা টাউন হলে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সংঘ কর্তৃক কবি দিলওয়ারকে প্রদত্ব সংবর্ধনার মানপত্রে উল্লেখ করা হয়-
‘সাথী আজ তোমাকে সংবর্ধিত করার সুযোগ পেয়ে আমরা আনন্দিত। তোমাকে সম্মান জানানোর নাম মানুষকে ভালোবাসা।
… তুমি কোনো একটি দেশের নও। কোনো দেশের কোন সীমানা তোমাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। তোমার আশ্চর্যজনক সুস্থমন, প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও দৃঢ় আত্মসম্মানবোধ তোমাকে এক কর্মযোগী করে তুলেছে।’

কবি দিলওয়ার সাম্য, মানবতা ও শোষিত মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছিলেন। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। তিনি আমাদের অনেক স্মরণীয় রচনা উপহার দিয়েছেন। তার কবিতার বহু পংক্তি সাধারণ মানুষেরও মুখস্থ। সমাজ পরিবর্তনে সংগ্রামীদের উদ্দীপ্ত করে তার এসব ছড়া ও কবিতা। জাতীয় মুক্তির সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি বলেন-
‘চাই বিপ্লব, চাই বিপ্লব, চাই
বিপ্লব ছাড়া মুক্তির উপায় নাই
পুরাতন করে কর্তন
আনো নব পরিবর্তন
নরদানবের বংশ
করবো সমুলে ধ্বংস
বুঝে নাও আজ এই ধরণীর
প্রাপ্য যে যার অংশ
রুখিয়া দাঁড়াও ভাইরে
জীবনের গান গাইরে
প্রাণ ধারণের প্রাপ্য রাসদ
চাইরে মোদের চাই
বিপ্লব ছাড়া জীবন জাগার কোনো উপায় নাই
দাও তবে প্রতিঘাত
হাতেতে মিলাও হাত
দাও হুঙ্কার, টুটাবোই মোরা
দুঃস্বপ্নের রাত।’

সিলেট শহরতলীতে ঠিকানা থাকলেও কবি দিলওয়ার আলোচিত ও সমাদৃত ছিলেন রাজধানী ঢাকা ও কলকাতার শীর্ষ কবিদের মধ্যে।
১৯৮০ সালে কবি দিলওয়ার কাব্যচর্চায় বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা একাডেমী ফেলোশীপ লাভ করেন ১৯৮১ সালে। ২০০৮ সালে সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে একুশে পদক প্রদান করা হয়। তিনি একাধারে কবি, ছড়াকার, সাংবাদিক, নাট্যকার ও গীতিকার ছিলেন।
বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামে তার কবিতা প্রেরণা সঞ্চার করেছে। দিলওয়ার গণমানুষকে হদয়ে কতটা জায়গা দিয়েছিলেন তার প্রমাণ মেলে তাঁর বিভিন্ন কবিতায়।

‘আয়রে চাষী মজুর কুলি মেথর কুমার কামার
বাংলা ভাষা ডাক দিয়েছে বাংলা তোমার-আমার।’
অথবা
‘বহু লাঞ্ছনা, বহু অপমান সহিয়াছে যারা মুখ করি ম্লান
জয় হবে সেই নিপীড়িতদের
জালিমেরা শির নোয়াবে
এইবারে রাত পোহাবে।‘

১৯৭৭ সালের ৭ মার্চ সিলেটে কবি দিলওয়ারকে দেয়া নাগরিক সংবর্ধনার মানপত্রে ‘গণমানুষের কবি’ অভিধায় অভিষিক্ত করা হয় তাঁকে। এরপর তিনি আজীবন বরণীয় হয়েছেন এই গণমানুষের কবি নামেই।
সিলেটে বৃটিশ ঐতিহ্যের নিদর্শন কীনব্রীজ নিয়ে কবি লেখেন – ‘কীনব্রীজে সূর্যোদয়’।
‘এখন প্রশান্ত ভোর। ঝিরঝিরে শীতল বাতাস
রাত্রির ঘুমের ক্লান্তি মন থেকে ঝেড়ে মুছে নিয়ে
আমাকে সজীব করে। উর্ধ্বে ব্যাপ্ত সুনীল আকাশ
পাঠায় দূরের ডাক নীড়াশ্রয়ী পাখীকে দুলিয়ে।
নীচে জল কলকল বেগবতী নদী সুরমার,
কান পেতে শুনি সেই অপরূপ তটিনীর ভাষা
গতিবন্ত প্রাণ যার জীবনের সেই শ্রেয় আশা
সৃষ্টির পলিতে সেই বীজ বোনে অক্ষয় প্রজ্ঞার।…
পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ পায়ে হাঁটার সেতু। বড় বড় লোহার কাঠামোয় অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। ১৯৩৩ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়। চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় ১৯৩৬ সালে। তৎকালীন আসাম প্রদেশের গভর্নর মাইকেল কীনের নামে এই সেতুর নামকরণ হয় কীনব্রীজ। ১১৫০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৮ ফুট প্রস্থ ব্রীজ দিয়ে হাঁটার সময় বড় মনোরম দেখায়। নদীর কাব্যময় ঢেউ বয়ে চলে অবিরাম। বুকের মধ্যে ছল ছল করে ঢেউ ছলকায়। কখন পৌঁছে যাই কবি মন্জিল। ভার্থখলা, খান মন্জিল।
কবিপুত্র কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার, শাহীন ইবনে দিলওয়ার, কামরান ইবনে দিলওয়ার সহ তাদের ভাই-ভাতিজা সহ অনেকে লেখেন। মান সম্পন্ন লেখা। তবে আমার কাছে মূলত তিনিই প্রধান আকর্ষণ। মনের গভীরে থাকে সুরমা পারের কবি, আমাদের প্রিয় দিলু মামা।

সমকালীন বাংলা সাহিত্যের জননন্দিত লেখক কবি দিলওয়ার আমাদের সাহিত্যে দৃঢ়তা ও শক্তিময়তার অভাব অবলীলায় পূরণ করেছেন। তার কবিতা স্বাধীনতা, মানবতা এবং সুবিচার প্রত্যাশায় তীক্ষ্ণ, তীর্য ও উজ্জ্বল। তার কল্পনায় ধর্মীয় উদারতা ও সাম্যবাদ আবার কখনো নৈরাজ্য স্পর্শ করেছে। তবে ভালোবাসা সর্বত্র প্রাধান্য পেয়েছে।
‘সে’ কবিতায় কবি দিলওয়ার বলেন-
‘ভারি মজার মজার কতো কথাই-না সে বলতো
সে বলতো হাত দুটি নেড়ে নেড়ে, সহাস্যে, সোল্লাসে
ছাই চাপা আগুনের মত সেই ক্ষণে সে জ্বলতো
আমি বুঝতাম বৈকি। আমি বুঝতাম অনায়াসে।

… তার সেই ক‘টি কথা এই মনে এখনো সরব
হিটলারের মুন্ডু হাতে আমি যেন মার্শাল জুকভ।’

কবির মুখে কত শত পংক্তিমালা শুনেছি, আজো কানে বাজে। সমাজ বিকাশের চেতনাকে কেন্দ্র করে সৃজিত অবিস্মরণীয় পংক্তিমালা। যে কবিতা সূর্যের মতো সর্বত্রই রশ্মি ছড়ায়।
‘যতোদিন বেঁচে আছো ততোদিন মুক্ত হয়ে বাঁচো
আকাশ-মাটির কন্ঠে শুনি যেনো তুমি বেঁচে আছো।’ অথবা
‘মৃত্যুর মিছিলে তুমি জীবনের দীপ্ত তরবারী
একথা নতুন করে তোমাকে জানাতে হবে নাকি?
এ-কথারি ঢেউ নিয়ে কখন ছেড়েছে নীড় পাখী
উন্মুক্ত আকাশ তলে তোমারি বন্দনা শুনি, নারী…সে কথা ভুলোনা তুমি। ভুলো না পাথর চাপা ঘাসে
তোমারি সৌহার্দে, নারী, ঈশ্বর শিশুর মতো হাসে।
‘তুমি রহমতের নদীয়া, দোয়া করো মোরে হযরত শাহজালাল আউলিয়া’
এসব গান ও কবিতা সিলেটের জনমনে এখনো ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। সিলেট বেতার কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়েছিলো কবি দিলওয়ারের এই গানটি দিয়ে। প্রায় পাঁচ দশক ধরে সিলেটের অসংখ্য শিল্পী তার লেখা গান গেয়ে আসছেন। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে তার লেখনী নিসৃত হয়েছে। কবিতায় শ্রেণী বিভক্তির বিরুদ্ধে কবির দৃপ্ত উচ্চরণ-
‘শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন যদি অপরাধ হয়
আমরা কি আজো দিতে পারলাম
মানুষের পরিচয়?
ডুবে আছি আজো খন্ডে খন্ডে সাম্প্রদায়িক পাঁকে
দম্ভদূষিত নাগপাশে বেঁধে
মানুষের বিধাতাকে।

নিপীড়িত জনতার সাহসের বাতিঘর গণ মানুষের কবি দিলওয়ার এর সত্যিকারের সহযাত্রী ও সহধর্মিণী আনিসা দিলওয়ার আছেন তার সৃষ্টিশীলতার বড় একটা অংশ জুড়ে। তাকে ঘীরে কবি লেখেন –
‘প্রিয়তমা এসো তুমি যৌথকণ্ঠে শেষ বার বলি
আমরা বহন করি অলৌকিক মানবতা বোধ
তাকে রোজ স্নাত করে অতলের জলীয় আমোদ
তার স্বাদ পেতে চায় আদিম প্রাণের কথাকলি
উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখি রোদ হাতে নাজিম হিকমত
ম্যাক্সিম গোর্কির রাত আজো কিনা হয়নি নিঃশেষ
জননীর কণ্ঠে শুনি বাঁধভাঙ্গা কঠোর আদেশ
ধ্বংসকে দেখিয়ে দাও সৃজনের ধ্র“পদী হিম্মত
প্রিয়তমা, মনে রেখো পৃথিবীর সূর্যপ্রদক্ষিণ
অগত্যা বিশ্রাম নেই আকাঙ্খিত আলোর সফরে
অনাগত সন্তানেরা রক্তস্রোতে বিচরণ করে
পশু মানুষের হাতে নয় তারা কখনো অধীন
প্রিয়তমা তুমি নও, গোটা বিশ্ব আজ প্রিয়তমা
তার জন্য অনিবার্য বৈপ্লবিক প্রেম-পরিক্রমা।’
ষাটের দশকে দক্ষিণ স্বাধীনতাকামী নেলসন মানদেলা যখন জেলে বন্দি, তখন দিলওয়ার তাকে নিয়ে লিখেন-
‘নেলসন মানদেলা: একটি আগ্নেয় স্মরণ।’ কবি বিশ্বমানবতার পক্ষে কলম ধরেন ‘আনিসা শুনতে পাও, ‘উহুরু’ ‘উহুরু’ সেই ডাক?
অগ্নিগোলকের মতো কৃতঘ্ন আঁধার ভেদ করে
সে-ডাক ছুটন্ত দ্যাখো। রৌদ্র নৃত্য কালের অধরে!
কৃষ্ণ সাগরের স্রোতে শ্বেতদৈত্য আতংকে নির্বাক
এবং শুনতে পাও খাচাভাঙ্গা সিংহের গর্জন?…

কবি দিলওয়ারের প্রথম কবিতা ‘সাইফুল্লাহ হে নজরুল’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে সাপ্তাহিক যুগভেরীতে। ১৯৫৩ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জিজ্ঞাসা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৪ সালে বের হয় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ঐকতান’। এরপর কবি একে একে লিখেন পুবাল হাওয়া (গানের বই, ১৯৬৫), উদ্ভিন্ন উল্লাস (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৬৯), বাংলা তোমার আমার (গানের বই, ১৯৭২), ফেসিং দি মিউজিক (ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ, ১৯৭৫), স্বনিষ্ঠ সনেট (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৭৭), রক্তে আমর অনাদি অস্থি (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৮১), বাংলাদেশ জন্ম না নিলে (গ্রবন্ধগ্রন্থ, ১৯৮৫), নির্বাচিত কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৮৭), দিলওয়ারের শত ছড়া (ছড়ার বই, ১৯৮৯), দিলওয়ারের একুশের কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৯৩), দিলওয়ারের স্বাধীনতার কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৯৩), ছাড়ায় অ আ ক খ (ছড়ার বই, ১৯৯৪), দিলওয়ারের রচনাসমগ্র ১ম খণ্ড (১৯৯৯), দিলওয়ার-এর রচনা সমগ্র ২য় খণ্ড (২০০০), ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর ডাকে (ভ্রমণ, ২০০১), দুই মেরু, দুই ডানা (কাব্যগ্রন্থ ২০০৯) ৷
সাহসী শব্দ সৈনিক কবি দিলওয়ারের ‘চলমান শব্দাবলী’র মতো কলামগুলো দেশে-বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। তার গল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘সাদা কালো বিড়াল’ এবং ‘ইলিশ মাছের কাঁটা’। মঞ্চ নাটক হচ্ছে ‘আসল মুক্তিযুদ্ধ এবং রুধিরাক্ত কাল’।
ইংরেজি রচনা ও অনুবাদেও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন কবি দিলওয়ার। অনুবাদ করেছেন মার্কিন কবি নরমান, কোরীয় লেখক মোগউ, জার্মান কবি কাল ক্রালাউ, রুশ কবি আইওন, ইতালিয়ান কথা সাহিত্যিক মোরাকিয়ান সহ বিখ্যাত লেখকদের বই।

কবি দিলওয়ার ১ জানুয়ারি ১৯৩৭ সালে সিলেট শহরের দক্ষিণ সুরমার ভার্থখলাস্থ পৈতৃক নিবাস খান মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৌলভী হাসান খান এবং মাতা মোছাম্মৎ রহিমুন্নেসা। পুরো নাম দিলওয়ার খান। যদিও তিনি পারিবারিক ‘খান’ পদবি কখনো ব্যবহার করেননি। রক্ষণশীল পারিবারিক ঐতিহ্য ভেঙে কবি দিলওয়ার সাধারণ মানুষের সাথে মিশে গিয়েছিলেন। সকল চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্বে কবি দিলওয়ারের চেতনায় ছিল শুধুই দেশপ্রেম। মানুষকে ভালোবেসে তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন।
‘আমার মৃত্যুর পর’ শীর্ষক লেখা কবিতায় কবি দিলওয়ার বলেছেন
‘আমার মৃত্যুর পরে যদি তুমি
কখনো খুঁজতে যাও এই মর্মভূমি
মনে রেখো তবে
বাংলার হৃদয় নিয়ে কেটেছে
আমার দিন
প্রতীচ্যের মুক্তির গৌরবে।’
২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর বার্ধক্যজনিত কারণে ইহকাল ত্যাগ করেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই প্রধান কবি। যার ভালবাসা ছিল কর্মচঞ্চল মানুষের সাথে।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!