বিশৃঙ্খল শেবাচিমে ১০টি লিফটের ৯ টি অকেজো: যোগ্য পরিচালক নিয়োগের দাবী সুশীল সমাজের
, বিশেষ প্রতিবেদক
বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (শেবাচিম) এর পুরাতন ও নতুন মেডিসিন ভবনসহ মোট ১০ টি লিফটের ৯টিই এই মুহূর্তে অকেজো হয়ে আছে। একটি মেরামতের কাজ চলমান রয়েছে। তবে তা কবে চালু হবে ঠিক নেই বলে জানান মেরামতকারী। এদিকে গত কয়েকদিনের ঘটনা ও সেবার মান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে এই হাসপাতালের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পরিচালনায় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন বরিশালের সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ।
সরেজমিনে ১১ জুলাই বৃহস্পতিবার সকালে বরিশালের ঐতিহ্যবাহী এই হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড পার হয়ে ১১১ নং কক্ষসহ অর্থোপেডিক্স বিভাগের সামনে অসংখ্য রোগীর ভিড়। এখানে কোনো বসার ব্যবস্থা না থাকায় হাটু, কোমড় ব্যাথা, হাত-পা ভাঙা নিয়ে আসা রোগীদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ডাক্তারের ডাকের অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ডাক্তার সহকারী সাইফুল জানালেন সকাল ৭ টা থেকে এই লাইন শুরু হয়। ডাক্তার আসেন নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার মধ্যে। দুপুর বারোটা পর্যন্ত প্রায় শ’দুয়েক রোগীকে ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয়েছে। বেলা দুটো পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৩০০ রোগীর চিকিৎসা হয় এখানের এই একটি কক্ষে। পাশেই আরেকটি কক্ষে অর্থোপেডিক্স ডাক্তার বসেন। সেখানেও একইচিত্র। এখানে পাশেই উপরে পাঁচতলায় ওঠানামার জন্য দুটো লিফট রয়েছে। তবে দুটো লিফটের একটি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ পরে আছে দীর্ঘদিন। অন্যটিতে মেরামত কাজ চলতে দেখা গেছে। তবে প্রতিদিনই এই লিফট মেরামত করতে হয় দাবী করে মেরামতকারী লিফট ব্যবহারে আসা রোগীদের বলছেন, মাঝখানের লিফটে যান, এ লিফটটি আগামী দু-তিন দিনে ঠিক হবে না। হাসপাতালের চার-পাঁচ তলায় বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে। যেখানে রোগীদের আবাসিক সুবিধা দিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়। কিন্তু লিফট দুটো বন্ধ থাকায় একটু পর পরই রোগীরা এসে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। শেবাচিমে প্রবেশের প্রধান বা মাঝখানের প্রবেশপথ সোজা তিনটি লিফট রয়েছে। যার দুটো পাকিস্তান আমলে সেই ১৯৬৮ সালের। একটি নতুন লিফট এখানে চলছে।
বরিশাল তথা দক্ষিনাঞ্চলের চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্যতম এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৬৮ সালে চালু হওয়ার পর থেকে ছয় জেলার মানুষের একমাত্র নির্ভরতা হয়ে আছে। এ হাসপাতালের দশ শয্যা বিশিষ্ট আইসিইউর সাথে ২০২০ সালে করোনা বিভাগ এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৮টি আইসিউ শয্যা ও ১৫০ টি নতুন বেড নিয়ে। সবমিলিয়ে আইসিইউ এখন ২৮ টি এবং শয্যা সংখ্যা ১১৫০টি থাকার কথা। তবে প্রচণ্ড ভাবে লোকবল সংকট এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংকট এই হাসপাতালের তা অনেকবারই স্বীকার করেছেন পরিচালক ডাঃ সাইফুল ইসলাম। এখানের ডাক্তার সংকট এতোটাই যে, রাতে ডাক্তার কক্ষে অবস্থানরত চারজন ইন্টার্নি চিকিৎসক দেখছেন এই ১১৫০ বেড ছাড়াও ফ্লোরিং ও আইসিইউতে অবস্থান করা আরো প্রায় ১০০০ রোগীকে।
২০২১ সালে নতুনভাবে তৈরি করোনা ওয়ার্ডটিকেই বর্ধিত করে সেখানে এখন চারতলা মেডিসিন ভবন করা হয়েছে। সেই ভবনে চারটি লিফট তৈরি হলেও এই মুহূর্তে চালু আছে একটি লিফট। আরো একটি চালু বা আধাআধি চালু রয়েছে তবে তা শুধু ডাক্তার ও ভিআইপিদের ব্যবহারের জন্য। অন্যটিতে দীর্ঘ লাইনে রোগীদের চলাচল। হাসপাতালের বহিরাঙ্গনে খুবই ধীর গতিতে চলছে দেয়াল নির্মাণ কাজ। এখানে নতুন কিছু ভবন ও সৌন্দর্যবর্ধন হবে বলে জানা গেছে। পুরাতন ভবনের নীচতল থেকে উপরতলা পর্যন্ত সংস্কার কাজ করা হয়েছে। তবে তা এখনো ঝুকিপূর্ণ। পলেস্তারা খসে পড়া আতঙ্ক কাজ করে এই ভবনে প্রবেশমাত্র। ঐতিহ্যবাহী এই হাসপাতালের পরিবেশ নিয়ে ইতিপূর্বেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাসপাতালের নতুন সভাপতি স্থানীয় সংসদ সদস্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল অবঃ জাহিদ ফারুক শামীম এবং এর আগে পরিদর্শনে আসা সয়ং স্বাস্থ্য সচিবও। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক হাসপাতাল ঘুরে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, একটি এলাকার মানুষের সেবা করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হচ্ছে এই হাসপাতাল। এতোদিন আমি তা পরিনি কেননা আমার সুযোগ ছিলনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে সেই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। তিনি আমাকে এই হাসপাতালসহ সদর উপজেলার দুটি হাসপাতালের সভাপতি বানিয়েছেন। এই হাসপাতাল দুটির সেবার মান এখন থেকে তিন মাসের মধ্যে উন্নতি করা হবে। এসময় জাহিদ ফারুক হাসপাতালের করনীয় ঠিক করতে নাগরিকদের সাথে মতবিনিময়ও করেছেন।
তারপরও বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, লোকবল সংকট এবং কর্মীদের স্বেচ্ছাচারিতা খুবই স্পষ্ট এখানে। এমনকি বহিরাগত বেসরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউটের থেকে টাকা নিয়ে তাদের শিক্ষার্থীদের প্রাকটিস করতে সুযোগ করে দেওয়ারও একাধিক অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে এই হাসপাতালে। এছাড়াও এখানে ভিআইপি কেবিন সহ বেশিরভাগ কেবিন সাবেক সভাপতি বরিশাল এক গৌরনদী আগৈলঝারা আসনের সংসদ সদস্যের নিজস্ব লোকে পরিপূর্ণ রয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন হাসপাতালের বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও পরিচালক সাইফুল ইসলাম নিজেও। ইতিপূর্বে একাধিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এই সাইফুল ইসলাম এর রোষানলের স্বীকার হয়ে অন্যত্র বদলী হয়ে আছেন। সর্বশেষ এখানের জনপ্রিয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং অর্থোপেডিক্স বিভাগের প্রধান ডাঃ মনিরুজ্জামান শাহিনও বদলী হয়ে চলে যান। শত অনুরোধেও বর্তমান প্রশাসনিক ব্যবস্থায় তিনি ফিরে আসতে সম্মত হননি বলে জানা গেছে। যদিও এ বিষয়টি এড়িয়ে ডাঃ মনিরুজ্জামান শাহিন বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার মান ও পরিবেশে ঐতিহ্যের ঘ্রাণ থাকতে হবে। এখানের পরিবেশ সুন্দর করতে হলে সবার আগে চিকিৎসকদের আন্তরিক হতে হবে। শূণ্যপদগুলো পূরণ এবং দায়িত্ব পালনে সচেতন চিকিৎসক দরকার শেবাচিমে। আর নতুন সভাপতিকে অভিনন্দন জানিয়ে ডাঃ মনিরুজ্জামান বলেন, সার্বক্ষণিক তদারকির বিকল্প নেই। শুধু পরামর্শ আর আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতি দিলেই হবেনা, এগুলোর সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা তদারকি খুবই জরুরী শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
ডাঃ শাহিনের বক্তব্যেই এখানের অনিয়ম চিত্রের অদৃশ্য ঈঙ্গিত রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের সাথে দহরম মহরম থাকায় পরিচালক ডাঃ এইচ এম সাইফুল ইসলাম নিজেও বরিশালে দুটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনা করছেন। যার একটি সিএন্ডবি রোডে নিরূপণ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও অন্যটি হাসপাতালের সামনে পার্টনারশিপে রয়েছে বলে জানা গেছে।এমনকি হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে তার আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠ লোক নিয়োগ দেয়ার একাধিক অভিযোগ রয়েছে। চক্ষু ও নাক-কান গলা বিভাগে তার প্রমাণ রয়েছে।
যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করে পরিচালক ডাঃ সাইফুল ইসলাম বলেছেন, চিকিৎসক সংকট ও বরাদ্দের অভাবেই তিনি কিছু করতে পারেননি। আর চুক্তিভিত্তিক চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম হয়েছিল। সব শিক্ষিত লোকজন নিয়োগ দেয়ায় এই সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে জানান পরিচালক সাইফুল ইসলাম।
তবে এখানেই স্পষ্ট হয় যে তিনি হাসপাতালের সাবেক সভাপতিকে খুশি রেখে নিজের খেয়ালখুশি মতো হাসপাতাল পরিচালনা করেছেন এতোদিন। আবার বর্তমান সভাপতি জাহিদ ফারুককেও হাসপাতালের সঠিক চিত্র তুলে ধরেন না বলে অভিযোগ করেছেন অনেকেই। যে কারণে বরিশালের সুশীল সমাজের অনেকেই জাহিদ ফারুক এর মতবিনিময় সভায় উপস্থিত হয়ে শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালনা দায়িত্বে সেনাবাহিনী থেকে নিয়োগের দাবী জানিয়েছেন। আর এ দাবী বরিশালের আপামর জনগণেরও। তারা চিকিৎসকদের হাতাহাতি ও ঝগাড়ার দিকে ঈঙ্গিত করে বলেছেন, ঐ বৈঠকে পরিচালক নিজেও উপস্থিত ছিলেন। তার সামনেই এ ঘটনা ঘটেছে। একটি ঐতিহ্যবাহী হাসপাতালের সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে এতে।
তারা বলেন, বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিবেশ ও চিকিৎসা সেবার মান উন্নত করতে হলে বর্তমান সভাপতি প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম এমপিকে অবশ্যই সাবেক সভাপতির অনুসারীদের সরিয়ে সেনাবাহিনী থেকে অভিজ্ঞ পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে। তানা হলে এ হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার মান উন্নয়ন তার জন্য অসম্ভব হবে বলে জানালেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কেএসএ মহিউদ্দিন মানিক বীরপ্রতীক, সামাজিক আন্দোলনের নেত্রী সনাক সাবেক সভাপতি শাহ সাজেদা, সাংবাদিক সাহিত্যিক অরূপ তালুকদার, বাংলা একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত কবি তপংকর চক্রবর্তী, নগর চিন্তাবিদ কাজী মিজানুর রহমানসহ বরিশালের সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দের প্রায় সবাই।