আবারও উত্তপ্ত হালিমা খাতুন বালিকা বিদ্যালয়: প্রধান শিক্ষকসহ বিতর্কিত কোন শিক্ষককেই চায়না শিক্ষার্থী ও অবিভাবক

সাহিত্য বাজার

Sharing is caring!

আবারও উত্তপ্ত হালিমা খাতুন বালিকা বিদ্যালয়: প্রধান শিক্ষকসহ বিতর্কিত কোন শিক্ষককেই চায়না শিক্ষার্থী ও অবিভাবক

বিশেষ প্রতিবেদক

আবারো উত্তপ্ত ও আলোচিত হয়ে উঠেছে বরিশালের হালিমা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। প্রধান শিক্ষকের অপসারণের দাবিতে রবিবার সকালে বিদ্যালয়ের প্রবেশপথে দুজন শিক্ষকের ব্যানার নিয়ে মানববন্ধন এবং সেই মানববন্ধনকে বাধা দেয়া ঘটনাকে কেন্দ্র করে অভিভাবক ও শিক্ষকদের হট্টগোল শুরু হয়। এসব কিছু সামলাতে ৫ প্লাটুন সেনাবাহিনী, পুলিশসহ জেলার তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট এর উপস্থিতি বিদ্যালয়ের ভিতর আতঙ্কিত পরিবেশ সৃষ্টি করলেও উত্তেজনাকর পরিস্থিতি শান্ত হয় এবং স্বস্তি ফিরে পায় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা । তবে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সাধারণ অবিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অনেকেই। অবিভাবকের দাবি, ইতিপূর্বে আরো কয়েকবার এরকম পরিস্থিতি হয়েছে এই বিদ্যালয়ে। দুজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যেমন অভিযোগ রয়েছে তেমনি অর্থ আত্মসাৎ ও দূর্নীতির অভিযোগ রয়েছে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধেও। তাই আমরা বিতর্কিত প্রধান শিক্ষকসহ তিন শিক্ষকের কাউকেই এই বিদ্যালয় চাইনা। একই সাথে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতে কোনরকম দলীয় লোক দেখতে চাই না বলে জানালেন তারা। এ সময় সাবেক শিক্ষার্থীদের কয়েকজন বলেন, হালিমা খাতুন এর সুন্দর পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সবার আগে ম্যানেজিং কমিটিকে দলীয় লেবাস মুক্ত করতে হবে। শুধু হালিমা খাতুনই নয়, দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই দলীয় রাজনীতি মুক্ত প্রশাসন প্রয়োজন। তানা হলে মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত হবেনা বলে জানান তারা।
এর আগে গত ১৪ নভেম্বর বৃহস্পতিবার হালিমা খাতুন বালিকা বিদ্যালয়ের ভিতরে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে লিফলেট বিতরণ করার অভিযোগে একজন শিক্ষক মহিউদ্দিনকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। যে ঘটনার প্রতিবাদে আরেক অভিযুক্ত শিক্ষক মাইদুল ও মহিউদ্দিন একসাথে ১৭ নভেম্বর রবিবার সকাল থেকে বিদ্যালয়ের সামনে ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশের চেষ্টা করে। এতে প্রধান শিক্ষক পক্ষের কিছু অবিভাবক ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের সাথে তর্কে লিপ্ত হয়। এসময় আন্দোলনরত শিক্ষকদের পক্ষ নিয়ে প্রতিবাদ জানায় অবিভাবকদেরই আরো একটি অংশ। যা নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ কামনা করেন প্রধান শিক্ষক ফখরুজ্জামান। সঙ্গে সঙ্গে ৫ প্লাটুন সেনাসহ বরিশালের সেনাবাহিনীর দায়িত্বরত কর্মকর্তা মেজর রাশেদ নিজেই ছুটে আসেন। অভিযুক্তদের সাথে নিয়ে প্রধান শিক্ষকের কক্ষেই বৈঠকে বসেন তিনি। দোষী প্রমাণিত প্রধান শিক্ষক পক্ষের একজনকে সতর্কতা দিয়ে চলে যান মেজর রাশেদ। এরপরই আসেন মডেল থানা পুলিশসহ জেলা প্রশাসনের শিক্ষা দপ্তরের তিনজন নির্বাহী কর্মকর্তা।
ইতিপূর্বেও এই হালিমা খাতুন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে এরকম ঘটনা ঘটেছে দাবী করে তৃতীয়, সপ্তম ও নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কয়েকজন অবিভাবক বলেন, বরিশালের সবচেয়ে খ্যাতিসম্পন্ন এই বিদ্যাপীঠে আমরা সন্তানকে নিয়ে এসেছি সুশিক্ষিত করার জন্য। কিন্তু এখানে ইতিপূর্বে দুবার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ ছাড়াও নিজেদের মধ্যে মারামারির ঘটনাও সংবাদ হয়েছে। তাই এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ধূয়ে মুছে ছাপ করা উচিত। প্রধান শিক্ষকসহ অভিযুক্ত সব শিক্ষকদের বহিষ্কার করা উচিত বলে জানান তারা।
এসময় কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের প্রতিটি টেবিল বা বেঞ্চে সর্বোচ্চ চারজন ও তিনজন বসার কথা থাকলেও আমরা চাপাচাপি করে ছয়জন ও আটজন বসতে বাধ্য হই এখন। এছাড়াও কোচিং বাধ্যতামূলক করতে হয় বলে জানান তারা।
একজন অবিভাবক অভিযোগ করেন, ৬০০ টাকা সেমিস্টার ফি নিয়েও পরীক্ষা নেয়নি। সেই টাকা ফেরতও দেয়নি। ১৮ লক্ষ টাকার কোনো হিসাব দিতে পারেন নাই প্রধান শিক্ষক। তার বিরুদ্ধে এরকম কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে দাবী করেই প্রতিবাদী মানববন্ধন করেছেন কয়জন শিক্ষক। যে কারণে ওই শিক্ষকদেরও হেনস্থা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
ঘটনার অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৯ মে হালিমা খাতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক মাইদুল ইসলামের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে শ্রেণিকক্ষে ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটে জানিয়ে প্রায় ছয় মাস পর একটি মামলা হয়। ওইদিন বিদ্যালয় খোলা ছিলো। তবে প্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার ছাত্রী, ৪২ জন শিক্ষক ও ৯ জন কর্মচারীর কেউ ঘটনাটি দেখেননি বলেও সংবাদ হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। বলা হয়েছে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরায়ও ধরা পড়েনি ধর্ষণচেষ্টার কিছু। আবার অভিযুক্ত শিক্ষককে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে বহিষ্কার করার পরও তিনি নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করছেন বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে সাধারণ শিক্ষক ও অবিভাবকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষকদেরই একটি চক্র ছাত্রীদের দিয়ে এসব মামলা করায়। প্রতিষ্ঠানে বছরে কয়েক কোটি টাকা আয়ের নিয়ন্ত্রণ এবং কোচিং বাণিজ্য নিয়ে বিরোধে এখানে পক্ষ বিপক্ষে দুটো গ্রুপ তৈরি হয়েছে। একপক্ষে প্রধান শিক্ষক সহ গত সরকারের অনুসারী ম্যানেজিং কমিটির কয়েকজন এবং অন্যপক্ষে রয়েছে সুবিধা বঞ্চিত অবিভাবক ও শিক্ষক। যে কারণে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ছাত্রীদের ব্যবহার করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এর আগে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে ছাত্রীর মামলা আদালতে মিথ্যাও প্রমাণিত হয়।
এ বিষয়ে শিক্ষক মাইদুল ইসলাম বলেন, তিনি প্রায় আট নয় বছর ধরে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। শিক্ষকদের কোচিংয়ের ৪০ ভাগ টাকা বিদ্যালয়ে দিতে হয়। গত মে মাসে তৎকালীন সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক সেটি ৫০ ভাগে উন্নীত করেন। তিনি এতে রাজি না হওয়ায় ৬ মে ষষ্ঠ শ্রেণির ১৩ ছাত্রীকে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ডেকে যৌন হয়রানির মিথ্যা অভিযোগে সই করানো হয়। ওই দিনই তদন্ত কমিটি গঠন এবং পরদিন সভা ডেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়। মাইদুল ইসলাম আরো বলেন, চাকরি ফিরে পেতে তিনি আদালতে মামলা করেছেন। এ ছাড়া মানহানির মামলাও করেছেন। দুটি মামলাতেই প্রধান শিক্ষক ধরাশায়ী হবেন। এ কারণে এক ছাত্রীর নানাকে দিয়ে মিথ্যা মামলা করিয়েছেন বলে জানান তিনি। আজকের ঘটনা সম্পর্কে মাইদুল ইসলাম বলেন, আমাদের ব্যানারে লেখা ছিলো – বিদ্যালয় এর ক্যাম্পাসে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের দিয়ে সিনিয়র শিক্ষক মহিউদ্দিনের উপর হামলার প্রতিবাদ।
এসময় শিক্ষক সিনিয়র মহিউদ্দিন সভাকক্ষ থেকে বের হয়ে এসে জানান, এর হোতা প্রধান শিক্ষক এসএম ফখরুজ্জামান। তার বিরুদ্ধে গেলেই শিক্ষককে ফাঁসাতে ছাত্রীদের ব্যবহার করা হয়। তিনি বলেন, আজ আমরা কয়েকজন এ জন্য প্রতিবাদ সভা করছিলাম। মহিউদ্দিন আরো বলেন, অর্থ লোপাট, ছাত্রীদের ব্যবহার করে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিসহ নানা অনিয়মে জড়িত প্রধান শিক্ষক। তিনি এর প্রতিবাদ করায় তাকে হত্যার হুমকিও দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক।
অবিভাবকদের একজন বলেন, এই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে যা এখনো তদন্তাধীন রয়েছে। জেলা প্রশাসকের তদন্ত কমিটি গত ১০ বছরে স্কুলটির সব আয়-ব্যয়ের প্রমাণপত্রও চেয়েছে বলে জানান তিনি ।
প্রধান শিক্ষক পক্ষের একজন অভিভাবক এ সময় প্রতিবাদ জানান ও বলেন, মাত্র দুইজন লোক কখনো প্রতিবাদ হয় নাকি? কোন অভিভাবক তাদের সাথে নেই অথচ তাদের ব্যানারে অভিভাবক কথাটিও লেখা ছিল। এই প্রধান শিক্ষক আসার পর থেকে বিদ্যালয়ের উন্নয়ন হয়েছে। তিনি অত্যন্ত ভালো মানুষ। তিনি আসার পরই এখানে শিক্ষার মান উন্নত হয়েছে।
সর্বশেষ পরিস্থিতি ও ধর্ষণচেষ্টা মামলা প্রসঙ্গে প্রধান শিক্ষক এসএম ফখরুজ্জামানকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
সর্বশেষ জেলা প্রশাসনের তিনজন নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান, লুৎফর রহমান এবং মারজান রহমান সহ প্রধান শিক্ষক ও অভিযোগকারী শিক্ষকদের নিয়ে বৈঠকে বসেন।
বৈঠক শেষে সিনিয়র সহকারী কমিশনার আরিফুজ্জামান বলেন, আগামী তিনদিনের মধ্যে হালিমা খাতুন বিদ্যালয়ের সমস্যার সমাধান করা হবে। এই মূহুর্তে তদন্তাধীন বিষয়ে এর বেশি কিছু বলতে পারছি না।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!