উদ্বোধন অপেক্ষায় জেলা শিল্পকলাঃ বিস্তর অনিয়মের অভিযোগ
বাংলাদেশ জাতীয় শিল্পকলা একাডেমির আওতায় সারাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে বেগবান করতে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে জেলা ও উপজেলায় শিল্পকলা একাডেমির ভবন নির্মাণ ও মুক্তমঞ্চ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করে সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে এ জন্য জেলা প্রতি প্রায় ৩০ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয়া হয়। সাংস্কৃতিক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এর আন্তরিকতায় প্রায় একইসময় মানিকগঞ্জ, জামালপুর, নারায়নগঞ্জ, মৌলভীবাজার, পাবনা, বরিশাল, খুলনা ও রংপুরে শিল্পকলা একাডেমী ভবন নির্মাণ ও অডিটরিয়ামের কাজের অনুমোদন হলে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। কারণ দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর তাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে।
গণপূর্ত দফতরের অধীনে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ কাজের দায়িত্ব পায়। বরিশালে ইনফিনিটি ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, খুলনায় রুটস ইন্টারন্যাশনাল, রংপুরে গণপূর্ত দফতর নিজেই
এ কাজের দায়িত্ব পায়। ৮ জেলায় পৃথক পৃথক সময়ে এ ভবন নির্মাণ কাজ শুরু করে তারা। এবং ২ বছরের মধ্যে কাজ সমাপ্তে কথা থাকলেও তা ব্যাহত হয়ে চার বছরে সমাপ্ত হয়েছে। নির্মাণাধীন ভবনেরই সংস্কার করতে হয় বহুবার।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বরিশালে জেলা শিল্পকলা একাডেমির কাজের উদ্বোধন করেন তৎকালীন সংস্কৃতিক মন্ত্রী আসাদুজ্জান নূর। এরপর ডিভিশনাল এবং জোনাল লিল্পকলা একাডেমি নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় কার্যাদেশ ৪১/২(৬) অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারী ভবন ও অডিটরিয়াম নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সব জেলাতেই ভবন নির্মাণ কাজ সমাপ্তের দিকে। এখন শুধু উদ্বোধন অপেক্ষা।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে ৮ জেলায় মোট ১শ’৮৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই কাজের গুনগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খুলনা, বরিশাল, মানিকগঞ্জ, রংপুরসহ সব জেলার সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ।
১৭ ডিসেম্বর ২০১৮ তে রংপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমির কাজ পরিদর্শন শেষে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন, ‘স্বাধীনতার ৪৬ বছরের মধ্যে এ ধরনের উদ্যোগ আগে নেয়া হয়নি। আমরা পুরনো শিল্পকলা একাডেমী ভবন গুলোতে মেরামত কাজ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আধুনিকায়নের কাজও চালিয়ে যাচ্ছি। সেখানে নিয়মিত সিনেমা প্রদর্শন করার জন্য আমরা প্রজেক্টর পাঠাচ্ছি, পাঠাগার স্থাপনের জন্য বইয়ের ব্যবস্থা করছি। শুধু তাই নয় জেলার পাশাপাশি ১২টি উপজেলায়ও মুক্তমঞ্চ এবং একটি করে কমপ্লেক্সে নির্মাণের কাজেও হাত দেয়া হয়েছে।’
নতুন শিল্পকলা একাডেমী ভবনের কাজ বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। এতে করে সে এলাকাগুলোতে শিল্প সংস্কৃতি চর্চায় নতুন মাত্রা যোগ হবে।’
এর অল্পদিন পরেই আসাদুজ্জামান নূরের স্থানে সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী হিসেবে কেএম খালিদকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি দায়িত্ব গ্রহণ জেলা শিল্পকলা একাডেমির কাজের অগ্রগতি নিজ চোখে তদারকি করেন।
নির্মাণ কাজে অনেক ত্রুটির অভিযোগ উঠার কারণে ২০২০ সালের অক্টোবরে সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী বরিশাল ও খুলনা জেলা শিল্পকলা একাডেমির নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করেন।
এসময় খুলনার সংস্কৃতি কর্মীরা জানান, কমপ্লেক্সে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, লিফট ও আর্ট গ্যালারিতে শীতাতপ যন্ত্র নেই। এছাড়া নাটক করার জন্য যথার্থভাবে ইন্টেরিয়র ডিজাইন হয়নি। ত্রুটি রয়েছে আধুনিক লাইটিং ও সাউন্ড সিস্টেমেও । তাছাড়া সি সি ক্যামেরাসহ কমপ্লেক্স রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিতেরও দাবি তাদের।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ পরিদর্শন শেষে স্থানীয় সাংস্কৃতিককর্মী ও গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, নির্মাণাধীন খুলনা শিল্পকলা একাডেমির নিরাপত্তা নিশ্চিত, ভবনে লিফট ও সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা, অডিটোরিয়ামে অধিক সংখ্যক মাইক্রোফোন ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যুক্ত করা হবে।
কে এম খালিদ আরো বলেন, আমাদের কাজ এখনও প্রক্রিয়াধীন। যেখানে যেটির ঘাটতি আছে সেটি পূরণ করার জন্য আমরা এটি রিভাইস করছি।
কিন্তু বর্তমানে অডিটোরিয়ামের মান ও টাইলসের কাজ মানসম্মত নয় বলে অভিযোগ এখানে। একই অভিযোগ রংপুর ও বরিশালের।
বরিশালের সাংস্কৃতিক নেতা, বরিশাল থিয়েটারের সভাপতি ও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কাজল ঘোষ জানান, একটি মঞ্চনাটক উপযোগী মঞ্চের দাবীতে নাট্যকর্মীদের আন্দোলন সংগ্রাম দীর্ঘদিনের। বর্তমান সরকার সবসময় সাংস্কৃতিক বান্ধব। এই সরকারের সাবেক সাংস্কৃতিক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর নাট্যকর্মীদের সঙ্গে সহমত পোষণ করে আধুনিক অডিটোরিয়াম সহ ৮ টি জেলায় একইসাথে শিল্পকলা একাডেমির ভবন নির্মাণের অনুমোদন করেন এবং সে লক্ষ্যে কাজও শুরু হয়। কিন্তু যেভাবে এ কাজ শেষ হয়েছে তাতে নাট্যকর্মীরা সন্তুষ্ট নয়। কারণ, আমাদের মূল দাবী মঞ্চনাটক উপযোগী মঞ্চই এখানে চরমভাবে অবহেলিত হয়েছে। যে মঞ্চ হয়েছে তা নৃত্য, সভা সেমিনারের জন্য। নাটকের জন্য নয়।
জেলা প্রতি ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত শিল্পকলা একাডেমি ভবনের চাকচিক্য অবশ্যই প্রশংসনীয় বলে দাবী করেন সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ। তবে এ চাকচিক্য শুধুই বহিঃঅংশে। ভিতরে আসবাবপত্র এবং অডিটোরিয়াম সরঞ্জাম অত্যন্ত নিম্নমানের এবং ব্যবহৃত টাইলসের স্থায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ।
অন্যদিকে পর্যাপ্ত লোকবল সংকটের কারণে আসবাবপত্র নষ্ট ও রক্ষণাবেক্ষণ সমস্যা হবার আশংকা সয়ং জেলা কালচারাল কর্মকর্তার।
এ অনিয়ম নিয়ে কথা বলতে আমরা অসংখ্যবার শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর ফোনে কল ও মেসেজ করি। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তিনি নিরবতা পালন করেন। তবে ইতিমধ্যেই লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধে নানান অনিয়ম ও সরকারের ২৬ কোটি আত্মসাৎ এর অভিযোগ উঠেছে।
সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রীও এ বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী নন বলে মনে হলো। কেননা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে বিষয়টি চোখে পড়েছে তার, কিন্তু উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন নাই। ফোনকলও রিসিভ করেন নাই। একান্ত সচিব আলতাফ সাহেব জানালেন, স্যার আপনার প্রশ্ন দেখেছেন। ব্যাস্ততার কারণে উত্তর দিতে পারছেন না।
গত চারদিন ধরেই চলছে সাংস্কৃতিক দায়িত্বশীল দুই ব্যক্তিত্বের ব্যস্ততা। তাই পাঠকই বুঝে নিন প্রায় দেড়শ কোটি টাকায় শিল্পকলা একাডেমির কি উন্নয়ন পেয়েছেন আপনার জেলায়?