পদ্মাসেতু ও পটুয়াখালীর পায়রা বা লেবুখালী সেতুর কাজ সম্পূর্ণ সম্পন্ন হলেই বরিশাল তথা এ বিভাগের ছয় জেলার ভাগ্যোন্নয়নের বানিজ্যিক সব পথ উম্মুক্ত হবে বলে আশাবাদী জেলার সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ।
বর্তমানে পদ্মাসেতুর কাজ প্রায় শেষের দিকে। ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করার পর নিজস্ব অর্থায়নে দ্রুত এগিয়ে চলছে এর সার্বিক কাজ।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়লেও উদ্বোধন করা হবে আগামী ২০২২ সালের জুন মাসে। আর এ মেয়াদ বাড়ার কারণে বাড়বে না খরচ। মূল পদ্মা সেতুর ৯৪ দশমিক ২৫ শতাংশ কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। সার্বিক কাজ শেষ হয়েছে ৮৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের বাস্তব কাজ আগের বেঁধে দেয়া ২০২২ সালের জুনেই শেষ হবে। তবে ভুল-ত্রুটি সংশোধনের সময়সহ প্রকল্পের মেয়াদ জুন ২০২৩ পর্যন্ত বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে।
সেতু বিভাগের সচিব বলছেন, করোনার কারণেই বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের মেয়াদ।
প্রতিকূল আবহাওয়া, গুজব ও মহামারি করোনাভাইরাস সঙ্কট উপেক্ষা করে প্রমত্তা পদ্মার বুকে এগিয়ে চলছে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ। সেতু প্রকল্পের কাজ এখন একেবারে শেষের পথে। ধাপে ধাপে কাজ এগিয়ে মূল সেতু দৃশ্যমান হওয়ার পর এবার যান চলাচলের জন্য উপযোগী হয়েছে উঠছে। দেশের কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নের এই পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা দ্বার উম্মুক্ত হবে বলে মনে করেন রাষ্ট্র প্রধান সয়ং।
এদিকে বরিশাল বিভাগের স্বপ্ন দ্বার খুলে যায় পটুয়াখালীর লেবুখালী বা পায়রা সেতুর নির্মাণ সূচনায়।
২০১৩ সালের ১৯ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রা সেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। এরপর দ্রুত গতিতে কাজের প্রায় সবটাই সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ।
সেতুর প্রকল্প পরিচালক আবদুল হালিম বলেন, কর্ণফুলী দ্বিতীয় সেতুর আদলেই নির্মাণ করা হয়েছে ফোরলেন লেবুখালী সেতু। পায়রা নদীর মূল অংশের ৬৩০ মিটার ‘বক্স গার্ডার’ চারটি স্প্যানের ওপর নির্মিত হয়েছে। যার মূল অংশ ২০০ মিটার করে দুটি স্প্যান ১৮.৩০ মিটার ভার্টিক্যল ক্লিয়ারেন্স রাখা হয়েছে পায়রা সমুদ্র বন্দরে উপকূলীয় পণ্য ও জ্বালানীবাহী নৌযান চলাচলের জন্য। এছাড়া সেতুর মূল অংশের দু’প্রান্তে ৮৪০ মিটার ভায়াডাক্ট-এ ৩০ মিটার করে ২৮টি স্প্যানে বর্ধিত অংশের ভার বহন করছে। লেবুখালী সেতুর ৩২টি স্প্যান এখন দাঁড়িয়ে আছে ৩১টি পিয়ারের ওপর। সেতুটির ২৮টি স্প্যানের ১২টি বরিশাল প্রান্তে এবং ১৬টি পটুয়াখালী প্রান্তে।
তিনি আরও জানান, মূল সেতু ও তার ভায়াডাক্টের জন্য টেস্ট পাইল, ওয়ার্কিং পাইল, পিয়ার ক্যাপ, পিয়ার এবং ভায়াডাক্টসহ সাব-স্ট্রাকচার নির্মাণ করা হয়েছে। ভায়াডাক্টের ওয়ার্কিং পাইলসহ পাইল ক্যাপ, অ্যাবাটমেন্ট ওয়ালও কঠোর মান নিয়ন্ত্রণে সম্পন্ন হয়। মূল সেতুটি বিভিন্ন মাপের ৫৫টি টেস্ট পাইলসহ ১০টি পিয়ার, পাইল ও পিয়ার ক্যাপের ওপর নির্মিত হয়েছে। এছাড়া ১৬৭টি বক্স গার্ডার সেগমেন্ট রয়েছে সেতুতে। যার ফলে দূর থেকে সেতুটিকে মনে হবে ঝুলে আছে।
এছাড়া পায়রা নদীতে জোয়ারের সময় নদী থেকে সেতুর মধ্যে ১৮.৩০ মিটার উঁচু থাকবে। এতে করে নদী থেকে বড় বড় জাহাজ চলাচলে কোনও রকমের সমস্যা হবে না বলে জানান তিনি।
নদীমাতৃক বরিশাল বিভাগের ভোলা বাদে অন্য পাঁচটি জেলার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরাসরি যানবাহনের যোগাযোগ স্থাপন হবে এই সেতু চালুর ফলে। কুয়াকাটা সহ পটুয়াখালী, বরগুনা ও সুন্দরবন অঞ্চলের নৈসর্গিক দৃশ্য উম্মুক্ত হবে পর্যটকদের জন্য।
পদ্মা ও পায়রা সেতুকে ঘিরে তাই বরিশাল তথা গোটা দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে উঠতে শুরু করেছে হোটেল-মোটেলসহ বহু ছোট-বড় শিল্পায়ন-কল-কারখানা। সেতু দুটিতে যান চলাচল শুরু হলে দক্ষিণাঞ্চলের সাথে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে। পাশাপাশি গড়ে উঠবে ব্যবসায়ীক সর্ম্পক।
বাড়বে এখানকার পর্যটন কেন্দ্রেগুলোতে লোক সমাগম। এতে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য দুয়ার খুলে যাবে বলে আশাবাদী সবাই।
পর্যটন করপোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল বিভাগজুড়ে পর্যটন শিল্পে ব্যাপক সম্ভবনা রয়েছে। বিশেষ করে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, পায়রা সমুদ্রবন্দর ও তার পার্শ্ববর্তী গঙ্গামতী, কাউয়ারচর, বরিশালসহ পদ্মার পাড় ও কীর্তনখোলা তীরের চর এলাকা হতে পারে শিল্পায়নের নতুন সম্ভাবনা
।
বরিশালের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি কবি ও অধ্যাপক তপংকর চক্রবর্তী বলেন,
পদ্মা ও পায়রা সেতুতে যানবাহনের চলাচল শুরু হবার আগেই বরিশালের প্রশাসন, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, রাজনিতীবিদ ও ব্যবসায়ীদের সমন্বিত একটি উন্নয়ন কমিটি হওয়া জরুরী। একটি বিভাগীয় শহরে নাগরিকদের কোনো ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম নেই যা সত্যি লজ্জার। এই কমিটির তত্ত্বাবধানে হোক বা জেলা ও সিটি করপোরেশনের অধীনে হোক প্রবাসীদের এখানে ইনভেস্ট জরতে উৎসাহিত করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, সৃজনশীল ও উৎপাদনশীল শিল্প কারখানা স্থাপনে আগ্রহী ব্যবসায়ীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। অত্যাধুনিক ডকইয়ার্ড তৈরির চমৎকার সুযোগ এখানে। তবে সবার আগে ভোলা থেকে পাইপলাইনে গ্যাস আসার বিষয়টি কেন এতো বিলম্ব তা সমস্যার সমাধান করে দ্রুত গ্যাস আসা নিশ্চিত করতে হবে।
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস বলেন,
পদ্মা সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর তা বাস্তবায়ন করছেন তারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি আরও বলেন, স্বপ্নের পদ্মা ও পায়রা সেতু নির্মাণ হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও জীবন-জীবিকা বদলে যাবে। দক্ষিণাঞ্চল বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। এই জনপদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করবে পদ্মা ও পায়রা সেতু।
আর বিএনপির বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন বলেন,
ভোলার গ্যাসটা যদি নিশ্চিত এসে যায় আর যদি সরকারের এ অঞ্চলের উন্নয়নের স্বদিচ্ছা থাকে তাহলে গার্মেন্টস শিল্পকে গুরুত্ব দিলে সবচেয়ে লাভজনক হবে বাংলাদেশ। চিটাগং এর মতো বরিশালেও ইপিজেড স্থাপনের পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুব্রত বিশ্বাস দাস জানান, জেলার সাংবাদিক বন্ধুদের এখন বেশি বেশি উন্নয়ন বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। পায়রা ও পদ্মাসেতু চালু হওয়া মানেই বরিশাল বানিজ্যিক নগরীর সব গুনাগুন অর্জন করা। প্রবাসী ও রাজধানীর ব্যাবসায়ীদের এখানে ইনভেস্ট করতে উৎসাহিত করতে হবে। আমরা আমাদের মতো সে চেষ্টা করছি। সাংবাদিক বন্ধুরাও সেটা করতে পারেন।