আজ জরুরী হয়ে পড়েছে বৃষ্টির মুখোমুখি হওয়া
আজ নিজের ভিতর ভেজা শালিকের দ্রোহকাল।
অনন্ত স্নানঘরে আমাদের যৌথ আকাশ
বর্ষাতি হারিয়ে ফেলা বালক, তোয়ালেতে মুখ
মোছার আগে নড়ে উঠেছে বাণভাসি পাতার শব্দ
তাই নিয়ে আমাদের দূর অবগাহনের দিন-
৭০ দশকের কবি কামাল চৌধুরীর সম্প্রতী লেখা স্নানঘর নামক কবিতাটির মাধ্যমেই কবি কামাল চৌধুরীকে চিনতে ও বুঝতে পারি। যদিও তার সাথে আমার প্রথম আলাপ হয়েছিল ২০০৯ সালের মার্চে কোনো এক দুপুরে। সাহিত্য বাজার পত্রিকার রেজিস্ট্রেশন সুবিধা পেতে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ আমাকে পাঠালেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক সচিব আবু নাছের কামাল চৌধুরীর কাছে। অমায়িক এই প্রশাসক আমাকে তার কক্ষে ডেকে সাহিত্য বাজারের ৫/৬টি সংখ্যা নিজে খুঁটিয়ে দেখলেন, তারপর আমার একক চেষ্টায় এতগুলো সংখ্যা হয়েছে শুনে খুব প্রশংসা করলেন এবং ফোন তুলে ঐ সময়ের ঢাকা জেলা প্রশাসক জিল্লার রহমানকে সাহিত্য বাজার ও আমার বিষয়ে জানালেন। পরদিনই জিল্লার রহমান সাহেব আমাকে দেখা করতে বলেন এবং নতুন কওে সাহিত্য বাজারের আবেদনপত্র জমা নেন। পরবর্তীতে আমার সহধর্মীনীর অসুস্থতা জনিত কারণে এ বিষয়ে আর খোঁজ নেয়া হয়না। কিন্তু শাহবাগের কোনো কবিতা আড্ডা কিম্বা উৎসবে কামাল ভাইয়ের সাথে দেখা হলেই তিনি জানতে চান সাহিত্য বাজার এর কি অবস্থা। এই আন্তরিকতা শুধু একজন কবির মধ্যেই আমি পেয়েছি। তিনি কবি কামাল চৌধুরী। আগে লোকটির প্রতি ভালোলাগা বোধ আমাকে তার কবিতার প্রতি আগ্রহী কওে তোলে। আমি খুঁজে পাই তার প্রকাশনা ধূলি ও সাগর দৃশ্য, পান্থশালার ঘোড়া ও নির্বাচিত ১০০ কবিতা। জানতে পারি তার প্রথম কবিতার বইটির নাম মিছিলের সমান বয়সী। বইগুলো শুধু উল্টেপাল্টে দেখেছি, কোনটাই পড়ার সুযোগ পাইনি। তবে কোথাও তাঁর টুকরো কবিতা ছাপা হলেই আমি হুমড়ী খেয়ে সেটা পড়ে ফেলি। একটি বুলেটিনে খুঁজে পেলাম তাঁর কবিতা –
রাত্রিলিপি
রাত্রিলিপি, আমারও কিছু গান আছে
আমারও বসন্ত আছে, উন্মুখ, ধূলিবর্তী, পাতাময়
ঝওে পড়বার আগে শোন ছায়া-নিদ্রাহীন কারো পাশে
আমার গভীর গান, শ্রাবণের নতজানু প্রার্থনার ভাষা-
ঘয়তো পাঠের ছলে শুল্কপক্ষে ষোড়শী বেদেনী
যে নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছে
সেখানে উদ্বাস্তু কোন খাড়িমুখে
আমিও সত্যজল, নদীশব্দ, রবীন্দ্রসঙ্গীত।
সম্প্রতী কবি কামাল চৌধুরীর সাথে দেখা হয়ে গেল পাঠক সমাবেশের এক কবিতা আড্ডায়। সেখানে সাহিত্য বাজারের ৭ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সম্পর্কে শুনলেন এবং প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখাটি হাতে নিলেন। এবারও আমার কাজের প্রশংসা ছিল তাঁর মুখে। আমাদেও ময়মনসিংহ ঘোষণা প্রদানের বিষয়টিতে তিনিও ঐক্যমত পোষণ করছেন বলেন জানালেন।
একটি কবিতা চাই – সেদিন এ আবেদন জানাতেই তিনি হাতে গুঁজে দিয়ে গেলেন তারই লেখা কবিতা –
স্মৃতি কাতরতা
সমুদ্রের দিকে তাকাতে তাকাতে
বালি ও ফেনার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে স্মৃতিকাতরতা
সেখানে অচেনা বালক আমাকে গান শোনাচ্ছে
সন্ধ্যাবেলায়
এই ফাঁকে সূর্য ডুবছে। ডুবুক
এক ফাঁকে রাত নামছে। নামুক
সৈকতে যারা গান গায় তারা ভিখিরি বালক
আমিও তাদেও মতো এক সন্ধ্যা
তোমাকে উৎসর্গ করছি খালি গলায়।
বন্ধুবর ভোরের কাগজের প্রতিনিধি প্রয়াত কিশোর কুমার তখন আমার পাশেই ছিলেন। বন্ধুটি সেদিন তার সম্পর্কে জানালেন – ১৯৫৭ সালের ২৮ জানুয়ারি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বিজয়কড়া গ্রামের চৌধুরী বাড়িতে কবি কামাল চৌধুরীর জন্ম। তাঁর পিতার নাম মরহুম আহমদ হোসেন ও মাতার নাম তাহরো হোসেন। ১৯৮১ সালে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ মিছিলের সমান বয়সী প্রকাশিত হয়েছিল মাওলা ব্রাদার্স থেকে। তিনি ২০১১ সালে বাংলা একাডেমী ছাড়াও এ পর্যন্ত অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। তারমধ্যে জীবনানন্দ, সিটি-আনন্দআলো সাহিত্য পুরস্কার, রুদ্র পদক উল্লেখযোগ্য। তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় ১০টি।
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে : কামাল চৌধুরীর পুরো নাম ‘কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী। ১৯৫৭ সালের ২৮ জানুয়ারি কামাল চৌধুরীর জন্ম হয়েছিল কুমল্লিা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বিজয় করা গ্রামে। বাবা আহমদ হোসেন চৌধুরী ও মা বেগম তাহেরা হোসেনের ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে নারায়ণগঞ্জের গোদনইল হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন তিনি। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মাতাল জীবন। এখানেই কাব্যলক্ষ্মীর কাছে চিরসমর্পণ। এখানেই রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তসলিমা নাসরিন সহ সমসাময়িক কবিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। এখানেই কবিতার সঙ্গেচিঁরকালের গাঁটছড়া। এখানেই নিজেকে কবিতা পথিক হিসেবে চিহ্নিত করা। কবিতা লিখতে লিখতেই এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন সমাজবিজ্ঞানে। কিন্তু সেখানেই লেখাপড়ার গণ্ডী শেষ হয়ে যায় নি। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে যদিও সরকারী চাকুরী করছেন পেয়ে যান একটু অবসর;- সেই ফাঁকে নৃবিজ্ঞানে পিএইচ, ডি। পি এইচ, ডি গবেষণা করেছেন ‘গারো জনগোষ্ঠীর মাতৃসূত্রীয় আবাস প্রথা’ নিয়ে।
২০১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা সচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ২০১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মার্চ ২০১৪ থেকে জনপ্রশাসন সচিব হিসাবে কর্মরত। একই সময়ে তিনি সরকারের সিনিয়র সচিব পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৮১’র বাংলা একাডেমী বই মেলাকে উপলক্ষ ক’রে একদল তরুণ কবি জীবনের প্রথম কাব্যগ্রন্ত প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কামাল চৌধুরী তাদেরই একজন। এ উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দ্রাবিড় প্রকাশনী। একুশের বইমেলাতেই বেরিয়েছিল কামাল চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ মিছিলের সমান বয়সী। কবিতার সংখ্যা ৪৮। কবিতাগুলো ভাষা ও শৈলী বলে দেয় শামসুর রাহমান তাঁকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
প্রকাশনা
কামাল চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ মিছিলের সমান বয়সী প্রকাশিত হয় ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে। এরপর চাকুরী জীবনের ব্যস্ততা তাঁকে কবিতা থেকে কিছুটা দূরে ঠেলে দিয়েছিল। ’৮১ থেকে ’৯০ – টানা নয় বছর কোনো কবিতার বই প্রকাশ করা হয়ে ওঠেনি। এই বন্ধ্যাত্ব কেটে যায় ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে। এ বছর প্রকাশিত হয় কামাল চৌধুরীর দ্বিতীয় কবিতা-সংকলন টানাপোড়েনের দিন । অতঃপর একে একে আরো আটটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যথা:- এই পথ এই কোলাহল (১৯৯৩), এসেছি নিজের ভোরে (১৯৯৫), এই মেঘ বিদ্যুতে ভরা (১৯৯৭), ধূলি ও সাগর দৃশ্য (২০০০), রোদ বৃষ্টি অন্ত্যমিল (২০০৩), হে মাটি পৃথিবীপুত্র (২০০৬),[২]প্রেমের কবিতা (২০০৮) এবং পান্থশালার ঘোড়া (২০১০)। ১৯৯৫-এ তিনি প্রকাশ করেছেন একটি বাছাই সংকলন নির্বাচিত কবিতা । এরই ধারাই ২০১১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেছেন কবিতাসংকলন । এগারোটি গ্রন্থ থেকে তিন শত নয়টি কবিতা এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এছাড়াও কামাল চৌধুরী ২০০৭-এ প্রকাশ করেন কিশোর কবিতা সংকলন আপন মনের পাঠশালাতে। ১৯৯৫-এ আলী রীয়াজ-এর সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন সত্তর দশকের কবিদের কবিতা।
পুরস্কার
- রুদ্র পদক (২০০০)
- সৌহার্দ্য সম্মাননা(পশ্চিমবঙ্গ) (২০০৩)
- কবিতালাপ সাহিত্য পুরস্কার (২০০৪)
- জীবনানন্দ পুরস্কার (২০০৮)
- সিটি- আনান্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার (২০১০)
- দরিয়ানগর কবিতা সম্মাননা (২০১০)
- বাংলা একাডেমী পুরস্কার (২০১২)
কবি কামাল চৌধুরী সম্পর্কে জানাবার জন্য সাহিত্য বাজার কে ধন্যবাদ।