দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাজ্ঞলি
হুমায়ুন আহমেদ: বহুমাত্রিক এক কথাশিল্পী
আরিফ চৌধুরী
সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অসামান্য জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ। একাধারে উপন্যাসিক, নাট্যকার, ছোটগল্পকার, চলচ্চিত্রকার ছাড়াও বাংলা কথাসাহিত্যের পথিকৃৎ ব্যাক্তি¦ত্ব। জনপ্রিয়তার বিচারে কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়া কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের চাইতে গুরুত্বর্পূণ লেখক অনেকে থাকলেও তার মতো জনপ্রিয় লেখক বাংলা ভাষার ইতিহাসে বিরল। পাঠকদের ধরে রাখার মতো অসাধারণ মতা ছিলো তার। লেখায় পরিমিতবোধ, বাঙালির প্রত্যহিক জীবনের অস্তিতকে নতুনভাবে আবিস্কার করার েেত্র তার ভুমিকা ছিলো অপরিসীম। নতুন দৃষ্টিভংঙিতে সাহিত্যে রুচি, লেখার বিষয় আঙ্গিকের মেলবন্ধন, সমকালীন সমাজ বাস্তবতার নতুন বিশ্লেষণ তার লেখায় এসেছে স্ব্াচ্ছন্দ্যভাবে, তিনি কিছু মৌলিক চরিত্রের সঙ্গে বাঙালি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। হিমু, মিসির আলী, শুভ্রা, ইত্যাদি চরিত্র তাকে জনপ্রিয়তার শিখরে টেনে নিয়ে গেছেন। মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার দৃর্লভ প্রতিভার অধিকারী সৃষ্টিশীল সাহিত্যে জগতের যাদুকর হুমায়ুন আহমেদ সৃষ্টিশীল কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে সন্মোহনি শক্তিতে ধরে রেখেছিলেন দীর্ঘকাল ধরে। তার লেখার মূল উপকরণের সাথে সহজ ও সাবলীল ভাষায় হিউমার ঢুকিয়ে দিয়ে মধ্যবিও জীবনের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও আবেগ, ভালোবাসা, আনন্দ-বেদনাকে ভিন্ন্ দৃষ্টিভংঙ্গিতে রুপায়ন করে তুলেছেন অনূভুতির চিত্রাবলীতে। তার অসামান্য উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের ভুমিকা লিখতে গিয়ে ড.আহমদ শরীফ লেখকের নতুন পথ চলার সন্ধ্যান করেছেন এমনি করে- ‘বইটি পড়ে অভিভূত হয়েছি। গল্পে অবিস্ময়ে প্রত্য করেছে একজন সুদর্শী শিল্পীর , একজন কুশলী ¯্রষ্টার পাকা হাত। বাংলা সাহিত্য েেত্র এক সুনিপুণ শিল্পীর, এক দ রুপকারের, এক প্রজ্ঞাবান ¯্রষ্টার জন্মলগ্ন যেনো অনুভব করলাম। বিচিত্র বৈষয়িক ও বহুমুখী মানবিক সম্পর্কের মধ্যেই যে জীবনের সামগ্রিক বষ্ণনা নিহিত, সে উপলব্দি লেখকের রয়েছে। হুমায়ুন আহমেদ বয়সে তরুণ মনে নবীণ দ্রষ্টা, মেজাজে জীবন রসিক, স্বভাবে রুপদর্শী, যোগ্যতায় দ রুপকার। ভবিষ্যতে বিশিষ্ট জীবন শিল্পী হবেন এই বিশ্বাস ও প্রত্যাশা নিয়ে অপো করবো’। হুমায়ূন আহমদকে নিয়ে এমন ভবিষ্যৎ বাণী বিফল হয়নি। তার সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে তিনি সেই সম্ভাবনাকে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। তাইতো হুমায়ুন আহমদের উপন্যাস ও গল্প নিজস্ব বৈশিষ্ট্যর ভিওির উপর গড়ে উঠেছে বলেই তিনি জননন্দিত কথাকার হয়ে উঠেছেন অনায়াসেই । মানুষের রুচি, ও স্বপ্নকে জীবন কথার মধ্য দিয়ে তিনি সংবেদনশীল অনূভবে নতুন প্রজন্মের কাছে উপলব্দি করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি এতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।
হুমায়ুন আহমেদ জীবনের শুরুতে বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন্ । তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে ও শংখনীল কারাগার’ উপন্যাসে মধ্যবিও জীবনের গভীরতর বেদনাকে গল্পের বুননে এমন চিরচেনা চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটিয়ে সৃষ্টি করেছেন তাতে পাঠককে সন্মোহনী শক্তিতে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে। জীবনের যাদু বাস্তবতা, সামাজিক জীবনের ভেতরের জটিলতাকে নিজস্ব জগতের রহস্যময়তার উপস্থাপনায় সাহিত্য বাঙময় করে তুলেছেন। তাইতো উপন্যাস, নাাটক, চলচ্চিত্র, ছোটগল্প প্রভৃতি নানা শাখায় তার অবাধ বিচরণ তার গল্পে, উপন্যাসে কল্পনা বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে তিনি গল্পে এনেছেন নিঁখুত জীবন শৈলীর রুপায়ণ। নিজের রচনাকে জনপ্রিয় করে তোলার কলা-কৌশল হুমায়ুন আহমেদ বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করেছিলেন। নন্দিত নরকের কাহিনি গড়ে উঠেছিলো মধ্যবিও জীবনের সুখ-দু:খ গাথা এক কাহিনিতে। সাবলীল ও সহজবোধ্য ভাষার কিছুটা হিউমার , জীবনের প্রচলিত আবেগ, লড়াই,ভালোলাগা-মন্দলাগা ছাড়াও গল্পের কাহিনিতে এমন কিছু চিরচেনা নাটকীয় মূর্হুতকে তুলে আনা হয়েছে যা পাঠ করলে পাঠককে অনেক দূর নিয়ে যাবে। ‘নন্দিত নরক উপন্যাসের কাহিনি এগিয়েছে মধ্যবিও এক পরিবারকে কেন্দ্র করে। যে পরিবারের বাসিন্দা রাবেয়া ,খোকা, মন্টু, রুনু, ও বাবা-মা। এছাড়াও এই পরিবারের আরেকটি চরিত্র কাকা। এই সকল চরিত্রের সুথ-দু:খ নিয়ে উপন্যাসের কাহিনিতে সাবলীল সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন হুমায়ুন আহমেদ। এই উপন্যাসের পথ ধরে হুমায়ুন আহমেদ তার বেশীরভাগ উপন্যাসে মধ্যবিওের স্বপ্নকে চিত্রিত করেছেন ফলে বাস্তবতা থেকে সরে এসে পাঠক তার নিজস্ব জগত উপন্যাসে খুঁজে পেয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য আর একটি উপন্যাস মধ্যাহ। মধ্যাহ উপন্যাসের কাহিনি শুরু হয়েছে ১৯০৫ সালের প্রোপট নিয়ে। ভারতবর্ষে বঙ্গভংঙ্গের তোড়জোড়[ । লর্ড কার্জনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে হিন্দু সমাজ। ঢাকা রিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্টার বিরোধিতা করছে তারা। জায়গায় জায়গায় হিন্দু- মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়েছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ হিন্দু- মসলিম বিরোধ ঠেকাতে রাখি বন্ধনের আয়োজন করছেন। হুমায়ুন আহমেদ এমনি এক কাহিনি বর্ণনার পাশাপাশি সংযুক্ত করেছেন ইতিহাসের সব তথ্য। এছাড়াও বিগত শতাব্দির প্রথম দিকে হিন্দু সমাজের কঠোর বর্ণ প্রথার কথা আছে উপন্যাসে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের বর্ণ ও পেশার মানুষের আনাগোনা উপন্যাসটিকে অর্থবহ করে তুলেছে।
হুমায়ুন আহমদেও আরেকটি চমকপ্রদ ঐতিহাসিক শেষ উপন্যাস ‘দেয়াল ’। এটি রাজনৈতিক উপন্যাস। একাওুরের পটভুমিতে মন ছুঁয়ে যাওয়া উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প” যেমন লিখেছেন তেমনিভাবে ইতিহাসের উপাদান নিয়ে উপন্যাসে ইতিহাসকে ফুটিয়ে তুলতে বিশ্বস্থ থেকেছেন দেয়াল উপন্যাসে। ইতিহাস আশ্রিত করে পাত্র-পাত্রির সন্নিবেশ ঘটিয়ে নিজের সফলতায় তিনি আখ্যান তৈরি করে গল্প কথকের ভুমিকায় সত্য গুলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টের ভয়াবহ নির্মমতার মধ্য দিয়ে যে আলো দেখেছেন তাতে রঙ ছড়িয়ে ইতিহাসকে দেয়াল বন্দী করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এখানেই তার সার্থকতা। শুধু উপন্যাসে নয় গল্পেও বহুমাত্রিকতার সম্ভাবনা দেখেছেন হুমায়ুন আহমেদ। বাংলা সাহিত্য অদ্ভুত গল্প, ভৌতিক গল্প, অতি প্রাকৃত গল্প, ইত্যাদি শিরেনামে যে গল্প গুলো লিখেছেন তা বাংলা সাহিত্য নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। মধ্যবিও জীবনের হাসি-কান্না ,নানান জটিলতাকে উপলব্দি করে স্পর্শকাতর বেদনাগুলোকে ফুটিয়ে তুলতে তার জুড়ি নেই। সেই প্রতিভার কারণে তিনি বাংলা সাহিত্য জনপ্রিয়তার আসনে অসীন হয়ে আছেন। একাধারে কালজয়ী কথাকার অন্যদিকে নন্দিত নাট্য নির্মাতা তিনি। একর পর এক সৃষ্টি করেছেন চম্যকার সব গল্প, উপন্যাস, নাটক ও চলচ্চিত্র। আমাদের তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধভিওিক যে সকল চলচ্চিত্র দেখেছে তার মাঝে নি:সন্দেহে প্রথম দিকে থাকবে হুমায়ুন আহমদের ‘আগুনের পরশমনি”, শ্যামল ছায়া ,শ্রাবণ মেঘের দিন। টেলিভিশনের জন্য জনপ্রিয় নাটক লেখার পর হুমায়ুন আহমদ ১৯৯০ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দেন। আগুনের পরশমণি মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালে, ২০০০ সালে শ্রাবণ মেঘের দিন, দুইদুয়ারি, ২০০৩ সালে চন্দ্রকথা ও অন্যান্য চলচ্চিত্র। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পটভুমিতে নির্মাণ করেন শ্যামল ছায়া, ২০০৮ সালে আমার আছে জল, ২০০১২ সালে তার পরিচালনায় সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ তার মৃত্যুও পরে মুক্তি লাভ করে। ১৯৮০ দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে নাটক রচনা শুরু করেন। বেশকটি ধারাবাহিক নাটক তাকে রাতারাতি জনপ্রিয় নাট্যকার হিসাবে পরিচিত করে তোল্ েযেমন- কোথাও কেউ নেই, বহুব্রীহি, অয়োময়, এই সব দিন রাত্রি, মেঘ বলেছে যাব যাব, নীতু তোমাকে ভালোবাসি, রুপালি নত্র, রুমালি, আজ রবিবার, আজ জরির বিয়ে, অন্যতম। তার মধ্যে ধারবাহিক নাটক কোথাও কেউ নেই এর বাকের ভাইয়ের চরিত্রের জনপ্রিয়তা সব নাটকের জনপ্রিয়তাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। অন্যদিকে নাটক ও চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে তিনি অনেক জনপ্রিয় গান ও রচনা করেছেন তেমনিভাবে অনেক নতুন শিল্পীদের দিয়ে গান তৈরি করে তাদেরও জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। তার জনপ্রিয় গান গুলো মধ্য অন্যতম – ও আমার উড়াল পঙ্খিরে, একটা ছিলো সোনার কন্যা, বর্ষার প্রথম দিনে, চাঁদনি পসর রাইতেআমার,ঢোল বাজ দোতারা বাজে, আজই আমার কুসুম রাণীর ,আমার আছে জল, বাদল দিনে মনে পড়ে, যদি মন কান্দে চলে এসো, প্রভৃতি। নিজের লেখা গানকে জনপ্রিয় করে তোলার কলা- কৌশল তিনি জানতেন। গানকে চলচ্চিত্রকে সংযোজনের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রকে জনপ্রিয় করে তোলার নতুন কৌশল যেনো তার ছিলো জানা।
আজ হুমায়ুন আাহমেদ মৃত্যুতে কর্মের মহিমাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাইতো বৃষ্টি¯œাত শ্রাবণের মেঘের বৃষ্টির ছোঁয়ায় তিনি শেষ শয্যায় শায়িত হয়েছিলেন নিজের গড়া নুহাশ পল্লীতে। আজ যে ভূবনে তিনি প্রবেশ করেছেন তা থেকে ফেরার কোন সম্ভাবনাই নেই । তবুও তার প্রতিভার স্পর্শে ও সৃষ্টিশীল মনন ও কর্মকান্ডের মাধ্যমে বহ গ্রন্থের জনক হিসাবে বাংলা কথাসাহিত্য সকল ভাষাভাষি মানুষের মাঝে সমাদৃত হয়েছেন সফল শিল্পের অসামান্য সৃষ্টিতে। কথাসাহিত্যের নন্দিত ¯্রষ্টা হুমায়ুন আহমেদ নিজস্ব ভুবনেই স্বতন্ত্র মহিমায় প্রজন্মেও পর প্রজন্ম বেঁচে থাকবেন এ বাংলায়।