আরিফ আহমেদ
বর্তমান বাংলাদেশের ইতিহাসে ছোটগল্পে বা উপন্যাসে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক অপরিহার্য একটি নাম। শুধু বাংলাদেশ নয়, বাংলাভাষা-অঞ্চলে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গেও মানুষের কাছেও তাঁর নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হচ্ছে। সেই ষাটের দশকের শুরু থেকে কেবল গল্প বুনে চলেছেন তিনি। কিংবা বলা যায় জীবন চলার পথের সমুদয় অভিজ্ঞতাকে গল্পের বা উপন্যাসের কাহিনী ও চরিত্রে জীবন্ত করে রেখেছেন তিনি। এট্ইা কি কেবল তাঁর পরিচয় বহন কওে নাকি আরো কিছু আছে? হ্যাঃ আছে, আছে বলেই তো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটেই তার বসত ভিটা গড়েছেন। শেষ সময়টা লেখা লেখিতে ডুবে থাকার জন্য চমৎকার সেই নিবাস। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শেষে অবসর জীবন এখন তাঁর লেখালেখিতেই কাটে।
প্রতিটি প্রগতিশীল সংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে রাজধানী থেকে দূরে থেকেও তিনি সামনের কাতারে অবস্থান করেছেন সবসময়। এমনকি ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির মতো সাহসী সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, জীবনের ঝুঁকি গ্রহণ করেছেন। তারপরেও লেখাটাকেই তিনি মুখ্য ভেবেছেন। সাহিত্যেেত্র অবদানকে সামনে এনে বিবেচনা করলেও তাঁর অন্য পরিচয়কে খাটো করে দেখার উপায় নেই কথাটা ড. তপন বাগচী বারবার বলেছেন হাসান আজিজুল হক সম্পর্কে তাঁর প্রায় সব লেখায়।
হাসান আজিজুল হক প্রথম উপন্যাসিক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন ২০০৬ সালে ‘আগুনপাখি’ নামের উপন্যাসের আত্মপ্রকাশ ঘটলে। যদিও তিনি সাহিত্যযাত্রা শুরু করেছিলেন উপন্যাস দিয়ে-ই। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘মাটি ও মানুষ’ অসম্পূর্ণ ও অপ্রকাশিত। এরপরে অনেকবার উপন্যাস লেখার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সম্পূর্ণ না করেই তিনি ছোটগল্পের দিকে ফিরে গেছেন। যাঁরা কথাসাহিত্যচর্চা করেন, তাঁরা প্রায় সকলেই উপন্যাস ও ছোটগল্প একই সঙ্গে লেখেন। এমন ঔপন্যাসিক নেই, যিনি ছোটগল্প লেখেন না। আবার এমন গল্পকার নেই, যিনি উপন্যাস লেখেননি। অবশ্য দু-একটি ব্যতিক্রম হয়তো রয়েছ্ েকিন্তু তা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। হাসান আজিজুল হক এই ব্যতিক্রমীদেও দলে ছিলেন। যিনি কেবল ছোটগল্প লিখেই তাঁর কথাসাহিত্যচর্চার ধারা পূর্ণ করে চলেছিলেন। একবারে পরিণত বয়সে পৌঁছে তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে আবির্ভূত হলেন।
৬৭ বছর বয়সে তিনি লিখলেন পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস আগুনপাখী। আর একটি উপন্যাস লিখেই তিনি হইচই ফেলে দিলেন বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে। সন্ধানী প্রকাশনী চার মাসের মধ্যে বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশ করে। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকা একে বর্ষসেরা গ্রন্থের স্বীকৃতি দিল। দুই বছর পরে ২০০৮ সালে এই বই-ই এনে দিল আনন্দ পুরস্কার। আনন্দবাজার কতৃপক্ষ তাকে পুরস্কিত করলেও বাংলাদেশে দৈনিক প্রথম আলো ছাড়া তখনো আর কেউ তাঁর মর্ম অনুধাবন করতে শুরু করেনি। যদিও এখন প্রায সব পত্রিকাতেই তাঁর লেখার প্রকাশ দেখা যায়। তবে ঠিকমত সম্মানী না দেয়ার অভিযোগ সয়ং লেখকের।
এই লেখাটি তৈরির মাত্র-ই চারদিন আগে সাহিত্য বাজার পত্রিকাটি এখন অনলাইন পত্রিকা হয়েছে, এ তথ্য তাকে জানাতে গেলে তিনি বলেন, আরিফ, চেষ্টা কর, ছোট বড় সব লেখককেই তার ভালো রেখাটির জন্য সম্মানী দিতে। তোমার পত্রিকার উপদেষ্টা হিসেবে এাঁই আমার তোমার নিকট প্রথম পরামর্শ। অনেক বড় পত্রিকা যেটা ঠিকমত দিচ্ছে না। তুমি অন্তত এাঁ শুরু কর।
ঐাইহোক, ‘আগুনপাখি’ কলকাতায় বা ভরতে পুরস্কৃত হওয়ার পরে আমাদেও দেশের পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় হাসান আজিজুল হককে নিয়ে বেশ হৈ চৈ পড়ে গেল। এই সম্মান যে কেবল হাসান আজিজুল হকের নয়, প্রতিটি বাঙালি, মিডিয়াজগত দেরীতে হলেও সেই সত্য অনুভব করেছে।
আনন্দ বাজার পুরস্কার প্রসঙ্গে লোক গবেষক ড. তপন বাগচী জানান, বাংলাদেশে ইতিপূর্বে লেখিকা তসলিমা নাসরিন দুইবার আনন্দ পুরস্কার পায়, প্রতিবারই মিডিয়ায় সংবাদ এসেছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যখন এই পুরস্কারটি পান, একটু কম হলেও তখন মিডিয়ার সরবতা ল করা গেছে। কিন্তু এর বাইরে, আমার জানামতে আরও তিনবার বাংলাদেশের চারজনের হাতে আনন্দ পুরস্কার এসেছে। আমি মিডিয়ার অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, এই তথ্য তাদের অনেকরই অজানা। এমনি যাঁরা সহিত্যে খবর রাখেন তাঁরা আনন্দপুরস্কারের প্রাপক হিসেবে শামসুর রাহমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক ও তসলিমা নাসরিনের নাম জানে। কিন্তু বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও মোগল সংস্কৃতি’ গ্রন্থের জন্য আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন, এই তথ্য আমরা অনেকেই মনে রাখিনি। কিংবা ‘শব্দরূপ’ নামের একটি সংগঠন ‘ঐতিহ্যের অঙ্গীকার’ নামে বাংলা কবিতার ধারাবাহিক ক্যাসেটবদ্ধ করার জন্য আনন্দপুরস্কার পেয়েছেন, সেটিও আমরা মানে রাখিনি। ‘শব্দরূপ’ কর্ণধার ও মূল পরিকল্পক অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস এই পুরস্কার লাভ করেন। আর এই সংগঠনের সভাপতি হিসেবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানও যৌথভাবে এই পুরস্কারে সম্মানিত হন।
ড. তপন বাগচী আরো বলেন, এাঁ তদবিরের যুগ, তাই হাসান আজিজুল হককে পুরস্কার দিতে আমাদেও এতো দেরি হল। তাকে আরও আগে-ই এই পুরস্কার দেয়া যেত। ‘প্রথম-আলো পুরস্কার’ কিংবা আনন্দ পুরস্কার না পেলেও হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ বাংলাসাহিত্যের অনন্য সৃষ্টি হিসেবে টিকে থাকার যোগ্যতা রাখে।
প্রসঙ্গক্রমে ‘আগুনপাখি’র কথা কিছু বলতেই হয়। শ্রদ্ধেয় কবি আবুবকর সিদ্দিকে মতে, ‘জাহানারা নওশীনের কাছ থেকে বইটি পেয়েছি। একবসায় পড়ে শেষ করেছি। বাংলাদেশের এই মানের উপন্যাস আমি আমাদের কালে আর পড়িনি। হাসান যে কত বড় কাজ করেছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। গত দুই-তিন দশকে এত ভালো লেখা আমি পড়িনি।’
ড. তপন বাগচী বইটি সম্পর্কে এক লেখায় বলছেন, বছর দুই আগে বন্ধু আরিফ আহমেদ বইটি নিয়ে আমাকে কিছু লিখতে অনুরোধ করলো। বইটি তখনই পড়া হয়। কেবল পড়া নয়, বইটি আমি দারুণভাবে উদ্যাপন করি। বলার ভাষাটা একটু অচেনা বলে ঢুকতে একটু সময় লাগে। কিন্তু একবার ঢুকে পড়লে বোঝা যায়, আঞ্চলিক উচ্চারণের শক্তি কত প্রবল হতে পাওে ! উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংকট তো কেবল শহুরে ‘বাবু’দের নয়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাধারণ সদস্যেরও। এটি কেবল পুরষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষ-প্রতিভুর নয়, ‘অবলা’ নারীরও। গ্রামের একজন অশিতিা সাধারণ নারীর ভাবনা তাঁর নিজের মুখের ভাষায় না হলে কি পুরোটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ঊঠত? মানভাষা ব্যবহারে তার সৌন্দর্য অনেকটাই ম্লান হয়ে পড়ত। তাই হাসান আজিজুল হক আঞ্চলিক ভাষায় গ্রামীণ নারীর জবানীতে এই উপন্যাস লিখতে অগ্রসর হলেন।
দেশভাগের পটভূমিতে রচিত ‘আগুনপাখি’ অনেক কারণেই বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশ-কাল-সমাজের কথা উপন্যাসে থাকে। রাঢ়বঙ্গের মুসলিম সমাজের চিত্র এঁকেছেন লেখক। হাসান আজিজুল হকের শৈশব-কৈশোরের বাস্তব অভিজ্ঞতা এই উপন্যাসের ভিত্তি তৈরি করেছে। একটি পরিবারের উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে তিনি গোটা মুসলিম সমাজের উত্থান-পতনের চিত্র এঁকেছেন। দেশব্যাপী হানাহনির খবরও বাদ যায়নি তাঁর কলম থেকে।
এই উপন্যাসের ধরন কিছুটা ভিন্ন
প্রতি পর্বে রয়েছে পৃথক শিরোনাম। ভাই কাঁকালে পুঁটুলি হলো শিরোনাম দিয়ে এ উপন্যাসের আত্মকথন শুরু হয়েছে। এরপর ক্রমান্বয়ে শিরোনাম হয়েছে- “ বিছানা ছেড়ে একদিন আর উঠলেন না, আমার বিয়ের ফুল ফুটল,মাটির রাজবাড়িতে আমার আদর, বড় সোংসারে থই মেলেনা, আমার একটি খোঁকা হলো, সোয়ামি সোংসার নিয়ে আমার খুব গরব হলো, সোংসার সুখ-দুখের দুই সুতোয় বোনা বই-তো লয়, ও মা-মাগো- কতদিন যাই নাই-এইবার বাপের বাড়ি যাব, ছেলে চলে গেল শহরে, সব গোলমাল লেগে যেচে, খোঁকা ভালো আছে তবে সোময়টো খারাপ, ছেলে আনো বাড়িতে-আর পড়তে হবে না, যা ভয় করেছিলাম তা-ই হলো-সান্নিপাতিক জ্বর, সারা জাহান খাঁ খাঁÑহায়রে শোধ তোলা, সোংসার কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না, কত লোকের কত বিচের-কতো বিধেন, পিথিমির র্পেজা আর কতো বাড়াবো, কি দিন এল-সারা দুনিয়ায় আগুন লাগল, আবার অ্যানেকদিন বাদে বাপের বাড়ি, গিন্নি বিছেনা নিলে-আর উঠলে না, আকাল আর যুদ্ধুর দুনিয়ায় কেউ বাঁচবে না, নোহ নবীর সোমায়ের কেয়ামত কি আবার এল, দুনিয়ায় আর থাকা লয়-গিন্নি দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল, সোংসার তাসের ঘর-তুমি রাখতে চাইলেই বা কি, ভাই ভাই-ঠাঁই ঠাঁই-সবাই পেথগন্ন হলো, এত খুন-এত লউ-মানুষ মানুষের কাছে আসছে খুন করার লেগে, আর কেউ নাই-এইবার আমি একা দিয়ে শেষ হয়েছে এই উপন্যাসের কথন,
কিছু উক্তি
যেমন, স্বামী যখন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন করার ইচ্ছে প্রকাশ করে, তখন স্ত্রী তাকে বলে, ‘তোমার বুজিন এ্যাকন ্যামতার প্রয়োজন? দ্যাশে কতো রকম হানাহানি হচে, তুমিই তো বলো, হিঁদু-মোসলমানে হানাহানি, বিটিশ তাড়ানোর লেগে হানাহানিÑসব জায়গায় হানাহানি। গাঁ-ঘরও বাদ যেচে না। এই হানাহানিতে তুমিও ঢুকবে? ্যামতার লেগে?’ (পৃ. ৭১)
এই উক্তির মধ্যে হানহানির দ্বান্দ্বিকতাও প্রকাশিত হয়েছে। হানাহানি মানে কখনো সম্প্রদায়িক দাঙ্গা, আবার হানাহানি মনে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। হানাহানির কলঙ্ক ও মহিমা একই সঙ্গে প্রকাশিত। কিন্তু গ্রামীণ নারীর ভাবনায়, সকল হানাহানিই মতার জন্যে, তাই এটি ভালো নয়। কিন্তু স্বামীর এতে দমে না গিয়ে নির্বাচন করার েেত্র নিজের ব্যাখ্যা হাজির করেÑ‘মতা পেলেই তবে কিছু করা যায়Ñ নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়া যায়, আবার দেশের কাজও করা যায়। মতা না পেলে কিছুই করা যায় না। নিজেরও না, পরেরও না।… তোমাকে বলি, যদি একটা নিজের কাজ করি, দশটা সমাজের কাজ করব।’ (পৃ. ৭২)
সংকট বেশি ঘনীভূত হয় দেশভাগের সময়ে। এই সময়ে যাঁরা অপশন নিয়ে দেশত্যাগ করেছেন, তাঁদের তীব্র মনোদ্বন্দ্বের কথা হাসান আজিজুল হক ভালো করেই জানেন। আর জানেন বলেই তাঁর মতো লোকের হাতে এত সুষ্ঠুভাবে প্রকাশিত হল। ভিটেমাটি বদল হলেও শান্তি আসে না। এই সত্যও উচ্চারিত হয়েছে উপন্যাসের ভেতরে। হিন্দুপ্রধান ভারতের মুসলমান অপশন নিয়ে মুসলিম প্রধান পাকিস্তানে অভিবাসী হয়েছে। আর পান্তরে মুসলিম প্রধান পাকিস্তানের হিন্দু গেছে হিন্দু প্রধান ভারতে। এই ঐতিহাসিক সত্যের ভেতরে যে আরো সূক্ষ্ম সত্য লুকিয়ে আছে, একজন সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টি দিয়ে লেখক তা তুলে এনেছেন। তাই গ্রামীণ নারীর উপলব্ধির প্রকাশ, ‘পানি কুনোদিন ওপরদিকে গড়ায় না। দাঙ্গা হাঙ্গামায় কই ই দেশের এ্যাকটো মোসলমানকে পাকিস্তানে যেতে দেখলম না। গেয়েছে কিনা আমি কি করে জানবে। ই এলাকায় তো দেখলম না। কিন্তুক বড়লোক অবস্তাপন্ন মোসলমানদের লেগে ভালো ঢল নেমেছে পাকিস্তানের দিকে। অ্যানেক মোসলমানই সিদিকে গড়িয়ে যেচে। আমার ছোট খোঁকাটিও একদিন গড়গড়িয়ে চলে গেল। ভালো হলো কি মন্দ হলো, সিকথা আমি বলতে পারব না, শুদু জানলম আমার সব খালি হলো, সাথে আর কাউকে পাব না। এই খালি সোংসারে একা বসে থাকব।’ (পৃ. ১৫১)
এই একা বসে থাকার দর্শনই এই উপন্যাসের শেষ উপজীব্য। সবাই দেশ ছেড়ে যায়। একজন নারী যায় না। সে দেশভাগের ভ্রান্ত রাজনীতির বিরুদ্ধে নিজের অজান্তেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। কেবলই নিজের জন্যে এই প্রতিবাদ। কেবলই বাস্তুভিটের টানে এই প্রতিবাদ। কেবলই অস্তিত্বের প্রয়োজনের এই প্রতিবাদী লড়াকু জীবনের পথে পা বাড়ায় গ্রামীণ এক নারী। স্বামী-সন্তান-সংসার ছেড়ে একাকী ভিটেমাটি আগলে রাখার মধ্যে যে প্রতিবাদী চেতনা, তা-ই এই উপন্যাসের মূল সুর।
নারীটি নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে বলে ওঠেÑ, ‘আমি আমাকে পাবার লেগেই এত কিছু ছেড়েছি। আমি জেদ করি নাই। কারুর কথার অবাধ্য হই নাই। আমি সবকিছু শুদু লিজে বুঝে নিতে চেয়েছি। আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না ক্যানে আলেদা একটা দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে যিখানে শুধু মোসলমান থাকবে কিন্তুক হিঁদু কেরেস্তানও আবার থাকতে পারবে। তাইলে আলেদা কিসের? আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটা আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটা আমার লয়।’ (পৃ. ১৫৮) কিন্তু এই উক্তির পরে কি এই নারীকে আর অজ্ঞ বলে মনে হয়? এই নারী হয়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রজ্ঞাদীপ্ত দেশপ্রেমী সচেতন মানুষ। কিন্তু দেশভাগের রাজনীতির শিকার এই পরিবারের সকলেই যখন দেশত্যাগের আয়োজন করছে, তখন সে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে বিপ্লবী এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রকাশ পায় তাঁর জীবনদর্শন, ‘আমার সোয়ামি গেলে আমি আর কি করব? আমি আর সোয়ামি তো একটো মানুষ নয়, আলেদা মানুষ। খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ, কিন্তুক আলেদা মানুষ।’ (পৃ. ১৫৮) মানুষ যে শেষপর্যন্ত একাÑএই আত্মোপলব্ধিতেই এই উপন্যাসের পরিসমাপ্তি। হাসান আজিজুল হক দেশভাগের পটভূমিতে যে আখ্যান রচনা করলেন, তাতে আমাদের উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসই নতুনভাবে ব্যাখ্যা পায়। আর এভাবেই ‘আগুনপাখি’ হয়ে ওঠে সময়ের মহান সৃষ্টি।
আমার উপলব্দি
আগুনপাখি বইটি হাতে নিয়ে পড়তে বসেই হোচট খেলাম। ভাই কাঁকালে পুঁটুলি হলো শিরোনামে এ উপন্যাসের প্রথমপর্ব শুরু। ্ই শিরোনামের মানে কি? কাঁকালে মানে কি? পুঁটুলি মানে কি? এতোগুলো প্রশ্ন নিয়ে কি এ বইটি আমার বোধগম্য হবে। তবুও পড়ার চেষ্টা করলাম। বুঝলাম কাঁকাল মানে কোল আর পুঁটুলি দিয়ে কোলের পুতুল বা হাল্কা ওজনের বোজাঁও বুঝানো যায়। অর্থাৎ উল্টরাঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার বলা যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আঞ্চলিকতায় যারা মরে, তারা কখনো মারা যায় না। অকূলে ভাসে না।
আঞ্চলিকতার সাথে শুদ্ধ চলতি ভাষার মিশ্রনটা আবার ানেকটাই খুলনার কালিগঞ্জ ও যশোর অঞ্চলের আঞ্চলিকতাকেও স্পর্শ করেছে। যে কারণে উপন্যাসটির ‘থই’ পাওয়া খুব কঠিন হয়ে গেছে। সাদারণ পাঠকের জন্য এাঁ বোঝা খুবই দূর্বিসহ। এ জন্যই হয়ত বইয়ের ফাপে আগেই লিখে দেয়া হয়েছে যে, এই সেই উপন্যাস যা মেধাবী পাঠককে দেশ-কাল-ইতিহাসের মুখোমুখি করে।
কাইয়ুম চেšধুরীর আঁকা প্রচ্ছদে ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ উপন্যাসটি প্রকাশ করে সন্ধানী প্রকাশনী।