২০১৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন বেলারুশের লেখক ও সাংবাদিক সভেতলানা আলেক্সান্দ্রোভনা আলেক্সিয়েভিচ ( Svetlana Alexandrovna Alexievich)। নামটির উচ্চারণ শুনলাম সভেতলানা অ্যালেক্সিয়িচ। কিন্তু লেখার সময় আমরা লিখছি সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ। সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ মূলত ইংরেজি ভাষাভাষীদের কাছে কম পরিচিত হলেও, তাঁর কণ্ঠস্বরটি সারাবিশ্বের নির্যাতিত, নিপিড়িত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষের নিদারুণ দুঃখকষ্টের একটি সামষ্টিক প্রতিচ্ছবি হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচিত। প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নির্যাতিত ও নিপিড়িত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, হতাশা ও গ্লানি এবং চেরনোবিল দুর্ঘটনায় নিপতিত অসহায় মানুষের আর্তনাদ থেকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসীতে নির্যাতিত আফগান মানুষের দুর্দশা ও দুঃখের বিষয় আলেক্সিয়েভিচের লেখার মূল উপজীব্য বিষয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত টেপরেকর্ডার হাতে নিয়ে তিনি গোটা সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে ঘুরে যুদ্ধে আহত ও নির্যাতিত সোভিয়েত নারীদের অসংখ্য সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন। সেই সব সাক্ষাৎকার থেকে ১০০ বাছাইকৃত সাক্ষাৎকার নিয়ে তিনি ১৯৮৫ সালে প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম বই ‘ বীরাঙ্গনাদের মুখ বা আনউয়োমেনলি ফেস অব ওয়ার (The Unwomanly Face of War)’।
এই বইটি তখন গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যাপক সাড়া জাগায়। বইটি তখন প্রায় দুই মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়। যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের একেবারে প্রান্তিক নারীর যুদ্ধে অংশগ্রহণের এবং যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ, নির্যাতিত, ধর্ষিত নারীর একেবারে ব্যক্তি পর্যায়ের এক নিভৃত দৃশ্যকে আলোড়িত করে। প্যারিস রিভিউতে আলেক্সিয়েভিচ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বইটিতে আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সামগ্রিক সোভিয়েত নারীদের কথা না বলে হাজার নারীদের একেবারে ব্যক্তি পর্যায়ের তিক্ত অভিজ্ঞতাকেই তুলে ধরেছি। আর সেই সংখ্যাটি হাজার হাজার। যে গল্পের কোনো শেষ নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জীবিত নারীদের আর তাদের শিশুদের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতাই এই বইতে সরাসরি তাদের মুখের ভাষায় স্থান পেয়েছে। যেখানে আমি নতুন করে কিছুই আরোপ করিনি। রুশ ভাষায় বইটির নাম ‘ উ ভয়নি জেনেস্কোয়ি লিকো (U vojny ne ženskoe lico)’।
১৯৪৮ সালের ৩১ মে ইউক্রেনের ইভানো ফ্রান্কোভস্ক শহরে সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় সভেতলানা আলেক্সান্দ্রোভনা আলেক্সিয়েভিচ। তাঁর বাবা ছিলেন একজন বেলারুশ আর মা ছিলেন ইউক্রেনিয়ান। বাবা সোভিয়েত সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেবার পর পরিবার নিয়ে তিনি মস্কো থেকে বেলারুশ চলে যান। সেখানে গিয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আর দু’জনেই সেই স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। স্কুল জীবন শেষ করে আলেক্সিয়েভিচ মিনস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় ভর্তি হন। পাশাপাশি তখন তিনিও বাবা-মায়ের সঙ্গে স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। এই সময়ে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত ও নির্যাতিত সোভিয়েত নারী ও শিশুদের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। ২৪ বছর বয়সে সাংবাদিকতায় গ্রাজুয়েশান শেষ করে তিনি ব্রেস্ট নামক একটি পত্রিকার চাকরি নিয়ে পোল্যান্ড সীমান্তে চলে যান।
পরে তিনি আবার মিনস্ক ফেরত আসেন এবং ‘সেলেজকায়া গেজেট (Sel’skaja Gazeta) পত্রিকায় চাকরি নেন। লেখার ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রার ফরমেট নিয়ে তিনি তাঁর সংগ্রহ করা সাক্ষাৎকারগুলোকে ‘কলেজ অব হিউম্যান ভয়েস’ রূপে সংকলন করেন। পরে যেটি ‘আনউয়োমেনলি ফেস অব ওয়ার (The Unwomanly Face of War)’ (রুশ ভাষায় ‘ উ ভয়নি জেনেস্কোয়ি লিকো (U vojny ne ženskoe lico)’ নামে ১৯৮৫ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৮ সালে বইটি ইংরেজিতে ‘The Unwomanly Face of War’ নামে প্রকাশিত হয়।
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ-এর দ্বিতীয় বই ‘শেষ সাক্ষি বা দ্য লাস্ট উইটনেসেস (The Last Witness)’। বইটিতে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেসব শিশুরা যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছে, তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের সাক্ষাৎকার নিয়েই যুদ্ধের সেই করুণ দৃশ্যকে বর্ণনা করছেন আলেক্সিয়েভিচ।
১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেনে ভয়াবহ চেরনোবিল পারমানিবক দুর্ঘটনা ঘটে। চেরনোবিল দুর্ঘটনায় যে অসংখ্য মানুষ ভয়ংকর তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়ে পঙ্গু হয়ে যান এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন, তাদের আর্তনাদকে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘চেরনোবিল আর্তনাদ (Voices from Chernobyl) বা রুশ ভাষায় চেরনবিলস্কায়া মোলিতভা (Černobyl’skaja molitva)-এ। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে। চেরনোবিল পারমানবিক কেন্দ্রে বয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে জীবিত আহত মানুষদের সাক্ষাৎকারগুলোকে তিনি এই বইতে স্থান দিয়েছেন। পারমানবিক দুর্ঘটনা যে কতটা ভয়ংকর এবং বংশানুক্রমে তার যে ভয়াবহ জটিল দুর্দশা ও দুঃখের স্মৃতি, তাকেই এই বইতে আলেক্সিভিচ অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় তুলে আনেন।
১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে অভিযান চালায়। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সেনারা রাশিয়ায় ফেরত যায়। দীর্ঘ দশ বছরে দূরবর্তী আফগানিস্তানে আফগান মানুষের যুদ্ধের স্মৃতি তথা সোভিয়েত সেনা কর্তৃক আফগানদের নির্যাতন, নিপিড়ন ও দুঃখ-কষ্টের যে আর্তনাদ, সেই করুণ ঘটনাই তিনি তুলে আনেন আলেক্সিয়েভিচ তাঁর ‘জিংকি বয়েস (Zinky Boys)’ রুশ ভাষায় যেটি ‘চিংকোভি মালসিকি (Cinkovye mal’čiki)’ নামে ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয়। ওই সময় তিনি আফগানিস্তান যুদ্ধের খবর সংগ্রহের জন্য কাবুলে অবস্থান করেন।
১৯৯১ সালে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নতুন রাশিয়ার নারীদের নতুন স্বপ্নের কথা তিনি লিখেছেন ‘পালাবদল সময়: রক্তিম ললনাদের ক্ষত (“Second-hand Time: The Demise of the Red (Wo)man”) যেটি রুশ ভাষায় ‘ ভরেমা সেকন্ড চেন্ড (Vremja second chènd) নামে এবং পরবর্তী সময়ে এটি ‘যোদ্ধা রমণীদের কথা বা ‘ভয়েস অব উটোপিয়া ‘”Voices of Utopia”) নামে ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সৈন্যদের নানান কিসিমের অভিজ্ঞতার যে বর্ণনা ও নোট রুশ নার্স ও লেখিকা সোফিয়া ফেদেরচেঙ্কো (১৮৮৮-১৯৫৯) তাঁর ডায়েরিতে টুকে রেখেছিলেন, সেই নোট থেকেই মূলত সেভেতলনা আলেক্সিয়েভিচ ব্যাপকভাবে উদ্ভুদ্ধ হয়েছিলেন। এছাড়া বেলারুশের বিশিষ্ট লেখক এলিস আদামোভিচ (১৯২৭-১৯৯৪) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর যেসব ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মাণ করেছেন, তা থেকেও আলেক্সিয়েভিচ নানাভাবে তথ্য সংগ্রহ করা ছাড়াও উদ্ভুদ্ধ হয়েছেন। আলেক্সিয়েভিচের প্রিয় লেখকও বেলারুশ লেখক এলিস আদামোভিচ। তাঁর বইগুলো যখন প্রকাশ পেতে থাকে তখন সোভিয়েত ইউনিয়নে তিনি সরকারিভাবে ব্যাপক তোপের মুখে পড়েন। আর ওই সময় তিনি রাশিয়ার বাইরে ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স ও সুইডেনে যাযাবর জীবনযাপন করেন।
সারাজীবন আলেক্সিয়েভিচ যুদ্ধ ও ব্যক্তি সৃষ্ট দুর্দশায় মানুষের ভেতরের আসল দুঃখ-কষ্ট, হতাশা, গ্লানি, নিপিড়ন ও নির্যাতনের খবর নিয়েছেন। পেশায় সাংবাদিক হিসেবে তিনি গোটা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইউরোপ চষে বেড়িয়েছেন। চেরনোবিল থেকে কাবুল পর্যন্ত যুদ্ধ ও পারমানবিক দুর্ঘটনায় আহতদের পাশে গিয়ে তিনি আহত মানুষের ভয়াবহ দুর্দশাকে তাদের জবানিতে রেকর্ড করেছেন। যুদ্ধাহতদের সাক্ষ্যপ্রমাণ ও স্মৃতি সংগ্রহ করেছেন। আর কোনোরকম ভূমিকা ছাড়াই সেগুলো সরাসরি যুদ্ধাহত সেসব বিচ্ছিন্ন মানুষের মৌলিক কণ্ঠস্বরে তুলে ধরেছেন। যা রুশ সাহিত্যে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সাহিত্য বিচারে আলেক্সিয়েভিচ বেলারুশ লেখক এলিচ আদিমোভিচ দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত।
নির্যাতিত-নিপিড়িত মানুষের মুখের ভাষায় সরাসরি তাঁর লেখনির এমন একটা তেজস্বিভাব রয়েছে, যা এমনকি বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাসেঙ্কোকে পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে বাধ্য করেছিল। যে কারণে ২০০০ সালে তিনি বেলারুশ থেকে জোরপূর্বক বিতারিত হন। তখন তিনি ফ্রান্সের প্যারিস ও জার্মানির গুটেনবার্গ ও বার্লিনে বসবাস করেন। আলেক্সান্ডার লুকাসেঙ্কোর’র পতনের পর ২০১১ সালে তিনি নিজের দেশ বেলারুশে ফেরত আসেন।
সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সেক্রেটারি সারা দানিউস (Sara Danius) বলেন, সেভেতলনা আলেক্সিয়েভিচ-এর লেখনি এতই শক্তিশালী যা সাধারণ নির্যাতিত মানুষের করুণ আর্তনাদকে অত্যন্ত মর্মস্পর্শীরূপে একেবারে আত্মার গভীরে এক স্থায়ী অনুরণন ঘটায়। যা পাঠক মাত্রই তাকে আকৃষ্ট করতে বাধ্য। আলেক্সিয়েভিচ-এর লেখনি স্টাইলকে দানিউস ‘পোলিফোনিক রাইটিং’ বলে অভিহিত করেন।
সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ তাঁর নিজের ব্লগে লিখেছেন, তিনি বেলারুশ লেখক এলিচ আদিমোভিচ-এর উপন্যাস ও ডকুমেন্টারি ফিল্ম থেকে গভীরভাবে অনুপ্রেরণা ও উৎসাহবোধ করেন। বিশেষ করে আদিমোভিচ-এর উপন্যাস সমগ্র, উপন্যাস ত্রয়ী, ও তাঁর উপন্যাসের বিভিন্ন নজরকাড়া এভিডেন্স তাঁকে সর্বদা দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। এছাড়া সাধারণ মানুষের নিজস্ব ঢঙ্গে কথা বলার যে ভঙ্গি, সেই রূপটি তিনি সাহিত্যে কোনো ধরনের আরোপিত ছাড়াই সরাসরি প্রয়োগে বিশ্বাস করেন। যাকে তিনি বলতে চেয়েছেন ‘এপিক-কোরাস’। যার একটি নিজস্ব শক্তিশালী আবেদন রয়েছে। সেই আবেদনটি তিনি লেখার কোথাও কোনোভাবেই খর্ব করেননি।
প্যারিস রিভিউতে এক সাক্ষাৎকারে আলেক্সিয়েভিচ বলেন, আমি এমন একটি লেখ্য ভাষা আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছি, যেটি সাধারণ মানুষের ঠিক কথপোকথনের অনুরূপ। যেখানে কোনো আলাদা ঢঙ যুক্ত করাটা আমি একদম পছন্দ করি না। বরং একেবারে অবিকল মানুষের মুখের ভাষাটি তুলে আনার প্রাণান্ত চেষ্টা করি। যে ভঙ্গিতে যে কায়দা ও আচরণ অনুসরণ করে সাধারণ মানুষ সবসময় কথা বলে, আমার লেখার ভাষাটি অনেকটা তার কাছাকাছি। যা বুঝতে কোনো পাঠকের একদম কষ্ট হবার কথা নয়।
সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ এর ‘চেরনোবিল আর্তনাদ বা ভয়েস ফ্রম চেরনোবিল’ এর কাহিনী অবলম্বনে আইরিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা জুয়ানিতা উইলসন ‘দ্য ডোর’ নামে ১৬ মিনিট ৪৯ সেকেন্ড-এর একটি শর্ট ফিল্ম নির্মাণ করেছেন। ২০১০ সালে যেটি অস্কার নমিনেশান পায়। ছবিটি চেরনোবিল দুর্ঘটনার তেজস্ক্রিয়তায় নিহত নিকোলাই কুলাজিন ও তার সাত বছরের নিহত কন্যাকে উৎসর্গ করা হয়। (সামহোয়ারইন ব্লগ থেকে গৃহিত)