সাহিত্যের নারী প্রতীক কবি ও সাহিত্যিক
সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় পুরুষ-নারীর অবদান অনস্বীকার্য। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গবেষণা, সমালোচনা – কোথায় নেই নারীর স্পর্শ। সর্বত্র বর্তমান। অন্যান্য বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর আসন প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করতে পারি। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, স্থপতি, বৈমানিক, প্রশাসনের সর্বোচ্চ ক্ষেত্র থেকে সর্বনিম্ন ক্ষেত্র পর্যন্ত নারীর ভূমিকা অনবদ্যভাবে বিদ্যমান। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, দেশনীতি – কোন পর্যায়ে নারী তাঁর উচ্চারণে, আন্দোলনে সচকিত নন। সাহিত্য, সংস্কৃতির জগতে আমাদের নারী প্রতিনিধিরা উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আছেন। সাংবাদিকতার জগতেও নারীরা পিছিয়ে নেই। এসব প্রতিটি জায়গাতেই নারী তাঁর নিজস্ব যোগ্যতা, দক্ষতা ও আন্তরিক পরিশ্রম দিয়ে অর্জন করেছেন। নারী সমাজের কল্যাণে পুরুষরা দু’হাত বাড়িয়ে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন প্রয়োজনে।
এই প্রয়োজন শব্দটি বিশেষভাবে বিবেচ্য। আমাদের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং মেধা, মনন ও প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা পিছিয়ে আছেন আমাদের গ্রামীণ সমাজে। এর জন্যে অবশ্য গ্রাম্য কুসংস্কার এবং ধর্মীয় অনুশাসন অনেকখানি দায়ী। আমাদের সেই সব প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়েই আলোর পথে এগোতে হয়।
এবারে প্রসঙ্গান্তরে আসি। দেশে যখন প্রধানমন্ত্রী নারী। স্পিকার নারী। বিরোধী নেত্রী নারী। তখন অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছেন – দেশ যখন নারী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন; সেখানে আলাদা করে নারী ভাবনা কেন? সাহিত্যের পাতার পাশাপাশি নারী পাতা কেন? নারী-সাময়িকী কেন? অপরাজিতা, অঙ্গনা, শংখমালা, মহিলা আসর, সুরঞ্জনা, ঘরোয়া (আরো অনেক থাকতে পারে) ইত্যাদি নারী পাতার সঙ্গে সঙ্গে ‘অনন্যা’ সাহিত্য সাময়িকীর প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এসব পাতার কাজের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত থাকেন তারা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন।
প্রতিটি দৈনন্দিন খবরের কাগজের মাঝে একটি নির্দিষ্ট দিনে সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশিত হয়। সেখানে কিছু কিছু নারী সাহিত্যিকের নাম আমরা লক্ষ্য করি। তবে যেদিন নারী-ভাবনার সাহিত্য পাতাগুলো ভিন্ন ভিন্ন ধারায় প্রকাশিত হয় তখন এদেশের বেশকিছু নারী সমাজ তাতে নিজেদের ভাবনা-চিন্তা, সমস্যা ইত্যাদির প্রকাশ ঘটাতে পারে। এবং সেটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন।
নারীদের অনেক প্রতিকূলতা থাকে। বিশেষ করে সংসার-ধর্ম, স্বামী-সন্তান সামলিয়ে যে কোন ধরনের সৃষ্টিশীল রচনা নিয়ে তারা সবসময় সব পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন না। নারীদের জন্যে আলাদা যে পাতা থাকে সেখানে তাঁরা পৌঁছাতে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কবিতা, গল্প, সাহিত্যবিষয়ক মূল্যায়ন নিয়ে তাঁরা নিজের কথা নিজের মতো করে প্রকাশের পথে সহায়তা পেতে পারেন। হৃদয়ের ফল্গুধারাকে উৎসাহিত করার জন্যে একটু পা রাখার প্রয়োজন যেখানে কিছুটা অবাধ গতি থাকবে পথচলার জন্যে। আমি মনে করি, এতে নারী তাঁর সমুদয় অস্তিত্ব নিয়ে এগিয়ে চলার সাহস পাবে। এই সাহসটুকু নারী তাঁর নিজের ভেতর থেকে তৈরি করে পাশাপাশি জনগণের একান্তে এগিয়ে যেতে পারে। সাহিত্যে নারী তাঁর পদচারণা সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত করতে পারে। বলতে পারে। বলতে পারে – ‘আমায় একটু সহযোগিতা দিন, আমি সবটা সমন্বয় করতে পারবো।’
আমি ‘অনন্যা’ সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেছি এ শুধু আমার অর্জন নয় – সকল নারী সমাজের উচ্চারণের অর্জন। এই যে সাহিত্য পুরস্কার প্রথা ‘অনন্যা’ প্রচলিত করেছে এটি সাহিত্য অঙ্গনে নারী সমাজের, নারী কবি, নারী সাহিত্যিক, নারী প্রাবন্ধিক সকল ক্ষেত্রেই একটি মাইলফলক। নারী তাঁর লেখার হাত শাণিত লেখনী দিয়ে প্রাচুর্যপূর্ণ করে তোলে সাহিত্য পাতার প্রতিটি ক্ষেত্রে। লিখবার জন্যে ভেতর থেকে তাগিদ অনুভব করে। জীবন বোধের ধারাপাতগুলো নিজস্ব ঘরানায় অবস্থান করিয়ে নিজেকে সক্রিয় করে তোলে। ‘অনন্যা’ একটি অসাধারণ প্রেক্ষাপট। বছরের পর বছর এগিয়ে চলেছে তাদের নারীমুখী কর্মকাণ্ড নিয়ে। ‘অনন্যা’কে আমি স্যালুট জানাই।
আমাদের দেশের সাহিত্য ঘরানায় নারী সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হয়ে যারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে রিজিয়া রহমান, রাবেয়া খাতুন, সেলিনা হোসেন, নাসরীন জাহান, রুবী রহমান, নুরজাহান বেগম, ঝর্না রহমান, মালেকা বেগমসহ আরো অনেক কবি-সাহিত্যিক যার যার নিজস্ব উচ্চারণে এখনো প্রকম্পিত আছেন। এরা সবাই নারী প্রগতির এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছেন।
নারী সম্পৃক্ত অনেক কবি এবং সাহিত্যিক তাদের পারিপাশ্বর্িকতা থেকে জীবনের দর্পণ থেকে তুলে এনেছেন তাদের লেখনী সুধা। অনেকে নামের মধ্যে বেশ কিছু নাম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন এবং রাখছেন। প্রথমে কয়েকজন কবি যেমন – দিলারা হাফিজ, নাহার ফরিদ খান, ঝর্ণা রহমান, শিরীন রহমান, রিফাত আরা শাহানা, নাসরীন নঈম, অঞ্জনা সাহা, সুমী সিকান্দারসহ আরো বেশ কিছু নবীন – তরুণ (সবার নাম উচ্চারণ করতে মনের নাগাল পাচ্ছি না – ক্ষমা করবেন) কবি তাদের শব্দভান্ডার সাজিয়ে পাঠকের হৃদয়ে আসন করে নিয়েছেন। গল্প উপন্যাসের সঙ্গে সংযুক্ত কয়েকটি নাম যেমন – অদিতি রহমান, পাপড়ি রহমান, শাহনাজ মুন্নীর মতো আরো অনেক নবীন এবং তরুণেরা সদর্পে তাদের জায়গা করে নিচ্ছেন (এখানেও বলা ভালো অনেক অনেক নাম এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না – ক্ষমা করবেন) – আগামীতে এদের অস্বীকার করা যাবে না।
সাহিত্যের আয়নায় পোড় খাওয়া জীবনযুদ্ধ আমাদের প্রতিটি নিত্যদিনের সহচর। গ্রামাঞ্চলে এখনো অনেক নারী উনুনের আঁচে তাদের শিল্প বোধকে জাগ্রত করেন। কেউ লেখেন সেই আলোতে কেউ পড়েন। ঈদ সংখ্যার দু’একটি বিশেষ প্রকাশনা তাঁদের হাতে গিয়ে পৌঁছালে আমি জানি তারা গ্রোগ্রাসে সেগুলো গিলে ফেলেন। আমি তাদের প্রশংসা করি।
সংবাদের সাহিত্য পাতা উত্তরাধিকার সূত্র ধরে আজ অবধি বলিষ্ঠ নান্দনিকতার পরিবেশনে সমৃদ্ধ হয়ে আছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এর পাতায় পাতায় সাহিত্য-উচ্চারণ পর্ব রেখে যাচ্ছেন। অন্যান্য পত্র-পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন সর্বত্রই নারী-পুরুষের অবস্থান আছে। তবে বিশেষভাবে নারী-পাতাগুলো নারীদের এগিয়ে চলার পথকে সুদৃঢ় করেছে। মফস্বল থেকে ডাকে আসা অনেক নারী লেখক-কবি এসব পাতায় স্থান করে নিতে পেরেছেন। সংবাদের সঙ্গে যেসব নারী তাদের রচনা প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং আছেন তাঁরা জানেন সংবাদে অত্যন্ত মূল্যবান নারী পাতা সাময়িকী সপ্তাহে একদিন প্রকাশ পায়। এবং যেখানে লিখতে পারার সুযোগ পেয়ে নারী তাঁর চিন্তা-চেতনাকে সমৃদ্ধ করতে পারে।
আমি নরী সাময়িকী পাতাগুলোকে অসম্ভব মূল্যায়ন করি। আমি চাই দেশে নারী লেখক এবং কবি তৈরি করতে এসব পাতার বিশেষ অবদান সব সময়ই থাকবে। ‘অনন্যা’ সাহিত্য পত্রিকার মতো আরো কিছু কিছু পত্রিকা অনন্য সাহস নিয়ে এভাবে আসবেন – নারী ভালোবাসায় নিজেদের নিবেদন করবেন সেটাই আমি আশা করি।