১১ অক্টোবর, রবিবার। ময়মনসিংহ শহরের সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনে ছিল শোকের ছায়া। এদিন ফেসবুক জুড়েও ছিল ইয়াজদানী কোরাইশী, সজল কোরায়শী, কানিজ গোফরান কোরাইশীদের শোকার্ত লেখনী। অতঃপর বন্ধু স্বজন নূর মোহাম্মদ নুরু তুলে ধরলেন অধ্যাপক গোলাম সামদানী কোরায়শীর জীবন চরিত।
গোলাম সামদানী কোরায়শী যিনি অধ্যাপক গোলাম সামদানী কোরায়শী নামে সুপরিচিত ছিলেন। গোলাম সামদানী কোরায়শী বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট সহিত্যিক, সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ, গবেষক, অনুবাদক এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা আধুনিক শিক্ষায় সর্বোচ্চ শিক্ষিত মানুষ ছিলেন গোলাম সামদানী কোরায়শী। স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত জবরদস্ত মাওলানা গোলাম সামদানী ছিলেন চিন্তাজগতের এক অসামান্য মানুষ। নীতি-নৈতিকতা এবং একটি আদর্শ মানব দর্শনেরও অধিকারী ছিলেন গোলাম সামদানী কোরায়শী। কেদারনাথ থেকে শুরু করে আবুল মনসুর, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, সৈয়দ আব্দুল সুলতান, সৈয়দ বদরুদ্দিন প্রমুখ সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বের শূন্যতা পূরণ করেছিলেন গোলাম সামদানী কোরায়শী। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সপ্তগুরু ছিলেন যথাক্রমে সক্রেটিস, শ্রীকৃষ্ণ, গৌতম বুদ্ধ, যিশুখ্রিস্ট, হজরত মুহাম্মদ (সা.), কার্ল মার্কস এবং নিজের পিতা। ‘বুদ্ধির মুক্তির বিকল্প নেই’ এমন বাণী প্রচার করে ঊনবিংশ শতকের রেনেসাঁ পুরুষদের যথার্থ উত্তরাধিকার হতে পেরেছিলেন গোলাম সামদানী কোরায়শী। অথচ দুঃখের বিষয়, আমরা তাঁকে ভুলে যেতে বসেছি। আজ এই গুণী ব্যক্তিত্বের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯১ সালের আজকের দিনে তিনি ময়মনসিংহের আকুয়া মৃত্যুবরণ করেন। সহিত্যিক, সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ গোলাম সামদানী কোরায়শীর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
গোলাম সামদানী কোরায়শী ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ এপ্রিল বর্তমান নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়ার কাউরাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৌলভী বাবু শেখ আবু আছল মোঃ আঃ করিম কোরায়শী এবং মাতার নাম আলতাফুন্নেসা। তাঁর পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার বীর আহাম্মদপুর। গোলাম সামদানীর কোরায়শীর পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর ঘাটুরকোণা প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাঠালিয়া মধ্য ইংরেজী স্কুল থেকে ১৯৩৫-৩৬ সালে প্রাইমারী পড়াশুনা শেষ করেন। এরপর ১৯৩৭–৪১ সাল পর্যন্ত ভর্তি হন নেত্রকোণার চন্দ্রনাথ হাই স্কুল ও বীর আহাম্মদপুর হাই স্কুলে। এরপর ১৯৪৫-৫০ সাল পর্যন্ত বাস্তা জুনিয়র মাদ্রাসা(নেত্রকোণা) ও কাতলাসেন মাদ্রাসায় পড়েন(ময়মনসিংহ)। কাতলাসেন মাদ্রাসা থেকে ১৯৫০ সালে আলিম ১ম শ্রেণীতে ৮ম স্থান অধিকার করেন। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯৫২ সালে জামাতে উলা (ফাজেল) ১ম শ্রেণীতে ৩য় স্থান ও ১৯৫৪ সালে এম. এ (কামিল) ১ম শ্রেণীতে ১ম স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি বাংলা মাধ্যমে পড়াশুনা করেন। ১৯৫৫-৫৬সালে তিনি নাসিরাবাদ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (ময়মনসিংহ) থেকে আই. আই. এ ১ম শ্রেণীতে ১ম স্থান অর্জন করে বাংলায় ভর্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯ সালে বাংলায় (অনার্স) ২য় শ্রেণীতে ৫ম ও ১৯৬০ সালে এম. এ. বাংলা – ২য় শ্রেণীতে ২য় স্থান অর্জন করেন। মাঝে ১৯৫৩ সালেকুমিল্লার ময়নামতি এ্যানুয়েল ক্যাম্প থেকে সামরিক শিক্ষা (ইউ ও টি সি) ২০ দিনের মিলিটারী ট্রেনিং এবং ১৯৫৫ সালে হাই মাদ্রাসা শিক্ষা অঙ্ক ও ইংরেজি বিষয়ে পরীক্ষা দেন।
গোলাম সামদানী কোরায়শী’র কর্ম জীবন এক বহুমুখী বিচিত্র অভিজ্ঞতার সমাহার। আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে তিনি ৩ বছর (১৯৪২-৪৫) ধরে রাখাল হিসেবে ছিলেন। তারপর ধানীখোলা বাজার, ঈদগাহ্ মাঠ মসজিদের ইমাম ছিলেন। তিনি ১৯৫৫ সালে ধানীখোলা হাই মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর তিনি ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লার সম্পাদনা সহকারী, পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রকল্প ও পান্ডুলিপি ও সংকলন বিভাগ, বাংলা একাডেমীতে (১৯৬১-৬৮) কাজ করেন। (১৯৬৮-৯১ সালে তিনি ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। অধ্যাপক গোলাম সামদানী কোরায়শী অসংখ্য রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। তার মধ্যে তিনি সভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু পরিষদ, ময়মনসিংহ সাহিত্য পরিষদ, আকুয়া জুনিয়র হাই স্কুল কমিটি, আকুয়া প্রাইমারি স্কুল ম্যানেজিং কমিটি, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, ময়মনসিংহ শাখা (১৯৮৪-৯১) উজিরাবাদ সমবায় সমিতি, আকুয়া পৌর কবরখানা, ময়মনসিংহ ও সহ-সভাপতি হিসেবে ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাব, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী (ময়মনসিংহ) এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মাদ্রাসায়ে আলীয়া, বাংলা সমিতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৮), বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (১৯৮৪-৯১) দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সংগঠনের আহ্বায়ক, উপদেষ্টা ও সদস্য ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সিনেট (১৯৮২-৮৫, ১৯৮৭-৮৮) সদস্য, বাংলা একাডেমীর (নং ৪৪৫) আজীবন সদস্য ছিলেন।
সাহিত্যে অধ্যাপক গোলাম সামদানী কোরায়শী’র বিশাল ভান্ডার বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।। তাঁর বিচিত্র বৈচিত্রের সাহিত্য দর্শন যে কোনো সাহিত্য প্রেমিককে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। তাঁর মৌলিক রচনার পাশাপাশি অনুবাদ ও সম্পাদনার পরিমাণও বিশাল। তার লিখতি উপন্যাসঃ ষষ্ঠীমায়া (সেমেটিক মিথলজী ভিত্তিক রচনা, শুরু ১৯৭৯ অসম্পূর্ণ) স্বর্গীয় অশ্রু(১৩৮০), পুত্রোৎসর্গ (১৩৮১), মহাপ্লাবন, চন্দ্রাতপ (১৩৮৩) এগুলো তাঁর সেমেটিক মিথলজী ভিত্তিক রচনা। ‘প্রদীপের নীচে’ মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক (রচনা শুরু ১৯৮৩ – অসম্পূর্ণ) ‘দেব না জানন্তি’ নাগরিক উপন্যাস (১৯৮৫), ‘রূপ ও রূপা’ পারিবারিক উপন্যাস (অসম্পূর্ণ)। এছাড়া ‘সংলাপ’ সম্পূর্ণ সংলাপে রচিত (১৯৯১) ও ‘কামিনী’ উপাখ্যান। গল্প ও গল্প সংকলনঃ শ্রী গোলের আত্মকাহিনী প্রথম গদ্য রচনা (১৯৪৩), লেখার দোকান, কালকেতু উপাখ্যান, কারূণের উট, শাদ্দাদের বেহেস্ত, কাল নাগিনী, কোরবাণী, দুর্ভিক্ষ, কল্পনা ও বাস্তব, এক যে ছিল কুল গাছ, একুশের কড়চা, কান্না, শয়তানের দোকন, জ্ঞানের ঘাট, বাঁশী, জায়দার বাপের বেহেস্ত, হজ্জ্ব, অভিনেত্রী, ভাগ্যরেখা, রক্ত চোষার ফরিয়াদ, থার্ড ক্লাশ, বিসমিল্লাহ, বিশ্বাসঘাতকতা, সাধু, দাদা, আদি, অভিসার, নরম গরম, দুই ভাই, দুই বোন, দুই মা, দুই বন্ধু, গল্প শুনো, মেঘলা রাতের কাব্য, বুড়া ঘুমালো পাড়া জুরালো, তিন দিন তিন রাত প্রভৃতি। নাটকঃ টুপিচোর, আমাদের দেশ (নাটিকা), গাধার কলজে, সাতটি নক্শা, সাপের ছোবল, উটের মাংস, আরও ৪টি। শিয়ালের সাফাই, নাটিকা, সবুজ পাতা(এ তিনটি শিশুতোষ নাটক) ক্ষুধিত সিংহাসন, হেমলক (নাটিকা)। কবিতা ও কবিতা সংকলনঃ খেয়ালের ঝুলি, দূর্ঘটনা, উটকোর জিভ, বাদশাজাদা ও গল্পিকা (কিশোর কবিতা সংকলন), মানুষ (১২টি সনেটের সংকলন)। ১৯৬১ সালে কিংবদন্তিতুল্য ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লার আহ্বানে সাড়া দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রকল্পে বাংলা একাডেমীর ড. শহীদুল্লার সহযোগী হন। অভিধান প্রকল্পের পাশাপাশি তিনি অনুবাদকর্মেও মনোনিবেশ করেন। ১৯৬৫ সাল থেকে আরবি, ফারসি, উর্দু, ইংরেজি বিভিন্ন ভাষার বহু মৌলিক গ্রন্থ তিনি অনুবাদ করেন। তাঁর অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছেঃ কালিলা ও দিমনা (১৯৬৫); আইন-আদালতের ভাষা আরবি-ফার্সি শব্দ (মূল ইংরেজি), অশাস্ত্রীয় পুরাণ (মূল সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়); শব্দাদর্শ অধ্যয়ন (মূল মুহম্মদ ওবায়দুল্লাহ); তারিখ-ই-ফিরোজশাহী, তোহফা (মূল ফার্সি) প্রভৃতি এবং বাংলা একাডেমী থেকে এসব গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাঁর অনূদিত হেজাজের সওগাত (মহাকবি ইকবালের আরমুগানে হেজাজ—এর অনুবাদ) ১৯৬৫ সালে করাচির ইকবাল একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া বহু অনুবাদ এবং মৌলিক সৃজনশীল সাহিত্যকর্মের নিদর্শন রেখে যান তিনি। ১৯৮১-৮২ সালে বিখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ইবনে খলদুনের আল মোকাদ্দিমা বাংলা একাডেমী থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজে সাড়া পড়ে। তিনি ইবনে খলদুনের জীবনীগ্রন্থসহ ২৪টি গ্রন্থের অনুবাদক। তাঁর কৃতকর্মের অবদানস্বরূপ অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার (১৯৯০) উল্লেখযোগ্য হলেও তাঁর কর্মের প্রতি সুবিচার হয়নি মনে হয়। আজও মরণোত্তর পদকে ভূষিত করার দাবি রাখেন এ বুদ্ধিজীবী।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার মহান পুরুষ গোলাম সামদানী কোরায়শী ১৯৯১ সালের ১১ অক্টোবর ময়মনসিংহের আকুায়ায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬২ বছর। তাঁর মৃত্যুতে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে ময়মনসিংহবাসী আর দেশ হারায় অনন্য প্রতিভাবান, বহুভাষী পণ্ডিত, বহুদর্শী সমাজকর্মীকে। আজ এই মহন সাধকের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রতিভা ভান্ডার গোলাম সামদানী কোরায়শীর মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।