Sharing is caring!
সাংবাদিক ও সাহিত্যিক অরূপ তালুকদারঃ নামটিই এখন প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকে প্রায়শই মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, সমসাময়িক সংকট ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত কলাম লেখক একজন সাংবাদিক অরূপ তালুকদার! নামটিই এখন একটি প্রতিষ্ঠান। বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলের জীবন্ত ইতিহাসও বলা যায় তাকে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে বরিশালের যে চারজন সাংস্কৃতিক কর্মী কাজ করেছেন তাদেরই অন্যতম একজন অরূপ তালুকদার স্বীকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাও। যদিও অন্যদের মতো নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জাহির করার কোনো প্রবণতা তার মধ্যে নেই। কেন নেই? প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কেউ কেউ সম্মান জানিয়ে শব্দ সৈনিক বলেন বটে। এতেও আমি আসলে বিব্রত হই। মুক্তিযুদ্ধ করেছি স্বাধীন সুন্দর একটি রাষ্ট্র পেতে। মুক্তিযোদ্ধা নাম ভাঙিয়ে সেই রাষ্ট্র থেকে সুবিধা আদায় করতেতো আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি।
আপনার বেশিরভাগ লেখনীতে মুক্তিযুদ্ধের কথা চলে আসে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই আপনার গল্প প্রবন্ধ বেশি। এটা কেন?
হেসে ওঠেন অরূপ তালুকদার, দরাজ কণ্ঠের হাসি থামিয়ে বলেন, তোমাদের, বিশেষ করে তোমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মনে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলো গেঁথে দিতেই মূলত আমার এই চেষ্টা । একটা সময় এমন হবে যে, মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে সবাই গল্প ভাবতে শুরু করবে। তখন অন্তত আমার এই গল্পগুলো ওদের গল্পের ছলে সত্যকে জানতে সাহায্য করবে।
এই হচ্ছেন অরূপ তালুকদার। সাহিত্য বাজার পত্রিকার সাহিত্য পদক ২০২২ এবছর তার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে বরিশালে এসে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল সাহিত্য সংসদ সাহিত্য বাজার পত্রিকার ১৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এই পদক প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বরিশালের সার্কিট হাউস মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার এর হাত দিয়ে তুলে দেয়া হয় এই সাহিত্য পদকটি। সাথে নামমাত্র কিছু সম্মানীও দেয়া হয়। যা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক অরূপ তালুকদার তৎক্ষনাৎ দান করে দেন বরিশালের একটি বৃদ্ধাশ্রমকে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তিনি বাংলা ও ইংরেজি কথিকা লিখতেন ও স্বরচিত কবিতা পাঠ করতেন। অন্য তিনজনের মধ্যে খ্যাতিমান চলচিত্রকার আলমগীর কবির ইংরেজি বিভাগের দায়িত্ব পালন করেছেন। কবি আসাদ চৌধুরী তার ভরাট কণ্ঠে আবৃত্তি করতেন স্ব রচিত কবিতা এবং গৌরনদী উপজেলার আশোকাঠি গ্রামের অরুনা রাণী সাহা নিয়মিত গান করতেন। স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের এই চারজন শব্দ সৈনিক গেজেট ভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। অথচ এই চারজনের জীবীত দুজন অরূপ তালুকদার ও কবি আসাদ চৌধুরী নিজেদের কখনোই মুক্তিযোদ্ধা দাবী করে যত্রতত্র আলোচনা মঞ্চ মাতিয়ে তোলেননি। নিরব ভালোবাসায় আজো তাদের লেখনীতে তারা স্মরণ করেন তখনকার স্মৃতি।
তাইতো অরূপ তালুকদারের লেখনীতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি মন্থন খুব বেশি চোখে পড়ে।
যতদূর জানা যায়, বর্তমান বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলার পাথরঘাটা থানাধীন গোলবুনিয়া গ্রামে সন্তান অরূপ তালুকদার ছাত্র জীবনের শুরু থেকেই স্কুল-কলেজের ম্যাগাজিনে লেখালেখি শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএএলএলবি সম্পন্ন করার পর জড়িয়ে যান সাংবাদিকতা পেশায়। তার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায় ১৯৬২ সালে I ১৯৬৩ সালে বরিশাল থেকে প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস ‘সারাদিন সারারাত’ I দ্বিতীয় উপন্যাস ‘নীলিমায় নীল’এবং তৃতীয় উপন্যাস ‘আশার নাম মৃগতৃষ্ণীকা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম গল্পগ্রন্থ রংরাজ ফেরে না’ I প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সেই নির্বাচন চাই’ প্রকাশিত হয় স্বাধীনতার পরে ঢাকার মুক্তধারা থেকে ১৯৭৪ সালে I
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা নিয়ে লিখেছেন তিনি গল্প উপন্যাস শিশু সাহিত্য। তবে তার কবিতায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের বেদনা পাঠ। তিনি যখন লেখেন…
আবার কোনোদিন ফিরে আসবো, ভাবিনি।
ভাবিনি, আবার কোনোদিন দেখা হবে
আপনাদের সঙ্গে, আমার যারা প্রিয়জন
একান্ত আপন বন্ধুবান্ধব তাদেরকে
কোনোদিন দেখবো, দেখতে পাবো আমার
সেই প্রিয়তমার মুখ ম্লান নক্ষত্রবীথিতলে…।’ (যুদ্ধোত্তর প্রত্যাবর্তন/নির্বাচিত কবিতা)
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই শব্দসৈনিক
নিবিড়ভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তীকালকে। যা তিনি অবলীলায় ধারণ করেছেন তার কবিতায়। ফলে দেশাত্মবোধ হয়ে উঠেছে তার কবিতার মৌল প্রেরণা। তাই নিজ বাসভূমি, স্বজনদের মধ্যে ফিরে আসার আকুতি তার প্রবল।
মুক্তিযুদ্ধ অরূপ তালুকদারের কবিতার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। তার কবিতার ব্যাপক আয়তন জুড়ে মুক্তিযুদ্ধের বিস্তার। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ বিক্ষত সময় তার কবিতায় বিধৃত হয়েছে- ‘স্বাধীনতা আমার জীবন, আমার রক্ত, রক্তবীজের ঋণ
স্বাধীনতা আমার চিরদুঃখিনী মায়ের দুফোঁটা অশ্রুজল
স্বাধীনতা আমার প্রিয়তমার মুখ, দোয়েল পাখির গান
স্বাধীনতা আমার স্বপ্নের ধন, এই দীপ্ত প্রাণের ফসল।’ (স্বাধীনতা/নির্বাচিত কবিতা)। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তার কবিতার হৃৎস্পন্দন ও ধ্বনিত হয় উজ্জ্বল মহিমায়- ‘তুমি নেই, হে অমৃতের পুত্র, আমাদের মধ্য থেকে
অকস্মাৎ একদিন তুমি চলে গেলে, যেন
এক ঝংকৃত দুর্বার ঝড়ের মতো তোমার
তোমার সেই আসা আর যাওয়া।’ (তুমি নেই, কাঁদে বাংলার মানুষ, নির্বাচিত কবিতা)
এযাবৎ প্রকাশিত বেশকিছু কাব্যগ্রন্থের মাঝে উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ- সেই নির্বাসন চাই (১৯৭৪), দূরের হরিণী (১৯৮২), অন্ধকারে আলোর ম্যাজিক (১৯৮৬)। কবিতার সংকলন ‘নির্বাচিত কবিতা’। গ্লোব লাইব্রেরি (প্রা.) লিমিটেড থেকে প্রকাশিত এই নির্বাচিত কাব্য সমগ্রটিতে রয়েছে চৌষট্টিটি কবিতা। তবে বয়সের ভারে ন্যুব্জ-নত নয়, বরং ধাবমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিরন্তর ছুটে চলেছেন কবি। জীবনের দেখা না দেখার অনেক জটিল সমীকরণকে লিপিবদ্ধ করছেন নানা মাত্রিকতায় কী গল্পে, কী উপন্যাসে, কী কবিতায়।
তার মুক্তযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস আঁধারকাল বাজারে এসেছে ২০১৪ এর বইমেলায়। সাহিত্যমালা থেকে প্রকাশিত ১৩০ পৃষ্ঠার এ বইটিতে ফুটে উঠেছে লেখকের অভিজ্ঞতার চিত্র।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে অগম্যপ্রায় গহীন বনাঞ্চল সুন্দরবনের অভ্যন্তরে চলে যাওয়া মানসিক যন্ত্রণাক্লিষ্ট এক সাধারণ ফেরারী যুবকের আত্ম অনুসন্ধানের অসাধারণ কাহিনী নিয়ে রচিত এই উপন্যাসের গভীরে খুঁজে পাওয়া যায় অন্যরকম স্বাদ। এ উপন্যাসের নায়ক যেন তিনি নিজেই। দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরুতেই তার জীবনের এক অধ্যায়ের অকস্মাৎ সমাপ্তি ঘটে গেলে সূচনা হয় আরেক অধ্যায়ের। যখন তার জীবনের সাথে ঘটনাচক্রে জড়িয়ে গেছে এক নারী ও আরো কিছু মানুষ। যাদেরকে অবলম্বন করে সে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে। চারিদিকে তখন শুধু মৃত্যুর মিছিল। আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলেপুড়ে ছারখার সব। অনেকটা এভাবেই গাঁথা আছে গল্পের কাহিনী।
আবার তার শিশুতোষ গল্পের স্বাদ কিন্তু পুরো পাল্টে দেয় কবি ও ঔপন্যাসিকের দর্শন। লেখক ও কবি অরূপ তালুকদার তখন হেসে ওঠেন শিশুদের মতো করেই। বলেন, চলো চা আড্ডা হয়ে যাক আজ কীর্তনখোলার পাড়ে। তেমনি শিশুদের উপজীব্য করে লিখে ফেলেন তুতুলের গল্প।
“একদিনে ঘর থেকে হারিয়ে গেছে মিতুলের কলম, পেনসিল, ছোট দু-তিনটে খেলনা, প্লেট ইত্যাদি। সবার ধারণা, ফাতেমাই সরাচ্ছে এসব। কিন্তু তাকে বললে, সে শুধু কাঁদে। তা হলে কি ভুতের উপদ্রব হচ্ছে বাড়িতে? ভুতে বিশ্বাস করে মিতুল। ভয় পায়। তুতুল ভুতে ভয় পায় না। বলে, ভুত কোথায়? আমাকে দেখাতে পারো, আপু মণি?
জানা যায় ভুতুড়ে এই কাণ্ড পুরোটাই তুতুলের সাজানো।
একনজরে অরূপ তালুকদার
১৯৪৪ সালের ৬ জানুয়ারি বরগুনা জেলার গোলবুনিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন সাহিত্যিক সাংবাদিক অরূপ তালুকদার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে সম্পন্ন করেন এমএ, এলএলবি। ষাটের দশকে যুক্ত ছিলেন চলচ্চিত্র, রেডিও, টেলিভিশন, সাংবাদিকতা ও পত্রপত্রিকা সম্পাদনার কাজে। ষাটের দশকে প্রকাশ হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘সারাদিন সারারাত’, এরপর ‘আশার নাম মৃগতৃষ্ণিকা’, ‘নীলিমায় নীল’ ও গল্পগ্রন্থ ‘রংরাজ ফেরে না’। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যুক্ত ছিলেন ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’র সঙ্গে। তিনি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ‘শব্দসৈনিক’। ‘৭৪-এ মুক্তধারা থেকে প্রকাশ হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সেই নির্বাসন চাই’। ‘৭৮-এ কলকাতা হতে বের হয় কাব্যগ্রন্থ ‘দূরের হরিণী’, ‘৮২ সালে উপন্যাস ‘বন্ধদুয়ার’ ও কাব্যগ্রন্থ ‘অন্ধকারে আলোর ম্যাজিক’। অরূপ তালুকদার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে ছিলেন ‘কমনওয়েলথ জার্নালিস্টস এ্যাসোসিয়েশন (সিজেএ), লন্ডন-এর সদস্য। বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, দি ডেইলি স্টার, নিউজ টুডে, ইউএনবি ও আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা এএফপি এবং রয়টার্স-এ।
প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৪০টিরও বেশি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ বন্ধ দুয়ার ( উপন্যাস)
দক্ষিণাঞ্চলের কথা
অন্ধকারে একা ( উপন্যাস)
আঁধারে আলোর ম্যাজিক ( কাব্যগ্রন্থ)
নির্বাচিত গল্প
নির্বাচিত কবিতা
অদ্ভুত সব ভূতের গল্প
আঁধারকাল ( মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস)
Global Warming : Facing the Havoc
দ্য স্পাই– পাওলো কোয়েলহো ( অনুবাদ) ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে এসেছে করোনাকালের কথা, আমাদের ভাষা আন্দোলন ও আমাদের বঙ্গবন্ধু। গ্রন্থগুলো প্রকাশিত হয়েছে বাউণ্ডুলে প্রকাশনী থেকে।
Sharing is caring!