শেকড় সন্ধানী কবি ওমর কায়সার
সেলিনা শেলী
সেই আদি কবির কথাতো আমরা সবাই জানি – যিনি অভিশাপ দিয়েছিলেন ক্রৌঞ্চ মিথুনের সুখ হত্যাকারীকে – উচ্চারণ করেছিলেন প্রথম কবিতা। আপাতঃ বিচারে সেই উচ্চারিত শব্দরাজিকে মনে হতে পারে সামান্য এক পাখি হত্যার বিরুদ্ধে শব্দভল্লের সেই শর নিপে, বস্তত তার ভেতরের গভীর এবং চরম সত্য তো এই যে, সুন্দরের, স্বপ্নের, প্রেমের, সৃজনের, স্বাভাবিকত্বের বিনষ্টি ঘটায়ককে চিহ্নিতকরণ। কিন্তু সত্য এবং সুন্দর হলেও এ কাজটি বড় কঠিন। সকলের পে তা করা সম্ভব নয়। যেহেতু মানব সভ্যতা উচ্চারণ নির্ভর – তাই, একমাত্র কবিই যুগে যুগে বিনষ্টির দিকে তীব্র কটা হেনেছেন এবং সুন্দরের পে রচনা করেছেন দ্বীপঙ্কর বাক্যবন্ধ। কিন্তু কী দায় কবির? তিনি তো জানেন –
‘কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধনমান’ এবং স্বয়ং কবিও। কবিতা এক সময় ছিলো বচন (মৌখিক রূপ)। সেই মৌখিক শিল্প থেকে যখন লেখ্য শিল্পের জন্ম হয় তখন দেখা যায় সৃজনকারীর ব্যক্তিগত নামাঙ্কন প্রথমে এবং পরে বাণিজ্য স্বত্বের প্রবল তাগিদ এতে নিহিত। কবি যে দৃষ্টিতে পৃথিবী সমাজকে দেখেন তা যেমন তার নিজের একদিকে, তেমনি সেই স্বকীয়তা যখন জরুরি ও অপরিহার্য হয়ে ওঠে, তখন তা যুগের নির্বিশেষ প্রবণতাকে প্রকাশ করে। ওই মুহূর্তে কবিতা থাকে না আর ব্যক্তিগত, হয়ে পড়ে সামষ্টিক। তবে শিল্প সৃষ্টির আদি ইতিহাস থেকে আমরা দেখেছি শিল্পই শেষ পর্যন্ত সত্য হয়ে থাকে, কোথায় হারিয়ে যায় সৃজনকার, কখনও কখনও তার হদিওস পাওয়া যায় না। অজন্তা-ইলোরা গুহাচিত্রে আমরা মুগ্ধ হই। কিন্তু সৃজনকার কে? অথবা মমি প্রস্তুতকারক সম্রাট কিংবা উচ্চ কোটির অভিজাতবর্গের শবাধারে গলিত স্বর্ণ এবং মিশ্র ধাতুর কারুকাজ, শোভা, সৌকর্য রয়ে গেছে, কিন্তু শিল্পী কে? তিনি তো তাঁর নামটি পর্যন্ত উৎকীর্ণ করেন নি। মমির শবাধারের সৌন্দর্যে তিনি নিজের ‘আমিত্ব’কে বিসর্জন দিয়েছেন। দাকিকির ব্যালাড থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ‘শাহনামা’ লিখেছেন-ফেরদৌসীর এ স্বীকারোক্তি আমরা মানবের উত্থান-পতনের ইতিহাসে কেবল শিল্পই বেঁচে থাকে, শিল্পী নয়।
মাটির পাঁজর চিরে উঠে আসে পুরোনো প্রসাদ।
লুপ্ত সভ্যতার ধুলো জেড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে প্রতœ নিদর্শন।
ভূমিকম্প
ভূমিয়
অনেক ধারালো জল শুষে নিল পুরাতত্ত্বের প্রবীণ পাতা।
তবু গ্রীবার বাঁকের মতো নিষ্ঠুর মহিমা নিয়ে
বেঁচে আছে প্রাচীন প্রাসাদ…
তোমার বিষণœ কীর্তি-অজ্ঞাত স্থপতি।
এ নিপুণ স্থাপত্যকলার নাম ভালবাসা ছাড়া আর কিছু নয়।
(প্রাচীন প্রাসাদ: প্রতিমা বিজ্ঞান)
কালকালান্তরের এই সত্য জানেন কবি ওমর কায়সার। তবু কেন তিনি সৃজন করেন, নাকি কাব্যই সৃজিত করে থাকে, কবি যার নাম দিয়েছেন ‘ভালোবাসা’। শেকড় সন্ধানী কবি ওমর কায়সারের তিনটি কাব্যগ্রন্থ ‘প্রাগৈতিহাসিক দু:খ’ (১৯৮৮), ‘প্রতিমা বিজ্ঞান’ (২০০১) এবং ‘বাস্তুসাপও পালিয়ে বেড়ায়’ (২০০৫) পাঠ করতে গিয়ে উপরোক্ত ভাবনাটি প্রকট হয়ে দেখা দেয়। আশির দশকের সাড়া জাগানো ‘দ্রৌপদীর প্রেমিকেরা ও অন্য একজন’ এর কবি ওমর কায়সার। কবির গ্রন্থত্রয়ী আলোচনার আগে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, কবি ওমর কায়সার – এর কবিতা শ্রুতির নয়, এগুলো নিবিড় পাঠ দাবি করে। কবির তিনটি গ্রন্থই প্রাচীন ভারতের সভ্যতা, ঐতিহ্যে নিমজ্জমান। গ্রন্থত্রয়ের নামাঙ্কনেও সেই বিশেষ লণটি সমুজ্জ্বল। পাশাপাশি আছে নিবিড় প্রেম, দ্রোহ, মোহ-মাদকতা এবং আর্দ্রতা। তিনটি কাব্যেই কবি কায়সারের অন্ত:শীলতা দেশ-মৃত্তিকার কাছে নতজানু। ‘প্রাগৈতিহাসিক দু:খ’ প্রথম গ্রন্থের প্রথম কবিতা ও গ্রন্থ শিরোনাম। কবিতাটি শুরু হয়েছে আদি অকৃত্রিম হƒদয়-কাতরতা দিয়ে। কবির প্রিয়াকে পুরোপুরি না পাওয়ার না বোঝার সরল স্বীকারোক্তিতে;
না আলো না অন্ধকার
তুমি এক বিজন প্রদোষ
এক হাতে ধরে আছো মেহেদির রঙে রঙে নিটোল বিশ্বাস
অন্য হাতে অবিশ্বাস মলিন কালিমা
কোন হাত তোমার নিজের
কবির প্রিয়া যেনো খুঁজে পাওয়া কোন অস্পষ্ট প্রাচীন শিল্প, যা স্পর্শের অতীত, যার নাম ‘প্রাগৈতিহাসিক দু:খ।’
অথবা-
লিলি গাংগুলি পাখি নয়
পাখিদের পালক থাকে
লিলির শরীর ছিল পালকের মতো নরম
চিন্তায় চর্চায় যত্ন দিয়ে গড়া
(লিলি গাংগুলি পাখি নয়, প্রা. দু.)
গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘সেপাই’ অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল পাঠক মহলে। কবিতাটি আমাদের এরশাদীয় ভয়াবহ সেই সামরিক শাসনের ভেতর নিয়ে যায় – যেখানে মৃতেরা কেবলি কবরস্থ হতে থাকে। আর জীবিতদের জায়গা হয় কারাগারে। বন্দী থাকে মানুষ, তার শুভবোধ, মেধা, মনন। কবি তাকে কুখ্যাত ‘চেঙ্গিসের অশ্বারোহী’, ‘সাইরাসের তীরন্দাজ’, ‘ম্যামবিসেসের রথের চালক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যে কেবলি তার নিকষ কালো বুটের ছাপ ফেলে সবুজ ঘাসে। যে সহস্র শতাব্দী ধরে বেঁচে আছে মানুষের ধ্বংসযজ্ঞে, লোহিত রক্তের হোলি খেলায়। ‘সেপাই’ কবিতাটিই গ্রন্থের একমাত্র রাজনৈতিক বিষয়নির্ভর কবিতা, যদিও আরও দুএকটি কবিতায় সমকালীন রাজনৈতিক অনুষঙ্গ উঠে এসেছে। যেমন –
আফ্রিকার এশিয়ার ভাগ্য হারাদের দল
নেভাতে এসেছে সব বেদনার গুপ্ত তুষানল
(জলের মিছিল-প্রা.দু.)
কবি ওমর কায়সারের প্রায় কবিতাই নাতিদীর্ঘ। কিন্তু বহুমাত্রিক তারা। আছে হীরক-কাঠিন্য দ্যুতি, আছে জীবন সম্পর্কে প্রগাঢ় প্রতীতি, কাল-মহাকালিক ব্যাপ্তি। তবে প্রথম গ্রন্থের চেয়ে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় গ্রন্থে এই ব্যাপ্তির গভীরতা প্রকট। তাঁর কবিতায় প্রেম, স্মৃতিকাতরা, দ্রোহ সবই আছে। কিন্তু বারবার বলি – কবি কায়সারের কোন ভাব বা বিষয়ই উচ্চকিত-চিৎকৃত নয়, বরং গভীর, নিটোল, কঠিন অথচ øিগ্ধ। এমন কি যখন কবি স্বকাল, সমাজ, রাজনীতি অথবা সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কথা বলেন সেখানেও কোন অহেতুক উš§াদনা দেখা যায় না। সেজন্যেই তাঁর কবিতার নিবিড় পাঠ প্রয়োজন।
জলে ও কাদায় বপন করেছি আগামী দিনের আশা
বর্গীর পাখি খেযে গেছে সব সম্ভাবনার ধান।
বাঁকানো কাস্তে হাতের মুঠোয় জেগেছে আদিম চাষা
সূর্যের মত কাস্তের চোখে জ্বলে ওঠে অভিমান।
(জলে ও কাদায়-প্রা.দু.)
এখন বজ্রকণ্ঠ হও সম্পন্ন মিছিলে,
করপুটে কেড়ে নাও ঐশ্বর্যের উত্তরাধিকার
এই ক্রান্তিকাল তোমার যৌবন চায়
…………………..
এখন কার্ফ্যু ভাঙার ছন্দে
বারিকেড ভাঙতে ভাঙতে পংক্তি লেখ কিছু।
(শেষ সন্ধান প্রা. দু.)
এই নিরাপত্তাহীন ুধাদীর্ণ ব্যাধি- আক্রান্ত পৃথিবীতে মানুষের জন্মের দুর্বার মিছিল কবি বন্ধ করে দিতে চান। কেননা, কোথায় দাঁড়াবে মানুষ, কেবল –
গুলি খাবে
শুধু গুলি খাবে
আর ঘুরে ফিরে যাবে সর্বনাশা কালো দরোজায়।
(আদিম দরজা-প্রা.দু.)।
একজন যৌনকর্মী নগরের মানুষের যে ইতিহাস জানে, সাধারণ মানুষ তা জানে না। সে শরীর বিকোয়। কিন্তু তার কি সবুজ হৃদয় নেই? সেই সবুজ হৃদয়ের সুরভীর খোঁজ কেউ রাখে না, কেবল কবি ছাড়া –
যে পণ্যের দাম নেই কোনো সেইটুকু কোথায় লুকোলে
দেহের অতীত সেই অবলুপ্ত সম্ভাব্য সবুজ।
…………………………………
পদ্মের সুরভিটুকু আমাকেই দিও
সমস্ত নগরী আমি তাই দিয়ে মালঞ্চ বানাব।
(প্রার্থনা-প্রা.দু.)।
অভিজ্ঞানমণ্ডিত ইতিহাস চেতনা বোধের কবি কায়সার। দ্বান্দ্বিক সত্যে তিনি ধর্মীয় উপকথার অসারত্ব এবং বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় মুগ্ধ হয়েছেন। জীবন-জিজ্ঞাসার প্রশ্নে দীর্ণ হয়েছেন। শেষ অবধি সভ্যতা, বিজ্ঞান এবং দর্শন থেকে এ সত্যই জেনেছেন যে:
‘আমরা শ্রমের উপরই একমাত্র বিশ্বাস রাখতে পারি।’
তার কারণও তিনি বলেন Ñ এভাবে:
আমাদের অঙ্গুলি হেলনে চাঁদ কখনো দু’ভাগ হবে না
নিজেদের উপর দৃঢ় বিশ্বাস রেখে আমরা চাঁদের উপর পা
রেখেছি
এবং আমরা আরও অনেক নতুন নতুন দ্বীপ
নতুন নতুন গ্রহপুঞ্জকে বসবাসযোগ্য করে নেবো।
(বিশ্বাসের জš§দিন-প্রা.দু)
একজন কবির চেতনার বিবর্তন যখন সমকালের সমাজ, মানুষের স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের কথা বলে, মননে মেধায় এক হয়ে চলে, তখনতো তাকে সেই সময় এবং সমাজের ভাষ্যকারই বলতে হয়। আর কবির বড় দায় এই যে, তিনি যা বলেন, বলার পর সেটি আর তাঁর নিজের থাকে না।
“Dying is an art” – কবি সিলভিয়া প্লাথ এই উচ্চারণের মধ্য দিয়ে মৃত্যুকে শিল্পের মহিমা দিয়েছেন। তাঁর মৃত্যু সকল সাহিত্যপ্রেমীর জন্যে বেদনাদায়ক। নিজ সন্তানদের জন্যে সকালের দুধ-নাস্তা তৈরি করে রেখে একজন মা, একজন মানুষ জ্বলন্ত চুল্লীতে মাথা পেতে কীভাবে ইচ্ছামৃত্যুকে ডেকে আনেন, কতোটা বেদনায়, হতাশায়, নিস্পৃতায় তা আমরা উপলব্ধি করতে পারবো না। কবি ওমর কায়সার গভীর বেদনা থেকে জানতে চান – কেন সেই ভোরটি অয় হয়ে থাকলো না, কেনো একটি দোয়েলও সে ভোরটিকে তার কণ্ঠে ধরলো না। কেন ফুল সুগন্ধী ছড়িয়েছে সেই নিষ্ঠুর হননকালে?
অন্তত একটি দোয়েল যদি অস্ফুট গলায় তার
ভোর বেলাটাকে ধরে রাখত
কিংবা কোন কুসুম কোরক পাঁপড়ির সুগন্ধ
ছড়িয়ে দিতো না তার করুণ হাওয়ায়।
……………..
মৃত্যু
কী নিপুণ করে থাকে শিল্পের বয়ন।
(মৃত্যু কি নিপুণ শিল্প প্রা.দু.)
তাঁর উচ্চারণগুলো স্ব-অভিজ্ঞতা এবং সংবেদনার দীপ্তিতে আলোকিত। ভারতীয় দর্শনে সভ্যতায় বারংবার আশ্রয় খোঁজেন কবি। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘প্রতিমা বিজ্ঞান’ পাঠ করতে করতে পাঠক পৌছে যান Ñ ‘হরপ্পার বিজন প্রদোষে’ Ñ এ সিন্ধু, বিদর্ভ নগরে দেখাবেন অশ্বমেধ যজ্ঞের রাজাকে। কবি কায়সার দেখাবেন:
‘ভারতীয় আÍার পথ।’
এই গ্রন্থেই গভীরভাবে পাই কবির মানবীয় সংবেদনশীলতা। স্বপ্নের সমগ্র বৃত্তেই তার বিচরণ, জীবনের বীজকণা, মনোবীার অন্বেষণ। কবির কথায় তাঁর বিচরণ ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত, আবার বৃত্ত থেকে বিন্দু’ পর্যন্ত। জীবনকে ব্যক্তিগত রোমান্টিক প্রিজমের ভেতর দিয়ে দেখেন কায়সার। সেখানে ঠিকরে বেরোয় নানা বাহরি রঙ। তবে রঙগুলো চড়া নয়, উচ্চকিত চিৎকৃত নয়, কোমল আর্দ্র প্রেমের মতো। এটিই কায়সারের কবি স্বভাব। তাঁর কবিতার আর একটি প্রধান সুর ‘নৈঃসঙ্গতা’ এটি কেবল নারী-প্রেম কেন্দ্রিক নয়, এই লোনা অন্ধকারময় সুরটি জীবন ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বব্যাপী। তাই কায়সার এক বেদনাদীর্ণ যুবক, অন্তঃশীল এক একাকিত্ব তাকে ঘিরে রাখে, করে বৃত্তায়িত। কবি কি সেই বৃত্ত ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চান? না। কবির কাব্য পাঠ আমাদেরকে এই সত্যই জানায় যে, কবি ওমর কায়সার একাকীত্ব, নৈঃসঙ্গ উপভোগ করেন। তিনি এক বেদনা-বিলাসী কবি। এখানে কবি জীবনানন্দ দাশের ছায়া দেখি আমরা। একদিন ছুটি নেবো, বৃরে স্বভাবে তুমি, প্রবারণার ফানুস, করতালি ইত্যাদি বহু কবিতায় হঠাৎ জীবনানন্দ আলো ফেলেন। কবি প্রিয়তমা নারীকে পেত্রাকীয় প্রেমিকের মতো দেবী স্তোত্র শোনাতে চান, আবার জীবনানন্দীয় ঢং-এ নারীকে স্থাপন করেন নিসর্গের ফ্রেমে। নিসর্গ তার কাব্যে এসেছে বোধের অনুধ্যান হয়ে। সে জন্যে প্রিয় স্বদেশকে নিয়ে ধর্মীয় অনুষঙ্গে তার আশাবাদ এভাবেই ব্যক্ত হয়।-
আগুন তোমার শরীর ছোঁবে না
আগুনের শরীর থেকে সিংহীর গর্জন হয়ে
তুমি বেরিয়ে আসবে অগ্নিময়ী।
পূর্ব জনমে আমি অগ্নি উপাসক ছিলাম
অগ্নিময়ী। তোমাকে সাস্টাঙ্গ প্রণাম।
(আগুন তোমার শরীর ছোঁবেনা প্র.বি.)
কবির কাব্যে এমন কোন শব্দ-বাক্যবন্ধ নেই – যা লিবিডোয় আক্রান্ত, আছে জীবন সম্পর্কে গভীর প্রীতি, ভারতীয় ঐতিহ্য, এই ইতিহাসানুসন্ধান যা তার কাব্যগ্রন্থত্রয়ের নামকরণ থেকে অন্তঃস্থল পর্যন্ত ব্যাপ্ত। তার কাব্যত্রয়ে এর ধারাবাহিকতা দেখতে পাই আমরা। শেকড়ের কাছেই আÍ পরিচয়ের সূত্র। আÍজিজ্ঞাসার উত্তরও তাই কবি কায়সার এর সামনে –
উৎখননের শেষে পেয়ে গেছে বোধের প্রতিমা
আমিই আরাধ্য তার, আরাধনা কখনো করি না।
… … …
হরপ্পার বিজন প্রদোষে দেয় মৌমাছি ইঙ্গিত
আমার কালের কাছে বোধের প্রতিমা গায় প্রার্থনা সঙ্গীত
(বোধের প্রতিমা প্র. বি)
‘পুরান’ কথাটির বুৎপত্তিগত অর্থ ‘প্রাচীন কথা’। এসব কাহিনী প্রত্যেক জাতি সম্প্রদায়ের নিজস্ব সম্পদ এবং অবিচ্ছিন্ন উত্তরাধিকার। এমন কেউ নেই যিনি পুরাণ ঐতিহ্যহীন। তাকে তার ভাবনায় এসবের কিছু না কিছু গ্রহণ করতেই হয়। এই েেত্র নাস্তিক আর আস্তিকেরও তেমন তফাৎ নেই। কেননা, পুরোপুরি ধর্মকথা নয়। বরং প্রাচীন এবং মধ্যযুগের মানুষের চিন্তা, আচার-আচরণ লোকিক কিন্তু তৎকালীন মানুষের জীবনবোধ। কাজেই পুরাণ প্রতিটি জাতি সম্প্রদায়েরই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ যা মানব সভ্যতার বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কবি কায়সারের কাব্যগ্রন্থ বিশেষত: ‘প্রতিমা বিজ্ঞান’ আমাদেরকে সেই বোধের দরোজায় নিয়ে যায়। মানুষের ক্রমবিকাশের ধারাক্রমতো আমরা জানি। জানি পুরানো মানুষ বদলে বদলে নেয়ালডার্থাল থেকে প্যালিওলিথিক, সেখান থেকে নিওলিথিক এভাবেই আধুনিক মানুষ বিশ্ব-সাংস্কৃতিকবোধে নবীন আধুনিক থেকে উত্তরোত্তর আধুনিক। একটা উপন্যাস যেমন জাতিসত্তার পুরো ইতিহাস বলে দেয়- ওমর কায়সারের শেষোক্ত গ্রন্থ দুটিও আমাদের সেই বোধকে পুনর্জাত করে। তিনি কেবল নতুনকে নির্মাণ করেননি। পুরোনোকেও করেছেন পুনর্জাত নতুন সময় আর সমাজের আলোকে। এখানেই কবি ওমর কায়সার উত্তর উপনিবেশিক হয়ে উঠেছেন। কবি ওমর কায়সারের কবিতার প্রকরণত সাফল্য ও বিষয়ের যথার্থভাব উšে§াচনে অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞানের চমৎকার সাযুজ্য রয়েছে। তাঁর কাব্যত্রয়ের মৌল চরিত্র ব্যক্তি এবং জাতীয় আবেগের সুগভীর অঙ্গীকারের মধ্যে নিহিত। তাঁর অপোকৃত ুদ্র কবিতাগুলোর বুনন ঠাঁসা। সকল কবিতাস্রোতে মানবিক সংবেদনই কবির একমাত্র অম্বিষ্ট।
শব্দ নিয়ে অহেতুক জটিলতা সৃষ্টি করেন না কবি। সরল উচ্চারণে অত্যন্ত বেদনাদায়ক ইতিহাসের একটি পর্বকে তুলে এনেছেন কবি ‘আকাশ বুনন’ কবিতায়।
আসুন, প্রিয় পাঠক, পুরো কবিতাটি আমরা পাঠ করি।-
একটি ম্যাচের বাক্সে মস্ত আকাশ বুনে ভাঁজ করে রেখেছি বালক,
তোমাকে শেখাবো তাঁর নিখুঁত বুনন
সূক্ষ্ম মহাজাগতিক তন্তু দিয়ে
ছায়াপথ থেকে বেছে বেছে কী করে নত্র বসাতে হয়।
সপ্তর্ষির এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে রেখা টেনে
কীভাবে বানিয়ে নেবে মসলিন আকাশ-
সবটুকু জেনে যাবে সম স্বভাবে।
তার আগে বুড়িগঙ্গার তীর থেকে
এনে দাও আমার আঙ্গুল…
রক্তাক্ত নিখোঁজ মুক বিজিত আঙুল।
প্রিয় পাঠক, এতোণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন এই বেদনার উৎস কোথায়। আমরা ভুলে যাইনি আমাদের নত্রখচিত মসলিন কাপড়ের কথা। ভুলে যাইনি বার হাত মসলিন শাড়ি একটি আংটির নিচে অথবা ম্যাচের বাক্সে ভাঁজ করে রাখা যেতো। ঈর্ষাকাতর দাম্ভিক মতালিপ্সু ইংরেজের অনেক অত্যাচারের সাথে যুক্ত হয়ে আছে এই সত্য কাহিনীটিও যে, ওরা বিশ্বখ্যাত মসলিন শিল্পটি ধ্বংস করার জন্য কেটে দিয়েছিলো সকল মসলিন শিল্পীর আঙুল, ইতিহাস তার সাী।
কবি ওমর কায়সার-এর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বাস্তু সাপও পালিয়ে বেড়ায়’-এ একটিও নর-নারীর প্রেমের কবিতা নেই। এমনকি ‘কক্সবাজারের ভালবাসা’-কেও পুরোপুরি প্রেমের কবিতা বলা যায় না। তেমনি -দ্বিতীয় গ্রন্থেরও দু’একটি কবিতায় (স্মৃতির মধ্যে দুইটি পাথর, যে গান শুনিনি কখনো, আমার তৃষ্ণার কাছে) প্রেমের আমেজ থাকলেও তা নিটোল প্রেমের হয়ে ওঠেনি। কিন্তু প্রেমের কবিতা রচনায় যে তিনি সিদ্ধহস্ত প্রথম গ্রন্থে তার প্রমাণ রেখেছেন। (এক পাণ্ডুর রোগিনীকে, লিলিগাংগুলি পাখি নয় ইত্যাদি)।
কবির তৃতীয় গ্রন্থে আছে বৈচিত্র্যের স্বাদ, আছে বহুমাত্রিকতা। পূর্বোক্ত দুটি গ্রন্থের মেজাজ নিয়েই এখানে যোগ হয়েছে নতুনমাত্রা। কবি প্রাচীন ভারত থেকে হেঁটে হেঁটে এসে দাঁড়িয়েছেন মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে। কবির কথায় ‘বৃত্ত থেকে বিন্দুতে।’ তবে রয়ে গেছে পূর্বোক্ত গ্রন্থদ্বয়ের জীবনানন্দীয় বেদনাবোধ, অস্তিত্ব সন্ধানী কর্ম প্রয়াস এবং লুপ্ত জীবনের অঙ্গীকার। দখলমত্ত মানুষ আজও দখল করতে পারেনি নিসর্গ মেঘ বিদ্যুৎ যদিও সে দখল করে ফেলেছে আকাশ।
তুমি আমার আকাশটুকু কেড়ে নিয়েছ– আমি তোমারটুকু
কিন্তু তোমার বিদ্যুৎ আর আমার মেঘ কেউ কারো কাছ
থেকে ছিনিয়ে
নিতে পারি নি।
(হারানো আকাশ, বা. সা. পা. বে)।
গ্রন্থের নামাঙ্কিত ‘বাস্তুসাপও পালিয়ে বেড়ায়’ একটি উৎকৃষ্ট কবিতা। কবি ওমর কায়সার সিরিয়াস বিষয়কেও খুব সহজ শব্দবন্ধে প্রমিতবাক্যে চাুস করে তুলতে পারেন। কবিতাটির বিষয় এই সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। যেখানে ধর্মের নামে চলছে অধর্ম, সন্ত্রাস, হরণ করা হচ্ছে সংখ্যালঘু অধিকার। সাম্প্রতিক সময়ের প্রতিমা ভাঙার এবং মৌলবাদীদের তীব্র উত্থান স্বরবৃত্তের দোলাচলে চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন কবি। কবি এখানে তুলে ধরেছেন সেই বাংলাদেশ যেখানে নেই কোন সাম্য, প্রতিসাম্য। মানুষ পলায়নপর। কোন্ সন্ত্রাস তাকে বিতাড়িত করছে তার জš§ভূমি থেকে? পুতুল খেলার মতো অবলীলায় অন্যের ধর্মীয় চেতনায় আঘাত করা এতো সহজ হলো কেনো আজ? এই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে আমরা তাঁর কবিতাংশটি পাঠ করি-
অনেকগুলো মাটির পুতুল বিনা তালে নাচছে এবং কাঁদছে দেখি
নাচা-কাঁদার মধ্যে কোনটা আসল কোনটা মেকি
বিষয় ছাড়া নাচছে পুতুল, কাঁদার মধ্যে রহস্য কি?
এখন বিষয় খুঁজতে কবির পুতুলগুলো লণ্ডভণ্ড
দশখানা হাত দশদিকে যাক-এটাই হবে আসল দণ্ড।
পুতুলগুলো কাঁদবে ঠিকই তাদের জন্য এটাই ধার্য
পুতুল নাচের ইতিকথায় বিসর্জনই অনিবার্য।
বিষয় ছাড়া পদ্য এবং ছন্দ ছাড়া পুতুল নাচের
আÍীয়তা অনেক দিনের, ঘনিষ্ঠতা খুবই কাছের।
প্রতিটি কবিতাই নিজস্বতা নিয়ে আলাদা আলোচনার দাবি রাখে। চেয়ারের গান, টেবিলের গান, বহু রক্তে গড়েছে ভারত, কিছু কান্ত পালক আর শান্ত শব্দ, অনিবার্য লোহিত ধারা, অভিধানের পাতায় এরকম অসংখ্য কবিতা বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ুদ্র ুদ্র সিম্বলিক টেবিলের গান, চেয়ারে গান-এর ব্যাপ্তি কিন্তু মহাকালিক। অনিবার্য নিদারুণ পরিণতি জেনেও দখলমত্ত মানুষের জীবনের সংপ্তি অথচ কী অসাধারণ প্রতীক চিত্রকল্প এঁকেছেন কবি-
স্বরমণ্ডলের মতো সাজিয়ে রেখেছো সাত-সাতটি চেয়ার
অথচ মানুষ আছে আট জন
একজন নিশ্চিত ঝরে যাবে জেনেও মানুষ চেয়ার সঙ্গীত শোনে,
আর বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে সাতটি চেয়ারের চারপাশে আটজন দখলমত্ত মানুষ
এভাবে বারবার এককেটি চেয়ার উঠে যাবে আর এক একজন মানুষ জরে যাবে।
কবি এও জানেন-
কবিতা সবসময় জীবনের অনুগামী নয়
বরং কবিতার জন্য মাঝে মাঝে পেতে তীব্র কাক্সা প্রকাশ করেন কবি-
অন্তত: একটি ভোর যদি আমি নিজের মতো করে রচনা করতে পারতাম,
একটা নিজস্ব নিদ্রায় যদি আÍজের ঘ্রাণমাখা স্বপ্ন পেতাম।
(কিছু কান্ত পালক আর শান্তশব্দ বা. সা. পা. বে)।
মুক্তিযুদ্ধের চিন্তাচেতনা লুপ্ত ধ্বংস বাংলাদেশকে কবি- ‘বত্রিশ বছরের পুরোনো লাশ তার সমাধিসমেত ফের তাজা’ হয়ে উঠতে দেখেন যেমন, তেমনি দেখেন-
জšে§র একহাজার নয়শত একাত্তর বছর পর পৃথিবীর ভূখণ্ডে
যীশু আরেকবার অনেক হয়ে জšে§ছিলেন। (করতালি-বা.সা.পা.বে)
অথবা, ’৭২-এর সংবিধান নিয়ে লেখা
অভিধানের পাতায় পেলাম হঠাৎ করে তিরিশ বছরের পুরোনো চার/পাপড়ির ফুল।
(অভিধানের পাতায়, বা. সা. পা. বে)।
কবির গ্রন্থত্রয় থেকে অসাধারণ কিছু উপমা ভরা পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।
১। সমুদ্রের ডিম থেকে যখন জলের শিশুরা ফুটে বের হয়।
২। স্বরমণ্ডলের মতো সাজিয়ে রেখেছো সাতসাতটি চেয়ার।
৩। মাখনের কাঁচুলী পরা শরীর বালিকা।
৪। কালের রূপালি ডিম।
নিঃসঙ্গতা তার তিনটি কাব্য গ্রন্থেরই প্রিয় বিষয়-
১। ব্যবধান ঘুচে যাওয়ার মত সান্নিধ্য কোথাও নেই (প্রা. দু.)
২। কালরাতে মরমী মরমী সিথানে মন্ত্রপাঠে মগ্ন ছিল মায়াবী পরীরা।
ভেতর কান্নাকে ওরা দেব শিশুর উত্থান বলে ভ্রম করে
দোল দিয়ে গেছে মগজের নাগরদোলায়।
(প্রা.বি.)
৩। বিকৃতভোরের থেকে ছায়াহীন একটা ভুবন আমাকে
একা পার হতে হবে।
(বা. সা. পা. বে)
তিনটি গ্রন্থের মধ্যে ‘প্রতিমা বিজ্ঞান’ এ-ই কবি সবচেয়ে বেশি ভারতেশ্বরীমুখী। যদিও অরবৃত্ত ছন্দে কবির অগাধ বিচরণ তবুও মাত্রাবৃত্ত এমনকি স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতায়ও কবি রেখেছেন সমানকৃতির স্বার। মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ‘এক পাঞ্জুর রোগিনীকে’ যেমন একটি সার্থক কবিতা তেমনি হিন্দু ধর্মের প্রতিমা ভাঙা যে আজ একটি মজার এবং পুতুল খেলার মতোন বিষয় সেটিকে ব্যাঙ্গার্থে জমিয়ে তোলার জন্যে স্ববৃত্তের আশ্রয়ে লেখা ‘বাস্তু সাপও পালিয়ে বেড়ায়’ অথবা ‘এই কবিতায় ‘স্বপ্ন’ এসব কবিতার ছন্দ যথাযথভাবে তার মেজাজকে ধরতে পেরেছে।
আবার কবি কায়সার ভাষাকে শাসন করে ঠাঁসা গদ্যের ছাঁদে লিখেছেন শেষ গ্রন্থের বেশি কিছু উল্লেখযোগ্য কবিতা। কবি কায়সারের সমগ্র কাব্যগ্রন্থই প্রথাগত আধুনিক শব্দ জটিরতা এবং কাঠিন্য দোষে দুষ্ট নয়। স্বেচ্ছাকৃত শাব্দিক জটিলতা পরিহার করায় কবিতার বিষয় ভাবনা স্পষ্টতর ও সুখপাঠ্য হয়েছে।
বাঙালি জাতির আভ্যন্তরীণ কাঠামোকে শক্তিশালী করে বাঙালি সত্তার পুনরুজ্জীবনে সচেষ্ট হয়েছেন তিনি। দর্শনে চিন্তায়, চেতনায়, ধর্মে সংস্কারে তিনি অতিক্রম করতে চেয়েছেন এই নষ্ট আধুনিকতাকে এবং এই জাতির ঐতিহ্যক পরিচয়কে তুলে ধরেছেন। আর এখানেই আমি বলবো কবি ওমর কায়সার হয়ে উঠেছেন মহাকালিক এবং মহাজীবনের সাথে সেই মহাকালের দুন্দুভি সম্মিলন ঘটাতে পেরেছেন। এই খোলকরতাল বাজাতে গিয়ে তিনি দ্বারস্থ হয়েছেন হিন্দু-বৌদ্ধ খ্রিস্টান-মুসলিম পুরাণ কথার। এভাবে অস্তিত্বের নানাবিধ দ্বন্দ্ব-দ্বৈততার সাথে কাব্যিক উম্মোচনে কবি ওমর কায়সার হয়ে উঠেছেন এক মহামহিম।#
সেলিনা শেলী, কবি ও প্রাবন্ধিক