লিঙ্গভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা
তামান্না কদর
বাঘকে বাঘ হবার জন্যে, বেড়ালকে বেড়াল হবার জন্যে জীবনের সারাটাবেলা কোনও সাধনা করতে হয় না। বাঘ জন্মেই বাঘ, তেমন অন্যান্য প্রানীও তাই কিন্তু মানুষ প্রাণী হিসেবে জন্মে মানুষ হবার জন্যে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালায়। কেউ হয় অমানুষ, ঊন্মানুষ, কেউ মানুষ। দুটি হাত আর দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারলেই মনুষ্য প্রাণী, মানুষ হয় না। মানুষ হয়ে উঠার জন্যে তাকে বিশেষ কিছুর আশ্রয় নিতে হয়। তার নাম শিক্ষা। শিক্ষা নানাভাবেই মানুষ অর্জন করতে পারে। আমরা সবাই জানি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নামে একটি শিক্ষা ইট, কাঠ ,টিন, দেয়াল এসব ভৌত অবকাঠামোর মধ্যে সম্পন্ন হয়। এই শিক্ষা প্রক্রিয়াটির সঙ্গে যুক্ত থাকেন শিক্ষাবিদ, বইপ্রণেতা, শিক্ষা সম্পর্কিত নীতিমালাতৈরিকারী, অভিভাবক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং শিক্ষোৎসাহী সামাজিক ব্যক্তিসকল। ৬ বছর বয়স থেকে, বর্তমানে ৫ বছর বয়স থেকেই শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ শুরূ হয়। মূলতঃ শিশু শিখে মাতৃগর্ভ থেকে। তারপর পৃথিবীর আলোয় এসে পরিবার, আত্মীয় এবং সমাজের মানুষের কাছ থেকে শিখে। এই শিক্ষাটা আমাদের সমাজে মূলতঃ মানুষ শেখায় না, শেখায় নারী আর পুরুষেরা। নানারকম নিষেধ আর প্রশ্রয় মেয়েশিশু এবং ছেলেশিশুকে আলাদা করে দেয়। এমনভাবেই আলাদা করে যে, যেখানে মেয়েশিশু হীনমন্যতায় ভোগে আর ছেলেশিশুটি পায় অবারিত পৃথিবী। ছেলেশিশুর কাছে তখন মেয়েশিশু অত্যন্ত তুচ্ছ, ঊন্মানুষ হয়ে ওঠে। আর এই ঊন্মানুষ হয়ে ওঠার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটি পায় বিদ্যালয়গুলিতে।
ভাবতে অবাক লাগে যে বিশ্বের প্রথম যে কয়টি দেশ নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যবিলোপ সনদ অনুমোদন করে বাঙলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। অথচ এ কেমন শিক্ষাব্যবস্থা! এ যেন ভেতরে ইঁদুর রেখে উপরে লেপেপুছে ভাবা ইঁদুর যেহেতু আর দেখা যাচ্ছে না, ইঁদুর নেই। এভাবে ইঁদুর বিনাশ হয় না। এ কি না বোঝার মতো কোন বিষয়? আমার ধারণা, এটা বোঝেন সবাই। তাহলে এখনো কেন শিক্ষাব্যবস্থায় এমন সব বিষয়, এমন সব পাঠ্যসূচী রয়েছে যা ’মহিলা’ বানায়; ’পুরুষ’ বানায়; মানুষ বানায় না? পুরুষ ভাবতে শিখে- মহিলা তুচ্ছ বিষয়, মহিলা পুরুষের থেকে নি¤œমানের, তাই তার অধিকার এবং প্রাপ্য হবে কম। আমার ধারণা ভেতরে ভেতরে খুব সচেতনভাবেই পাঠ্যসূচী প্রণেতারা এটি করে থাকেন। কারন এদের বেশীরভাগই পুরুষ অথবা পুরুষমগজজাত নারী। এরা কিছুতেই নারীকে মানুষ হয়ে উঠতে দিতে চায় না কেননা এতে যে সমাজে সুবিধেভোগের সমস্যা হবে তাদের এবং তাদের পুরুষ প্রজন্মের।
এখানে কিছু উদাহরণ দেয়া গেলে খুব সহজেই ধরা পড়বে যে ঈঊউঅড নিয়ে আমাদের যে উচ্ছাস এবং অঙ্গীকার তা পূরণ হবার পথ বহুদূর। ৮ মার্চ পালন কতোটাই না প্রহসন! অত কিছুর দরকার পড়ে না যদি শিক্ষাব্যবস্থায় মেয়েশিশু এবং ছেলেশিশুকে একই শিক্ষা দেয়া হয়। পাঠ্যসূচী হয় এক, শিক্ষকের আচরণ এবং উপদেশ উভয় শিশুর ক্ষেত্রে এক হয়।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক ২০০৪ শিক্ষাবছর থেকে তৃতীয় শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকরুপে নির্ধারিত ’পরিবেশ পরিচিতি সমাজ’ বইটির ১৯ পৃষ্ঠায় ’চিত্র১ঃ দাদাদাদীকে সাহায্য করা’ শিরোনামের চিত্রটিতে দেখা যায় দাদীর পাশে পরিবারের ছেলেশিশুটি কিছু একটা পড়ছে আর মেয়েশিশুটি দাদাকে পানি দিচ্ছে। এ ভীষণ চিরাচরিত দৃশ্য। এরকম চরিত্র চিত্রায়ণে আমরা বহুকাল থেকে অভ্যস্থ। আর এরকম চরিত্র চিত্রণে মেয়েশিশু এবং ছেলেশিশুর মধ্যে পার্থক্য থেকেই যাবে। কাজ হয়ে পড়ে নারীর-পুরুষের নির্দিষ্ট। অর্থাৎ মেয়েরা বড় হয়ে পরিবারের পরিচর্যাই করবে,পাশাপাশি অন্য কিছু করলে করতে পারে। বিষয়টি এমন হওয়া উচিত নয়। ছেলেশিশুকে পরিবারের পরিচর্যায় নিয়োজিত না করলে জেন্ডার বৈষম্য দূর করা অসম্ভব। রাষ্ট্র দায়িত্ব নেবে পাশাপাশি সচেতন মানবসমাজ। তবে এমন গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যসূচীতে এমন চরিত্র চিত্রণ কি যুক্তিযুক্ত? আমার তা মনে হয় না।
একই বইয়ের ৫৮ পৃষ্ঠার চিত্রটিও পুরাতন অভ্যাসের চিত্র দিয়ে শোভিত! বাবা অর্থাৎ পুরুষটি বই নিয়ে ব্যস্ত বা বই গোছাচ্ছেন, ছেলেটি তার সহায়ক। মা বিছানা গোছাচ্ছেন, মেয়ে তার সহায়ক। এর ব্যত্যয় ঘটলে কি আমাদের শিশুদের লিঙ্গবিভাজনের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ হয়ে উঠত না? সবাই সব কাজ করতে পারে কিন্তু মনে হয়েছে এখানে সেই চিরাচরিত মানসিকতা ত্যাগ করা সম্ভব হয়নি। এভাবে লিঙ্গবৈষম্য আরো গেঁথে যাবে।
একই বইয়ের ৫৯ পৃষ্ঠায় পেশা হিসেবে কৃষক, তাঁতি, জেলে, কামার, কুমোর, দর্জি, নাপিত, মুচি, কুলি, ফেরিওয়ালা, মাঝি, রিকশাচালক, রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, বিদ্যুৎমিস্ত্রি, কারখানা শ্রমিক, শিক্ষক, বিচারক, আইনজীবি, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, সেবিকা- এদের ছবি দেখানো হয়েছে। উল্লিখিত পেশাগুলির সবগুলিই নারীরা অল্পবিস্তর করেছে এবং করছে। খুব অবাক করা বিষয় যে, শুধু সেবিকার ছবিটাই নারীর। আবার সেই নারীর চিরাচরিত চরিত্র চিত্রণ। যেন নারীর জন্মই হয়েছে সেবা করার জন্যে। এসব ছবি থেকে আমাদের কোমলমতি শিশুরা কী শিখবে! মেয়েশিশুরা হীনমন্যতায় ভুগবে আর ছেলেশিশুরা মেয়েশিশুদের তুচ্ছ ভাবতে শিখবে। আমরা জানি, একটি ছবি অনেক কথার চে বেশী কার্যকরী। সেক্ষেত্রে ছবি প্রতিস্থাপনের সময় সতর্কতা খুব প্রয়োজন।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক ২০০৪ শিক্ষাবছর থেকে তৃতীয় শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকরুপে নির্ধারিত ’পরিবেশ পরিচিতি বিজ্ঞান’ বইয়ের ২৭ পৃষ্ঠায় বাতাসের অস্তিত্ব পরীক্ষার জন্যে ছেলেশিশুটিকে ঘুড়ি ওড়ানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ চরিত্র চিত্রণ আমাদের পরিচিত। এতে লিঙ্গবৈষম্য দৃঢ় হয়। এখানে মেয়েশিশুটিকে অথবা উভয় শিশুকে এই দায়িত্ব দেয়া যেতো। তাতেই আমাদের কোমলমতি শিশুরা অনুধাবন করতে পারত যে মেয়ে এবং ছেলেতে মানুষ হিসেবে কোনও পার্থক্য নেই। আর যদি উচ্চ বিদ্যালয়ের দিকে তাকাই তাহলে কী দেখতে পাই-
দেখতে পাই যে, ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত দুটো বই আছে যেগুলোর নাম গার্হস্থ্য অর্থনীতি ও কৃষি শিক্ষা। সাধারণত মেয়েরা গার্হস্থ্য অর্থনীতি পড়ে আর ছেলেরা কৃশি শিক্ষা নিয়ে পড়াশোনা করে। ক্ষেত্রবিশেষে মেয়েরা কৃষি শিক্ষা নিয়ে পড়ে থাকে। গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে কৃষিশিক্ষার কিছু বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত কিন্তু গার্হস্থ্য অর্থনীতির কোন বিষয়, যা সাধারণত আমরা ঘর-দোরের বিষয় বুঝে থাকি তা কৃষি শিক্ষাতে নেই। ভাবতে অবাক লাগে যে এমন পাঠ্যসূচী ও কারিকুলাম নিয়ে আমরা নারী-পুরুষের সমতা বিধান করবো বলে থাকি। মেয়েদের বলি- মানুষ হও। ঘর নয়, বাইরের আলোতে আস আর ছেলেদের বলি-মেয়েদের সম্মান করো। এমন বৈষম্যযুক্ত সিলেবাস দিয়ে এসব উপদেশ দেয়া আর মুর্খামি করা এক কথা। মেয়েরা কৃষি শিক্ষা নিয়ে পড়লে কেউ হাসে না কিন্তু ছেলেরা গার্হস্থ্য অর্থনীতি নিয়ে পড়লে হাসির রোল পড়বে এবং ছেলেটি হয়ে যাবে তথাকথিত ’হাফলেডিস’। এ মানসিকতা আমাদের তথাকথিত সমাজের তৈরি। আর এ মানসিকতা বয়ে নিয়ে চলেছি আমরা, নিজেরা যাদের প্রগতিশীল বলে দাবি করি। এ ধরণের সিলেবাস প্রণয়নে প্রশ্ন জাগে ছেলেরা কি ঘরে বাস করে না? ঘর-দোরের বিষয়গুলি তাদের জানার দরকার নেই? ছেলেরা ঘর এলোমেলো করবে, মেয়েরা গোছাবে এই নিয়ম মানি না, মানি, মানি না, মানি এরকম চলছে। গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে মেয়েদের প্রাকৃতিক শারীরগত কিছু বিষয় রয়েছে বলে শুধু মেয়েরাই গার্হস্থ্য পড়বে? ছেলেরা জানবে না বিষয়গুলি? সব উঠতি এবং প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেই জানে। তবে উঠতি বয়সের ছেলেরা বেশীরভাগ সময়ই ভুল জানে বরং বইটি পড়লে তার জানাটি শুদ্ধ হবে। আর জানবেই বা না কেন? ছেলের জন্ম প্রক্রিয়ায় নারী, নারীর শরীর, নারীর প্রাকৃতিক শারীরগত বিষয়গুলি তো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই আমাদের উচিত এমন একটি বই তৈরি করা যেটি মেয়ে-ছেলে উভয়েই পড়বে এবং তাতে গার্হস্থ্য অর্থনীতি এবং কৃষি শিক্ষার ৫০%/৫০% বিষয় থাকবে। তবেই ছেলেরা বুঝবে- মেয়েরা তুচ্ছ নয়, সম্মানের দাবিদার আর মেয়েরা ভুগবে না কোন হীনমন্যতায়।
এবার আসি একটি নমুনা প্রসঙ্গে-
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা কর্তৃক প্রণীত ৭ম শ্রেণীর গাহস্থ্য অর্থনীতি বইয়ের ৭০ পৃষ্ঠায় ’স্ত্রী-পুরুষভেদে’ শিরোনামে লিখা আছে-প্রত্যেক দেশেই নারী ও পুরুষের পোশাকের ভিন্নতা দেখা যায়। পুরুষ এবং মেয়েদের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পোশাক প্রয়োজন। আমাদের দেশে মেয়েদের শাড়ী, সালোয়ার-কামিজ ইত্যাদি প্রচলিত। ছেলেদের জন্যে শার্ট, প্যান্ট, লুঙ্গি, পায়জামা, পাঞ্জাবি ইত্যাদি উপযোগী। ছোট শিশু ও ছেলেমেয়েদের পোশাকে অনেক সময় তারতম্য থাকে না। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে ছেলেদের জন্যে ছেলেদের পোশাক এবং মেয়েদের জন্যে মেয়েদের পোশাক নির্বাচন করা উচিত। অনেক সময় স্কুল-কলেজের মেয়েরা যে শার্ট, প্যান্ট পড়ে এতে তাদের ব্যক্তিত্বকে ক্ষুন্ন করে। তাছাড়া পোশাকের বস্ত্র ও রং স্ত্রী-পুরুষভেদে পৃথকভাবে নির্বাচন করতে হবে।
বইটি রচনায় রয়েছেন- সুরাইয়া বেগম, ফিরোজা বেগম।
সম্পাদনা-ছিদ্দিকা খাতুন।
আমরা জানি, সমাজ নারী-পুরুষ তৈরি করেছে নানারকম বিষয়াবলীর পৃথক পৃথক ব্যবস্থা করে। পোশাক তার মধ্যে অন্যতম। প্রকৃতি বলে দেয়নি কে কেমন পোশাক পড়বে। সেক্ষেত্রে পোশাক হওয়া উচিত আরামদায়ক ও গতিস্বাচ্ছ্যন্দের, সেটা নারী এবং পুরুষ উভয়ের বেলাতেই।
তামান্না কদর
কলাম লেখক
ইমেইল -tamannakodor@gmail.com