রেজাউদ্দিন স্টালিন ও তার কবিতায় মিথের জগত
রনজু রাইম
আশির দশকের মাঝামাঝি অর্থাৎ ১৯৮২ সালে রেজাউদ্দিন স্টালিনের প্রথম যৌথ কবিতার বই ‘পূর্ণপ্রাণ যাবো’ প্রকাশিত হয়। তার একক কাব্য সংকলন ‘ফিরিনি অবাধ্য আমি’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। লেখালেখি শুরু করেছিলেন আরও আগে। আশির দশকের শুরু থেকেই দেশের শীর্যস্থানীয় দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী এবং বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিনে কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের অসংখ্য কবিতা মুদ্রিত হয়ে আসছে।
২০০৭ সাল পর্যন্ত তার প্রকাশিত গ্রন্থ, স্বতঃস্ফূর্ততা সমসাময়িক শীর্যস্থানীয় দু’একজন লেখকের তুলনায় অগ্রগণ্য। আর একজন কবিতাকর্মী হিসেবে তার নিরন্তর সাধনার স্বীকৃতিও কম মেলেনি। দেশে ও দেশের বাইরে, একাধিকবার তাকে সম্মাননা- সংবর্ধনা প্রদান এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন কবিতার জন্য। আর এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে তার কবিতা সর্বমহলে আলোড়ন সৃষ্টির কারণে। তার কবিতায় যে মিথের ব্যবহার তাতে একজন কবির ধ্র“পদীশক্তির কথাই উচ্চকিত হয়। শব্দকথা, মিথ ও পঙ্তির আড়ালে যে দর্শন ও প্রজ্ঞা তা আমাদের বিস্মিত করে।
বাংলা কবিতায় অনেক কবিই এইসব মিথের ব্যবহার করেছেন কিন্তু তা নতুন কিছু নয়। শামসুর রাহমানের কবিতায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য মিথ, আল মাহমুদের কবিতায় মুসলিম মিথের ব্যবহার আছে। এছাড়াও আধুনিক বাংলা কবিতার সকল পর্যায়েই কিছুসংখ্যক কবি মিথের শরণাপন্ন হয়েছেন। কিন্ত স্টালিনের কবিতায় একইসঙ্গে প্রাচ্য,পাশ্চাত্য এবং মুসলিম মিথের প্রাসঙ্গিক প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। তার কবিতায় কেবল মিথের ব্যবহারই নয়- রয়েছে সমকালীন জীবনবোধ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, মানবতাবোধ, প্রেম-অপ্রেম, আকাক্সক্ষা শূন্যতা দীর্ঘশ্বাস, অস্থিরতা ঘৃণা ও অন্তজাগর্তিক রহস্যের রূপরেখা। নিজস্বপথ ও মতের আলোকে উজ্জীবিত ক’রে স্টালিন পাঠককে নিয়ে যান কল্পনার এক নতুন জগতে। ভিনদেশী পাঠকরাও তার এই কল্পনাজগতে প্রবেশ করে তার বোধের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারেন। চিন্তা বিশ্বের মধ্য দিয়ে আমারা প্রবেশ করি আমাদের ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কেন্দ্রে যেখানে সময় ও স্বপ্ন একই সূত্রে গাঁথা ।
যশোরে কৌশরে
যশোর নলভাঙা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত প্রগতিশীল পরিবারে ২২ নভেম্বর ১৯৬২ সালে কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের জন্ম। শিক্ষক পিতামাতার সন্তান তিনি। ছোটবেলা থেকেই গড়ে ওঠে পাঠাভ্যাস এবং সেই থেকেই শুরু হয় কাব্যচর্চার এবং সেই থেকে লেখালেখিতে সম্পৃক্ততা। কৈশোরে তার মায়ের আকাক্সক্ষা ছিল যে তার ছেলে বড় কবি হবে। মায়ের স্বপ্ন বুকে পাঁচ বছর বয়স থেকেই যশোরে বেড়ে ওঠেন তিনি এবং কবিতা লিখতে শুরু করেন। বেগম আয়শা সরদার সম্পাদিত ‘শতদল’পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা মুদ্রিত হয়। ঐতিহ্যবাহী মাহমুদুর রহমান বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয় থেকে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। অর্থনীতিতে সম্মান সহ øাতক পাশ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধীনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে øাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। নজরল ইন্সটিটিউটের উচ্চপদে কর্মরত আছেন কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন। পৃথিবীর বেশকয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার কবিতা। ভারতের প্রায় সবকটি ভাষতেই তার কবিতা অনূদিত হয়েছে। বজ্রনাথ রথ উড়িয়া ভাষায় তার কবিতা অনুবাদ সংকলন প্রাকাশ করেছেন। খুবই আড্ডাপ্রিয় স্টালিন। একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- কোনদিন আড্ডা দিতে না পারলে সে রাতে ঘুম হয় না। স্টালিন বিবাহিত এবং এক কন্যা সন্তানের জনক।
সৃষ্টি, পুরস্কার ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ২১টি। পূর্ণপ্রাণ যাবো (১৯৮৩), ফিরিনি অবাধ্য আমি (১৯৮৫), দাঁড়াও পথিকবর (১৯৮৬), ভেঙে আনো ভিতরে অন্তরে (১৯৮৭), সেইসব ছদ্মবেশ (১৯৮৯), আঙুলের জন্য দ্বৈরথ (১৯৯২), আশ্চর্য আয়নাগুলো (১৯৯২), ওরা আমাকে খুঁজছিল সম্ভাবনার নিচে (১৯৯৬), পৃথিবীতে ভোর হতে দেখিনি কখনো (১৯৯৭), আশীর্বাদ করি আমার দুঃসময়কে (১৯৯৮), হিংস্র নৈশভোজ (১৯৯৯), আমি পৃথিবীর দিকে আসছি (২০০০), লোকগুলো সব চেনা (২০০১), নিরপেক্ষতার প্রশ্নে (২০০২), পদশব্দ শোনো আমার কন্ঠস্বর (২০০৩), পুনরুত্থান পর্ব (২০০৬), অবিশ্র“ত বর্তমান (২০০৭), মুহূর্তের মহাকাব্য (২০০৬), রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা (১৯৯০), রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা সংগ্রহ (১৯৯৫), রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা সমগ্র (১৯৯৬)। মৃত্যুর জন্ম দিতে দিতে (২০০৮) শিশুতোষ গ্রন্থ: হাঁটতে থাকো (২০০৮), নজরুলের আত্ম-নৈরাত্ম (২০০৬)। স্বকন্ঠে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তির অডিও ক্যাসেট: ফিরিনি অবাধ্য আমি (১৯৮৫) (গিতালী), সেই সব ছদ্মবেশ (১৯৮৭) (গীতালী) উপন্যাস: সম্পর্কের ভাঙে (২০০৩)
প্রাপ্ত পুরস্কার
সাংস্কৃতিক খবর সম্মাননা ভারত (১৯৮৭), ছোটকাগজ সম্মাননা-রাউরকেল্লা উড়িষ্যা, ভারত (১৯৮৭), ইকো সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮), দার্জিলিং নাট্যচক্র পুরস্কার, ভারত (১৯৯১), ধারা সাহিত্য আসর স্বর্ণপদক (১৯৯৩) লাইফ ইন্টারন্যাশনাল এওয়ার্ড (১৯৯৪), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক একাডেমী স্বর্ণপদক (১৯৯৫), নাইট জুভেনাইল কনফেডারেসী পুরস্কার (১৯৯৮), বর্জন পুরস্কর (১৯৯৯), শব্দবার্তা সম্মাননা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত (২০০৫), সম্মিলনী মহিলা সমবায় সমিতি লি. পুরস্কার (২০০৪), মহানগর সাংস্কৃতিক ফোরাম পুরস্কার (২০০৪), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (২০০৫), রোদসী সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন সম্মাননা (২০০৫), দেশ, মাটি ও মানুষ সম্মাননা (২০০৩), অনন্য আশি সম্মাননা খুলনা রাইটাস ক্লাব পুরস্কার (২০০৫), খুসাস স্বাধীনতা পদক (২০০৭), ম্যাজিক লণ্ঠন সম্মাননা (২০০৫) মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার (২০০৮)। অনুবাদ: ঝঊখঊঈঞঊউ চঙঊগঝ ঙঋ জঊতঅটউউওঘ ঝঞঅখওঘ ঞৎধহংষধঃবফ নু তধশধৎরধ ঝযরৎধুর. উড়িয়া ভাষায় রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতার অনুবাদ- ব্রজনাথ রথ (১৯৯৫)। এছাড়া রুশ, জার্মান, হিন্দী, মালায়লাম, উর্দু, চীনা ও ফরাসী ভাষায় তার কবিতা অনুবাদ হয়েছে।
টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা ও পরিকল্পনা
বিটিভি, এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই, আরটিভি ও মাইটিভিসহ অধিকাংশ চ্যানেলে। অনুষ্ঠান উপস্থাপন (১) চাওয়া পাওয়া (২) তারুণ্য (৩) শিল্প ও সাহিত্য (৪) সবার জন্য (৫) আরশিনগর (৬) অক্ষরের গল্প। (৭) প্রতিধ্বনি।
একক সংখ্যা
রেজাউদ্দিন স্টালিনের কাব্যকীর্তি সংখ্যা: রেজাউদ্দিন স্টালিন সংখ্যা ‘গদ্য’ সম্পাদনা; প্রত্যয় জসীম। ‘দিগন্তবলয়’ রেজাউদ্দিন স্টালিন সংখ্যা কলকাতা, ভারত সম্পাদনা বরুন দাস সম্পাদিত পত্রিকা ‘রৌদ্র দিন’, ‘বসন্ত-বর্ষা-শরতের পদাবলী’। রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা বিষয়ক আলোচনা; শিবনারায়ণ রায়, শঙ্খ ঘোষ, আল মাহমুদ, বিশ্বজিৎ ঘোষ, শান্তনু কায়সার, জাকারিয়া শিরাজী, আহমাদ মাযহার, রহমান হেরনী, তপন বাগচী, নির্মল বাসাক, মতিন বৈরাগী, বিমল গুহ, আহমেদ মাওলা, শিমুল আজাদ, চঞ্চল আশরাফ, রনজু রাইম, শাহীন রেজা, রওশন ঝুনু বুননু রাইন, জামসেদ ওয়াজেদ প্রমুখ।
মূল্যায়ন
রেজাউদ্দিন স্টালিন যে নিঃসন্দেহে একজন শক্তিমান ও শ্রেষ্ঠতম কবিদের একজন দুই বাংলার প্রখ্যাত লেখক সমালোচকগণের তার কবিতার ওপর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ও মূল্যায়নই তার প্রমাণ। স্টালিনের কবিতা সম্পর্কে ওপার বাংলার প্রখ্যাত সমালোচক শিবনারায়ণ রায় বলেছেনÑ ‘স্টালিন চেষ্টা করেছেন মিথকে বর্তমান প্রেক্ষিতের সাথে সম্পৃক্ত করতে। গ্রীক রোমক ও ভারতীয় পুরাণ থেকে প্রাসঙ্গিক ব্যবহার তার কবিতাকে ধ্র“পদীগুণে অভিষিক্ত করেছে। তার তিথোনাসের কান্না, হারকিউলাস, নবজাতক, পৃথিবীতে ভোর হতে দেখিনি কখনো, আত্মস্বীকৃত ঘুম-এই কবিতাগুলো আমার ভালো লেগেছে। জাকারিয়া সিরাজী লিখিছেনÑ ‘বিপ্রতীপ কবিতা লেখা তখনই সম্ভব যখন কবিতা একটি পরিণতিতে আসে। এখন হয়তো বলা যায় বাংলা কবিতা এ্যান্টি পোয়েট্রিকে ধারণ করতে পারে। এ্যান্টি পোয়েট্রি স্টালিনের কবিতায় এক বিশেষ দিক। ঐতিহ্যের বাইরে গিয়ে কবিতাকে নতুন ব্যঞ্জনায় অন্বিত করা।’ বিশ্বজিৎ ঘোষ লিখিছেনÑ ‘মানুষের প্রতি প্রবল বিশ্বাস স্টালিনের কবিতাতে এনে দিয়েছে স্বতন্ত্র চারিত্র্য। সূচনাসূত্রেই বলা হয়েছে, ইতিহাসের প্রবহমান ধারাকে বিন্যস্ত ও প্রকৃতিকে ব্যবহার করেই তিনি দেখেছেন মানুষকে। সুতরাং লেখা যায়, স্টালিন তার সময়ে অন্যতম উল্লেখযোগ্য একজন প্রধান কবি।
জীবনাচারণ
আমরা রেজাউদ্দিন স্টালিনকে মূল্যায়ন করবো আরো সামনের দিনগুলোতে। তিনি নিরস্তর সৃষ্টিশীল মহৎপ্রাণ এক কবি। তিনি নিঃস্বার্থ প্রেমিক ও বিপ্লবী। ভালোবাসেন দেশকে। কথা বলেন সরাসরি। অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার শিল্পীত উচ্চারণ আমাদের মনোলোকে রেখাপাত করে। তার শত্র“ ও বন্ধুর সংখ্যা সমান। আস্তিক কিংবা নাস্তিক্যের ভেদাভেদ ভুলে তিনি এক সর্বমানবিক ধর্মের অন্বেষক। যা’ কিছু ভালো তার সঙ্গে থাকার ব্যাকুলতা আছে তার। পছন্দ করেন অসম্ভব নিরবতা। ভালোবাসেন ফুল আর গভীর নীলাকাশ। কৈশোর ব্যাপকভাবে টানে অতীতে। একটা স্বপ্নের সাঁকোর উপর দাঁড়িয়ে থাকতে ভালোবাসেন। বাংলাদেশ, দেশের মাটি ও মানুষ তার অন্বিষ্ঠ। যেখানেই যাবেন ফিরবেন এই বাংলায় এই দেশপ্রেমই কবি ব্যক্তিত্বের মূল স্পন্দন। তার জীবনাচরণ ঐশ্বর্যশীল ও গতিময়, তিনি বন্ধুবৎসল। প্রাণময় এই কবি শব্দের ভেতর স্থাপন করেন অনন্ত সংখ্যক অর্থ। উজ্জ্বল চোখের কাব্যদ্যুতিতে ভরা তার ললাটে জুটুক বিশ্ব-স্বীকৃতি।
মুক্তবাজার
রেজাউদ্দিন স্টালিন
কোথাও কেউ নেই গভীর বনপথ
পথের মাঝখানে কে যেন চিতাবৎ
অবুঝ ভঙ্গিতে চাটছে থাবা তার
হয়তো ভাবনায় আসছে বার বার
শিকার ফুরিয়েছে অভাবী সংসার
হঠাৎ দেখলো সে আমার ছায়াধার
উঠলো জ্বলে তার চোখের তলোয়ার
আমিও বহুদিন ঘুরছি বনে বনে
ক্ষুধায় পিপাসায় হয়েছি গন্গনে
প্রতিটি আচরণে রয়েছে উল্লেখ
আমাকে দেখছে সে আমিও অনিমেখ
দু’জন দুজনার বসেছি মুখোমুখি
পারলে এক্ষুণি কল্জে ছিঁড়ে ঢুকি
এভাবে কেটে গেলো হাজার হিমযুগ
এখানে কেউ নই কারোরই কৃপাভূক
কে কাকে ছিঁড়ে খাবে জানে না কেউ কিছু
ক্ষুধার হার বাড়ে শুধুই মাথাপিছু
সম্প্রতী দৈনিক যায়যায় দিন পত্রিকায় প্রকাশিত কবিকে নিয়ে লেখা প্রতিবেদনটি হুবহু সংযুক্ত হলো।
কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা
জন্ম দেবে নিজেরই আকাঙ্ক্ষার ভেতর’
_রেজাউদ্দিন স্টালিনদশকের খুপরিতে পুরে কবিতাকে বিচার করবার একটা রেওয়াজ দাঁড়িয়ে গেছে। তবে শুধু রেওয়াজই বা বলি কী করে; শ্রেণিকরণ ও পর্ববিন্যাস তো যে-কোনো বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের স্বীকৃত পদ্ধতি। রেজাউদ্দিন স্টালিনের দশকে অর্থাৎ আশির দশকে বাংলাদেশের কবিতা একটু নিষপ্রভ হয়ে পড়েছিল, তবে কয়েকজন মৌলিকতা-ঋদ্ধ, সৃষ্টি-সম্ভব কবির আগমন এই আশির দশকেই ঘটেছে। রেজাউদ্দিন স্টালিন নিঃসন্দেহে তাঁদের একজন এবং মডার্নিস্ট বা আধুনিকতাবাদীদের কবিতায় যে বুদ্ধিবৃত্তির প্রাধান্য সেটাকে স্টালিন বজায় রেখেছেন। ধ্রুপদী ভাবানুষঙ্গের ব্যবহার, মিথের প্রয়োগ, এই মডার্নিস্ট ধারারই অনুবর্তন।
কবিতা বুঝার জন্যে বা জানার জন্যে, কবিতার প্রাণ তার অর্থময়তা, ভাব না সঙ্গীত, পরিমিতি না নির্মিতি, সৌন্দর্যবোধ, অনুভূতির তীক্ষ্নতা না দর্শন, এ নিয়ে অনেক তর্কাতর্কি হতে পারে। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, কবি-মনের যদি থাকে উড়াল দেবার শক্তি, যদি এটা কবিতাকে পরিচিত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের ঊধর্ে্ব কোনো মানসলোকে নিয়ে যেতে পারে, সেটা হবে অবিনাশী কাব্যগুণ। কথাটা শুধু যে কবিতার বেলায় খাটে, তা নয়। কালজয়ী উপন্যাসকেও বাস্তবতা ও যুক্তির বাঁধন ছিঁড়ে বাস্তব-অতিরিক্ত একটি মাত্রা অর্জন করতে হয়। এই উড়াল দেবার অপরিমেয় শক্তি ছিল জীবনানন্দ দাশের। যেজন্য তিনি বাংলা সাহিত্যের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবি। জীবনানন্দ তাঁর অসাধারণ অনুভূতি আর কল্পনাশক্তি দিয়ে বাংলা কবিতার সীমানাকে বহুদূর বিস্তৃত করে দিয়েছেন যেটা বাংলার আর কোনো কবি পারেননি। জীবনানন্দের প্রসঙ্গ এখানে এজন্য আসলো যে, বড় ছোট_যে কোনো কবির আলোচনায় ঐতিহ্য, প্রেক্ষাপট ও প্রমিতির কথা এসে যায়। বাংলা কবিতায় তিরিশের দশকে এবং বাংলাদেশের কবিতায় ষাটের দশকে বাংলা কবিতায় যে পালাবদল ঘটল রেজাউদ্দিন স্টালিন সে-ঐতিহ্যকে উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছে। কিন্তু এই সমৃদ্ধ প্রেক্ষাপট সত্ত্বেও স্টালিন নিজস্ব নিরীক্ষা করেছেন, নিজস্ব অস্মিতা নির্মাণ করতে পেরেছেন। স্টালিনের কবিতা থেকে_
‘প্রত্যেক মানুষের আদল ভিন্ন এবং কণ্ঠস্বরও
এবং অবশ্যই দেখার ধরনও
যেমন আমি নীলাকাশকে কালো দেখি
সূর্যকে সবুজ, রঙধনুকে বর্ণহীন, নিষপ্রভ।’
বিপ্রতীপ কবিতা লেখা তখনই সম্ভব যখন কবিতা একটা পরিণতিতে এসেছে। এখনো হয়তো বলা যায় বাংলা কবিতা অ্যান্টি পোয়েট্রিকে ধারণ করতে পারে। অ্যান্টিপোয়েট্রি স্টালিনের কবিতার এক বিশেষ দিক। ঐতিহ্যের বাইরে গিয়ে কবিতাকে নতুন ব্যঞ্জনায় অন্বিত করা। যেমন তাঁর একটা কবিতা, শিরোনাম ‘নতুন শব্দের কথা’ –
‘কিছু শব্দ বহু ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গেছে
আমি নিরক্ত শব্দগুলোকে
নতুন অর্থে জাগিয়ে দিতে চাই
যেমন কালো শব্দটির স্থলে লাল
সাদার জায়গায় হলুদ
সবুজ শব্দের স্থানে নীল
আর ধূসরকে উজ্জ্বল বলে উল্লেখ করতে চাই
যেমন গরু বললে সিংহ বুঝতে হবে।’
অ্যান্টিপোয়েট্রি সাহিত্যের অঙ্গনে নতুন, যদিও বিপ্রতীপ উপন্যাস ও বিপ্রতীপ নাটক সাহিত্যাঙ্গনে দৃঢ় আসন করে নিয়েছে। বিপ্রতীপ সাহিত্য অভিধাটা প্রথম পরিচিত করেছিলেন ইংরেজ কবি ডেভিড গ্যাসকয়েন যিনি ছিলেন একাধারে স্যুরিয়্যালিস্ট ও কমিউনিস্ট। সাহিত্যের সব প্রচলিত নিয়ম ও রীতিকে উল্টে দেয়া। নিরক্ত শব্দগুলোকে নতুন অর্থে জাগিয়ে দেবার চেষ্টায় তিনি ‘কালো’ শব্দটির স্থলে ‘লাল’, ‘সাদা’র স্থলে ‘হলুদ’, ‘শৃগাল’ অর্থে ‘বাঘ’, ‘পাখি অর্থে’ ‘বানর’, ব্যবহার করার ঘোষণা দিয়েছেন। আমি সবুজ ঘাসের ওপর হাঁটছিলাম না বলে তিনি বাক্যকে এভাবে পুনর্গঠিত করতে চান, সবুজ ঘাস আমার উপর দিয়ে হাঁটছিল। এই নিরীক্ষা নতুন। ঞৎধহংভবৎৎবফ বঢ়রঃযবঃ বা বিশেষণের স্থানান্তর বলে কবিতা ও গদ্যের একটা প্রচলিত রীতি আছে, কিন্তু এখানে যে কর্তা-কর্মের অর্থগতভাব পরস্পর স্থানচ্যুতি সেটা অনিয়মকে অনেক দূরে ছড়িয়ে দেয়। এ-ছাড়া অন্তত একটি কবিতার অনিয়মও আছে (বিষাদের বিরুদ্ধে সম্মোহন)।
স্টালিনের অনেক কবিতায় একটা কাহিনী বলার চেষ্টা থাকে। কাহিনীর মধ্যে সংলাপও থাকে। কিন্তু এই কথকতা ভিন্ন ধরনের। বর্ণনাপ্রধান কাব্য বা ন্যারেটিভ কবিতার সঙ্গে অথবা এ যুগের রবার্ট ফ্রস্টের দীর্ঘ কাহিনীভিত্তিক কবিতার সঙ্গে এর মিল নেই। এই কাহিনী কোনো পরিণতিতে পেঁৗছায় না, কথকতার মাঝখানে পথ হারায়, এলোমেলো হয়ে যায়। অর্থাৎ ধহঃর-হড়াবষ ধারা তাঁর কবিতায় মিশেছে।
ষাটের কবিতার ঐশ্বর্য পরবর্তীকালে কবিরা ধরে রাখতে পারেননি, এটা সত্য। কবিতা প্রেরণার অক্লেশ উৎসারণ নয়; কবিতা বুদ্ধিবৃত্তির কর্ষণা, নিঃসঙ্গ আত্মার রোদন, আধ্যাত্মিক যন্ত্রণা, কিছুটা কৃৎকৌশল ও চাতুর্য। সেই নৈরাশ্য, বুদ্ধিবৃত্তির চমক আর নাগরিক যন্ত্রণা পরবর্তীকালে অনেকটা ফিকে হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল যেন কবিতা লেখা অত্যন্ত সহজ কাজ। যে-কয়জন কবির মধ্যে আধুনিক কবিতার বুদ্ধিবৃত্তির ধারা টিকে রয়েছে, আমার মনে হয় রেজাউদ্দিন স্টালিন তাঁদের একজন। স্টালিনের কবিতায় মিথ ও ধ্রুপদী ভাবানুষঙ্গের বহুল ব্যবহার সংক্রান্ত মডার্নিস্ট ধারার উদাহরণস্বরূপ উদ্ধৃত করি ‘তিথোনাসের কান্না’ –
নৈরাশ্যের তীব্রতা অবশ্য স্টালিনের মধ্যে কম অনুভূত হয়েছে এবং তিনি এক স্বপ্নজগতের কথাও বলেন। তা সত্ত্বেও একজন এলিয়েনেটেড আধুনিকতাবাদীর মতো তিনি অবরুদ্ধ। দেয়াল তাঁর কবিতায় বারবার এসেছে, দেয়াল কবিকে প্রতিহত করেছে, শূন্যতাবোধে আক্রান্ত হয়ে তিনি অসহায়ভাবে দেয়ালকে অাঁকড়ে ধরেছেন, দেয়াল তোলার শব্দে তিনি কবর খোঁড়ার অনুরণন শুনতে পেয়েছেন। জীবন যে এলোমেলো পারস্পর্যহীন, অনুপাতবোধ-বর্জিত সেটা প্রতিফলিত উদ্ভট নাটক ও বিপ্রতীপ উপন্যাসে। এই বাস্তব জগতের উপাদান আহরণ করে কি কোনো কল্পজগৎ নির্মাণ করা যায় যেখানে বাস্তবের বিরোধ হয়ে যাবে নির্বিরোধ এবং উল্টোটাও ঘটবে অর্থাৎ বাস্তবে কোনো স্থিতি বা সৌষম্য থাকলে সেটা হয়ে যাবে সৌষ্ঠবহীন, বিশৃঙ্খল। এমন জগৎ যেখানে নাদের আলীর সঙ্গে সুনীল তিন প্রহরের বিলে গিয়ে দেখে আসবে পদ্মফুলের মাথায় ভ্রমর আর সাপের খেলা, ক্ষমা প্রার্থনার ফলে সক্রেটিসের হাতে তুলে দেয়া হবে হেমলকের বদলে কোকাকোলার গ্লাস, উৎকোচের বিনিময়ে আর্কিমিডিস রাজার মুকুটটি খাঁটি স্বর্ণনির্মিত বলে ঘোষণা করবেন, জিওর্দানো ব্রুনো পাদ্রীদের ভয়ে (পরবর্তীকালের গ্যালিলিওর মতো) স্বীকার করবেন সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে? ‘প্রাপ্তি’ একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা।
চিত্রশিল্পের জগতের ভাবানুষঙ্গ স্টালিনের কবিতায় প্রায়ই পাওয়া যায়_ভ্যানগগ, মাতিস, শাগাল, বিন্দুবাদ। তাঁর অনেক কবিতায় যে চিত্রকল্পের বিপর্যয় ঘটছে অথবা অসদ্ভাবজনিত মিশ্রণ ঘটছে এর প্রেরণা চিত্রকলার জগৎ থেকে এসেছে সন্দেহ নেই।