রাজনীতির চাঁদপুরে ধরাশায়ী সব গভীর জলের মাছ
পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত ও ‘ইলশে বাড়ি বা ইলিশ মাছের ঘর হিসেবে পরিচিত’ ছোট সুন্দর একটি জেলা চাঁদপুরে এবার ইলিশের খুব আকাল চলছে। হতদরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ ইলিশতো দূরের কথা তেলাপিয়া কেনারও সামর্থ্য নেই। তারউপর চাল, তেল, ডাল, পিঁয়াজ ছাড়াও নিত্য পণ্যের দামে অস্থির জনজীবন। নির্বাচন বা রাজনীতির কথা শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন আর বলেন – রাখুনতো। পেট নীতির ফুরসৎ নেই আবার রাজনীতি। এদেশে আর সুষ্ঠু রাজনীতি আছে নাকি? থাকলে চাল আটার দাম এতো বাড়ায় কেমনে ব্যবসায়ীরা? ২২ ও ২৩ মে রবিবার ও সোমবার এভাবেই উল্টো প্রশ্ন বাণে সংবাদ কর্মীদের জর্জরিত করেন চাঁদপুর জেলার হাইমচর, ফরিদগঞ্জ ও মতলব উপজেলার বাসিন্দারা। তাদের চাওয়া পাওয়া সবটাই যেন বাজার দরে আটকে আছে। এর বাইরে কিছু বলা বা কওয়ার সময় কারোই নেই।
চট্টগ্রাম বিভাগের আওতাধীন চাঁদপুর জেলার রাজনৈতিক বিন্যাস ৫ টি আসনে। এখানকার আট উপজেলা ও থানা চাঁদপুর সদর, হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি, হাইমচর,ফরিদগঞ্জ, কচুয়া, মতলব দক্ষিণ ও মতলবউত্তর নিয়ে ৫ টি সংসদীয় আসনে বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজত্ব চলছে। জেলার মোট আয়তন ১,৭৪০.৬ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ হলেও কাগজপত্রে এখনো ২৬,০০,২৬৩ জন উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ ১৩,৫৪,৭৩২ ও মহিলা ১২,৪৫,৫৩১ জন আর জেলার মোট ভোটার সংখ্যা ১৪,১১,৬০৬ জন বলে জানা গেছে। তবে হালনাগাদ তথ্য এখনো চলমান রয়েছে।
জেলায় মোট ৭টি পৌরসভা রয়েছে এবং এই পৌর মেয়র বা চেয়ারম্যানের সমর্থকরাই মূলত সংসদীয় আসনের প্রভাব বিস্তার করে সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে চাঁদপুর পৌরসভা এ গ্রেডের মর্যাদা লাভ করায় আওয়ামী লীগের দলীয় মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েল এখানে ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। স্থানীয় বা চাঁদপুর তিন আসনের সাংসদ দীপু মনির ডান হাত হিসেবে চিহ্নিত মেয়র জুয়েলের প্রতি স্থানীয় জনগণেরও ব্যাপক সমর্থন লক্ষ্য করা যায়। যে কারণেই সাবেক মেয়র ও জেলা আ’লীগ সভাপতি নাছির উদ্দিন আহমেদ, জেলা আ’লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাফাজ্জল হোসেন এসডু পাটওয়ারীর মতো সিনিয়রদের ডিঙিয়ে নৌকা প্রতীক জয়ী হয়ে দেখিয়েছেন তিনি। এসময় তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির আক্তার হোসেন মাঝি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত হাতপাখা প্রতীকের মামুনুর রশিদ বেলাল। চাঁদপুর-৩ (সদর ও হাইমচর উপজেলা) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. দীপু মনি নৌকা প্রতীকে পরপর চারবার নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন।
বিএনপির শেখ ফরিদ আহম্মেদ মানিক এখানে দূর্বল প্রার্থী বলে ধারনা সাধারণ মানুষের। তবে তার সাথে কথা বলে তাকে বেশ আত্মনির্ভরশীল মনে হয়েছে। তিনি বলেন, এই সরকারের অধীনে বিএনপি কোনো নির্বাচনেই অংশ নেবেনা। তাই এ নিয়ে আমরা ভাবছিনা। আমরা দলের সাংগঠনিক দূর্বলতা কাটিয়ে বড় আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছি এখন। এ সরকারকে গদি ছাড়তে বাধ্য করা হবে আমাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন।
হাজীগঞ্জ পৌরসভার বর্তমান মেয়র মাহবুব-উল আলম লিপন এবং শাহরাস্তি পৌর মেয়র হাজি আব্দুল লতিফ মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমকে ঘীরে শক্তিশালী দূর্গ গড়েছেন বলে এলাকাবাসীর দাবী। সাংসদ রফিকুল ইসলামের সততা ও এলাকার প্রতি দায়িত্বশীল আচরণের কারণে চাঁদপুরে তার জনপ্রিয়তা বিরোধী পক্ষেও বলে দাবী স্থানীয় আওয়ামী লীগের। তবে জেলা বিএনপির সভাপতি বলেন, নির্বাচন যদি আদৌ হতে দেয়া হয়, তাহলে বিএনপির জয় নিশ্চিত চাঁদপুরের সবকটি আসনেই। ২০১৮ সালের নির্বাচনে চাঁদপুর-৫ (হাজিগঞ্জ- শাহরাস্তি উপজেলা) আসনে আওয়ামী লীগের মেজর অব. রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম নৌকা প্রতীকে জয়ী হন। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির ইঞ্জিনিয়ার মমিনুল হক।
কচুয়া পৌরসভার মেয়র মো. নাজমুল আলম স্বপন সহ অনেকেই এখন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদের সাথে। এমনকি কচুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আইয়ুব আলী পাটোয়ারী, সাধারণ সম্পাদক সোহরাব উদ্দিন চৌধুরী সোহাগও রয়েছেন এই দলে। ফলে দূর্বল হয়ে পরেছে চাঁদপুর-১ (কচুয়া উপজেলা) আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদ ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সমর্থন। এখন তিনি নিজ এলাকায় বিতর্কিত। কচুয়া আসনে এবার বিএনপির মো. মোশারফ হোসেন আওয়ামী লীগের তুলনায় শক্তিশালী হলেও দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে উপেক্ষিত।
ছেঙ্গারচরের পৌর মেয়র বর্তমানে আওয়ামী লীগের আব্দুল মান্নান বেপারী। মতলবউত্তর উপজেলার আওতাধীন এই পৌরসভাটির সাথে মতলব পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব মোঃ আওলাদ হোসেন লিটনকে যুক্ত করে চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর ও মতলব দক্ষিণ উপজেলা) আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদ মো. নুরুল আমিন এলাকার উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছেন। তবে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখানেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়কেই খাচ্ছে। বিএনপির ড. জালাল উদ্দিন এখানে আলোচনায় আছেন।
চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ উপজেলা) আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংসদ মুহম্মদ শাফিকুর রহমানও এখন অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নাজেহাল প্রায়। এখানে এখন তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ফরিদগঞ্জের সাবেক সাংসদ শামসুল হক ভূইয়া ও পৌর মেয়র উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল খায়ের পাটোয়ারী। ২০১৮ এর নির্বাচনের পর শফির রহমানকে চোখেও দেখেননি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। তবে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিবর্গের অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকেন বলে জানা যায়। এখানে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন মো. হারুনুর রশিদ। তবে বর্তমানে এখানে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে এম এ হান্নান। করোনাকালীন সংকটে এমএ হান্নানের ভূমিকা প্রশংসনীয় বলে দাবী নয়ারহাট এলাকার বাসিন্দাদের।
এছাড়াও রয়েছে ৮৯টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছাড়াও ৫টি আসনের ১৩৬৫ জন মেম্বারদের প্রভাব। যা আগামীর হিসাবনিকাশে বিশাল প্রভাব বিস্তার করবে বলে ধারণা চাঁদপুরের স্থানীয় সাংবাদিক ও বিশ্লেষকদের। তবে সর্বত্রই টিসিবি কার্ডে পণ্য না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে ।
চাঁদপুর জেলার ৫টি আসনের সার্বিক চিত্র তুলে ধরে জাতীয়তাবাদী কৃষকদলের সভাপতি এনায়েতউল্লাহ খোকন বলেন, গত তের বছরে অসংখ্য হামলা মামলার শিকার আমরা। কদিন আগেও মিথ্যা মামলায় আমাদের জেলা সভাপতি মানিক ভাইকে ধরে নিয়ে যায় এই সরকারের বাহিনী। ফরিদগঞ্জে কোনো নেতা রাস্তায় বের হতে পারেনা। মতলব উত্তর ও দক্ষিণ নিয়েও একই সমস্যা। আমরা নির্বাচন নিয়ে ভাবছিনা। কারণ আমরা জানি এ সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন হতে দেবেনা। আমরা তাই দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য ধরে রাখতে দলকে গোছানোর কাজ করছি।
এদিকে অভ্যন্তরীণ নানা ঘটনাবলি নিয়ে চাঁদপুরের আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে দলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক টিম গত ২ ও ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবনে মতবিনিময় সভা করে। দুদিনের এ মতবিনিময় সভায় দলীয় কোন্দল নিরসনের চেষ্টাও করা হয় এবং জেলার পাঁচ সংসদ সদস্য (এমপি), জেলা ও আট উপজেলা, পৌর কমিটির নেতাদের সাথে এই মত বিনিময়ে আদতে কোনো সফলতা আনেনি। শুধু মাত্র চাঁদপুর-৩ আসনের অধীন সদর উপজেলা, চাঁদপুর পৌর ও হাইমচর উপজেলা আওয়ামী লীগেই যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে। এখানে কেউ আর সহজে মিডিয়ার সামনে কথা বলছেন না।