‘আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে’- এই রবীন্দ্রসঙ্গীতটি আমার ভারি প্রিয়। লেখাটা শুরু করতে গিয়ে এই কথাটা বলা। আসলে একটা মাত্র; রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য গান নিয়ে আমাকে হয়তো এই একই কথা বলতে হবে। তবু যে ওপরে লেখা গানটিই বেছে নিয়েছি তার কারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে একটা লেখা যখন এখনই শুরু করতে হবে আর কি জানি, মনের মধ্যে এখন হয়তো একটা প্রতীক্ষা কাজ করছে। অবিশ্রান্ত বর্ষণ, আলোহীন গভীর আকাশে বিদ্যুতের চিকুরহানা আর হয়তো কিছু স্মৃতিকাতরতা। অথচ এখন বসন্তের দিন, ফাল্গুন মাস শেষ হয়নি, গতরাতের বর্ষণের পর আকাশে মৃদু তাপ আলো, হাওয়া। বর্ষার কোনো কথাই নেই। দেখছি আমার পছন্দের গানের পাশে লেখা আছে: প্রকৃতি, বর্ষা; কানে আছে দেবব্রত বিশ্বাসের ভারী গলায় গাওয়া ‘আমার যে দিন ভেসে গেছে।’ আর তেমন কারো কণ্ঠে এই গানটি শুনিনি। অত ভারী গলা, দেবব্রত আবার একটু চেপে নিয়েছেন সম্ভবত একেই ‘যে দিন’ শব্দটিকে। বিশ্বভারতীয় সঙ্গীত বোর্ড সম্ভবত একেই বলে কণ্ঠ বিকৃত করা। উনিতো আরও অনেক কিছু করতেন, দেশি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার না করে বিদেশি যন্ত্র-লহরী দিয়ে গানকে ভরিয়ে তোলা-এসব সঙ্গীত বোর্ড অনুমোদন করতেন না। আমি নিজে সে আলোচনায় যাবার সাধ্য রাখি না। গান শোনা ছাড়া আমার আর কিছুই বলা বা করার নেই। আমি শুনে যাই, শোনা শেষ হয়ে গেলে আবার শুনি।
সঙ্গীতাতো ধ্বনিই যদিও ধ্বনিমাত্রই সঙ্গীত নয়। ধ্বনি কিভাবে সঙ্গীতে রূপ নেয়, সে কথা বলার জন্য বিশাল সঙ্গীতশাস্ত্র গড়ে উঠেছে। তাকে সমুদ্র বলাই সংগত। এমনিই গভীর বিশাল যে তাতে ডুবে মরেও মরাই সার হয় এবং তেমন মৃত্যুতে আক্ষেপ করারও কিছু থাকে না। মানুষের ভাষা ও ধ্বনি সংগঠিত ধ্বনিবন্ধ কেমন করে মানুষের ভাষা হয়ে ওঠে, তা জানানোর ও বিশাল শাস্ত্র রয়েছে। অতএব ভাষাকেও সঙ্গীত বলতে বাধা নেই তবে সঙ্গে সঙ্গে একথাটাও বলে নিতে হবে যে ধ্বনি বাদ দিয়ে সঙ্গীত সম্ভব না হলেও মানুষের ভাষা ছাড়াও শুধুমাত্র সংগঠিত ধ্বনিবন্ধ, ধ্বনিগ্রামকে সঙ্গীতে রূপ দেওয়া চলে। বরং বলা যায় সঙ্গীতের বিমূর্ত বিশুদ্ধ চেহারা তাতেই প্রাণবান হয়ে ওঠে। সঙ্গীতের বড়ো দুটি ভাগতো তাই: মানুষী ভাষা নির্মিত আর স্রেফ ধ্বনিগঠিত। রবীন্দ্রনাথের গান সম্বন্ধে কি বলা যায়? তাঁর প্রায় দু’হাজার গান সম্বন্ধে? এতক্ষণ ধোঁয়াশা করে যা বলবার চেষ্টা করেছি- যতো অস্পষ্টই; তা-এর সবই কোনো না কোনভাবে রবীন্দ্রনাথের গান সম্বন্ধে বলা চলে। অন্যান্য বাংলা গান সম্বন্ধেও। তবে একবারে শাদা কথায়, খুব নির্দিষ্ট করে নিশ্চয়ই বলা চলবে, রবীন্দ্রনাথের গান ভাষা দিয়ে রচিত। বাকি কথা সবই আছে সেখানে-সুরতাল, ছন্দলয় এবং আনুষঙ্গিক সঙ্গীত পরিভাষায় যা যা আছে, সব মিলিয়ে তাঁর গান। সুর তাল ছন্দ লয় ভাষিক নির্ভাষিক সব সঙ্গীতেরই মূল অঙ্গ। রবীন্দ্রসঙ্গীতের বেলায় এ সবের অনন্যতা স্বকীয়তা মেনে নিয়েও।
এবার আমি কবুল করতে চাই-যে গান দিয়ে এই লেখা শুরু করেছি সেটিকে সামনে রেখে আমি রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষার দিকেই আমার গোটা মনোযোগটাকে নিয়ে যাব। ভালোই জানি, কেবল বাণী দিয়েই রবীন্দ্রনাথেরও গান নয়। সুরে ছন্দে লয়ে শব্দবন্ধে ধ্বনি সংগঠনে বাণী কতোটা আশ্রয় নেয়, নির্ভর করে, প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে, সৌগন্ধ সুষমায় প্রকাশের দৃঢ়তায় কোমলতায় কতোটা অচেনা হয়ে ওঠে, ভাষার দৈনন্দিনতা অতিক্রম করে যায় সে সব অবশ্যই দেখার বিষয়। বাংলা সব গানের ক্ষেত্রেও তাই; অতুলপ্রসাদ, ডি. এল. রায়, রজনীকান্ত, নজরুল কেউ-ই বাণীসর্বস্ব নন। রবীন্দ্রনাথও নন। তবু আমি রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষা বা বাণীর দিকেই কথাটা নিয়ে যাব। যে অতুলনীয় অভাবনীয় অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, শুধু সেটুকু বলার জন্যেই।
ভাষা (ভাষার সবরকম রূপ) আমাদের কী দেয়, এ প্রশ্নের জবাব একটাই। ভাষা আমাদের সব দেয়। প্রকৃতির ধ্বনি তার ভাষাই। কিন্তু সে ভাষা প্রকৃতিকে কি দেয় আমরা জানি না, তবে আমাদের কী দেয় তা আমরা ঠিকই জানি। অর্থময় শব্দের ভাষা মানুষকে কী দেয় কিংবা সেই ভাষার সঙ্গে চোখের ভাষা, হাতের ভাষা, দেহের ভাষা কি জানাতে চায় আমাদের, তা নির্দিষ্ট করা না গেলও কোনো সংবাদই আমাদের দেয় না একথা ঠিক নয়।
জীবনে মানুষর পক্ষে ভাষা অপরিত্যাজ্য, সুনির্দিষ্ট, নিশ্চিত নির্দেশক।সর্বকর্ম পারদশী নিত্যদিনের অন্নজল। আবার তরল, আকারহীন বা বহু আকারধারী, অনিশ্চিত, দ্বিধাগ্রস্ত, আলোছায়াময় দুর্জ্ঞেয়তায় ঘেরা। সে যতোটা মূর্তকে নির্দেশ করতে পারে, ঠিক ততোটাই, কিংবা তারও বেশি অমূর্তকে প্রকাশ করতে ইংগিত সক্ষম। খুব সাধারণভাবে ’বই বললে,’চেয়ার’ বললে, মানুষ’ বললে স্থুল মূর্তকে বুঝি। আবার ওদের প্রত্যেকের আগে’ এই’ শব্দটা যোগ করলে বোঝাটা আরও স্থির হয়, নির্দিষ্ট হয়। এসব যে স্পষ্টত বস্তু, স্থানকাল জুড়ে থাকে তাতে কারও সন্দেহ হয় না। তবে বস্তু বলতে ঠিক কি বোঝা যায়, সত্তা, হিসেবে বোঝা যায় কিনা সেটা পরাবিদ্যার বিষয়। আমরা সাধারণ মানুষরা প্রশ্নহীন বস্তুই বুঝে থাকি।
তবে’দয়া’ বা ’ সহানুভূতি’ কিংবা’ স্থৈর্য’ বললে একটু বিপদে পড়ে যাই। একটু বিমূর্তের জগতে ঢুকে পড়ি। বড়োজোর কাউকে ভিক্ষে দিতে দেখলে অমূর্ত দয়াটাকে একভাবে মূর্ত দেখতে পাই। এ নিয়ে কোনো সমস্যা ব্যাকরণের হয় না। গুণবাচক বিশেষ্য বলে শব্দের একটা ভাগ করে দিয়েই সে নিশ্চিন্ত। মোটের উপর আমরাও নিশ্চিন্ত কারণ প্রতিদিনের কাজ চালিয়ে নেয়াটাই ভাষার কথা। যতোক্ষণ তা হচ্ছে, অন্তত যাচ্ছেতাই ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছেনা, ততক্ষণ ভাষার জটিলতা, কূটতা, আঁকিবুকি নিয়ে এত ভাবনা কিসের? কিন্তু ভাষা দিয়ে যে আমরা কাজ করি, আদেশ মানি, আদেশ করি, ব্যাকুলতা জানাই, আক্রোশ ক্রোধ ঘৃণা স্বার্থপরতা প্রকাশ করিÑ আর কি ভাষা দিয়ে কিছুই করিনা? এইখানেই শেষ? তাহলে তো ইতর প্রাণী মানুষের ভাষা থেকে বঞ্চিত হয়ে নিজেদের ভাষাতে প্রায় একই ধরনের কাজ চালিয়ে নিতে পারে! আমার ধারণা, আমরা মানুষের ভাষা সামান্যই ব্যবহার করি। কণা মাত্র বলব না, তবে ভাষার কার্যকারিতা আর সম্ভাবনার সামান্য মাত্র।
শিল্পের কাছে এলে এই বোধ আমার মাধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে আর রবীন্দ্রনাথের গানের কাছে এলে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাই। এত অনিঃশেষ এই সম্ভাবনা? এত অতল এত গভীর, এত অনির্দেশ্য, এত মন কেমন করা? এত বহুস্তরা অনুভব, এত সূক্ষ্ম মানবিক বোধ, এতটা সর্বগ্রামী? তখন যে আর ‘ভাষা’ শব্দটা চলল না। ‘বাণী’ না বললে প্রকাশটা যেন সম্পূর্ণ হচ্ছে না। শুধু ‘বাণী’- তেও হয় না, মাঝে মাঝে ‘প্রাণের পরশ’-ও প্রার্থনার মধ্যে থাকে। ‘আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে’-মাত্র সাতটা শব্দ। কি ভীষণ দৈনন্দিন, শাদামাটা, আটপৌরে! হাজার হাজার বাংলা ভাষী হাজার হাজার বার উচ্চারণও করছে। অর্থও আছে তাদের, নির্দেশ করে কিছু, স্পষ্ট করে বা একটু অন্যভাবে। ‘দিন’ খুব স্পষ্ট নয়, যেহেতু তা ঠিক বস্তু নয়। তবে প্রত্যক্ষগোচর তো বটে, মাপা কালিক দৈর্ঘ্য আছে তার, বেশ বোঝা যায় নির্দেশিতকে। ‘চোখের জলে’- দুটি শব্দ স্পষ্টতই বস্তু-‘চোখ’ ‘জল’। এইবার অর্থগুলো জোড়া দিলে ঠিক কি বোঝায়? যেভাবে ত্রিমাত্রিক বস্তু বুঝি, এমনকি বিমূর্ত ধারণা বা গুণ বুঝি সেইভাবে বুঝতে চাইলে এই পংক্তিটা প্রায় কিছুই বোঝায় না। এর সারাংশ করা যায় না, সারমর্ম লিখে ফেলা যায় না। ‘দীপ নিভে গেছে মম, নিশীথ সমীরে’ জগৎসংসারে কি হবে এই সংবাদটি জানিয়ে? ‘প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে’- কার কেমন আসা বোঝাবে? ‘বেদনা কী ভাষায় রে,’ “আমার প্রাণের ‘পরে চলে গেল কে,” ‘লক্ষ্মী যখন আসবে তখন কোথায় তারে দিবি রে ঠাঁই,’ ‘লিখন তোমার ধুলায় হয়েছে ধূলি, হারিয়ে গিয়েছে তোমার আঁখরগুলি’-রবীন্দ্রনাথের এরকম শতশত গানের দিনের দিনের নগদ ছাঁকা অর্থ কিছু নেই। আমি তো দুচারটি গানের শুরুটা বললাম। অতল দিঘির ঠিক মাঝখানে ফুটে থাকা পদ্মের মতো তাঁর কতো গানের ভিতরে এরকম ফুটে ওঠা পদ্ম ছড়িয়ে আছে। ‘সুখ নয়, দুঃখ সে নয় সে তো কামনা, শুনি শুধু দাঁড়ের ধ্বনি’ কি করে তৈরি এসব গান? ‘ভাষা’ দিয়ে? বাণী দিয়ে? এরা নীরবে জানাচ্ছে, অর্থ খুঁজো না। ‘আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে’-এক গভীর মধুর বিষাদের দিকে চেয়ে আছে, মানুষী সময়ের মাপে যা পিছনে চলে গেছে, অতীতে প্রবেশ করেছে সেইসব দিনের কোনো একদিন, কোনো কোনো দিন, হতে পারে বহু বহু দিন বয়ে চলে গেছে ভাসন্ত ভেলার মতো; দুঃখের দিন, সুখের দিন কান্নার দিন, উতলা হাওয়ার বসন্তের দিন। আজ তারই নিবিড় ছায়া পড়ছে ‘শ্রাবণ গগনতলে?’ কবি বসে আছেন হয়তো ‘শ্যামলী’তে, গো-চক্ষুর মতো জানালার ধারে-সামনে ‘কোপাই ছাড়িয়ে শূন্য মাঠ দিগন্তে গিয়ে ঠেকেছে, অঝোরে ঝরছে শ্রাবণের ধারা, ‘প্রান্তরের শেষে, কেঁদে চলিয়াছে বায়ু অকূল উদ্দেশে’-আকাশের কালো নিবিড় ছায়া মাটিতে, ভেসে যাওয়া দিনের ছায়া। ‘সে দিন যে রাগিণী গেছে থেমে, অতল বিরহে নেমে’- কি করে পরিমাপ করা যায় সেই অতল বিরহের (‘বিরহ’ কথাটা কি আজও আছে, না রূঢ় অশিষ্ট কোনো শব্দ তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে আসঙ্গ লিপ্সু শরীরের মাটিতে?) যাতে সব সুখ দুঃখের রাগিণী নিমজ্জিত হয়ে গেছে। সুর চলে গেলে সুরের প্রতিধ্বনি থাকে, প্রতিধ্বনিও নীরবতায় ডুবে গেলে কি আরও কিছু থেকে যায়? সুরের প্রতিচ্ছবি? বুঝতে পারছি ভাষা হাল ছেড়ে দিচ্ছে-সে যখন অর্থের জোয়াল কাঁধ থেকে ঝেড়ে নামিয়ে ফেলে, তারপরেও কি কিছু রেখে যায়? মনে হয় যায়, যা রেখে যায় তা ভাষারই সৃষ্টি কিন্তু ভাষাতে আদৌ প্রকাশিতব্য নয়। রাগিণী বিরহের অতলে ডুবলেও ‘আজি পুবের হাওয়ায়, অদৃশ্য রেখায় আঁকা থাকে।
‘নিবিড় সুখে আর মধুর দুখে জড়িত ছিল সেই দিন’-বীণা বাঁধা ছিল দুই তারে-নিবিড় সুখের আর মধুর দুখের-তারা আলাদাই থাকে, শিল্পী তাকে একসাথে জড়িয়ে বাজাতে পারেন।
মনে হতে পারে, বলা তো হলো যা বলা সম্ভব নয়, বাণীতেই বলা হলো-সে চেষ্টা একই গানে আবার কেন, তাতে রস কি সামান্য হাল্কা হয়ে যাবে না? তবে আরও একটি হাহাকার আছে, সেটা জানাতে হবে-তার ছিঁড়ে গেছে-শতবার বললেও যে ক্ষান্তি নেই। একদিন, কবে কোন্দিন কে জানে তাঁর ছিঁড়ে গেছে অজান্তে, চুরি হয়ে যাবার মতো, সর্বস্ব হারিয়ে যাবার মতো-কোন্ হাহারবে, তা শোনা যায়নি, তার ছিঁড়ে গেছে। একদিন ছিঁড়ে যায়, যাবেই, জীবন সুতো যেমন যায়। এই কথার পরে প্রায় মামুলি কথা, ‘সুর হারিয়ে গেল পলে পলে।’
এর পরেই একটি কঠিন প্রশ্ন তুলে এই লেখাটা শেষ করব। সে প্রশ্নের আলোচনা এখানে করব না। কোনোদিন হয়তো আমি চেষ্টা করব, হতে পারে আর কেউ করবে সেই প্রশ্ন- এসবই কি ভাষার কাজ, ভাষার নিজস্ব সৃজন না কি ভাষা যে ব্যবহার করে তার, তার ভাবনা অনুভব উপলব্ধি অভিজ্ঞতা কি এর মূল উৎস?