যে কথা এখনো বলা হয়নি : তানজীর হোসেন পলাশ
২০০৮ সালের ৩ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যার পর টাইমস নামের সমিতি অফিস কে বসে আছেন এলাকার ব্যস্ততম এবং জনপ্রিয় শিক মো. তরিকুল ইসলাম। সবাই তাঁকে তারেক স্যার বলেই জানে। লম্বাটে ফর্সা গড়ন, চোখে চশমা পড়েন প্রায়ই। চুলগুলো বেশ বড় বড়। চেহারা দেখে কেউ তাকে শিক হিসেবে স্বীকৃতি দেবে এরকম লোকের সংখ্যা খুব কমই পাওয়া যাবে। সাহিত্যের পাগল, দার্শনিক, আর্ট শিল্পী বা মিডিয়াজগতের একজন কর্মী হিসেবে এক দর্শনে স্বীকৃতি মিলবে তার। গণিতের শিক হলেও সাহিত্য জগতে তার পদচারণা অনেক আগেই হয়েছে। অবশ্য তার এই চুল বড় করার কারণ কেউ অনুধাবন করতে পারেনি বিন্দুমাত্র।
তারেক সাহেবের এক সময়ের ছাত্রী কাজল এসে বলল : স্যার, আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ এনেছি।
কিছুটা অবাক হলেন তারেক সাহেব। তারপর কাজলের দিকে তাকাতেই ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে হালকা সবুজ বর্ণের এক টুকরা কাগজ স্যারের হাতে দিল কাজল। তারেক সাহেব ভাঁজ করা কাগজটি খুললেন – যা ছিল একটি স্কুলে চাকুরির বিজ্ঞপ্তি। সেখানে লেখা –
ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল (সৃজনশীলতাই যার একমাত্র ল্য)
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে বিভিন্ন পদে শিক নিয়োগ করা হবে।
আগামী ৪ জানুয়ারি সকাল ১০টায় স্বহস্তে লিখিত দরখাস্ত নিয়ে সরাসরি সাাৎ করতে হবে।
বিজ্ঞপ্তিটা দেখে অবাক হলেন তারেক সাহেব। এই বিজ্ঞপ্তি কাজলের মা পাঠিয়েছেন নিশ্চয়। কারণ তিনি ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে চাকুরী করেন। হঠাৎ মাথায় আইডিয়া এল ইন্টারভিউ দিবেন তারেক সাহেব। কিন্তু একা একা ইন্টারভিউ দিতে যাবেন কি করে? সঙ্গে সঙ্গে তিনি আইডিয়াল ক্যাডেট একাডেমীতে তারেক সাহেবের বর্তমান কলিগ খন্দকার রিপন ও মিজানুর রহমানকে ফোন করলেন। সব শুনে তারাও ইন্টারভিউ দিতে রাজি হলেন।
রাতে বাসায় ফিরে দরখাস্ত লেখা শুরু করলেন তারেক সাহেব। অনেক রাত পর্যন্ত চোখে ঘুম এল না। মাথার মধ্যে দুইটা দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রথমত: দীর্ঘ আট বছর আইডিয়াল ক্যাডেট একাডেমীতে কাজ করার পর তা ছেড়ে চলে যেতে হবে! পারবে তো ছেড়ে যেতে! দ্বিতীয়ত: যদি পরীা দিয়ে চাকুরী না হয়, তবে জানাজানি হলে আইডিয়াল ক্যাডেট একাডেমীতে মুখ দেখাবে কি করে! এসব ভাবনায় সকালের সূর্যটা আলো বিকিরণ শুরু করেছে চতুর্থ তলার ফাটের জানালা দিয়ে।
৪ জানুয়ারি। শুক্রবার। ছুটির দিন থাকায় অনেকেই ঘুম থেকে ওঠেনি। অবশ্য যারা বাজার করতে অভ্যস্ত তারা অনেক আগেই বাজারে চলে গেছে। অথচ তারেক, মিজান ও রিপন সাহেবরা ভিন্ন উদ্দেশ্যে পথ চলছে তখন। ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সামনে একটি রিক্সা এসে থামল। যাত্রী তিনজন। সবার উদ্দেশ্য একই। ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ইন্টারভিউ দিবে। কিন্তু দু:খজনক হলো পরীার বিষয় তিনজনেরই ভিন্ন। অথচ তারা একই স্কুলে চাকুরী করেন। ছয়তলা ভবন বিশিষ্ট ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের নিচ তলায় কাগজপত্র জমা দিলেন তিনজন। তারপর অপোর পালা। কিছুণের মধ্যেই সিঁড়ি দিয়ে উঠলেন সবাই। ভিন্ন ভিন্ন তলায় তিনজনের সিট পড়েছে। ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অনেকেই তারেক সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে। বিশেষ করে তার চুলের দিকে। একজন তো বলেই ফেললেন এ পাগল পরীা দিতে এসেছে কেন? এ তো পরীার আগেই বাদ পড়বে। তিনি অন্যদের ডেকে দেখালেন তারেক সাহেবকে। এ দৃশ্য চোখে পড়েনি তারেক সাহেবের। অনেকেই ভেবেছিল তিনি হয়ত ড্রইং বিষয়ে পরীা দিবেন। অথচ সবাইকে অবাক করে দিল যখন তাকে দেখা গেল গণিত বিষয়ের ক।ে এও কি করে সম্ভব! এত বড় আধ্যাত্মিক ধরনের চুলওয়ালা লোক কি করে গণিতের শিক্ষক হতে পারে!
১৩ জানুয়ারি। ভাইভা পরীা। ডাক পড়ল মো. তরিকুল ইসলাম সাহেবের। খুব ভয়ে ভয়ে তিনি ভেতরে গেলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় তাকে কেউ চিনতে পারল না। ভাইভা বোর্ডে বসা সকলের মধ্যে একজন বললেন, আপনি তো আমাদের প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করার উদ্দেশ্যে অনেক বড় ঝধপৎরভরপব করেছেন। আপনার অনেক বড় চুল ছিল। নিশ্চয় অনেক শখ করে রেখেছিলেন। তিনি আরো বললেন, আমার বিশ্বাস আপনি পারবেন। আপনার সে যোগ্যতা নিশ্চয় আছে। আমাদের এখানে কাজ করে আপনি নিজেকে প্রমাণ করতে পারবেন। তার এই কথাগুলো তারেক সাহেবের খুব ভাল লাগল। তিনিই ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের কর্ণধার। পদাধিকারবলে তিনি মহাপরিচালক ও প্রতিষ্ঠাতা। অত:পর চারদিন উবসড়হংঃৎধঃরাব কাস করার জন্য বলা হল তারেক সাহেবকে। কিন্তু তারেক সাহেবের আপত্তিতে দুই দিনের উবসড়হংঃৎধঃরাব কাস করার অনুমতি দেওয়া হল।
১৬ ও ১৭ তারিখ তারেক সাহেবের উবসড়হংঃৎধঃরাব কাস হবে ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। তিনি আইডিয়াল ক্যাডেট একাডেমী থেকে ছুটি নিলেন দুই দিনের। ডেমো. কাস পছন্দ হল কর্তৃপরে। ১৮ তারিখে আবার সৌজন্য সাাতে মিলিত হলেন তারেক সাহেব। সেদিন মহাপরিচালক স্যারের সাথে একান্তে কথা হল। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপচারিতার পর নিয়োগপ্রাপ্ত হলেন তারেক সাহেব। চাকুরীতে যোগদান করতে হবে ১৯ তারিখ। এবারও আপত্তি জানালেন তিনি। কারণ তিনি এই মুহূর্তে একটি প্রতিষ্ঠানে আছেন। তাদের সময় না দিয়ে চাকুরী ছাড়া ঠিক হবে না। তারপরও সেখানে সহকারী প্রধান শিক হিসেবে আছেন। তবে আরো একদিন সময় নিয়ে ২১ তারিখ যোগদানের কথা বললেন তারেক সাহেব।
১৯ জানুয়ারি। আকাশ যেন হালকা মেঘে আবৃত ছিল। শুধু এক কোণায় উজ্জ্বল সূর্যের কিরণ দেখা যাচ্ছিল। আইডিয়াল ক্যাডেট একাডেমীতে ঢুকলেন তারেক স্যার। ইতোমধ্যে অনেকেই জেনে ফেলেছেন তিনি চলে যাচ্ছেন এই বিদ্যাপীঠ থেকে। সুতরাং তিনি বিদ্যালয়ে ঢোকামাত্রই উৎসুক দৃষ্টি প্রশ্ন করল কি খবর স্যার? সহাস্য তার জবাব ভাল। এরপর একে একে বিভিন্ন কাসে গেলেন এবং ঘোষণা করলেন আগামি দিন থেকে তিনি আর আসবেন না। তার চলে যাবার খবর সকলের মধ্যে ক্রন্দনের বিহঙ্গ তৈরি করল। বেদনার্ত পরিবেশ সৃষ্টি হল আইডিয়াল ক্যাডেট একাডেমী প্রাঙ্গনে। বিদায়ের সুর যত কঠিন হোক না কেন, বিদায় তো নিতেই হবে। এই মানসিকতা তৈরি করেই গিয়েছিল তারেক স্যার। সুদীর্ঘ আট বছর যে প্রতিষ্ঠানে সময় দিয়েছেন, যার সুখে-দু:খে দিন কেটেছে তাঁর। চাকুরী জীবনের শুরুটা হয়েছে যে স্কুলের মাধ্যমে তার মায়া ছেড়ে চলে যাওয়া তো এত সহজ কাজ নয়। অবশ্য এর আগে তারেক স্যার বহুবার চেষ্টা করেছেন অন্য কোথাও চাকুরী করার। কিন্তু পারেননি স্কুলের মায়ায়। এবার আর পিছে ফেরার কোন পথ নেই। কিছু দূষিত হাওয়া স্কুলটাতে প্রবেশ করে পরিবেশ নষ্ট করে ফেলেছে। শিক প্রতিনিধি ছাড়া কমিটি নামক কিছু অবাঞ্চিত লোক স্কুলের কার্যক্রমে পান্ডিত্য প্রকাশ করে স্কুলের মর্যাদা নষ্ট করছে বলে তারেক সাহেবের এই হঠাৎ সিদ্ধান্ত। এই জন্যই মায়া কাটাতে পেরেছে। শেষপর্যন্ত বিদায় দেওয়া হল তারেক সাহেবকে। তবে আনুষ্ঠানিক বিদায় হয়নি। হয়ত হবেনা কখনোই।
২১ জানুয়ারি। তারেক সাহেব যোগদান করলেন ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। শুরু হল নতুন সংগ্রাম। নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চার হল। সব কিছুই নতুন তারেক সাহেবের কাছে। সব অপরিচিত। অথচ সবাই খুব আন্তরিক। সকলেই আন্তরিকতার সাথে নতুনদের গ্রহণ করল। কেবলমাত্র ছাত্র-ছাত্রী ছাড়া। কারণ কোন শিার্থীই চায় না তাদের এতদিনের পরিচিত শিক চলে যাক। যেমনি চায়নি আইডিয়াল ক্যাডেট একাডেমীর শিার্থীরা। তারা চায় না তাদের অতিপ্রিয় তারেক স্যার হারিয়ে যাক তাদের মধ্য থেকে। অনেকেই অবশ্য স্যারের কারণে ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি হয়েছে। তারা মনে কওে, স্যার যেখানে নেই কি করে সেখানে লেখাপড়া করবে? অথচ তাদের কি দুর্ভাগ্য, তারেক স্যারের কোন কাস নেই তাদের। তবুও সান্ত্বনা এই ভেবে যে, স্যার যে স্কুলে আছেন সেখানে পড়ছি।
বেশ কয়েকদিন হল তারেক সাহেব যোগদান করেছেন ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। এখানকার সব কিছুর সাথে মোটামুটি মানিয়ে নিয়েছেন তিনি। কাস রুটিনও পেয়েছেন। অবশ্য তার প্রিয় বিষয়ের কাস একটাও পাননি বলে কিছুটা মনে কষ্ট। তারপরও নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। সেদিন ছিল সোমবার। রুটিন অনুযায়ী ৪০৮ নং কে দশম শ্রেণির পদার্থ বিজ্ঞান কাস। জনাকয়েক ছাত্রী গন্ডগোল করছে। অন্যভাবে বলা যায়, অপো করছে স্যার কাসে আসার। তারা তখনো জানে না কোন স্যার কাস নিবেন। তবে এটা জেনে ফেলেছেন নতুন শিকদের মধ্যে কেউ একজন আসবেন তাদের কাসে।
৪০৮ নং কে ঢুকলেন তারেক সাহেব। দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিার্থীদের কাস নিবেন তারেক সাহেব। ইতোমধ্যে অবশ্য এই শিার্থীদের সম্পর্কে বেশ বিরূপ ধারণা পেয়েছেন তারেক সাহেব। যেমন- তারা দুষ্টামী করে, নতুন শিককে সহজে গ্রহণ করতে পারে না; এই সব আর কি। কিছুণের মধ্যেই এর সত্যতা বুঝতে পারলেন তারেক সাহেব। প্রথম দিন শেষে বুঝতে পারলেন এদেরও গ্রহণ করার মতা আছে। তবে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে সময় লাগবে। প্রথম কাস ভেবে তারেক সাহেব তাদের উদ্দেশ্যে কিছু নীতিকথা শোনালেন। কে কার কথা শোনে। যার যার মত সেই সেই। এই বাস্তবতাকে বিশ্বাস করতে পারেন না তারেক সাহেব। তিনি মনে করেন তার আদর্শে অন্যদের তার মনের মত গড়তে পারবেন। এই ব্যাপারে তিনি ততটা সফল না হলেও একেবার ব্যর্থ হননি।
বুধবার। সপ্তাহের শেষ কাস তারেক সাহেবের সাথে দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিার্থীদের। বিগত দিনের পড়া আদায় করতে হবে এই মানসিকতা নিয়ে শ্রেণিতে প্রবেশ করলেন। সকলেই যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করল। তারপর অমনোযোগি। ইতোমধ্যেই ওদের নাম জেনে নিয়েছে তারেক স্যার। অনামিকা ইংরেজি খাতা খুলে কি যেন লিখছে। তারেক সাহেব নিষেধ করলে অনামিকা বলল : স্যার, আর এক মিনিট লাগবে।
বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। তবুও ইংরেজি খাতা বন্ধ করল না অনামিকা। মেজাজ খুব খারাপ হল তারেক সাহেবের। এটা আবার কেমন অভদ্রতা। পদার্থ বিজ্ঞান কাসে ইংরেজি বের করে কাজ করা। তাহলে পদার্থ বিজ্ঞান থেকে ইংরেজিটাই জরুরী ওর কাছে। নিজেকে অপমানিত বোধ করলেন তারেক সাহেব। তারপর সকলকে বাড়ির কাজ দিতে বললেন। সবাই বলল, স্যার আপনি তো কাজ করতে দেন নাই। এই কথা শুনে মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল তারেক স্যারের। কাসের ফাস্ট গার্ল স্বর্ণালী স্যারের ভাবমূর্তি বুঝে বলল : হ্যাঁ স্যার, মনে পড়েছে। আপনি আমাদের পদার্থ বিজ্ঞানের একটি অংক করতে দিয়েছিলেন। কিন্তু অংকটাতো পারি না স্যার।
: বাহ্ চমৎকার কথা সাজিয়েছো। এতণ তো মনেই ছিল না। এখন আবার বলছো হ্যাঁ দিয়েছিলেন স্যার। (ধমক দিয়ে) বেশ পারো। তোমাদের লেখাপড়া হবে না কোনদিনই।
এতণ চুপচাপ থাকা উর্মি নামের মেয়েটি বলল : আসলে স্যার, আমাদের ……….।
উর্মি আরো কিছুই বলার আগেই তারেক স্যার অনামিকার একই অবস্থা দেখে প্রচন্ড রাগান্বিত হয়ে বললেন : চুপ কর। থাপড়ে সবগুলো দাঁত খুলে ফেলা দরকার। কি সব বেয়াদব মেয়ে, একটু চিন্তা করতে পারে যেহেতু বাসায় অংকটা করিনি, এখন চেষ্টা করি। তা না করে ইংরেজি লেখে। কত বড় সাহস। (অনামিকার দিকে তাকিয়ে) বন্ধ কর তোমার খাতা।
অনামিকা বলল : স্যার আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন? অংক তো করেছিই। এই যে দেখুন।
অনামিকা ব্যাগের মধ্যে হাত দিয়ে কয়েকটা খাতা বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বলে,
ও স্যার, ভুল করে বাসায় রেখে এসেছি।
স্বর্ণালী অনামিকাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
তুই চুপ কর অনামি।
তারেক স্যার আর কোন কথা বলেনি সেদিন কাসে। ওদের কারো দিকে তাকায়নি। শুধু আসার সময় এক নজর তাকাতেই তিনি ল্য করলেন উর্মির চোখে অশ্র“। তখন তিনি রাগে টগবগ করছেন। ওর চোখের জল তার মন কাড়তে পারে নাই।
উর্মির কান্না কেউ থামাতে পারছে না। স্বর্ণালীসহ সকলেই ওকে সান্ত্বনা দেয়। তাতেও কোন কাজ হচ্ছে না। ওর চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। উর্মিও কিছুতেই নিজেকে বোঝাতে পারছে না। কেন স্যার আমাকে রাগ করল? আমি তো তেমন কিছু বলিনি। স্বর্ণালী এই কথাই ওকে বোঝায় তুই তো কিছুই করিসনি, সব দোষ ঐ অনামির। নতুন স্যার, তার সাথে এমনটা না করলেই পারত। অংক করিসনি ভাল কথা। অস্বীকার করলি কেন? এটা ঠিক করিসনি অনামি। এভাবে অনামিকাকে যাচ্ছে তাই ভাবে বকাবকি করল সবাই। কিন্তু উর্মিকে বোঝাতে পারল না কেউ। চোখের অশ্র“তেই স্কুলের সময়টা অতিবাহিত করল উর্মি। স্যারের ঐ কথাটি ওর জীবনে প্রথম প্রাপ্ত শাস্তির মত মনে হল। কিছুতেই ঐ মুহূর্তের কথা ভুলতে পারলো না উর্মি। স্যারের ঐ রাগান্বিত মুখোদর্শন তার জীবনে যেন আর কখনো না ঘটে।
স্কুলের কাস শেষে বাসায় ফিরে সারাটা দুপুর আজকের পদার্থ বিজ্ঞান কাসের ঘটনা স্মৃতিতে ভেসে ওঠে তারেক সাহেবের। কেন শিার্থীরা তার সাথে এমনটি করল। তারপর হঠাৎ অন্তর্দৃষ্টিতে এল উর্মির চোখের কয়েক ফোঁটা অশ্র“। ভাবনায় এল উর্মি। মেয়েটাকে এভাবে বলা ঠিক হয়নি বোধহয়। আসলে সমস্যা ঐ অনামিকা। মেয়েটা বড্ড বেশি কথা বলে। শিক হিসেবে শিার্থীদের আরো সহনশীলভাবে গ্রহণ করা উচিৎ ছিল তারেক সাহেবের। কিন্তু কিভাবে যে এ রকম হয়ে গেল তা বুঝতে পারলেন না তারেক সাহেব। শিকতা জীবনের এই দীর্ঘ সময়ে কখনো এ রকম সমস্যায় পড়তে হয়নি তারেক সাহেবকে। মনে মনে ভাবল পরবর্তী কাসে ওদের সাথে একটা কম্প্রোমাইজ করে নেবে। ওরাও নিশ্চয় বুঝে নিয়েছে স্যারের সাথে এমনটি করা উচিৎ হয়নি।
তারেক সাহেব অপো করলেও সময় তার কাজের জন্য তাগিদ দেয়। বের হয় শিার্থীদের বাসায় পড়াতে। সাধারণত রাত ৮টার দিকে তারেক সাহেব পড়াতে যান সিনতাহাদের বাসায়। কিন্তু সেদিন কেন জানি মনের অজান্তেই কলিং বেলের শব্দ সৃষ্টি করলেন সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিটে। দরজা খুলে তো সিনতাহা অবাক। এই অসময়ে স্যার এসেছেন। সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত সিনতাহা। আরো অবাক হওয়ার বিষয় ঘরে উর্মি এসেছে। সিনতাহা অবশ্য আগেই উর্মিকে জানিয়ে রেখেছে তারেক স্যারের কাছে পড়ার কথা। কিন্তু স্যার জানে না উর্মির সাথে তার এভাবে দেখা হবে। দরজা খুলে হা হয়ে থাকে সিনতাহা।
ওর এই অবস্থা দেখে তারেক সাহেব বলেন,
কি ব্যাপার মা, ভেতরে ঢুকতে দেবে না?
আপনি এই অসময়ে? জিজ্ঞাসু মনে বলে ফেলে সিনতাহা।
ভেতরে প্রবেশ করেন তারেক স্যার। দাঁড়িয়ে সালাম দেয় একটি মেয়ে। যাকে দেখে অবাক হন তারেক স্যার। এমন কি বিশ্বাস করতে পারেন না উর্মি এখানে আসতে পারে। তবুও সত্যি। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে উর্মি নামের সেই মেয়েটি। যে কিনা ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে দশম শ্রেণির পদার্থ বিজ্ঞান কাসের সেই মেয়েটি। যার চোখের অশ্র“ এখনো জল জল করছে হয়ত। এ অশ্র“ একজন শুধু দেখতে পারছে। তারেক স্যারের সাথে সেদিন অনেক আলাপ হয় উর্মির। উর্মির প্রতি স্যারের অবিচারের কথাও বলেন। কিন্তু সব কিছুই অনামিকার কারণে হয়েছে। উর্মির কাছ থেকে তিনি জানতে পেরেছেন অনামিকা সবার সাথেই এরকম করে। কেউ কিছু বলে না তাই। স্যারের সাথে কথা বলে সকল অভিমান দূর হল উর্মির। তার প্রতি আর কোন রাগ রইল না। বরং স্যারের প্রতি এক ধরণের মায়া জন্মে গেল। কেন জানি তাকে অতি চেনা এবং অতি আপনজনদের একজন ভাবতে শুরু করল উর্মি। অবসান হল øেহের দূরত্বের।
উর্মির সাথে আর প্রতিনিয়ত দেখা হয় না তারেক সাহেবের। মাঝে মাঝে সিনতাহার কাছে উর্মির খবরাখবর জানতে পারে। সেদিন সিনতাহাকে বললেন উর্মিকে দেখা করতে।
কয়েকদিন পর হঠাৎ সেই হাস্যোজ্জল মুখ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে উর্মি বলল,
কেমন আছেন স্যার?
মৃদু হেসে তারেক স্যারের জবাব
ভাল। তুমি ভাল তো?
জ্বী।
লেখাপড়া কেমন হচ্ছে?
আপনার দোয়ায় ভাল। স্যার আমাকে ডেকেছিলেন?
তোমাকে দেখার জন্য, তোমার খোঁজ নেওয়ার জন্য।
সত্যিই।
হ্যাঁ কেন বিশ্বাস হয় না?
তা নয়। ভাবছি এত বড় সোভাগ্য আমার।
আসলে তা নয়। তোমাকে একটা জিনিস দেবার জন্য ডেকেছি।
তারেক স্যার ড্রয়ার থেকে একটা বড় আকারের ছবি বের করে উর্মির দিকে এগিয়ে দেন। উর্মির উৎসুক চোখ জানতে চায় ছবিটি কার। তারেক স্যারের ছোট জবাব ছিল আমার মেয়ের। উর্মি খুব খুশি হয়। একজন ছাত্রী ছবিটা কার জানতে চায়লে উর্মি নি:সংকোচে উত্তর দেয় আমার ছোট বোনের। অবাক বিস্ময়ে উর্মির দিকে তাকিয়ে থাকে তারেক সাহেব। সেই দৃষ্টি কতণ স্থায়ী ছিল তা জানা নেই কারোর। তবে আজীবন থাকবে সেই øেহের দৃষ্টি তার মেয়ে উর্মি।
প্রায় এক মাস যাবৎ দশম শ্রেণির কোন কাস নেন না তারেক স্যার। শনিবার দশম শ্রেণির সাধারণ গণিত কাস। নির্ধারিত শিক ছুটিতে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই দায়িত্ব বর্তায় তারেক স্যারের উপর। কাসে যান তিনি। পূর্বের স্যারের নির্দেশ মোতাবেক কয়েকটা অংক করতে দেন শিার্থীদের। কয়েকজন দেখাতে সম হয়। বাকিরা ব্যর্থ। তবে যারা অংক করতে পারে তাদের মধ্যে উর্মিও ছিল। কিন্তু সামান্য ত্র“টি বিচ্যুতি ছিল যা সকল শিক এড়িয়ে চলেন। তারেক স্যার মনে করেন ভাল শিার্থীদের এ সম্পর্কে ধারনা পাওয়া দরকার। তাই তিনি সকলের উদ্দেশ্যে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো দেখাতে শুরু করলেন। ইতিমধ্যে স্বর্ণালী বলল,
স্যার এগুলো না করলে কোন সমস্যা হবে কি?
না না কোন সমস্যা নেই। তবে এ জন্য নম্বর কাটলে কিছুই করার নেই।
অনামিকার সেই বেশি বলার তালে স্যারকে উদ্দেশ্য করে বলা
তাহলে তো দেখছি আপনার কাছ থেকে এখন আবার নিয়ম শিখতে হবে।
তারেক স্যার কথাটি শুনেছেন। তবে না শোনার ভান করে কাস শেষ করে এসেছেন। রাগ হয়েছিল। কিন্তু উর্মির উদ্দেশ্যে নিয়ম দেখালেন বিধায় অনামিকাকে কিছুই বলেননি তারেক স্যার। বুঝতে পেরেছিলেন অনামিকা তাকে সহ্য করতে পারে না। হয়ত একদিন পারবে। অপোর সেই প্রহর কবে শেষ হবে তার প্রতীা করবেন তারেক সাহেব।
স্যার বের হওয়ার পর দশম শ্রেণিতে শুরু হল প্রচন্ড মল্লযুদ্ধ। উর্মির চিৎকারে সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল। অনামিকার সাথে তো উর্মির প্রচন্ড ঝগড়া। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না। এমন কি এই যুদ্ধে স্বর্ণালীও যোগ দিল। একে একে কাসের সকল মেয়েরা যোগ দিল। বিষয়টা পাশের কাসের মেয়েদের মধ্যেও জানাজানি হয়ে গেল। ঝগড়ার ধরণটা ছিল ঠিক এ রকম –
উর্মি বলে
স্যারের সাথে এভাবে কথা বলা তোর ঠিক হয়নি অনামিকা।
ঠিক বেঠিক তোর থেকে কম বুঝি না।
বেশি বুঝিস বলেই তোকে এসব বলা বাদ দিতে হবে।
স্বর্ণালী বলে
স্যারের কাছে তোর মা চাওয়া উচিত।
মা চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তোর দরকার হলে তুই যা। আমি এর কোন প্রয়োজন মনে করি না।
উর্মি উত্তেজিত হয়ে বলে
তোর মত অভদ্র বাজে মেয়ে আমার জীবনে দেখিনি। কেন যে তোর সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল?
বন্ধুত্ব না রাখলে না রাখবি।
দরকার নাই তোর সাথে বন্ধুত্ব।
অত দেমাগ দেখাস না উর্মি। স্যার তোর কি হয়? দরদ উথলে ওঠে। তার জন্য তোর অত দরদ কিসের?
স্যার আমার অনেক কিছু হয়।
তাহলে তুই মা চেয়ে নিস। আমার যার তার সাথে অত সম্পর্ক দরকার নেই।
চিৎকার দিয়ে উর্মি বলে
খবরদার অনামিকা যার তার বলবি না।
কেন? উনি কি তোর বাপ লাগে?
হ্যাঁ, লাগে। তাতে তোর কি?
তাহলে তুই যা। তোর বাপের কাছে তুই মা চেয়ে আয়।
বেশ তাই যাচ্ছি। স্বর্ণালী যাবি আমার সাথে?
স্বর্ণালী ও উর্মি কাস থেকে বের হয়ে যায় তারেক স্যারের খোঁজে। চার তলায় শিক মিলনায়তনে গিয়ে জানতে পারে তারেক স্যার কোন কাজে বাইরে গেছেন। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে উর্মি ও স্বর্ণালী। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় উর্মির।
গত দিনের ঘটনা সারা রাত বাসায় ভেবেছে অনামিকা। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর এ রকম আচরণ করবে না তারেক স্যারের সাথে। পর দিন স্কুলে এসে তারেক স্যারকে হন্য হয়ে খুঁজেছে। এখনো আসেননি তিনি। উর্মি ও স্বর্ণালীকে অনামিকা বলে তোমরা কি তারেক স্যারকে দেখেছো। উনার কাছে আমি মা চেয়ে নেবো। আমি বুঝতে পেরেছি আমার এ রকম করা ঠিক হয়নি। অনামিকার কথায় খুব খুশি হয় উর্মি। নিজেকে ধন্য মনে করে। উর্মির মনে হয় এই মুহূর্তে যদি স্যারকে বাবা বলে ডাকতে পারতাম! যদি বলতে পারতাম দেখো বাবা তোমার মেয়েরা তোমার আশির্বাদ নিতে এসেছে! ওদের ভাবনায় বাঁধা দিতে এল হাঁফাতে থাকা সিনতাহা। উর্মি বলল
কি রে সিনতাহা, এত হাঁফাচ্ছিস কেন? কি হয়েছে?
সিনতাহা হাঁফাতে হাঁফাতে বলে
তাড়াতাড়ি চল। সবাই বড় রাস্তার দিকে যাচ্ছে।
অনামিকা বলে
কেন?
তা জানি না। তবে শুনলাম, আমাদের স্কুলের কে যেন এ্যক্সিডেন্ট করেছে।
সবাই তাড়াতাড়ি ছুটে চলল বড় রাস্তার দিকে। রাস্তায় প্রচন্ড ভীড়। বন্ধ হয়ে আছে যান চলাচল। উত্তেজিত জনতা বেশ কয়েকটা গাড়ি ভাংচুর করেছে। সমস্ত এলাকা জুড়ে আইন শৃঙ্খলা রাকারী দলের লোকজন কর্তব্যরত আছে। রাস্তার চারিদিকে বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ও শিকবৃন্দ। দুর্ঘটনা কবলিত স্থান ঘিরে রয়েছে সকল জনতা। ভীড় ঠেলে যাওয়ার মতো কোন পরিস্থিতি নেই। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিার্থীবৃন্দ। তাদের এক পাশে উর্মি, অনামিকা, স্বর্ণালী, সিনতাহা। ওরা চারজন চুপচাপ। এখনো জানতে পারে নাই কে এ্যক্সিডেন্ট করেছে। মহাপরিচালক স্যার এসে বললেন তোমরা কি দেখেছো? ওদের না জবাবে তিনি দেখার জন্য সুযোগ করে দিলেন। সবাই যাচ্ছে লাশ দেখতে। কিন্তু উর্মির পা কেন জানি চলছে না। ওর গা শির শিরিয়ে উঠছে। সারা শরীর যেন মুহূর্তে ঠান্ডা হয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে আছে উর্মি। অনামিকা, স্বর্ণালী ও সিনতাহা ওকে এক প্রকার টেনে নিয়ে আসে লাশের কাছে। ওরা উর্মিকে বলে চোখ খুলতে। উর্মি চেষ্টা করছে আপ্রাণ। কিন্তু পারছে না কিছুতেই। কানে একবার শব্দ এল তারেক স্যার নামটি। উর্মির কান যেন বধির হয়ে যাচ্ছে। ও আর কিছুই শুনতে চায় না। বান্ধবীরা আবার উর্মিকে চোখ খুলতে বলে। উর্মি তো পারবে না চোখ খুলতে। ও চোখ যে øেহের ছায়ায় বাঁধা পড়ে আছে। উর্মির চোখ থেকে অশ্র“ বেরিয়ে এসে ওর ওষ্ঠে মৃদু আঘাত করে বলে ও মুখের ভাষা কি বোবা হয়ে গেছে? তোমার বাবাকে ডাকবে না? সে যে চলে যাচ্ছে দূরে। তোমার জীবন থেকে সে হারিয়ে যাচ্ছে। তাকে ফেরাতে ডাকবে না তুমি? উর্মির ঠোঁট দুটো মূহূ মূহূ বিশ হাজার কম্পাঙ্কের বেশি শব্দ করে ডাকছিল বাবা.. আ … আ…। কেউ শুনতে পায়নি সে শব্দ। শুনবেও না কোনদিন। যার শোনা উচিত ছিল সে তো মিশে গেছে রাস্তার পিচের সাথে রক্তাক্ত হয়ে।
উর্মির অশ্র“ তারেক সাহেবের রক্তের সাথে মিশে লুটোপুটি খেল। তৎনাৎ কেঁপে উঠল সারা পৃথিবী। মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল পাখিদের কলরব, আকাশের মেঘেরা ছুটে এল সূর্যের অহমিকা নস্যাৎ করতে। প্রকৃতির নিরবতায় সাড়া দিয়ে বৃষ্টির বারতা জানিয়ে দিল উর্মি তুমি কেঁদো না। তোমার শব্দ কেউ না শুনলেও বিধাতার রাজ্যের সকল বাবারা বুঝতে পেরেছে। সকলে ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু উর্মি কি করে ফিরবে? কি করে তাঁকে রেখে যাবে, যাঁকে এখনো বলা হয়নি সেই কথাটি; বাবা। পারবে না বলতে আর কোনদিন। কখনো।