বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি নির্মলেন্দু গুণ তার একটি কবিতায় গণআন্দোলনে কবিদের অগ্রযাত্রাকে নিবন্ধন করেছেন অত্যন্ত উজ্জ্বল আলোতে। সে কবিতায় কারাবন্দি কবি মোহন রায়হানের কথাটি উঠে এসেছে সাহসিকতার সঙ্গে।
‘আমরা দুর্বৃত্তের উদ্ধৃত্ত সঞ্চয় নিয়ে
প্রশ্ন তুলতে এসেছি জনতার প্রকাশ্য আদালতে।
আমরা শাহী হারেমের বিশ্বস্ত কাগজগুলোতে
শামসুর রাহমানের নাম উৎকীর্ণ করার জন্য
বা ‘মোহন’ মুক্তির জন্য দাবি জানাতে আসিনি।
আমরা রাজপথকে বিপ্লবীদের মিলনতীর্থে
পরিণত করতে চাই। যারা দেশমাতৃকার
শৃঙ্খল ছিঁড়বেন আমরা কবিতা লিখতে চাই
তাদের জন্য, তাদের নিয়ে, তাদের হয়ে।
[আমরা রাজপথে কেন/নির্মলেন্দু গুণ/নির্বাচিতা]
সত্তর দশকের আলোচিত কবি মোহন রায়হান এর বড় পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি যখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র, যমুনা পারের মফস্বল স্কুল পালিয়ে যোগ দেন ছয় দফা আন্দোলনের মিছিলে। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে মোহন তখন তুখোড় কিশোর ছাত্রনেতা। পরিনাম হিসেবে ভোগ করতে হয় পাক-পুলিশের বেদম রক্তাক্ত প্রহার। মাত্র ১৫ বছর বয়সে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে।
একটি জাতির মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেওয়ার বিরল সৌভাগ্য খুব কম কবিরই ঘটে। মোহন রায়হান সেই সৌভাগ্যের শৌর্যাধিকারী। তিনি কবিতা লিখে চলেছেন দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে। তাঁর আরও একটি বড় পরিচয় আছে। বাংলা কবিতাকে গণমানুষের অধিকার অর্জনের মুখ্য পঙক্তিমালা করে তুলেছেন যে কজন বিশিষ্ট কবি, মোহন রায়হান তাদের অন্যতম।
জ্বলে উঠ সাহসী মানুষ’¬ শিরোনামের প্রথম কাব্যগ্রন্থটিই তাই জানান দিয়েছিল একজন সাহসী কবির সফল অস্তিত্ব। ১৯৭৯তে প্রকাশ পায় গ্রন্থটি।
‘তোমাদের লোভাতুর জিভ টেনে ছিঁড়ে নেবো আমি
অলীক উচ্চারণে যারা নিজেদের ভেবে থাকো কবি
ভূমিতে শিকড়হীন; যে বৃক্ষ বাড়েনি তার মূলের মাটিতে
সেই শিল্প তরু আজ আমাদের প্রয়োজন নেই।
আমি হ্যান্ড গ্রেনেডের মতো আমার প্রচণ্ড রুদ্র-রোষ ছুড়ে দিই
সেই সব বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিক্ষক কবি ঘুণে ধরা রাজনীতিকের প্রতি। ’
[সাহসী মানুষ চাই/জ্বলে উঠি সাহসী মানুষ]
স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের সংগ্রাম ও তৎপরবর্তী সামরিক শাসনবিরোধী লড়াইয়ের গর্ভ থেকে মোহন রায়হানের অভ্যুদয়। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায় বিচারের স্বদেশ গঠনের আকাঙ্ক্ষা ও বিক্ষোভগুলি মোহন রায়হানের কবিতাকে ধারণ করে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। তিনি বাংলাদেশের ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংগ্রামের দহন থেকে উঠে আসা ইতিহাস মনোনীত এক কণ্ঠস্বর। তিনি একজন প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সংগঠক।
কবি মোহন রায়হানের কবিতাগুলো বাঙালি জাতিসত্তার স্বপ্ন ও বিরহের প্রতিকৃতি হয়েই জেগে আছে। বেঁচে আছে প্রেম ও পরিণয়ের ধ্রুব হয়ে। যে প্রেম বারবার নিবন্ধন করেছে এ বাংলার সবুজ প্রান্তর, এ পদ্মা-মেঘনার সৃষ্টির ঢেউ কিংবা এই মুষ্টিবদ্ধ তারুণ্যের একক শপথ, অঙ্গীকার।
যে চোখে নিবিড়
সমুদ্র নীল ঢেউ
লোনা জল মাখা
সে চোখে জ্বলুক
বিনাশী আগুন
কুমারী তোমার হলুদ বাটার হাতে
বিচূর্ণ করে শক্রর মস্তক।
আমি আছি হাতে বিজয়ের জয়মালা নিয়ে খুব স্থির
বুকের তলায় বিপ্লবে বিশ্বস্ত গভীর প্রেমে।
[সাথী/জ্বলে উঠি সাহসী মানুষ]
তার কাব্যগ্রন্থ ‘আমাদের ঐক্য আমাদের জয়’ (১৯৮০), ‘সাময়িক আদালতে অভিভাষণ’ (১৯৮৪), আর হলো না বাড়ি ফেরা (১৯৮৫)তে বাংলাদেশে স্বৈরাচারী জগদ্দল পাথরের শাসন চিত্র এবং এর বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের স্থিরচিত্র চিত্রিত হয়েছে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে।
তিনি তুমুলভাবে আলোচিত হয়েছেন তার ‘ফিরে দাও সেই স্টেনগান’ (১৯৮৬) কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর।
ফিরে চাই, ফিরে চাই সেই স্টেনগান
রেসকোর্সের সবুজ গালিচায় বিরহ কাতর
প্রেমিকের মতো জমা দিয়েছিলাম অজানা আশঙ্কায়
প্রিয়তম সেই হাতিয়ার,
ফিরে চাই, ফিরে চাই সেই স্টেনগান।
[ফিরে চাই সেই স্টেনগান/নির্বাচিত কবিতা]
যমুনা পাড়ের এই কবি, সময়ের খুব ঘনিষ্ঠ প্রবক্তা হয়েই জেগে উঠেছেন, মানুষের প্রয়োজনে, স্বাধীনতার প্রয়োজনে, কালের প্রয়োজনে। অনুপ চেটিয়া আসামের একজন বিপ্লবী। তিনি অন্তরীণ হন বাংলাদেশের কারাগারে। সেই মুক্তিকামী সংগ্রামী অনুপ চেটিয়ার মুক্তি চেয়ে মোহন রায়হানই বাংলাদেশের একমাত্র কবি যিনি সোচ্চার হয়েছিলেন। কবিতা লিখেছিলেন:
‘আমাদের মুক্তি সংগ্রামের অকৃত্রিম
বন্ধুদের ঠাঁই তাই কারাগার নয়
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনের সুরভি বাগান
অনুপ অনুপ্রবেশী নয় হৃদয়-প্রবেশ মুক্তিযোদ্ধা
অনুপ চেটিয়ার মুক্তি চাই¬
[অনুপ চেটিয়ার মুক্তি চাই/সবুজ চাদরে ঢাকা রক্তাক্ত ছুরি]
এই কবির আরো বেশকিছু কবিতা আছে যা কালের সাক্ষী হয়েই থেকে যাবে অনন্তকাল। ‘বসু তোমাকে মনে পড়ে যায়’¬ তেমনি একটি কবিতা:
মধুর কেন্টিনে যাই
অরুণের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়:
১১ই জানুয়ারি শিক্ষাভবন মুখে সামরিক শাসন ভাঙার
প্রথম মিছিলে তুমি ছিলে
রক্তাক্ত ১৪ই ফেব্রচ্ছারির কাফেলায় তুমি ছিলে
‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল ট্রাক’ মিছিল চাপা দেওয়ার দিন তুমি ছিলে:
[বসু তোমাকে মনে পড়ে যায়/কবিতা গণআন্দোলন/মুহম্মদ নুরুল হুদা সম্পাদিত]
এ ছাড়াও ‘মোহাম্মদ আলী : বাংলাদেশ’, ‘মোহন রায়হানের রক্ত চাই’, ‘নির্বাসিত ভূখণ্ডে’, ‘ইশতেহার’, ‘শাশ্বত হে শহীদেরা’, ‘আবার আমার নামে’, ‘লোকটি ছিলেন’, ‘শকুন সময়’, ‘তাহেরের স্বপ্ন’, ‘মিলনের মৃত্যু নেই’, ‘১৫০০ সাল’, ‘সবুজ চাদরে ঢাকা রক্তাক্ত ছুরি’ প্রভৃতি রাজনৈতিক কবিতাগুলো শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে।
কবি মোহন রায়হানের জন্ম ১ আগস্ট ১৯৫৬ সালে। সিরাজগঞ্জের খোকশা বাড়ির দিয়ারপাচিল গ্রামে। পিতা ফরহাদ হোসেন, মা মাহমুদা খাতুন। মোহন দ্বিতীয় সন্তান। ফরহাদ হোসেন ছিলেন আজীবন নির্ভিক আত্মত্যাগী জনদরদী সমাজ সংগঠক একজন জনপ্রিয় সামাজিক নেতা। নেতাজী সুভাষ বসুর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করেন। চুয়াল্লিশের দাঙ্গায় কলকাতায় সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনে অত্যন্ত দৃঢ় ভূমিকা পালন করেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্নেহছায়ায়। মা অত্যন্ত সংবেদনশীল। পিতার সাংগঠনিক ও সংগ্রামী চরিত্র এবং মার স্নেহকোমল হৃদয় যুগপৎ মোহনের মানস গঠনে ভূমিকা রেখেছে। যমুনার উদ্ধত দুর্বিনীত ভাঙা গড়া আর নদীভাঙা মানুষের সংগ্রামী চেতনা তাঁকে করেছে সাহসী। মানুষের দুঃখ কষ্ট সুতীব্র বেদনার আঝোর ক্ষত বুকে নিয়ে বেড়ে ওঠা মোহন আজন্ম স্বপ্নাহত এক রক্তাক্ত শব্দবিহঙ্গ।