মেঘনা পাড়ের সমকালীন সাহিত্য : সৌম্য সালেক

সাহিত্য বাজার

Sharing is caring!

140

লেখক স্যেম্য সালেক

এই অর্থে সাহিত্য একটি উন্মুক্ত প্রতিষ্ঠান যেখানে মূল্যবজায় রেখে যে কেউ যে কোন কিছু উপস্থাপনের সুযোগ পেয়ে থাকে। সুখ-দুঃখ, বেদনা – বিষাদ,স্বপ্ন – কল্পনাসহ জীবনের নানা মাত্রিক অণু – উপসর্গ যখন নান্দনিক ভাবে আমাদের সামনে আসে তাই সাহিত্য। মানুষের অনুভূতি সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকেই সাহিত্যের উদ্ভব। সাহিত্য শুধুমাত্র লেখার মাধ্যমে আসতে হবে এমনটি নয়। মানুষের বহু উচ্চরণকে আমরা দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়তে দেখি মুখেমুখে যার কোন কোনটি কিন্তু‘ শিল্পমাত্রায় চমৎকার ভাবে উত্তীর্ণ – সাহিত্যের ইতিহাস এমনটিই সাক্ষ্য দেয়। সৌন্দর্যকে যেমন স্থান-কাল-পাত্রে নির্দিষ্ট করা যায় না, তেমনি বিভিন্ন ধরণ থাকা সত্ত্বেও সাহিত্য গ্রহণ – বর্জন – নবায়ন গ্রাহ্য উন্মুক্ত এক নন্দনভূমি। যেখানে উড়ার, চর্চার তথা বিচরণের সমান অধিকার সবার। আমাদের সামষ্টিক জীবনে রয়েছে সাহিত্যের অপ্রতিরোধ্য প্রভাব। কোন না কোন ভাবে আমরা প্রত্যেকেই কম – বেশি সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত অবশ্য সে প্রভাব কখনও দ্রোহের আবার কখনও সুন্দরের।
শস্য – শ্যামল নদীমাতৃক বাংলাদেশের একটি ছোট্ট শহর চাঁদপুর। মেঘনা-ডাকাতিয়ার অকান্ত উচ্ছলতা বুকে নিয়ে জেগে আছে যেন নীলপদ্ম, জাতীয় মাছ ইলিশের প্রাণকেন্দ্র – এছাড়াও উৎপাদিত হয় এখানে প্রচুর খাদ্যশস্য, ফল-ফলাদি। শস্য-স্নিগ্ধ নিজ জেলার গুণে মুগ্ধ কবি ইদ্রিস মজুমদার স্বল্প শব্দ ব্যয়ে চাঁদপুরের স্বরূপ তুলে ধরেছেন – ‘চাঁদপুর ভরপুর জলে স্থলে/মাটির মানুষ আর সোনার ফসলে’। জল – শস্য-কাদামাটির লাবণ্যে ললিত এখানকার জীবন, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি বয়ে চলেছে হাজার বছর ধরে। হাজার বছরের স্বপ্ন কল্পনা রঙ্গিন নৌকাপালে ভেসে এখানে জলের মতো কথা কয়। তাই এখানে লোক আর নদী এক সুরে বাঁধা, এক ছন্দে একাকার। মধ্যযুগ থেকেই বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ভূমিকা রাখতে আরম্ভ করেছে চাঁদপুরের কবি-শিল্পীবৃন্দ। কবি দোনাগাজী এ জেলারই সন্তান যিনি কবি আলাওলের অনেক পূর্বেই ‘সয়ফুলমূলক বদিউজ্জামান’ নামের কাব্য রচনা করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারি পত্রিকা ‘সওগাত’ – পত্রিকাটির সম্পাদক মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন এ জেলারই কৃতিসন্তান।
তাঁদের পথ ধরে আজ অবধি এগিয়ে চলছে চাঁদপুরের কবি সাহিত্যিকদের কর্মযাত্রা। চমৎকার চিন্তা এবং লিখনীর মাধ্যমে যাঁরা জাতীয় পর্যায়ে চাঁদপুরকে তুলে ধরছেন তাদের কয়েকজন – অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, শান্তনু কায়সার, মুনতাসির মামুন, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শামসুল আরেফিন, হাশেম খান, হাসান মোস্তাফিজুর রহমান, তারিক টুকু, মনসুর আজিজ, হাসানুজ্জামান, রফিকুজ্জামান রণি, পান্থ ফরিদ, মুহাম্মদ ফরিদ হাসান, দন্ত্যন ইসলাম, কিশোর মাহমুদ, শ্রাবণ রহমান এবং সৌম্য সালেক। উৎসাহ, আলোচনা এবং পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে চাঁদপুরের সাহিত্যকে সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য যারা পালন করছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তাদের কয়েকজন – কাজী শাহাদাত, জীবন কানাই চক্রবর্তী এবং অধ্যাপক মনোহর আলী। আরো একজন বিশিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যিনি কৃষিকে সাহিত্যমানে উপস্থাপন করছেন বিশ্বজনের কাছে, সেই শাইখ সিরাজের কথা না বললেই নয়। চ্যানেল আইয়ের পরিচালক বার্তা পদে অধীন এই মানুষটিও চাঁদপুরেরই সন্তান।
চাঁদপুরের  সাহিত্য অঙ্গনে যারা সচল এবং ধারাবাহিক চর্চার মাধ্যমে মেঘনা পাড়ের সাহিত্যকে জাতীয় পর্যায়ে উন্নীতকরণে রেখে যাচ্ছেন বিশেষ ভূমিকা তাদের কয়েকজন – মোকলেসুর রহমান মুকুল, প্রকৌ.মো. দেলোয়ার হোসেন, পীযুষ কান্তি বড়–য়া, তসলিম হোসেন হাওলাদার, পীযুষ কান্তি রায় চৌধুরী, হাসেম প্রধানিয়া, এস.এম. জয়নাল আবেদীন, আব্দুল হক মোল্লা, মাহমুদুল বাসার, রনজিৎ চন্দ্র সাহা, মোস্তফা কামাল মুকুল, গাজী কবির, নূরুল ইসলাম ফরহাদ, জসিম মেহেদী,ম. নূরে আলম পাটওয়ারী, শ্যামল চন্দ্র দাস, মোকলেসুর রহমান ভূইয়া, শিমুল চন্দ্র শীল, কবির মিজি, আইনুন নাহার কাদরী, জাকির হোসেন, তৃপ্তি সাহা, আশিক বিন রহিম, সাদি শাশ্বত, আল আমিন মিয়াজী, জব্বার আল নাঈম, জয়ন্ত সেন, আসাদুল্লাহ কাহাফ, সাইফুল ইসলাম নাবিদ, সঞ্জয় দেওয়ান, মাইনুল হক তোহা, মিজানুর রহমান রানা, মহসিন মিজি, সরকার তৌহিদ, শেখ রুবি, মারুফা আক্তার রিতা, মাইসা মনি, সোহরাব হোসাইন, মনিরুজ্জামান প্রমউখ, সুমন কুমার দত্ত, শাহ বুলবুল, হোসাইন কবির, বি.এম হোসেন, পি. এম. বাহার, সজীব খান, জাহাঙ্গীর হোসেন, দুখাই মোহাম্মদ,আহমেদ সালেকীন এবং ইয়াহু তাপু। চাঁদপুর থেকে প্রকাশিত কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা – মৃত্তিকা, ঘনান্ত, সৃজন, উপমা, তরী, ববুলি এবং চাষারু।
১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমী। প্রতিষ্ঠার প্রথমদিকে এর কার্যক্রম গতিশীল ছিল; যার ফলশ্র“তি হিসেবে আমরা পেয়েছি ‘শত মাল্লার জলতরঙ্গ’ – এর মতো চমৎকার কাব্য সংকলন কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে যেনো ধীরে ধীরে এর জৌলস কমতে থাকে। তবে আশার কথা হচ্ছে আবারও প্রতিষ্ঠার সেই উদ্দিপনা নিয়ে আরম্ভ হয়েছে সাহিত্য একাডেমীর কার্যক্রম। বর্তমান সভাপতি এবং মহাপরিচালকের আন্তরিকতায় সবার অংশগ্রহণে এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিভিন্ন ধারার সাহিত্য প্রতিযোগিতা। প্রতি ইংরেজি মাসের শেষ বুধবার অনুষ্ঠিত হয় সাহিত্য আড্ডা আর আসছে জুলাই মাসে প্রকাশ হতে যাচ্ছে সাহিত্য ম্যাগাজিন। সাহিত্য একাডেমীর বর্তমান কার্যক্রমের সচলতা চাঁদপুরের সাহিত্যকে  জাতীয় সাহিত্যের সাথে সমন্বিত করণে তথা উন্নতি সাধনে বিরাট ভূমিকা রাখবে – নিশ্চিত।
001
চাঁদপুরের শব্দশিল্পীদের সমকালীন কাব্য-চর্চার গতি প্রকৃতি সম্পর্কে সামান্য ধারণা প্রদানের ল্েয কয়েকটি কবিতাংশ উপস্থাপন করছি।

‘ট্যান্টালাসের অতৃপ্তি নিয়ে বেঁচে আছে ইচ্ছে নিধি /স্বপ্নের জলছাপে জীবন হয়ে আছে বনসাই।’    বনসাই উপাখ্যান – পীযুষ কান্তি বড়–য়া
‘ধার দেওয়া টাকাগুলো ক’দিন পারেই জুতার তলা হয়ে/ ঠাস ঠাস গালে মারতে থাকে চপ্টাঘাত”    যখন নষ্ট সময় – তছলিম হোসেন হাওলাদার
‘এলিয়েন সা¤্রাজ্য ছিল তোমার ঠোঁটের কার্নিশে/ অন্ধ পৃথিবীর মতো তুমিও আজ বেশ বিবর্ণ’।      ধ্রুপদী স্বপ্নের পুলসিরাত – পান্থ ফরিদ
‘যদি আমরা পরস্পর বিনিময়ে জড়াই। আমার পালঙ্ক তোমার ঘুম – তোমার ডিঙ্গি আমার ঢেউ’,   কবিতার জন্য প্রার্থনা – সাদি শাশ্বত
‘একগুচ্ছ পৃথিবী পকেটে নিয়ে মহাকালের সমুখে দাঁড়িয়ে দেখি/ সামনে অন্তহীন শূন্যতা’, শূন্যতা – রফিকুজ্জামান রণি
‘নিঃশ্বাস সমান মেঘে হেসে ওঠে বৃষ্টি/ রাত যে কত হলো – বেখেয়ালে ঘাসের চোখে শুয়ে পড়ো রাত্তির’
বৃষ্টির অপো – মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
‘ছেঁকে-ছেনে ঘন সবুজ মিলে/মিলে যদি রাগমুক্তি/উষার নৌকাপালে/আরো নীল গুচ্ছগোলাপ…’
আত্মখুনের স্কেচ – সৌম্য সালেক
‘কাঠের গুড়ার মোম গালে পড়ে আধখান চাঁদের ফোকরে/ মীনাীর অন্তরালে তেজপাতা জ্বলে গন্ধ ছড়ায় উড়ন্ত মেঘের ভেলায়’, কামরসের পেয়ালা- দন্ত্যন ইসলাম
‘আমার স্বপ্নের রাজ্যেও রোজই খেলা করে বেড়া কাটা ইঁদুর/ কুকুরের ভয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে পোষা বিড়ালগুলো, স্বপ্নের মহড়ায় – কবির হোসেন মিজি
‘শিকড়ের ভিতর দিয়ে আমরা ফিরে আসি পাতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। পতনের পর আবার বাস্তুসংস্থানই আমাদের নিয়তি’। আত্মহত্যা ও পলায়ন বিষয়ক – হাসানুজ্জামান
‘তারাই কি নিরুদ্দিষ্ট স্মৃতি? লেবুবাগানের ঘ্রাণ? যেদিকে দৌড়ে নিজের অজান্তেই একদিন নীল কোন পাখি হয়ে যাব’। – তারিক টুকু
‘হৃদয়ের বারান্দায় আজ বুনো ঘাসের অবাধ বিচরণ/ তাই নিঃশব্দে অদৃশ্য ভালোবাসায় সব অণু-পরমাণু’
সমাপ্তি – জসীম মেহেদী
4‘ভাগ্যহত রাজকুমার বোরাকে যাবো পরবাসে/ পাড়ে থাকবে গাঙ্গচিল – কোষানাও – কালোবৈঠা/ উলঙ্গ না বলে ডাকাতিয়া ভিজালো না আমায়’ যে গল্প মায়াপুরী – কিশোর মাহমুদ
‘ফুলে গাঁথা কোন কাব্য নয়Ñ জীবন যেনো কৃষ্ণচূড়ার রঙে লাল হওয়া- গোধুলী সূর্য’, সময় গাঁথা – আহমেদ সালেকীন
‘লুটেরা হয়েছে বিবেকবোধ – মনুষ্যত্বের দলে হায়না /ভাসমান পরগাছা হয়ে বেশিদুর আগানো যায় না’। পরগাছা – ম. নূরে আলম পাটওয়ারী ।
‘দৃষ্টিকে গুটিয়ে শ্রবণকে নির্বাসনে দিয়ে/ ফিরে যাবই সেই পুরানো পথে’, ফিরে যাবো পুরানো পথে – দুখাই মুহাম্মদ ।
‘মুমূর্ষু গণতন্ত্র বার্ণ ইউনিটে রক্ত শূন্যতায়/ মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতর’। রক্ত শূন্যতা – আশিক বিন রহিম
‘বিশ্ববিবেকের আলোক রশ্মি সেন্ট হেলেনায় নির্বাসিত /স্কার্ভিতে আক্রান্ত পঙ্গু সমাজ- মৃত আগ্নেয়গিরি রোবেন দ্বীপ বহন করে – কালের পুরাণ’, আর্তনাদ -সঞ্জয় দেওয়ান ।
‘কবোঞ্চ জল গায়ে মেখে থমকে দাঁড়ায় এক কিশোরী/ আকাশ জুড়ে কাজল মেঘ শ্রাবণ মাসের/ উষ্ণ এখন নীল জলধি’, মগ্ন কিশোরী – প্রকৌ. মো.দেলোয়ার হোসেন।
‘আমাদের প্রাগৈতিহাসিক চুম্বনগুলি ডেমো পাখির উরুতে সুগন্ধা ফুল হয়ে ফুটছে-রহস্যময়ী ফুলের বাঁশঝাড়ের মতো বেড়ে ওঠে গিরিখাদের হেমন্তে’, বোধের পৃথিবী – শ্রাবণ রহমান।

শিল্প-সাহিত্য সুন্দরকে তুলে ধওে – সৌন্দর্য বোধকে সূক্ষ্মভাবে উসকে দেয় ফলে অন্ধকার অজ্ঞানতা পিয়াসুকে গ্রাস করতে পারে না। সাহিত্য মননের মধু পানকারী শুদ্ধ হয় নিজে – আলো ছড়িয়ে পড়ে সমাজে – রাষ্ট্রে। যে সমস্যায় আমরা আজ পীড়িত তার অন্যতম সমাধান হতে পারে পঠন-পাঠন এবং সুন্দরের সন্ধান। যেখানে ঘুমিয়ে আছে যুগ – যুগান্তের জ্যোতি, যেখানে স্তব্ধ হয়ে আছে ইতিহাস, প্রজ্ঞার রশ্মিরাশি সেইতো মহার্ঘ-পরম; সময়ের এবং সভ্যতার স্বার্থে। যারা চর্চায় আছেন এবং যারা নতুন এসেছেন আমাদের সবার একই স্বর – সুন্দরের উদ্যাপন এবং অবলম্বনই আমাদের যুগযাত্রা ।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!