মাসুদ আলম বাবুলের লেচু মিয়ার ঘর
(সামগ্রিক ভাবনা)
ওপার বাংলার খ্যাতিমান কবি ও কথাসাহিত্যিক মাসুদ আলম বাবুলের উপন্যাস “লেচু মিয়ার ঘর”।
বস্তিবাসী এক অনাথ কিশোরের করুণ জীবনাগাঁথা এ উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়।
লেচুর বাবা মাজু প্যাদা রহমান হাজীর বরফকলে কাজ করার সময় এক দুর্ঘটনায় মারা গেলে পাঁচ বছর বয়সী লেচুকে তার মা জয়তুনি রহমান হাজীর বাড়িতে পেটেভাতে রেখে ঘাটকুলি নিঃসন্তান আজু সর্দারের সাথে নিকা বসে।
রহমান হাজীর স্ত্রী মমতাময়ী জেসমিন রহমানের অপার মাতৃস্নেহে বেরে ওঠা লেচুমিয়াকে দীর্ঘ বারো বছর পর আজুর ইন্ধনে লেচুর মা লেচুকে ফেরত নিয়ে যেতে চায় অথবা তিন হাজার টাকা মাইনে দিতে হবে বলে।
১৭ বছরের লেচু জেসমিনের মাতৃত্বের আস্বাদে নিজের নিঃসঙ্গ দরিদ্র জীবনের কোন পদচিহ্ন লক্ষ্য করেনি। জেসমিনের মাতৃত্বের বারোটি সোনালি সময়ের সেবা-আদর সেই কবেকার শৈশবের অধঃবিস্তৃত পাঁচ বছরের মাতৃস্নেহ নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। তাই দুই মায়ের মাঝখানে পড়ে তার কোনো মানসদ্বন্দ্ব নেই। সে একেবারে সযৌক্তিকতায় জেসমিনের মাতৃত্বের প্রতি কৃতজ্ঞতার চেয়েও বড় কিছুর প্রতি নতজানু হয়ে দ্বিধামুক্ত হয়ে গর্ভধারিনীকে পরাস্ত করে। জেসমিনের অভিমানি মন তাকে ফিরে যেতে বলেছে। আর রহমান হাজী তিন হাজার টাকা দিয়ে বহাল করতে চেয়েছে। শেষ পর্যন্ত তার মায়ের সঙ্গে কাঁদতে কাঁদতে চলে যায় লেচুমিয়া।
জেসমিন লেচুর মায়ের গ্রাম্য উগ্র কথায় বিরক্ত হয়ে লেচুকে জোর করে বার করে দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু বারো বছরের তিলে তিলে বেড়ে ওঠা চারা গাছটা কখন ডালপালা মেলে তার সমস্ত অন্তর ছুঁয়ে ফেলেছে তিনি তা বুঝতে পারলেন সারারাত বিনিদ্রতায় কাটিয়ে।
জেসমিন তার অধ্যাপক বোন
কানিজের সঙ্গে চিকিৎসার জন্য ঢাকা শহরে যাবার পূর্বে অসুস্থ লেচুকে ময়লা কাঁথা গায়ে জ্বর অবস্থায় তার ঝুপড়ি ঘরে দেখতে যায়। এবং ডাক্তার দেখাতে দুই হাজার টাকা দিলে লেচু ওর আম্মার মান রাখতে মাত্র পাঁচশো টাকা রেখে বাকি টাকা ফেরত দেয়। জেসমিন রহমান যাবার সময় প্রচণ্ড জ্বরেও লেচুমিয়া ঘাটে যায়। জেসমিন তাকিয়ে দেখে কাঁথা গায়ে লেচু মিয়া আকুল নয়নে তাঁর কক্ষের দিকে তাকিয়ে আছে।
যদিও সব গরিরের সমস্যা ও জীবন পরিক্রমার ইশতেহার এক রকম নয়। প্রত্যেকের জীবনবৃত্তে একটা নিজস্ব লড়াই আছে। প্রর্তি মুহূর্তে বদল ঘটে যাচ্ছে সময় ও জীবনের অ-বনিবনার সংঘর্ষের। লেখক যা এ উপন্যাসে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
গর্ভধারিনী মা তার দ্বিতীয় স্বামী আজু সর্দারকে খুশি রাখার জন্য নিজের সন্তানের উপর যে অন্যায় আচরণ করে তা বিব্রতকর। জেসমিন লেচুকে দেখে যাবার পর স্বীয় সন্তানের ঘর তন্নতন্ন করে খোঁজে টাকা হাতিয়ে নেবার জন্যে।
তথাকথিত সৌখিন বুদ্ধিজীবীরা লঘুমানের দার্শনিক সেজে কৌটিল্য হতে চায়। ফলে সুস্থ ভাবনার বিনষ্টি ঘটে গিয়ে স্থবিরতার জপমালার খুশির ও স্বস্তির আমানতের মিথ্যা স্বপ্ন দেখে। তাই জেসমিন তার শিক্ষিতা বোনকে কত সহজে স্বভাববসে বলতে পারে, “মানুষকে শেখাও কিন্তু নিজে শেখ না”। এটাই হচ্ছে অনতিক্রম্য একশ্রেণীর শিক্ষিতের জীবন-ব্যধি। এই পিড়িত ভাবনাই দুঃস্থ ভবিষ্যৎ রচনা করেছে। মানবিক মূল্যবোধ শুধু পুঁথি বা মগজেই বন্দি ও নিশ্চল হয়ে আছে।
লেখক বলেছেন,”মধ্যবিত্তরা যে শ্রেণীভূক্ত ই হোক না কেন তারা শালীন ও সহনশীল। তাদের যেমন আছে সমাজ-সভ্যতা তেমনি আছে মানবিক মূল্যবোধ” এর পরেই বলেছেন, “অতি দরিদ্র ও অত্যাধিক ধনাঢ্য পরিবারগুলোর সংসার বালু আর খড়কুটা দিয়ে বাঁধা”। দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে তারা শুধু বেঁচে থাকার সংগ্রামই বা বিবেক আর মানবিক মূল্যবোধ ভাবার জন্য যে সময়টুকু তাদের ভাবতে হয় সে সময়টায় তাদেরকে পরিশ্রম করে আহার যোগাতে হয়, মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে হয়। এদের পরিবারগুলো বারবার ভাঙে গড়ে। কিন্তু জীবনের স্বাদ তারা কোনদিনই আস্বাদ হিসেবে নিতে পারেনা। উচ্চবিত্তদের সম্পর্কে তার মন্তব্য, “ভালোবাসা ও আবেগ তাদের কাছে অধরা। তাদের ও পরিবারের এই ভালোবাসা ভেঙে যায় কাচের চুড়ির মতো শুকনো ছনের মতো, গরিবের চেয়েও গরিবের মতো। সমাজ সভ্যতার শক্ত ভিত রচনা করে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যবিত্ত।” এমন অসাধারণ এ বর্ণনা সত্যিই নিচু শ্রেণির সমাজ বাস্তবতায় এক স্বার্থক রূপায়ন।
লেচু মিয়ার মা বারো বছর পরে লেচুকে ফিরে আনতে গেলে সে আসতে চায়নি। কৃতজ্ঞতা নয় কারণ কৃতজ্ঞতা কি জিনিস সে জানেনা, সে শুধু ভালোবাসা ও মমতার নিগরে বন্দি থেকেই স্বেচ্ছায় আসতে চায়নি, আর ওই একই কারণে জেসমিনও ছাড়তে চায়নি। আর একই কারণে জেসমিনের বড় শহরে যাওয়ার পথে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে কাঁথা গায়ে লেচু লঞ্চঘাটে বারো বছরের তিলে তিলে পাওয়া মাকে দেখতে বা বিদায় জানাতে দাঁড়িয়ে থাকে। আর তার সেই মাও ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা লেচু মিয়ার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে।
লেচুর জন্ম দেয়া মা সব কড়ায়-গণ্ডায় পয়সায় মাশুলে বুঝে নিতে চায়। লেচুকে জেসমিন দুই হাজার টাকা দিতে চাইলে সে পাঁচশ’ টাকা মাত্র অনিচ্ছায় নিয়েছে। আর সেই টাকা ছিনিয়ে নিতে অসুস্থ ছেলের উপর চড়াও হয়েছে তার নিজের মা। অন্যদিকে জেসমিনের বোন অধ্যাপক কানিজেরও অতি বাস্তববোধ এইসব মমতা, সহানুভূতি বা দরদকে সস্তা সেন্টিমেন্ট বলে মনে করে। ধনী-গরিবের বা মধ্যবিত্তের প্রশ্ন নয়। তার সঙ্গে আছে সময় স্থান পরিবেশ ও বিবেক। যে কারনেই একজন সাহিত্যিকের কলমে জন্ম নেয়া চরিত্র গড়ে ওঠে তার নিজের মতন করে।
ধনী কোন রাজা বাদশাহদের বুকের শিলালিপিতে ভালোবাসার অক্ষয় অক্ষর মুদ্রিত থাকে। বঙ্কিমচন্দ্রের জেব-উন্নিসা এক বিন্দু ভালোবাসার জন্য অশ্রু জলে মাটি ভেজাল। কিম্বা মহাশ্বেতাদেবীর “হাজারো চুরাশির মা” অাভিজাত্য আর সাজানো স্ট্যাটাসের আড়তে বসে যে পুত্র হারানোর যন্ত্রণা ভোগ করছে তা মর্মান্তিক। তারাশঙ্করের ‘পাখি কিংবা ঠাকুরঝি’, সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা পিপলাই’ এর জীবনী ‘চিন্ময়ী”…. ভালোবাসার আলাদা এক আধার ভুবন নির্মান করে। রবীন্দ্রনাথের যাইবেন, বিভূতিভূষণের রুপো বাঙাল বাড়ির পরিচারক অথচ মানবিক মূল্যবোধে স্বর্গসুষমা রচনা করেছে। তারা দরিদ্র কিন্তু কাঙ্গাল নয়, হৃদয়ের অর্ঘ্যে রাজার রাজা।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে যে মধ্যবিত্ত সমাজকে পাই তা পোকায় খাওয়া জর্জরিত সমাজ। হিংসা, দ্বেষ, ভণ্ডামি ও স্বার্থপরতার নগ্নতায় দিগম্বর সেজে বসে আছে। মধ্যবিত্তরা বড় ক্যারিয়ারিস্ট হয় যে কোনো সময় রং পাল্টায় চরিত্র ধর্মে তারা পেণ্ডুলাম। ঠিক তেমনি মাসুদ আলম বাবুলের উপন্যাসেও আমরা মধ্যবিত্ত সহ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের উপস্থিতি দেখতে পাই।
লেখক জীবন মন্থন করে সুধা ও গরল তুলবেন। সে জীবন যে কোন শ্রেণির যে কোন স্তরের জীবন হতে পারে। “নীলদর্পণ” নাটকে জমিদার এবং রায়তবর্গ একই সংকটে হাতে হাত মিলিয়ে লড়াই করেছে নীলকরদের বিরুদ্ধে। সেখানে দরিদ্র মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত এক ভালোবাসার সূত্রে কমন মূল্যবোধে সামিল হয়েছে।
উচ্চবিত্তরাই শুধু ভোগবিলাসে মত্ত হয় না। সুযোগ পেলে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরা আরো মারাত্মক অনিয়ন্ত্রিত বিলাসী জীবমত্ত হয়ে ওঠে। শুধু গরিব পরিবার বারবার ভাঙে গড়ে না, জীবনের ধর্মই ভাঙ্গা গড়া। মধ্যবিত্ত পরিবার এখন মিশ্র জটিলতার সমাধানহীন সংকটে দেখা যাচ্ছে। মাইক্রো পরিবারে মাইক্রো ক্রাইসিস তাদের জীবনকে সংঘাতে সংঘাতে চূর্ণ করে দিতে উদ্যত কারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে স্বপ্নের জাল বোনার স্বপ্ন বেশি। যে কোন পথে ও শর্তে আত্মপ্রতিষ্ঠা দুরাকাঙ্ক্ষায় সে নিত্য জর্জর। ফলে ব্যক্তি জীবন কর্ম জীবন ও সমাজ জীবনে সঙ্গতি সূত্র গ্রহণের অক্ষমতা তাকে আত্মসম্মান তছরুপের কুমন্ত্রণা যোগায়। সুতরাং তাদের মূল্যবোধের সবচেয়ে অবক্ষয় বেশি। দরিদ্র পরিবারে এই আত্মবিকার ও বিক্রয়ের কোন অধঃপতনের ইশারা নেই হয়তো কিন্তু রয়েছে রুঢ় সমাজ বাস্তবতার এক অভিনব রূপ।
লেখকের ভাষায়, “ভালোবাসা ও আবেগ তাদের কাছে অধরা”
কানিজের পরিচারিকা রহিমা কানিজকে আম্মা বলে ডেকেছিলো কিন্তু তিনি বারণ করে ‘খালা’ সম্বোধন করতে বলেছেন অর্থাৎ অশিক্ষিত দরিদ্র ও বাড়ির কাজের মেয়ের ধনী পরিবারের সঙ্গে নৈকট্য স্থাপনের দুঃসাহস তিনি বরদাস্ত করেননি। ঘরে ঘরে তো জেসমিন প্রদীপ জ্বেলে বসে থাকে না। নিম্নবিত্তের কোন উচ্চ মনের মানবের সঙ্গে স্বাভাবিক মধুর সম্পর্ক স্থাপন করলেই উচ্চবিত্তের স্ট্যাটাস নষ্ট হয় না। ওটা মনের দীনতা থেকে জন্ম নেয়… তা থেকেই জন্ম দেয় হীনতা। তাই কানিজ যা চিন্তায় আনতে পারে না তার দিদি কত সহজে তা বরণ করে নেয়।
জেসমিন ভদ্র উচ্চশিক্ষিত ন্যায় ও নীতিনিষ্ঠ, কর্তব্যদৃঢ়, ব্যক্তিত্ব ঋদ্ধ, মমতাময়ী মানবিক এবং আপন সিদ্ধান্তে অবিচল ও আপনপর নিরপেক্ষ, গরিব দরদি ও করুণাস্নিগ্ধ। এক কথায় একটি প্রায় পরিপূর্ণ মানুষ। এখানে লেখকের স্বার্থক সৃষ্টি জেসমিন রহমানের চরিত্র।
লেচুর মা জয়তুনি তার দ্বিতীয় স্বামী আজু সরদারের জুলুমে লেচুকে নিরাপদ আশ্রয় থেকে লঞ্চঘাটে কুলি হিসেবে নিয়োগ করে টাকা উপার্জন করার জন্যে।
ঘাটে কয়েকজন কুলি লেচুকে প্রহার করে বলে প্রতিবিধানে জাহাজঘাটের সরদার আজুকে জানালে সে গ্রাহ্য করে না উপরন্ত জয়তুনিকে নির্যাতন করে। এখানে একইসঙ্গে মাতৃ হৃদয়ের স্নেহ পিপাসা ও অর্থলিপ্সা তার বাস্তব চরিত্রকে তুলে ধরেছে।
জাহাজঘাটের সরদার আজু অ-মানসিক অত্যাচার করে জয়তুনির উপর। যে অর্থ, ভোজ্য ও নারী ছাড়া কিছুই বোঝে না। বস্তিবাসীর সব রকম ধর্মই তার আছে, সে স্বার্থপর, অবিবেচক এক নিষ্ঠুর মানুষ। জৈব সত্তাই তার সব সত্তা।
জয়তুনি হল আজুর পঞ্চম স্ত্রী। ইতিপূর্বে চারজন স্ত্রী তার অত্যাচারে তাকে ত্যাগ করেছে। আজু কামুক- ধূর্ত। সে ভিখারি ও ক্যাজুয়ালে দেহপজীবিনীর সঙ্গে দেহাসক্ত। স্ত্রী জয়তুনিকে তার স্বভাব ধর্ম উগ্রতার প্রতিকুলে গিয়ে শান্ত ও কৃত্রিম আন্তরিকতার স্টাইলে ছলে ছেলের কাছে থাকতে বলে, তাজেনূরের সঙ্গে সঙ্গটাকে অবাধ করার জন্যে।
জেসমিন ছাত্র বয়সে বামপন্থী ছিলেন। তাই কাজিনের বাড়ির পরিচারিকা রহিমার সঙ্গে তার ভালোলাগা গল্প। বাস্তব জীবনাচারে বিশ্বাসী কানিজের তাতে আপত্তি। কানিজ ও জেসমিনের পুত্র রাফিদ এরা একটা ক্লাস নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে। জনজীবন ও মানসিক জীবনের সঙ্গে তার কোন যোগ নেই। তারা শুধু অর্থ ও শিক্ষা দিয়ে মানুষকে দেখে…. মানুষ হয়ে মানুষকে দেখে না।
লেচুর মত ছেলেদের জন্মই যেন বড় লোকদের হাতে মার খাওয়ার জন্য। বিনা সংকোচে চড় থাপ্পড় মারে কারণে-অকারণে। একবিংশ শতাব্দীর উদার মানসিকতার কুলে দাঁড়িয়ে কিছু রুগ্ন মনুষ্যত্বের যাত্রীর এই পাশবিক আচরণ। সভ্যতার লজ্জা, লজ্জা জেসমিনের মত মায়ের ছেলে রফিদদের কুৎসিত উগ্র আচরণে।
আজু সরদার প্রথমত রিপুর অবৈধ স্বাদের জন্য তাজেনূরের তনুবসে পাগল হতে চায়। টাকা তখন তার কাছে ধুলোবালি, লেচুর মাকে নানা অজুহাতে লেচুর কাছে পাঠিয়ে দেয়।
তাজেনূরের জন্য তার মন অস্থির হয়ে উঠে। তাজেনূর কুৎসিত হতে পারে কিন্তু এই মুহুর্তের তার প্রাণের সুর যেন অন্যরকম, “তোমার মন তোমার দ্বারে হরদার, আমারটা আমারে, মধু ভরা রাইতখান দিমুআনে তোমারে।”
আজু সরদারের টাকার লোভ। তাই ট্যারা জয়নালেরর একচোখ কানা মেয়েকে এক লাখ টাকার বিনিময়ে লেচুর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে একটা দোকান করে দেয়ার কথা বলে লঞ্চঘাটে। কিন্তু আজুর উদ্দেশ্য ওই টাকাটা আত্মসাৎ করা। জয়তুনি ও লেচু তা বুঝতে পারেনা।
দারিদ্র, নিত্য কর্মসংস্থানের অভাব, বন্যা, ঝড়ে ভেঙে পড়া ঘরবাড়ি। অন্য সংস্থানের জন্য শহর সংলগ্ন বস্তি গড়ে ওঠে। বিভিন্ন ধরনের কাজ পাওয়ার ফলে উদরপূর্তির অভাব হয়না। লেখক বলেছেন ঠিকই, এই বস্তি কালচার সম্পর্কে.. “গ্রামীণ আর শহুরে সংস্কৃতির বাতাবরণে তাদের মধ্যে এক মিশ্র সংস্কৃতির ভাবধারা গড়ে ওঠে “।
“নিজেকে ভাবতে শেখো অন্যের মত করে, অন্যকে ভাবতে শেখো নিজের মতো করে”
আজু সর্দার লুলা ভিখারির স্ত্রী তাজেরনূরে সথে সম্পর্কের সব বাঁধা সরিয়ে দেবার জন্যে একেকটি কূটকৌশল করে ক্রমাগত আরো অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। সে জয়তুনিকে দিয়ে অবৈধ মাদকের ব্যবসা করাতো। লেচুর বিয়ের পর শ্বশুরের কাছ থেকে প্রাপ্ত এক লক্ষ টাকা লেচুর স্ত্রী তার সংসারে ফিরে পাওয়ার জন্যে চাপ দিতে থাকলে আজু সর্দার কৌশলে মাদক বিক্রির অপরাধে গোপনে পুলিশ দিয়ে লেচু, লেচুর মা ও লেচুর স্ত্রীকে গ্রেফতার করায়।
লেচুকে জেসমিন রহমান থানা থেকে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে এনে পুনরায় নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয়।
তাজেনুরের প্রতি আজুর কুৎসির যৌনাচারের পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লুলা আর তাজেনুর ঘাট ছেড়ে রূপাতলি বাসস্টাণ্ডে চলে গেলেও আজু তার পাশবিক আবেদন থেকে সরে যায়না। এক পর্যায়ে তাজেনুরের সাথে বাঁধাহীন সম্পর্কের শেষ কাঁটা অসুস্থ লুলাকে কৌশলে বিষপ্রয়োগে হত্যা করে আজু। তাজেনুরের স্বীকারোক্তি মতে আর শেষরক্ষা হয়না আজুর। ভোলার চড়াঞ্চলে এক নিকট আত্মীয়ের বাড়ি থেকে পলাতক আজু সর্দারকেও গ্রেফতার করে পুলিশ।
নিঃস্ব, অসহায় লেচুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার স্বীকৃতি প্রদানে মমতাময়ী জেসমিন তার পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত সম্পত্তির একটি অংশ লেচুকে লিখে দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করায় শুরুহয় নতুন করে আরেক বিপত্তি। লেচুকে নিয়ে রাফিদের মানসিক দ্বন্দ্ব, যেখানে ভিলেনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় কানিজ।
ষড়যন্ত্রের জালে আটকা পড়ে রাফিদের হাতেই জীবনের নির্মম আর করুণ পরিনতি বরণ করতে হয় লেচুর। যা চালিত হয় ছাদের উপর ইলেক্ট্রিক তারে তড়িতাহত হবার করন হিসেবে।
লেচুর আবাসস্থল ছিলো ঘাটের কাছাকাছি রসুলপুর বস্তিতে। তাকে কবরস্থ করা হয় কীর্তনখোলার পূর্বপারে চড়কাউয়ায় ভাঙনোদ্যত পিতা মাজু প্যাদার কবরের কাছে।
লেচুমিয়া অল্পকিছু লেখাপড়া শিখেছিলো হাজী সাহেবের বাড়িতে বসে, সে অক্ষরজ্ঞানটুকু দিয়েই বস্তির ঘরের সামনে আধোহাতে একটি প্লাকার্ডে লিখে রেখেছিলো “লেচু মিয়ার ঘর” নামে। প্লাকার্ডটি জেসমিন সে কবরের উপর পুঁতে রাখেন।
লেখকের কথায়- “জেসমিন রহমান সে প্লাকার্ডটি সংগ্রহ করে রেখেছিলেন, যেটিতে লেচুমিয়া আধোহাতে ছোপা রঙে লিখেছিলো “লেচু মিয়ার ঘর”। প্লাকার্ডটি আজকের এ অত্যুজ্জ্বল বিকেলে সদ্য প্রতিষ্ঠিত সে মাটির ঢিবির উপর যীশুর ক্রুশের মতো দাঁড়িয়ে থেকে সমহিমায় উচ্চারণ করে, এটাই লেচু মিয়ার ঘর, লেচু মিয়ারা এখানেই থাকে।
স্বার্থক নামকরণের নির্মম বাস্তবতার এ প্রতিরূপ অত্যন্ত চমৎকার ও সাবলীল ভংগীতে তুলে ধরেছেন লেখক। মানবিক মূল্যবোধের শৃঙ্খল মুক্তির শপথে এ কাহিনি শুধু বাংলারই নয়, গোটা বিশ্বের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের এক করুণ আহাজারি, আর হরণকারীদের কপালে শক্ত এক চপেটাঘাত।
“গডফাদাররা গডের মতোই নিরাকার।….. খেলা হয় মাঠে। হার-জিত নির্ধারিত হয় ফাইভস্টার হোটেলে বসে। মাঠ হচ্ছে দৃশ্যমান কিন্তু খেলাটা দৃশ্যমান নয়।
এ অদৃশ্য খেলা থেকে মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বিশ্বের সকল লেচু মিয়াদের বাসস্থান ও সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা বিধানে স্বার্থক উপন্যাস হিসেবে “লেচু মিয়ার ঘর” সময়োপযোগী বলে মনেকরি।
- # ড. শংকরপ্রসাদ নস্কর
প্রাক্তন অধ্যাপক ও গবেষক
# প্রকাশক প্রাণকৃষ্ণ মাজি কর্তৃক বিবেকানন্দ বুক সেন্টার, কলেজ স্ট্রীট, কোলকাতা থেকে প্রকাশিত।
প্রচ্ছদঃ সঞ্জয় বেরা।