ভীষ্মের পরাজয়
ইমরান উজ-জামান | ২০১৪-০৯-২৯ ইং
পৌরাণিক গ্রিক সভ্যতার সব চরিত্র যেন একে একে প্রবেশ করছে মঞ্চে। কোরিওগ্রাফি দলকে এ চমত্কারিত্বের জন্য সাধুবাদ দিতেই হয়। রাজকীয় ভীষ্ম যেন চিরকালীন যোদ্ধা, চলনে বলনে তারই প্রকাশ। ভীষ্ম চরিত্রে একেএম শহীদুল্লাহর অভিনয় প্রশংসা করার মতো। নাটকে নাটকীয়তা থাকবে, থাকবে হাস্যরস। মানুষ সাধারণত বিনোদনের প্রধান দিক হিসেবে হাস্যরসকেই গণ্য করে। কারণ এটি মনকে চাঙ্গা করে। কাজেই কঞ্চুকী চরিত্রে সোহেল রানা যেন এ প্রযোজনার ধারক। সারাটা সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে কখন কঞ্চুকী প্রবেশ করবে, তার মুখ থেকে বের হবে দু-একটি কথা, তাতে শব্দ করে হেসে ওঠবে সারা অডিটোরিয়াম। পাতকিনীরূপী তৃপ্তিরানী মণ্ডল তো তার পিশাচ চরিত্র পুরোটাই ধারণ করেছেন। নিবিড় রহমানের পাণ্ডু চরিত্র কখনো মনে হয়েছে চিরন্তন যোদ্ধা আবার কখনোবা অতি মাত্রায় অভিনয়ের কারণে কেমন যেন একটু হাস্যকর চরিত্র মনে হয়েছে। সুবল রাজার চরিত্রে সালাম খোকন বেশ ভালোই নজর কেড়েছেন সবার, আর শকুনি যেন চিরকালীন প্রচ্ছায়ার শকুনি। বিদুরের চরিত্রে আবদুর রাজ্জাক সাবলীল ছিলেন না বলে মনে হয়েছে। ধৃতরাষ্ট্ররূপী জে এম মারুফ সিদ্দীকী, ইরারূপী নাজনীন আক্তার শীলা, গান্ধারীরূপী তনুশ্রী গোস্বামী— সবার সুন্দর অভিনয় মন কেড়েছে দর্শকের।
বলা হয় নাটক জীবনের দর্পণ। সমসাময়িক সমাজ, সময় ও নানা সামাজিক সমস্যা প্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থাপন করাই নাট্যকারের মুন্সিয়ানা। মহাভারতের গল্প অবলম্বন করে মনোজ মিত্র বলে গেছেন, নারীর স্বাধীনতা, কন্যাসন্তানের প্রতি অবজ্ঞা, ধর্মের ঝণ্ডাধারী ভণ্ড সমাজপতি অথবা শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর প্রতি চাপ সৃষ্টি ও মোড়লসুলভ আচরণের প্রতি কটাক্ষ। ভারতের নাট্যকার মনোজ মিত্র তার মুন্সিয়ানার প্রকাশ ঠিকভাবেই প্রয়োগ করতে পেরেছেন এ নাটকে।
ক্ষমতাধর ও ক্ষমতালোভী রাষ্ট্রগুলোর আরো ক্ষমতালিপ্সা, সার্বভৌমত্বের নামে সাম্রাজ্যবাদ, একের পর এক রাষ্ট্র দখল ও লুণ্ঠন; তার সঙ্গে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধর্মীয় লেবাসধারী ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশ ও অযাচিত হস্তক্ষেপে যে দেশ ও সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে বর্তমান সময়কে ধারণ করে লেখা এ নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন মীর বরকত।
স্বনামধন্য আবৃত্তি সংগঠন কণ্ঠশীলনের শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রযোজিত এ নাটক এমন একটা সময় মঞ্চস্থ হলো, যে সময়ে কণ্ঠশীলন নিয়ে চলছে ভীষণ টানাপড়েন। যেন ‘যা নেই ভারতে’র বাস্তব কাহিনী। একপক্ষে মহাশক্তিধর যুদ্ধবাজ জগত্ জয়ের স্বপ্নে বিভোর ভীষ্ম ও অন্যপক্ষে চিরসত্য ন্যায়ের প্রতীক ধৃতরাষ্ট্র। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে কণ্ঠশীলন প্রমাণ করেছে তারাই সত্য, ষড়যন্ত্রকারীরা মিথ্যা। সত্য-মিথ্যার যুদ্ধে ন্যায়ের জয় অনিবার্য, কণ্ঠশীলন ফিরে পাক তার স্বকীয়তা। মিথ্যা চিরকালীন লোকান্তরে নিক্ষিপ্ত হোক। (দৈনিক বনিক বার্তা থেকে গৃহিত)