জহির সিকদার বলেন, গত বছর এই সময়ে পোর্ট রোডে কমপক্ষে এক হাজার মণ ইলিশ এসেছে। আমাদের ধারণা ছিল, এ বছর আগের চেয়ে বেশি আসবে। কিন্তু গত বছরের অর্ধেক ইলিশও আসেনি এবার। সোমবার পোর্ট রোডে ইলিশ এসেছে ২০০ মণ। রবিবার এসেছিল মাত্র দেড়শ মণ। অল্প ইলিশ আসায় দামও বেশি। যে ইলিশ এসেছে তার সাইজও তেমন ভালো নয়। বেশিরভাগ ইলিশের ওজন ৪০০ গ্রামের মধ্যে। কেজি সাইজের ইলিশ এসেছে হাতেগোনা।
তিনি আরও বলেন, এখন যে পরিমাণ ইলিশ আসছে; তাতে ব্যবসা করে কর্মচারী চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আমাদের ধারণা, আবহাওয়ার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারপরও আশা করছি, কিছু দিনের মধ্যে জেলেদের জাল ভরে ইলিশ উঠবে। আবারও সরগরম হয়ে উঠবে ইলিশের মোকাম হিসেবে পরিচিত নগরীর পোর্ট রোড।
মাছ ধরার উপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হতেই আশায় বুক বেঁধে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে জেলেরা ছুটে যান সাগরে ও নদীতে।ভেবেছিলেন নিষেধাজ্ঞা শেষে ইলিশের দেখা মিলবে। কিন্তু ইলিশের ভরা মৌসুমেও উপকূলীয় এলাকার পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী, ভোলা, বরগুনা এলাকার জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না রূপালী ইলিশ। মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর ও বরিশালের মিঠাপানি এরাকায় যে ইলিশ ধরা পরছে তা তুলনামূলকভাবে খুবই কম এবং সাইজে ছোট।তবে মৎস্য বিশেষজ্ঞরা আশাবাদী, শিগগিরই জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়বে।
নিষেধাজ্ঞার পর গত শুক্রবার মধ্যরাত থেকে মাছ ধরা শুরু হয়। কিন্তু নদ-নদী ও সাগরেও দেখা মিলছে না তেমন ইলিশের। সাগরে মোটামুটি ইলিশ পাওয়া গেলেও আগুনমুখা, দারছিড়া ও বুড়াগৌরাঙ্গ নদীতে মাছের হাহাকার।
অন্যদিকে শুক্রবার থেকে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। যার কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর সংকেত দেখিয়ে মাছ ধরার নৌকা-ট্রলারগুলোকে পরবর্তীতে নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি এসে সাবধানে চলাচল করতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
ফলে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে প্রস্তুতি নিয়েও শুক্রবার থেকে সাগরে যাত্রা শুরু করতে পারেনি কোনো কোনো জেলে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রোববার থেকে পুরোদমে জেলেরা সাগরে নামতে শুরু করেছেন।
উপকুলিয় এলাকার রাঙ্গাবালী, চরমোন্তাজ ও কোড়ালিয়া মাছ ঘাট আড়তের মালিকরাও হতাশা প্রকাশ করে জানালেন, সারা দিনে দুই এক ঝুড়ি মাছ ঘাটে আসছে। এতো কম মাছ নিয়ে টিকে থাকাই দায় হবে। সেই সঙ্গে উপজেলার হাট-বাজারগুলোতেও ইলিশের জন্য কোনো হাঁকডাক নেই।
ফলে শুধু পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার ১৩ হাজার ৮৪৭ জন নিবন্ধিত জেলেসহ প্রায় ২০ হাজার জেলে হতাশায় রয়েছেন। একদিকে করোনা সংকট, অন্যদিকে নিষেধাজ্ঞার পর ইলিশ না পাওয়ায় চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বরিশাল বিভাগের প্রায় তিন লাখ জেলে।
মুন্সিগঞ্জ ও চাঁদপুরের জেলেরা পদ্মায় আর বরিশাল বিভাগের জেলেরা বেশিরভাগগ সাগরে ও মেঘনা, আগুনমুখায় মাছ ধরার চেষ্টা করছেন বলে জানাগেছে।
কোড়ালিয়া ও চর মোন্তাজের জেলেদের মাছ শিকারের ঠিকানা মুললত আগুনমুখা, মেঘনা ও বুড়াগৌরাঙ্গ। সারা বছরই কিছু-না-কিছু মাছ মেলে এই নদী থেকে। কিন্তু বর্ষাকালে ইলিশের উপরে নির্ভর করেই তাদের জীবীকা চলে।
কোড়ালিয়ার মাছ ব্যবসায়ী মাহমুদ হাসান বলেন, টানা ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে। জেলেরা সাগরে গেছে। কিন্তু ভরা মৌসুমেও ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ এবার পাচ্ছে না কেউ।
জেলেনেতা খোরশেদ আলম জানান, গত বছরের সঙ্গে এ বছরের কোনও মিল পাওয়া যাচ্ছে না। গত বছর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার পর যে পরিমাণ ইলিশ উঠেছিল, তাতে জেলে ও আড়তদার সবাই খুশি ছিলেন। কিন্তু এ বছর জেলেদের খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে। এজন্য মোকামে ইলিশ নেই।
তার মতে, কিছু দিন ধরে পানি বৃদ্ধির কারণে ইলিশ গভীর পানিতে চলে গেছে। তাই ইলিশ মিলছে না। তবে পানি কমা শুরু হয়েছে। পানি কমে গেলে নদীতেও ইলিশ পাওয়া যাবে।
বরিশালের মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, মূলত চলতি বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হওয়ায় ও নদীতে স্রোত থাকায ইলিশ মাছের তেমন দেখা মেলছে না। একটু সময় দিতে হবে। দুচারদিন গেলেই মাছ ধরা পরবে বলে আশাবাদি তিনি।নিষেধাজ্ঞার পর থেকে উপকূলীয় দুবলার চর, হাতিয়া, মনপুরা, চাঁদপুরে বিপুল পরিমাণ ইলিশ মিলছে। আগামী তিন থেকে চার দিনের মধ্যে নদীতেও ইলিশ মিলবে।
জেলেরাও অনেকে বলছেন, বৃষ্টির পানি কমলেই মাছটা জাগবে। এখান বৃষ্টি হচ্ছে, তাই এখন মাছের দেখা মিলবে। বৃষ্টি যত বেশি হইবে মাছের তত দেখা মিলবে। তবে ভোলাসহ উপকূলীয় কিছু কিছু জায়গায় ছোট সাইজের ইলিশ মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। দেড়িতে হলেও মাছ হবে এমনটা আশা জেলেদের।
এ ব্যাপারে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, অ্যাকোয়াকালচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশ মাছের মৌসুম পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। সে কারণেই এই ভরা মৌসুমেও ইলিশ ধরা পড়ছে না।
তার মতে, বিষয়টি চিন্তার হলেও এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। জেলেদের জালে যে একদমই মাছ ধরা পড়ছে না তা কিন্তু নয়। ইলিশ ধরা পড়ছে তবে পরিমাণে কম। একই সঙ্গে ছোট সাইজের।(কৃতজ্ঞতা বাংলা ট্রিবিউন ও দৈনিক যুগন্তর)