ব্রতচারী আন্দোলনের গুরুসদয়
সনজীদা খাতুন
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় শেষদিকে (১০মে ১৮৮২) সিলেটের বীরশ্রী গ্রামে তাঁর জন্ম। বালক বয়স থেকেই ছিলেন দুরন্ত, নির্ভীক, আর একই সঙ্গে হৃদয়বান। বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর বালকই ছিল তাঁর খেলার সাথী। সংস্কারের বেড়াজালে বদ্ধ সে-কালের সমাজে এ আচরণ গ্রহণীয় ছিল না। বড় হয়েও কি-নমশূদ্র, কি-মুসলমান সকলের প্রতি তাঁর সৌহার্দ্য অবিচল ছিল। অল্প বয়সে কুস্তি, হা-ডুডু, গাছে-চড়া, সাঁতার-কাটায় সকলেই ছিল তাঁর সহচর। জেলেদের জীবনে তাঁর প্রবল আকর্ষণ ছিল। একা একা বুনো ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছুটে বেড়াতে ভালোবাসতেন তিনি। এই দুর্দান্ত বালক কালে কালে চমৎকার সুগঠিত দেহের অধিকারী হন। এই হচ্ছেন গুরুসদয় দত্ত।
তো, খেলাধূলা আর বনেবাদাড়ে দাপিয়ে বেড়ানোর ঝোঁকে ঘটে গেল এক বিপত্তি। পঞ্চম শ্রেণীর অঙ্ক পরীক্ষায় পেলেন শূন্য। একই কাসে থেকে যাবার অপমান সহ্য করা কঠিন। বুনো ঘোড়া বশ করবার জেদ নিয়ে গণিতবিদ্যাকে এমনই কবজা করলেন যে, শুরু হল অঙ্কে প্রথম হবার পালা। জীবনসংগ্রামে জয়ী হবার এই শিক্ষা পাবার ফলে, আর হোঁচট খেতে হয়নি। মেধাবী ছাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার বাধা রইল না আর।
বাধা এল, স্কুল শেষ হবার আগেই একে একে পিতা মাতার মৃত্যুর ফলে। সংগ্রামী কিশোর সে-সব আঘাত উত্তীর্ণ হয়ে লেখাপড়ায় একাগ্র হলেন। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়ে সিলেটের জন্যে গৌরব বয়ে আনলেন। আনন্দিত সিলেটবাসী বললেন এফ.এ. পরীক্ষায় প্রথম হতে পারলে এ ছাত্রকে তাঁরা বিলেতে পড়তে পাঠাবেন। জয়ী হবার প্রতিজ্ঞা যাঁর অন্তরে, তাঁকে প্রথম হতে হবে বৈকি।
তবে সে আমলে বিলেত যাওয়া কি সহজ কথা! কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সমাজ রয়েছে না! সমুদ্র পাড়ি দিলে প্রায়শ্চিত্ত করবার বিধান আছে শাস্ত্রে। পিতা নেই, আছেন কড়া সমাজপতি জ্যাঠামশাই। স্নেহশীল হেডমাস্টার তারকচন্দ্র রায় প্রিয় ছাত্রের ভবিষ্যৎ উন্নতিতে সহায়তা করবার জন্যে আগ্রহী হলেও, তাঁর নিজের মনেও কি নেই কুসংস্কার? সব সত্ত্বেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে সতর্ক কৌশলে অগ্রসর হয়ে শেষ পর্যন্ত জ্যাঠামশাইয়ের সম্মতি আদায় করতে পারলেন। অবশ্য গুরুসদয়কে বিদেশে বিচরণের বিষয়ে নানা শর্ত দিয়ে দিলেন তারকচন্দ্র স্বয়ং।
১৯০৩ সালে বিদেশে গিয়ে দুই বছরে আই.সি.এস. পরীক্ষা পাশ করলেন গুরুসদয়। আইন বিষয়েও প্রথম হয়ে পাশ করলেন সেই সঙ্গে। দেশে ফিরে আই.সি.এস. গুরুসদয় ব্রিটিশ সরকারের জেলা প্রশাসক হিসেবে চাকরি পেলেন। যখন যে-জেলায় দায়িত্বে থেকেছেন সে-জেলার লোকশিল্প আর সংস্কৃতির সন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েছেন। চিত্রিত মৃৎপাত্র, মাটির পুতুল, নকশি কাঁথা, পটচিত্র, শিল্পিত হাতপাখা, কাজললতা, বালিশ-ঢাকা, বিনুনি বাঁধবার দড়ি ইত্যাদি অসংখ্যা লোকশিল্পের নিদর্শন সংগ্রহ করেছিলেন গুরুসদয়। ভাস্কর্য নিদর্শন, কারুকাজ করা দরজা, খনন করে বার করা প্রাচীন মূর্তি ইত্যাদি অনেক ঐতিহ্য স্মারক জোকা ব্রতচারী গ্রামের সংগ্রহশালায় সযতেœ রাখা আছে। দেশের অতীতকে জানবার প্রবল আগ্রহে তিনি বহু গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
১৯০৬ সালে সরোজনলিনী দেবীর সঙ্গে গুরুসদয়ের বিয়ে হয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্ত্রী কাদম্বরীকে ঘোড়ায় চড়িয়ে দু’জনে মিলে বেড়াতে যেতেন, জানি আমরা। গুরুসদয় আর সরোজনলিনীও ঘোড়ায় চড়ে গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেড়াতেন। পাখি, হরিণ, নীল গাই, এমন কি বাঘ শিকারেও স্বামীর সঙ্গী হতেন সরোজনলিনী। গুরুসদয়ের আদর্শে পল্লীমঙ্গল আর মেয়েদের নানাবিধ উন্নয়নে সাগ্রহে যুক্ত হয়েছিলেন তাঁর সুযোগ্য স্ত্রী। এমন সহধর্মিণীর অকাল প্রয়াণে গুরুসদয় অতি গভীর দুঃখ পেয়েছিলেন। ‘সরোজনলিনী নারীমঙ্গল সমিতি’ গঠন করে তাঁর কাজের ধারাটি সচল রেখেছিলেন গুণগ্রাহী স্বামী গুরুসদয় দত্ত।
চাকুরী জীবনে স্বাধীনচেতা মানুষকে নানা দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। পরাধীন দেশে বিড়ম্বনার তো কোনো শেষ নেই আবার! সরকারী আদেশ বা ইঙ্গিত নয়, নিজ বিবেকের নির্দেশেই সবসময় চলেছেন গুরুসদয়। হাওড়া জেলার লিলুয়াতে কারখানা শ্রমিকদের উপরে পুলিশের অতর্কিত গুলি চালনার বিচারের দায়িত্ব ছিল গুরুসদয়ের উপরে। শ্রমিক সমাবেশে কোনোরকম হুঁশিয়ারি না দিয়ে বিনা প্ররোচনায় গুলি চালনার আদেশ দেবার জন্য ইংরেজ পুলিশ কর্মকর্তাকেই দায়ী করেন তিনি। আবার ময়মনসিংহে চাকুরি করবার সময়ে, গান্ধীজীর লবণ আন্দোলনে যোগদানকারীদের কঠোর হাতে দমন করবার নির্দেশ এলেও গুরুসদয় তাতে কর্ণপাত করেননি। ফলে শাস্তিস্বরূপ তাঁকে বদলি করা হয়।
পরাধীন দেশে সরকারি চাকুরি করেও, বাঙালির দৈহিক-মানসিক গঠন এবং নৈতিক বোধ উন্নয়নের ভাবনা থেকে গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত প্রাসঙ্গিক নৃত্যগীত অবলম্বন করে গুরুসদয় দত্ত ব্রতচারী আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। পল্লীর নৃত্যভঙ্গিমায় পল্লী সুরে গান বেঁধে দেশীয় রীতিতে ব্রতচারী নৃত্যগীত তৈরি করেছেন তিনি। বাঙালিকে যথার্থ মানুষ করে তুলবার এই সাধনা অনন্য। সরকারি চাকরির দরুন নিজেকে আড়ালে রাখবার জন্যে ব্রতচারী কর্মকা-ের দায়িত্ব অর্পণ করেন তাঁর অনুগত ‘আলাজী’ (নবনীধর বন্দ্যোপাধ্যায়)- এর উপরে। ১৯৩২ সালে গুরুসদয় নিজের প্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় পল্লীসম্পদ রক্ষা সমিতি’র লোকনৃত্য শিক্ষাশিবিরে ব্রতচারী দল প্রতিষ্ঠার কথা প্রকাশ করেন।
গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারণের শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হবার শিক্ষা। আজকের দিনে এর চর্চা বৃটিশ আমলের স্বাধীনতা আন্দোলনের চেয়ে অনেক বেশি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আত্মোন্নতির কিছুমাত্র চেষ্টা না করে অন্যায় পথে অপরকে লুণ্ঠন করে বিত্ত সংগ্রহ করবার সন্ত্রাসী তৎপরতার নীতিহীন চর্চা থেকে মুক্ত হবার জন্যে আজ গুরুসদয়ের প্রবর্তিত ব্রতচর্যা জরুরি।
‘ব্রত’ শব্দের অর্থ তপস্যা ও সংযমের সংকল্প। বিশেষ ব্রত নিয়ে যারা চলে, তারাই ব্রতচারী। ব্রতচারীকে প্রথমেই পাঁচটি ব্রতে আস্থা আনতে হয়। জ্ঞান, শ্রম, সত্য, ঐক্য আর আনন্দ হচ্ছে এই পঞ্চব্রত। জীবনের পথে জ্ঞান অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধা ও কায়িক শ্রমের প্রয়োজন উপলব্ধি করেছেন গুরুসদয়। সত্যনিষ্ঠা সমাজ-জাতি-দেশ এবং সর্বমানবের কল্যাণের সহায়ক। ‘ঐক্য’ প্রসঙ্গে প্রচলিত বচনই রয়েছে ‘একতাই বল’, বলা আছে ‘দশে মিলি করি কাজ / হারি জিতি নাহি লাজ’। শেষ ব্রত ‘আনন্দ’ কঠিন সাধনাকে সহজ আর সুবহ করে। একালে এসব খুব ফাঁকা-কথা মনে হতে পারে। কেননা মূল্যবোধ বিপর্যস্ত হয়ে সমাজের মানুষ আজ বেপথু। কিন্তু দেশ-কাল-সমাজের স্বস্থ হবার উপায় ব্রতচারী চর্চা।
সমাজ সেবাব্রতী গুরুসদয় দত্ত প্রণীত বিধিমালা ব্রতচারীকে দেশপ্রেম, ঐতিহ্যপ্রীতি, শিষ্টাচার ও সামাজিক আচরণ, যেমন: বাক্সংযম, স্বরসংযম, ভাষাব্যবহারের আদর্শ (খিচুড়ি ভাষায় বলিব না) শিক্ষা দেয়। ব্রতচারীর জন্যে আরো আছে – রাগ-ভয়-ঈর্ষা-লজ্জা-ঘৃণা বর্জনের নির্দেশ। পরস্পর দেখা হলে হাত তুলে ‘জয় সোনার বাঙলা’ (জসোবা) সম্ভাষণ আজ আমাদের সবাইকে বাঙালিত্বে প্রতিষ্ঠিত করে বাংলাকে সর্বজয়ী করবার আকাক্সক্ষায় উদ্দীপ্ত করবে।
ব্রতচারী কেবল নৃত্যগীতের চর্চা করে না, শ্রমসাধ্য কাজে যুক্ত হয়ে সমাজসেবাতেও নিয়োজিত হয়। গুরুসদয় বলেছেন:
‘পরহিতে কিছু শ্রম নিত্য
ব্রতচারীর অবশ্য-কৃত্য’।
এ সকল কর্ম শরীর-মনকে সংগঠিত করে, পরিণামে দেশের সমৃদ্ধিসাধনের লক্ষ্যে পরিচালিত করে ব্রতচারীকে। কারণ, ব্রতচারীর শিক্ষা নিত্য-সমৃদ্ধ হবার শপথ:
‘যতদিন বাঁচব ততদিন বাড়ব
রোজ কিছু শিখব রোজ দোষ ছাড়ব
যাহা কিছু করব ভালো করে করব
কাজ যদি কাঁচা হয় শরমেতে মরব’।
শ্রমজীবী মানুষেরাই গায়ে খেটে দেশকে বাঁচিয়ে রাখে, একথা ব্রতচারীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন গুরুসদয়:
‘যদি তার নই বা সরে মুখের ভাষা-
ছোটলোক নয় রে চাষা!
চাষীর জোরে শক্তি জাতির-
চাষের মূলে দেশের আশা ॥’
সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ঐক্য আর সম্প্রীতিচর্চার আহ্বানও রয়েছে ব্রতচারী গানে:
‘রাম রহিমের বিবাদ রচে রহিসনে অজ্ঞান-
যেই ভগবান সেই যে খোদা
নাই রে ব্যবধান-
শুধুই নামের ব্যবধান।’
ঐতিহ্য খুঁড়ে গুরুসদয় দত্ত দেখিয়ে দিয়েছিলেন, বাঙালি বাস্তবিক পক্ষে বীরের জাতি। বীরভূমের গ্রাম থেকে প্রাচীন বাঙালি যোদ্ধাদের রায়বেঁশে নাচ তুলে এনে ব্রতচারীদের শিখিয়েছিলেন তিনি। সেকালে যুদ্ধজয়ের পরে বীরত্বব্যঞ্জক এই আনন্দনৃত্যের ভিতরে আছে বাঙালির শৌর্যের সংবাদ।
গুরুসদয় দত্তের লোকঐতিহ্যের সন্ধান বাঙালি জাতিকে আত্ম-আবিষ্কারের পথে চালিত করে। স্বাধীনচেতা এই বাঙালি পরাধীনতার অপমান-অবমাননা দূরে ঠেলে জাতিকে আত্মশক্তিতে দৃপ্ত হবার ডাক দিয়ে গেছেন। তাঁর জন্মের ১২৯ বছর পরেও গুরুসদয়ের কথার প্রাসঙ্গিকতা অনুধাবন করে ব্রতগ্রহণ করতে হবে আমাদের যুবসমাজকে। নচেৎ স্বাধীনতার মায়াহরিণ বিচিত্র রূপ ধরে বার বার পরাধীনতার জালে জড়িয়ে ধরবে আমাদের।
গুরুসদয় দত্তের মুক্তির মন্ত্র দেশের নতুন প্রজন্মের কানে প্রবেশ করুক, তারা মনে প্রাণে স্বাধীন চিত্তের সাধনায় প্রবৃত্ত হোক। ব্রতচারণ শুরু হোক দেশের সর্বত্র।
শিল্পকলা একাডেমিতে ৪ দিনব্যাপী ব্রতচারী প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধন
গুরুসদয় দত্তের স্মরণে ‘ব্রতচারী’ কেন্দ্রীয় শাখা ১৭ই জুন থেকে ২০শে জুন পর্যন্ত ৪ দিনব্যাপী ব্রতচারী কর্মশালার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকায়। ৪ দিনব্যাপী ব্রতচারী প্রশিক্ষণ কর্মশালা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহায়তায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কর্মশালার শেষদিন অর্থাৎ ২০শে জুন শুক্রবার বিকাল ৫টায় কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী সকলকে নিয়ে ব্রতচারী অভিপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালার প্লাজায়। আলোচনা, অভিপ্রদর্শনী ও প্রশিক্ষণার্থীদের সনদ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট এর বিশ্বসভাপতি রামেন্দু মজুমদার।
গুরুসদয় দত্ত জ্ঞান শ্রম সত্য ঐক্য আনন্দ এই পঞ্চব্রতকে জীবনের মূলচাবিকাঠি মনে করে প্রকৃত মানুষ গড়ার যে প্রচেষ্টা নেন তাই হল ব্রতচারী আন্দোলন। এছাড়াও বাঙালির লোক ঐতিহ্য সংরণ এবং লোকনৃত্যগীতের চর্চার জন্য ব্রতচারী আন্দোলন শুরু করেছিলেন।
‘ব্রত’ শব্দের অর্থ তপস্যা ও সংযমের সংকল্প। বিশেষ ব্রত নিয়ে যারা চলে, তারাই ব্রতচারী। ব্রতচারীকে প্রথমেই পাঁচটি ব্রতে আস্থা আনতে হয়। জ্ঞান, শ্রম, সত্য, ঐক্য আর আনন্দ হচ্ছে এই পঞ্চব্রত। জীবনের পথে জ্ঞান অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধা ও কায়িক শ্রমের প্রয়োজন উপলব্ধি করেছেন গুরুসদয়। সত্যনিষ্ঠা সমাজ-জাতি-দেশ এবং সর্বমানবের কল্যাণের সহায়ক। ‘ঐক্য’ প্রসঙ্গে প্রচলিত বচনই রয়েছে ‘একতাই বল’, বলা আছে ‘দশে মিলি করি কাজ / হারি জিতি নাহি লাজ’। শেষ ব্রত ‘আনন্দ’ কঠিন সাধনাকে সহজ আর সুবহ করে। একালে এসব খুব ফাঁকা-কথা মনে হতে পারে। কেননা মূল্যবোধ বিপর্যস্ত হয়ে সমাজের মানুষ আজ বেপথু। কিন্তু দেশ-কাল-সমাজের স্বস্থ হবার উপায় ব্রতচারী চর্চা।
সমাজ সেবাব্রতী গুরুসদয় দত্ত প্রণীত বিধিমালা ব্রতচারীকে দেশপ্রেম, ঐতিহ্যপ্রীতি, শিষ্টাচার ও সামাজিক আচরণ, যেমন: বাক্সংযম, স্বরসংযম, ভাষাব্যবহারের আদর্শ (খিচুড়ি ভাষায় বলিব না) শিক্ষা দেয়। ব্রতচারীর জন্যে আরো আছে – রাগ-ভয়-ঈর্ষা-লজ্জা-ঘৃণা বর্জনের নির্দেশ। পরস্পর দেখা হলে হাত তুলে ‘জয় সোনার বাঙলা’ (জসোবা) সম্ভাষণ আজ আমাদের সবাইকে বাঙালিত্বে প্রতিষ্ঠিত করে বাংলাকে সর্বজয়ী করবার আকাক্সক্ষায় উদ্দীপ্ত করবে।
ব্রিটিশ সরকারের প্রশাসক হয়েও সিলেটের এই তেজস্বী সন্তান আপন বিবেকের বিরুদ্ধে কখনো কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। হুগলির কারখানা শ্রমিকদের উপরে ইংরেজের গুলিচালনার বিচারকালে তিনি উদ্ধত ইংরেজ কর্মকর্তাকেই দোষী সাব্যস্ত করেন। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ঘুরে লোকশিল্পের বিবিধ নিদর্শন সংগ্রহ করবার সঙ্গে সঙ্গে লোকগান এবং নৃত্য আয়ত্ত করেন গুরুসদয় দত্ত। স্বদেশের প্রতি ঐকান্তিক অনুরাগের দরুন বাঙালির জন্য ব্রতচারী নৃত্যগীত চালু করে তিনি জ্ঞানের সাধক শ্রমশীল সত্যপ্রিয় একতাবদ্ধ আনন্দময় জাতি হিসেবে বাঙালিকে সংগঠিত করবার চেষ্টা করেন।