বাংলাদেশের গল্প পর্যালোচনা : করতলে যা দেখি
[আত্মপক্ষ সমর্থন : প্রায় বছর দুয়েক আগে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের কথাসাহিত্য বিষয়ক এক আলোচনাসভায় একটি লেখা পড়েছিলাম। তারপর আর এ নিয়ে বলার মতো তেমন কিছু জমেনি। ফলে, এই লেখাটিতে নতুন করে তেমন কিছু বলা হল না, কিন্তু সে লেখা থেকে এই লেখা একেবারেই পৃথক। এই পৃথক করতে যেয়ে লেখাটি কোনও ভাবেই সম্পূর্ণ হল না। পুনরাবৃত্তি এড়াতে এই চেষ্টা। সেই লেখাটা প্রকাশিত হয়নি। হয়তো, এই দুটো লেখা মিলিয়ে নিলে এক প্রকার সম্পন্নতা পায়। ফলে, এখানে উহ্য থাকল সেখানের কিছু কথা। পরে কোনও সুযোগে দুটো লেখা মিলিয়ে একটি পূূর্ণ গড়ন দেয়া যাবে। আর, প্রয়োজনীয় কোনও তথ্যের ছাড় ও কোনও উল্লেখযোগ্য নাম অনুল্লেখ্য থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী।]
আলগোছে এমন কথা কোনও কোনও বন্ধুজনের মুখে শোনা যায়, আমরা সবাই একটি গল্পই লিখছি, যে-গল্পটি লিখতে শুরু করেছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্! যদিও এইসমস্ত কথায় তো কোনও দায় থাকে না। দায় নিতে হয় না। সরল চোখে হোক, পাঠক বা উত্তরকালের লেখকের সজ্ঞান বিচারকে সামনে রেখেই হোক, এই সত্য আমাদের তো মেনে নিতেই হয় যে, বাঙালির ভূখ–ভাগের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরে, তার সাহিত্যের ইতিহাসও হয়ে-গেছে দুইভাগের। যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও বুদ্ধদেব বসু এমন ভাগাভাগির আগেই প্রতিষ্ঠিত লেখক এবং পৈতৃক ভিটার অর্থে আজকের বাংলদেশেই তাঁদের জীবনের ও শিল্পের এক বিরাট অংশ এঁটে রয়েছে, তাঁরা নগর কলকাতায় জীবনযাপন ও সেখানেই পরবর্তী জীবনকে কাটিয়ে দেয়ার কারণে হয়ে যান পশ্চিমবাংলার তথা ভারতীয় লেখক। এমনকি এই হিসাবের বাইরে দিয়ে যান না প্রায় সারাটি জীবন নিম মফস্বল রবিশালে কাটিয়ে দেয়া জীবনানন্দও। অথচ, আমাদের এই হিসাবে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও আহসান হাবীরের প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে; সেখানেই, সেই তরুণ্যে তাঁরা লেখক হিসাবে মোটমুটি একটা ভালো পিঁড়ি পেয়ে গিয়েছিলেন। তবু রাষ্ট্রীয় বিভাজন তাঁদের ঠেলে দিল বাংলার পূর্বভাগে, তাঁরা প্রথমে পরাধীন পূর্ব পাকিস্তানের, আর তেইশ বছর পরে স্বাধীন বাংলাদেশের লেখক। যদিও স্বাধীন বাংলাদেশে দেখা হয়নি ওয়ালীউল্লাহ্র।
তাই বুঝি আমরা বলি, কখনও কখনও এ কথাও বলি, একে অন্যকে শুধাই নিজেদের জিজ্ঞাসাকে উসকে দেয়ার জন্যে : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র পরে ‘আমাদের’ প্রধান গদ্য লেখক কে? এই ‘আমাদের’-এ আমরা যে-হিসাব রাখি তাতে কিন্তু বাংলা সাহিত্যের রাষ্ট্রীক বিভাজন মেনেই আমাদের। এই ‘আমাদের’-এর ভিতরে রবীন্দ্রনাথ যেমন থাকেন না, একইভাবে থাকেন না মীর মশাররফ হোসেনও। (এর কারণ মোটামুটি এমন, তাঁরা এই অসম বিভাজন ঘটে যাওয়ার আগেই ভবলীলা সাঙ্গ করেছেন!) ফলে, বিভাজনকে মেনে নিয়ে যখন আমাদের নিজের কাছে নিজেরদের এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হতে হয়, তখন কিন্তু আমাদের প্রধানত গদ্যের ক্ষেত্রে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শওকত ওসমান, আবু ইসহাক বা তারও আগের মাহবুব-উল-আলমের কথা মনে রাখি। যেভাবে আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, আবুল হোসেনকে মনে রেখে আমাদের কাব্য আলোচনা শুরু করতে হয়। কিন্তু তাতে কি কোনও প্রকারে হিসাবে সুবিধা হয়, না, নিজ-রাষ্ট্রীয়তার আবহে একটা সাহিত্যিক ধারণা তৈরি করে নেয়া যায়? তাতে কি বাংলা গদ্য বাংলা কবিতা কোনও অর্থে একটু দূরে সরে যায় মূলধারা থেকে? এই সমস্ত বিষয়াদি মাথায় রেখে, আমাদের এগুতে হয় নিজভূখ-ের সাহিত্যিক বাতবরণ তৈরি করতে।
২
এ-কথা সত্য ‘দেশবিভাগোত্তর কালে’ সেই পরাধীন পাকিস্তানে পাকিস্তান রাষ্ট্র-পাওয়ার উন্মাদনায় এই দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের তো বটেই উচ্চবিত্তের একটি অংশের আবেগের আর সেই আবেগের গদগদানির কোনও অন্ত ছিল না। তারা দেশ মাটি মানুষ আর সংস্কৃতিকে ভুলে গিয়ে স্বাধীন পাকিস্তান আর সেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রপিতা-রাষ্ট্রনেতার নামে যে-পরিমাণে সাহিত্যিক উন্মাদনাকে ব্যয় করেছেন, তাতে যেমন মননশীলতার কোনও মাত্রা ছিল না, সেইসঙ্গে ছিল না রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি কোনও সজ্ঞানতার প্রকাশ। ফলে, একদিকে পাকিস্তান প্রাপ্তির উন্মাদনা, অন্যদিকে স্বাধীন পাকিস্তানে স্বাধীন-সাহিত্য করার নামে একদার বটতলার উপন্যাসের বানোয়াট কেচ্ছাকেই গদ্য রূপ দিয়ে তাকে উপন্যাস বলে চালানোর হাস্যকর নিদর্শন আজও আমদের সামনে আছে, আছে কবিতা হিসাবে অকবিতার প্রচুর প্রচুর নিদর্শন। এমনকি মহান ভাষা আন্দোলনের অগ্নি আর উত্তাপে যে সেই সমস্ত ধারা খুব একটা ভেঙে পড়েনি কিন্তু আর অন্যদিকে এঁটেও উঠতে পারেনি তা সাহিত্যের ইতিহাসের যে-কোনো বই একটু খুলে দেখে নিলেই বোঝা যায়। ভাষা আন্দোলন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে বাংলা সাহিত্যে যে-জোয়ারের সৃষ্টি করেছিল, তার প্রণোদনা যে আজও বহমান আর তার ধারবাহিকতার ভার তো আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে এই রাষ্ট্রের বয়সের সমান সমান দিন, অনাদি অনন্তকাল।
কিন্তু ওই সময়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ই ছিলেন বাংলা গদ্যের প্রধান কা-ারি। সঙ্গে শওকত ওসমান ও আবু ইসহাক। পাকিস্তান প্রাপ্তির জোয়ারে তাঁরা যেমন যেমন গা-ভাসাননি সেদিনের পাকিস্তানবাদি সাহিত্যের জোয়ারে এবং একই সঙ্গে সেই জোয়ারের তোড়ে-ভাসা গল্প-উপন্যাস লিখে সাহিত্যের জমি ভরাননি। তাঁর লালসালুকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিতের সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে ওই উপন্যাসের দূরদর্শিতার নিশানাকে আরও গভীরভাবে দেখা যায়। (সালু কাপড়ের তলে ঢাকা ‘স্বাধীন পাকিস্তান’ বাঙালির পায়ের আঘাতে চূর্ণ হতে মহাকালের হিসাবে বেশি দিন লাগল না!) সেই সঙ্গে তাঁর হাতেই লেখা হয়েছে গল্প বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী জায়গায় দাবিদার বেশকিছু গল্প। এই হাতকে চিরকাল সশ্রদ্ধ কুর্ণিশ জানাতে হবে যে-কোনও নবাগতকে। কিংবা, আবু ইসহাকের সূর্য-দীঘল বাড়ীর প্রামাণ্যতা আজও প্রাসঙ্গিক, এবং বহুদিন পর্যন্ত গ্রামীণ পটভূমি মানুষের ক্ষুধা ও সংস্কারের উপন্যাস হয়ে থাকবে এটি; সেই সঙ্গে শওকত ওসমানের জননী এবং এর পরের ক্রীতদাসের হাসি গুরুত্বপূর্ণ লেখা হিসেবে স্বীকৃত। হয়তো শুরুর নির্দশন হিসাবে এই তিনজনের লেখার গুরুত্ব, এবং এর পার্শ্বরচনা হিসাবে আরও কয়েকজন গদ্য লেখকের নাম আমাদের সামনে থাকে। তাদের প্রত্যেকের সৃষ্টি-প্রয়াস নিয়েই আমাদের দেশভাগ-পরবর্তী সাহিত্যের চলমানতা।
৩
দেশভাগ সঙ্গে তার পরে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা, সমস্ত কিছু মিলে ‘স্বাধীন পাকিস্তান’-এ যে-অচলায়তনের সৃষ্টি হয়েছিল তাকে ছাপিয়ে নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি হয়ে ভাষা আন্দোলনের ফলে। যদিও পঞ্চাশের তরুণেরাই ছিলেন মূলত ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী, কিন্তু এই আন্দোলনের অন্তর্গত সুবাতাসের সবচেয়ে জোরাল উপস্থিতি ষাটের সাহিত্য। একই সঙ্গে পঞ্চাশের তরুণেরা তার সঙ্গে যোগ দেন এবং এই ষাটদশকেই আমাদের সাহিত্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলতর-তম লেখকদের সমাগম ঘটেছে।
পঞ্চাশের গদ্যকারদের ভিতরে রশীদ করীম, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী প্রমুখের ভিতরে সৈয়দ শামসুল হক ও শওকত আলী শুরু থেকে আজও পর্যন্ত সমান সৃষ্টিশীল। সৈয়দ হকের বিপুল গদ্যভা-ার থেকে অবিস্মরণীয়ভাবে যে কোনও তরুণের মনে থাকে ‘তাস’, ‘মানুষ’, ‘নেপেন দারোগার দায়ভার’, ‘কবি’ কিংবা, ‘ভালো করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে’র মতো গল্প। আর লোকপ্রিয় খেলারাম খেলে যার মাত্রাকে মনে রেখে কোনওভাবেই আরও ভোলা যায় না, সীমানা পেরিয়ে, এক মহিলার ছবি, অনুপম দিন, জনক ও কালো কফির গদ্যের সেই গীতিময় চলন। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস হিসাবে চিহ্নিত নিষিদ্ধ লোবান বা নীল দংশন-এ তার ক্ষমতা চিহ্নিত হয়ে যায়। আলাউদ্দিন আল আজাদ কিংবা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীÑ একজন স্বদেশেই প্রবাসী অন্যজন সত্যিকার অর্থে প্রবাসী হয়ে, দুইজনই সৃষ্টিশীল লেখক হিসেবে দূরত্বে জায়গা করে নিয়েছেন। ফলে, যে-সম্ভবনায় আলাউদ্দিন আল আজাদ ‘ছাতা’র মতো গল্প দিয়ে শুরু করেছিলেন, কিংবা তার তেইশ নম্বর তৈলচিত্রর গুরুত্ব আজ ফিকে হয়ে গেছে; এমনকি গফ্ফার চৌধুরী হরহপ্তায় কলামে উপস্থিত থেকেও আমাদের মনে ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’ গল্পের আর চন্দ্রদ্বীপের উপখ্যান-এর লেখকের উপস্থিতি জাহির করে কিন্তু ওই আলোচনা উহ্যই রয়ে যায় তাঁর দীর্ঘদিন কথা সাহিত্যে অনুপস্থির কারণে। শওকত আলী তাঁর ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস প্রদোষে প্রাকৃতজনসহ ওয়ারিশ, দলিল ইত্যাদি উপন্যাসসহ গল্পে তরুণমানসে নতুন প্রভাববিস্তার করে থাকেন।
৪
কিন্তু যে-ষাটের দশকে আমার সবচেয়ে সৃষ্টিশীল গদ্যলেখকদের উপস্থিতি বাংলাদেশের সাহিত্যাকাশে। সেই ষাটের দশকের লেখকদেরই উপস্থিতির সঙ্গে হারিয়ে যাওয়াও যেন বেশি। এই ষাটের সাহিত্যের নতুন জোয়ার কিন্তু একই সঙ্গে বলে দেয় যে, বাংলাদেশ নামের একটি রাষ্ট্রর সৃষ্টি হতে পারে। আজ তো সরল চোখে বলাই যায় ষাটের তাবৎ তরুণ-তরুণীরাই ভাগীদার স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রধান ভূমিকায়। ফলে, তাদের সাহিত্যে নতুন সাহিত্য ইত্যাদি করতে হবে ব্যাপারগুলো যেমন ছিল সেই সঙ্গে ছিল নিজস্ব সার্বভৌমভাবে ভেবে-নেয়ার সেই তাগিদ বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোগত কোনও প্রকারের সংযোগ নেই, যতটুকু আছে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে এর সংযোগ। ফলে, তাদের সেই প্রচেষ্টায়, গদ্যে হাসান আজিজুল হক, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, মাহমুদুল হক, রাহাত খান, হাসনাত আবদুল হাই, রিজিয়া রহমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আবদুল মান্নান সৈয়দ, কায়েস আহমেদ, সেলিনা হোসেন বা অকালপ্রয়াত শহীদুর রহমানের নাম মনে থাকে। আবার, শহীদ কাদরী, সিকদার আমিনুল হক, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, মোহম্মদ রফিক, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আলতাফ হোসেন, আবুল হাসান, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ুন কবির, ফরহাদ মজহার, মুহম্মদ নূরুল হুদাসহ এই ক্রমে ক্ষীণশক্তির যে-সব কবির নাম আজও আমাদের সামনে ঘুরেফিরে আসে, আসে শুধু লেখকতার কারণেই নয়, সাংগঠনিক ক্ষমতাকেও বিবেচনায় রেখে সবমিলে ষাটের দশকের লেখকদের সামগ্রিক তৎপরতা আমাদের কাছে বিভিন্নভাবেই ধরা দেয়।
তাই হয়তো ঘুরে ফিরে আসে প্রভাবে বা স্মরণে হাসান আজিজুল হকের ‘শকুন’, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘আমৃত্যু আজীবন’, ‘পাতালে হাসপাতালে’সহ তাঁর পাঁচ দশকব্যাপী সাহিত্যচর্চায় আরও বহু বহু গল্পের নাম, এমনকি হাসান আজিজুল হকের বাইশ বছর বয়সের রচনা বৃত্তায়ণ-এর মতো মিতায়তন উপন্যাসের কলম হাসান আজিজুল হক হয়তো আজ আর ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। আর বহু প্রতীক্ষার পরে প্রকাশিত উপন্যাস আগুনপাখির অসাধারণত্ব তাঁর কাছে আর নতুন উপন্যাসের প্রত্যাশাকে জিইয়ে রাখে। আজও পর্যন্ত হাসান আজিজুল হকের গল্প তরুণতম লেখকের কাছে লেখকতার প্রথম পাঠ হিসাবে মান্য হয়ে থাকে, বাংলা গদ্যে তাঁর অনায়াস চলন বিস্ময়কে বাড়িতে তোলে।
ওদিকে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত বহে না সুবাতাস, শীতাংসু তোর সমস্ত কথায় যে সাফল্য ও সম্ভাবনার ইঙ্গিত রেখেছিলেন তা আর ফিরিয়ে আনতে পারলেন না কোনওভাবেই। ফলে, গদ্যের যে-সিধে চলনে ‘পুনরুদ্ধার’-এর মতো গল্পকে আমাদের বারবার ঘুরে ফিরে পড়তে হয় তা আর না-পাওয়া গেলে। হয়তো পরবর্তীকালে সাহিত্য তাঁর নিয়মিত না-হওয়াই এর কারণ। মাহমুদুল হকের হাতেই সবচেয়ে সহজে উঠে আসত উপন্যাস। জীবন আমার বোন, যেখানে খঞ্জনা পাখি, কালো বরফ তো ঔপন্যাসিক সাফল্যের নিদর্শন। বাংলা গদ্যকে হাতের তালুতে রেখে এমন ব্যবহারের ভার তো খুব কম গদ্যলেখকের ভিতরেই লক্ষ্য করা গেছে। ‘কালো মাফলার’, ‘অচল সিকি’, আর ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’ও তাঁর ছোটগল্পলেখক হিসাবে সেই বয়ে না-বেড়ানোর ভারকেই মনে করিয়ে দেয়; আমাদের বেড়ে-ওঠায় তাঁর রচনার সমস্ত গুণ বারবার স্মরণে আনতে হয় বহুকারণেই। বহুবার ঘুরে ফিরে আসে ষাটের আরও অনেকের সঙ্গে আবদুল মান্নান সৈয়দের নাম। গল্পে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কথা বলে গবেষণাবৃত্তিই হয়ে-উঠল কবি ও কথাশিল্পী ছাড়িয়ে বড় পরিচয়। অবিস্মরণীয় তাঁর সত্যের মতো বদমাশ। ষাটের দশকের শেষ দিকে আবির্ভাবের পরে লেখক হিসাবে সতত সৃষ্টিশীল সেলিনা হোসেন আমাদের সামনে থাকেন কাঁটাতারে প্রজাপতি কিংবা গায়েত্রী সন্ধ্যার মতো ইতিহাস-আশ্রয়ী উপন্যাসরাজি নিয়ে। শ্রমণ গৌতমের লেখক বিপ্রদাস বড়–য়া অন্য বাস্তবতাসহ উপস্থিত হন। রিজিয়ার রহমান বিষয়কে বছে নেয় স্বেচ্ছায়। সেখানে একই সঙ্গে তাঁর সাধারণত আয়ত্তাধিক বিষয়ের বাইরে পদক্ষেপ খুব দৃঢ় : রক্তের অক্ষরে, অলিখিত উপখ্যান সেই চেষ্টার ফল। স্বেচ্ছায় অকাল প্রয়াণের আগে কায়েস আহমেদ ছোটগল্পে তাঁর যে-ক্ষমতাকে চিহ্নিত করে যান, তার কাছেও আমাদের ফিরে ফিরে যেতে হয় বহু কারণে। গল্পে সংখ্যালঘু মধ্যবিত্তর চৌহদ্দির ও ক্ষয়িষ্ণু আদর্শের যে-ছাপ তাঁর লেখায় থাকে তাকে ‘লাশকাটা ঘর’, ‘পরান’, ‘মহাকালের খাঁড়া’ কিংবা, ‘বন্দী দুঃসময়’, ‘অন্ধ তীরন্দাজ’-এর সাফল্যে বারবার মনে আসে।
এই সময়ের গদ্য লেখকের ভিতরে পরিণতির দিক দিয়ে সাফল্যের জায়গাটিকে সবচেয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে নিশ্চিত ছুঁতে পেরেছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। যদিও বয়সের পরিণতির আগে তাঁকে কর্কটব্যাধির মরণঘাতি আক্রমণে বিদায় নিতে হয়েছে, তারপরও চিলেকোঠার সেপাই বা খোয়াবনামা তো তাঁর সফলতার সেই ইঙ্গিত যে-তিনি, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এই দুইটি উপন্যাস ও গ্রন্থিত অগ্রন্থিত তিরিশটি গল্পের ভিতর দিয়ে তিনি এক অর্থে তরুণদের কাছে হয়ে-ওঠেন ওয়ালীউল্লাহ্ পরবর্তী আমাদের প্রধান গদ্য লেখকদের একজন। ‘দোজখের ওম’, ‘মিলির হাতে স্টেনগান’, ‘কিটনাশকের কীর্তি’, খোঁয়ারি’, ‘কান্না’, ‘অপঘাত’, ‘যুগলবন্দী’ ইত্যাদি তাঁর রচিত প্রায় সমস্ত গল্পে তিনি যে-বিদ্রƒপ, রাগ ও ক্ষোভের সঙ্গে চলমান সামাজিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন তা অবশ্যই একই সঙ্গে তাঁর শক্তিমানতা ও সামজমনস্কতার কারণে বাংলা সহিত্যে স্থায়ী প্রতিষ্ঠা।
৫
আজ যাঁরা সত্তরের লেখক বলে চিহ্নিত, তাঁদের প্রায় সবাই লিখতে শুরু করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে। তাঁদের লেখায় আরও যে-কোনও লেখকের চেয়ে বেশি প্রতিভাত হয়, দেশ-পাওয়ার উচ্ছ্বাস। একই সঙ্গে লিখতে এসে নতুন-কিছু-করার নামে যতজনের লিখতে আসা তাঁদের প্রায় বেশিরভাগ জনেরই হারিয়ে-যাওয়ার সংখ্যাও বেশি। এই দশকের লেখকদের হাতেই শুরু হয়, গদ্যকে জনপ্রিয় করে তোলার তাগিদ। একে স্বাধীন রাষ্ট্র ফলে, উপন্যাসের বাজারায়নের ক্ষেত্রে এই দশকের লেখকরা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে। এই কারণে ষাটের লেখকদের কেউ কেউ, লেখা থামিয়ে দিয়ে হোক বা অকাল প্রয়াণের কারণেই হোক তার পরেও গদ্যে সফলতার যে-জায়গাটি স্পর্শ করতে পেরেছিলেন সত্তরের লেখকেরা তা পারেননি।
মঞ্জু সরকারের উত্থান ও বিকাশ অবিনাশি আয়োজনকে মনে রেখে। সেই শেষ সত্তরে প্রকাশিত তাঁর এই ছোটগল্পগ্রন্থ থেকে এর পর প্রকাশিত উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা বা মৃত্যুবাণÑ তাঁর ছোটগল্প লেখক হিসাবে যে-ক্ষমতার ইঙ্গিত বহন করেছিল তা আর যেন তিনি ধরে রাখতে পারলেন না। ফলে, তারুণের ভিতরে একদা মঞ্জু সরকারের যে-ক্ষমতার প্রভাব ছিল তা ঠিক একটি দশকেই তা থাকেনি। জনপ্রিয়তা বা পাঠকপ্রিয় রচনার যে-প্রয়াস তিনি নিতে চান তা তার লেখায় সেভাবে প্রতিভাত না-হলেও সেই সংজ্ঞা তার বর্তমান রচনায় অনেকাংশেই পাওয়া যায়। ফলে, নগ্ন আগন্তুক-এর সেই কলম তার লেখায় আর পাওয়া গেল না। পাশাপাশি গদ্যনির্মাণের যে-প্রয়াস সুশান্ত মজুমদারের ছেঁড়া খোঁড়া জমিতে ছিল তার থেকে সচেতনভাবে তিনি সরে এলেন রাজা আসেনি বাদ্য বাজাও-এ, এবং এর পরের জন্ম-সাঁতার কিংবা শরীরে শীত ও টেবিলে গু-াপা-ায় তারপর কিন্তু কোনও কোনও তরুণের মুখে শোনা যায় ছেঁড়া খোঁড়া জমির ‘নিরিক্ষাপ্রবণতা’র কথা। তবে, গরমহাত-এ তাঁর বলার কথার স্পষ্টতা ছিল, নকশারবাড়ি আন্দোলনের পটভূমিতে অগ্নিগর্ভতার গদ্যও তিনি হাতে ধরেছিলেন কিন্তু প্রকাশকের কারণেই হয়তো বইটি সেই আলোয় এল না। একই সমসাময়িকতায় মঈনুল আহসান সাবের একই সঙ্গে ছোটগল্পলেখক ও ঔপন্যাসিক হিসাবে নিজেকে আরও বেশি স্পষ্ট করে তুলতে পেরেছিলেন লেখকতার প্রায় শুরুতেই। ফলে, মধ্যিখানে তার জনপ্রিয়তার প্রয়াশ ছাপিয়ে ঢাকাই মধ্যবিত্ত হয়ে-ওঠে তাঁর লেখার প্রধান বিষয়। সেই সঙ্গে স্বাধীনতা-উত্তর স্বাধীনতার আশাভঙ্গ, সেই হতাশা ও স্খলনকে তীব্রভাবে চিহ্নিত করেন তিনি। সেই কারণেই তার অনেক লেখাকে পাশে ফেলে, পাথর সময়, সতের বছর পরে বা কবেজ লেঠেল তাঁর প্রধান রচনা। সেই সঙ্গে সাম্প্রতিক রেলস্টেশনে শোনা গল্প বা অবসাদ ও আড়মোড়ার গল্পও তাঁকে নতুন করে চিহ্নিত করে।
(এখানে, একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। আমার গল্প লিখতে শুরুর দিনগুলিতে, আশির দশকের শেষ দিকে, আমাদের বাগেরহাট শহরের তরুণ লেখক-সাংবাদিক অগ্রজদের মুখে মোটমুটি ৬ জন গদ্যলেখকের নাম আমরা শুনতাম : হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ আর সেই সময়ে সম্প্রতিকদের ভিতরে থাকত মঞ্জু সরকার, সুশান্ত মজুমদার, মঈনুল আহসান সাবের। তারা বলতেন গল্প লিখতে হলে এই কয়েকজনের গল্প পড়া থাকা উচিত। ফলে, সেই সময়ের বিচারে, হাতের কাছে যা পাওয়া গিয়েছিল সেইমতো তাঁদের প্রায় সব গল্পই পড়া হয়ে-গিয়েছিল। এবং পত্র-পত্রিকায় যা বের হত তার দিকেও চোখ রাখার আগ্রহও জিইয়ে থাকত।)
এই সমসাময়িকতায়, কখনও কখনও যে-উদ্ভাসে সামনে আসেন তাপস মজুমদার তাঁর মঙ্গল সংহিতায়, হরিপদ দত্ত জন্ম-জন্মান্তর নামের উপন্যাসে ও ‘একটি পুরাতন উর্দি’র মতো গল্পে, মুস্তাফা পান্না মঘা অশ্লেষায়।
আশির শুরুতে যে-তরুণ হুমায়ূন আহমেদের সত্তরের দশকে লেখা নন্দিত নরকে বা শঙ্খনীল কারাগার-এর পঠনচেতনায় কোনওভাবেই আবিষ্ট হয়েছিল সে যদি উপন্যাস ও বিনোদনের তফাৎ করতে না-পারে তাহলে আর হুমায়ূন আহমেদের পাঠক থাকতে পারবে না। তাঁর যে-কোনও উপন্যাস একটানে পড়া-যায় ঠিকই, কখনও কখনও তা আবেগের বাঁধ চোখকেও ভিজিয়ে ফেলে কিন্তু সেই উপন্যাস-পাঠ অভিজ্ঞতা পাঠককে কোথাও পৌঁছে দেয় না। ফলে, সেই পাঠ কোনও মাত্রা পায় না। যদিও ‘শীত’, ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’, ‘চোখ’, ‘খাদক’ কিংবা ‘মৃত্যু-গন্ধ’র মতন গল্প কখনও কখনও তাঁর গল্প-লেখনের সহজাত বিস্ময়কর ক্ষমতাকে মনে করিয়ে দেয়। আবার ইমদাদুল হক মিলন জনপ্রিয়তার যে-সহজ রাস্তাটাকে হাতড়ালেন তাতে কিন্তু তাঁর গল্প আর সিরিয়াস গল্পর আদলে যা তিনি লিখতে চান তাকে আর প্রাণ দিল না। ফলে, তার ওই গ্রাম তার গ্রাম্যতাকেই চিহ্নিত করল, কেননা, নাগরিক প্রেমের উপন্যাসের গদ্যে কখনও গ্রামীণ পটভূমির উপন্যাসের বিন্যাস সম্ভব নয়। যদিও একদা, তার এই কলম জনপ্রিয়তাকে আশ্রয় করার আগে যাবজ্জীবন¬-এর মতো উপন্যাস লিখেছিল, লিখেছিলেন পরাধীনতা। কিংবা, নিরন্নের কালও গল্পগ্রন্থ হিসাবে একটা সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করে। সত্তরের দশকের একেবারে শেষে লিখতে শুরু করেছিলেন মনিরা কায়েস। বহুদিন বাদে তাঁর গল্পগ্রন্থ মাটিপুরাণ পালা যেন তাকে নতুন করে চিহ্নিত করল। মানুষের যে-শর্তগুলো তিনি খুঁজতে যান, তাতে যেন এখনও সেই প্রতœমানুষের আদলেই আমাদের সামনে উপস্থিত হয় তাঁর গল্পে। পরে বের হয় : জলডাঙ্গার বায়োস্কোপ, ধুলোমাটির জন্মসূত্র।
৬
আশির দশকে আমাদের সামনে গল্পকে দাঁড় করিয়ে দিল পরীক্ষার-নিরিক্ষার প্রবল আদলে। এই দশকের লেখকদের বেড়ে-ওঠা ও জীবনের বিরাট এক-অংশ স্বাধীন দেশের সামরিক শাসনের ভিতরই কেটেছে, সেই জন্যে যে-কোনওভাবেই তাদের রচনায় এক-প্রকারের হোক যেন প্রচলিতের আদলকে তারা বাঁধ-ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন। সেই আবহের ফাঁক গলেই দেখা যায়, একদিকে সাহিত্যপত্র বা লিটল ম্যাগজিনের লেখকদেরÑ যাঁদের লেখায় কোনও-না-কোনওভাবে থাকে পূর্বতনদের অস্বীকারের অঙ্গীকার। সেই আয়তনে যাঁরা নিজেদের জড়িয়ে নেন : শহীদুল জহির, মামুন হুসাইন, সেলিম মোরশেদ, সুব্রত আগস্টিন গোমেজ, শহীদুল আলম, কাজল শাহনেওয়াজ, শামসুল কবির। এঁদের পাশাপাশি থাকে ‘প্রথাগত’ ওয়াসি আহমেদ, মহীবুল আজিজ, নাসরীন জাহান, পারভেজ হোসেন, ইমতিয়ার শামীমের নাম আর একটু দেরি করে হলেও শাহদুজ্জামান বা আকমল হোসেন নিপু। এঁদের সমবেত প্রচেষ্টায় তৈরি হয় বাংলাদেশের গল্পে নতুন আবহ নির্মাণের স্বরূপ। কিন্তু যাঁদের আমরা প্রাতিষ্ঠানিক আবহের বাইরের নতুন লেখক বলছি তারা বেশিভাগই বিষয়কে গদ্যে, গদ্যকে আঙ্গিক, আর নতুন কিছু করা মানেই ‘ভালো কিছু’র কাছে নিতে না-পারার কারণে, তারা আর সাহিত্যে থাকলেন না।
শহীদুল জহির গল্পে কথা বলার ধরন মিশিয়ে যে-কাহন তৈরি করেন, তাতে গল্প হারিয়ে যায়, আখ্যানের এমনি এক বিন্যাসে আমাদের গোঁলকধাঁধায় নিয়ে যান তাতে শেষমেশ গল্পটা কোথায় যায় সেই প্রশ্ন মাঝে মাধ্যেই দাঁড়িয়ে যায়! ‘আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফোটেনি কেন’,‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’ ‘আমাদের কুটিরশিল্পের ইতিহাস’-রÑ এই আবহে বরং তার গল্পের চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্খলন নিয়ে লেখা জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অনেক বেশি সফল রচনা মনে হয়। এমনকি সে রাতে পূর্ণিমা ছিলকে মনে রাখলেও জীবন ও…-র স্বতঃস্ফূর্ততার কাছে ম্লান করে দেয় কাহিনির নির্মাণের নতুন ছক, যেখানে মানুষ চলমান নয়, চলমান লেখকের বর্ণনায়, কোনও অংশেই, কোনও চরিত্রই নিজে বলি ‘হয়ে উঠতে পারে না, শহীদুল জহিরের কলমের চাপে। আবার মামুন হুসাইন কলমকে ঘোরান চরিত্রের ইচ্ছার মতো করে। একজন মানুষের স্মৃতি ও পারিপার্শ্বের সমস্ত পরিধিব্যাপী সেই অবস্থানে ঘুরে ফিরে আসে তার তাবৎ অনুসঙ্গ, শান্ত আবহে সন্ত্রাস সেখানে মানুষের সঙ্গে চাঁদমারি খেলে। সে কোথায় ছিল কেন ছিল তার উত্তর থেকে ভবিতব্যে পারলে মামুন হুসাইন নিয়ে যেতে চান। কিন্তু তাঁর এই সমস্ত মানুষও কিন্তু কথা বলে না। যা বলে তা মানুন হুসইনেরই সঙ্গে যেন। এবং এইভাবে ‘গল্প’-এ আদৌ ‘গল্প’ কোথায়? সেই প্রশ্নের উত্তরে জন্যে আজকাল ‘গল্প’-এ ‘গল্প’ থাকা-না-থাকার প্রশ্নও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সেই সফলতায় মামুন হুসাইন প্রধান কা-ারি। যেমন, ‘দারুচিনি দ্বীপের ভেতর’ বা, ‘এ এক পুনরুত্থান’, ‘আলো অন্ধকার আয়ু’র সফলতা। ওই সফলতায় মামুন হুসাইনের তেজ ও ক্রোধ সেই সঙ্গে গল্প-কাঠামোয় রাষ্ট্রশক্তির প্রতি তাঁর সমস্ত আক্রোশকেই চিহ্নিত করে। আবার, সেলিম মোরশেদ কাটা সাপের মু-ুতে, শহীদুল আলম ঘুণপোকার সিংহাসন-এ, কাজল শাহনেওয়াজ কাছিমগালায় এবং পারভেজ হোসেন ক্ষয়িত রক্তপুতুল-এ দেখিয়েছেন সাফল্য। তাঁরা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা।
ওয়াসি আহমেদ ও মহীবুল আজিজের লেখার পরিণত ভঙ্গিটি আমদেরকে থমকে দেয়। ওয়াসি আহমেদের গল্পগ্রন্থ ‘বীজমন্ত্র’ উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ। ‘তপুর ধর্মটিচারে’র মতো গল্পও আমাদের মনে রাখতে হবে অনেকদিন। মহীবুল আজিজের ‘মাছের মা’ গল্পটি সমসায়িকতার চাপকে চিরলীনতার ভিতর ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিল তারই শক্তির কারণে। যদিও সেই চলনে আমাদের মনে রাখতে হবে নবীতুনের ভাগ্য চাঁদ ও গ্রামউন্নয়ন কমপ্লেক্স-এর পরে দুগ্ধগঞ্জ¬-এ তিনি অনেকখানি পরিণত হয়ে ওঠেন।
নাসরীন জাহান সমসাময়িক লেখকদের ভিতরে সবচেয়ে অতিপ্রজ ও জনপ্রিয়। হয়তো সেই সমস্ত কারণ মিলিয়ে তার হাতে রচনার চাপ ও পরিমাণ বেশি। তাঁর রচনায় নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণটাকে মেনে-নেয়া যায় না এই কারণে যে, সেই চোখের অনেকখানিক তাঁর পুরুষের কাছ থেকে পাওয়া। ফলে, উড়ূক্কুর সফলতার পরে তার হাতের ছোটগল্পের চলন যেমন আগের চেয়ে অনেখানিক কমে গেছে সেই সঙ্গে উপন্যাস হয়ে-উঠছে তাঁর রচনার প্রিয় বিষয়। ‘বিচুর্ণ ছায়া’, ‘শিবমন্দির’, ‘মানুষ’ গল্প তাঁর সিদ্ধির পরিচয়।
শাহীন আখতারের তালাশ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। একইসঙ্গে তিনি লিখেছেন উল্লেখযোগ্য অনেকগুলো গল্প। ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর কাহিনি নির্মাণে পরিশ্রম ও মনোনিবেশ অসাধারণ। গদ্যলেখক হিসেবে আনিসুল হক ফাঁদ, চিয়ারী বা বুদু ওরাঁও কেন দেশত্যাগ করেছিল, বীরপ্রতিকের খোঁজে, মাসহ অন্যান্য উপন্যাসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন এবং কোনও কোনওটিতে সফল হয়েছেন।
ইমতিয়ার শামীম, শাহাদুজ্জামান, আকমল হোসেন নিপু ও সালাম সালেহ উদ্দিন তাদের বিষয়ের কারণে পৃথক। যদিও শেষোক্ত দুজনের সঙ্গে ইমতিয়ার শামীমকে এক করে আলোচনায় কিছু সমস্যা থেকে যায় যদি দশকওয়ারি বিভাজনকে মানা হয়। তা বাদে এখানে প্রথম বই প্রকাশের বিষয়টিকে মাথায় রাখলে সমস্যাটার সামান্য সমাধান হয়ে যায়। ইমতিয়ার শামীম স্পষ্টতই একই সঙ্গে গল্প ও উপন্যাস-লেখক, তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ডানকাটা হিমের ভেতর ও গল্পগ্রন্থ শীতঘুমে একজীবন একই বৎসর প্রকাশিত হয়েছিল। এই শীতঘুমে…-র গদ্যে যে-কাব্যময়তা ছিল তার থেকেও তিনি সরে এসেছেন অনেক। তার লেখায় আগের মতোই রাজনীতি উপস্থিত কিন্তু তা কোনওভাবেই কাহিনিকে নিয়ন্ত্রণ করে না বরং অনেক বেশি অন্তঃস্রোতে এই আবহ ধরা পড়ে। তাঁর উপন্যাস আমার হেঁটেছি যারা এবং গল্পগ্রন্থ গ্রামায়নের ইতিকথা তার পূর্বেকার রচনা থেকে আলাদা করে তুলেছে। বিষয় ও আঙ্গিকের দিক দিয়ে এটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগ্রন্থ। শাহাদুজ্জামানের গল্পলেখনের ভিতরে লুকিয়ে আছে তার গল্প বলার কৌশল। যে-কৌশলের কারণেই হয়তো তার গল্পের শেষাংশ পর্যন্ত আমাদের পড়তে হয়। ‘মৌলিক’, ‘মিথ্যা তুমি দশটি পিপীলিকা’Ñএইসমস্ত গল্পের বুননকৌশকে সমীহের সঙ্গে মনে রাখতে হয়। আকমল হোসেন নিপুর প্রথম গল্পগ্রন্থ জলদাসের মৎস্যঘ্রাণ একই সঙ্গে আছে জল, সেই জলের সহবাসে বেড়ে-ওঠা মানুষ সেই সঙ্গে সেই সমস্ত মানুষদের জীবনযাপনের প্রবল অনুষঙ্গ। যে-অনুষঙ্গে বেড়ে-ওঠা মানুষকে আকমল হোসেন নিপুর গদ্যের কারণে অমন পেলব আর কোমল ঠেকে। আবার সালাম সালেহ উদ্দীনের সরল বয়ানে গদ্যের প্রচেষ্টা ছায়াশিকারী। তাঁর ‘প্রার্থনার দুই পর্ব’ গল্পের যে-সফলতা তাও মনে রাখতে হয়। অথবা, হামিদ কায়সার দীর্ঘ বিরতির পরে প্রকাশ করেন প্রথম গল্পগ্রন্থ কলকব্জার মানুষ। যেখানে, ‘চেতন চেতনে বানেশ্বর’-এর মতো গল্প প্রচেষ্টাকে সহজে ভোলা যায় না।
৭
নিজস্ব সমসাময়িকতার কথা লিখতে গেলে, এই যাঁদের সঙ্গে পথচলা তাঁরাও কখনও কেউ কেউ হয়ে-ওঠেন নিজের লেখক। তাঁদের লেখায় যে-শক্তি খুঁজে নেয়া যায় তাও তো কখনও কখনও হয়ে-ওঠে নিজের লিখবার শক্তি। ফলে, খঞ্জমানুষের মতো, অথবা আলাজিহ্বাহীন হয়ে তোতলাতে তোলাতে যে-লিখি, সেই লেখায়ও তো লেগে-থাকে সাম্প্রতিক সহযাত্রীদের ঋণ।
যদি নাম ধরে যদি বলি : জাকির তালুকদারে মতো নন আহমাদ মোস্তফা কামাল, শাহনাজ মুন্নীর সঙ্গে মেলে না অদিতি ফাল্গুনীর, সালমা বাণীর আর শাহীন আখতারের বিষয় একেবারেই ভিন্ন, শাহাদুজ্জামানের সঙ্গে মাহবুব মোর্শেদের ব্যবধান বিস্তর, পাপড়ি রহমান আর নাসিমা আনিস পৃথক পথের যাত্রী; রায়হান রাইন, রাখাল রাহা, রবিউল করিম, মনি হায়দার, জিয়া হাসানÑ প্রত্যেকেই সবদিক দিয়ে স্বতন্ত্র; খোকন কায়সারের সঙ্গে সাদ কামালীর গল্পের বিষয় ও ভাষার দূরত্ব যোজন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ থেকে এই সমস্ত নাম এক করেই আমাদের কাহিনিগদ্য। তার ভিতরে পাওয়া ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র পরে আমাদের প্রধান গদ্যলেখক কে?’ আর, সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে আমাদের মন্তব্য, ‘এখনও পর্যন্ত একটি গল্প লেখা হচ্ছে, যে-গল্পটি লিখতে শুরু করেছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্!’Ñ এর উত্তর। পরিশ্রম ও সততার সমবেত প্রচেষ্টার উত্তর কাল দিতে বাধ্য!