বরিশাল সিটি করপোরেশনের এলাকার বাসিন্দারা এখন হোল্ডিং ট্যাক্স আতঙ্কে ভুগছেন। অনেকে ট্যাক্স কমানোর জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে। এই সুযোগে কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী সুবিধা নিয়ে হোল্ডিং ট্যাক্স কমিয়ে দিচ্ছেন অথবা হয়রানী করছেন বলেও অভিযোগ অনেক বাড়ি মালিকদের।কিন্তু এসব বিষয়ে মুখ খুলতে রাজী নয় বরিশালের কেউ। শুধু মাত্র বাসদ নেত্রী ডাঃ মনীষা একাই লড়াই করছেন বিসিসির সব অনিয়মের বিরুদ্ধে।
মনীষা বলেন, হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির সাথে সাথে গত একবছরে বরিশাল শহরের বাসাভাড়াও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। তাই ভাড়াটেদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। তারা মনে করছেন, বাড়ির মালিকরা তাদের ভাড়া বাড়িয়ে এই ‘ক্ষতি’ পুষিয়ে নেবেন। আমাদের এটা মধ্যমানের শহর। ঢাকা খুলনার সাথে বরিশালকে তুলনা করে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় করা যাবেনা।
সম্প্রতি বরিশাল শহরের ধান গবেষণা সড়ক ধরে রূপাতলী হাউজিং, ঠাকুরবাড়ি সড়ক, পশ্চিম নবগ্রাম রোড, বগুড়া রোড, কাউনিয়া, আলেকান্দা, ভাটিখানা, কাঠপট্টি, পুলিশ লাইনে ডাঃ খাদেম ও ওসমান সড়কের ঝুলন্ত অসংখ্য বাড়িভাড়া সাইনবোর্ডে দেয়া ফোন নম্বরে ফোন করে দেখা গেল, সর্বনিম্ন মানের দুইরুমের বাসা ভাড়া ৫ হাজারের নীচে নেই। মানসম্মত টাইলসকৃত হলে সাড়ে ছয়হাজার থেকে আট হাজার পর্যন্ত। তিনরুম হলে সাড়ে আট হাজার থেকে বারো হাজার।
যা দুই বছর আগেও ছিল তিন হাজার থেকে ছয় হাজারের মধ্যে বলে জানালেন ধান গবেষণা সড়কের ব্যবসায়ী আবদুল মতিন।
হঠাৎ এভাবে বাসাভাড়া বাড়ানোর কারণ হিসেবে বিসিসির মেয়রকে দুষলেন প্রায় সব বাড়িওয়ালা। তাদের মতে, মেয়র সাদিক রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করতে যে টাকা খরচ করছেন, তা উসুল করতেই হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়িয়ে দ্বিগুণ তিনগুণ বা তার ইচ্ছে মতো করে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ অনেক বাড়ি মালিকের।
বরিশাল সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ এ বিষয়ে খুব স্পষ্ট বলে দিয়েছেন এক সাংবাদিক সম্মেলনে। তিনি বলেছেন, ২০১৮ সালে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে নতুন হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ের নির্দেশনা দেয়া হয়। তাতে প্রতি বর্গফুটে ১৫ টাকা রেট ধার্য করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী ট্যাক্স আদায় হলে জনগণের ওপর অনেক বড় চাপ পড়বে। তাই ২০১৬ সালে বিএনপি নেতা ও তৎকালীন বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আহছান কামালের ধার্যকরা রেট বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। নতুন করে কোনো হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়াননি তিনি। তৎকালীন পরিষদ যে ট্যাক্স নির্ধারণ করেছিল, তাও আদায় হচ্ছিল না। নানাভাবে কর্পোরেশনকে ঠকানো হচ্ছিল। তাই সেটা বাস্তবায়নের চেষ্টা হচ্ছে শুধু ।
এসময় সিটি কর্পোরেশনের সাবেকসচিব ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. ইসরাইল হোসেন বলেছিলেন, বরিশাল নগরীর সদর রোডের ডা. সোবাহান মার্কেটের চায়না প্যালেসের সংযুক্ত ভবন বাবদ আগে কর্পোরেশনকে বছরে হোল্ডিং ট্যাক্স দেয়া হতো ২৭ হাজার টাকা। কিন্তু ২০১৬ সালে সিটি কর্পোরেশনের রেজ্যুলেশন হওয়া বিধি অনুযায়ী ওই ভবনের একাংশের নতুন হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। ভবনের হোল্ডিং ট্যাক্সও বেড়েছে আগের তুলনায় কয়েকগুন। একইভাবে নগরীর কাঠপট্টিতে ব্যবসায়ী গ্রুপ খান সন্সের একটি বহুতল ভবনে এতদিন বার্ষিক হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় হতো ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অথচ ২০১৬ সালের রেজ্যুলেশন অনুযায়ী ওই ভবনের হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূলায়ন করে কর ধার্য্য হয়েছে ২৫ লাখ ৭২ হাজার টাকা।
এই তথ্য জানিয়ে সচিব আরো বলেছিলেন, নগরীতে আগে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ে নানা অনিয়ম ছিল। আগের পরিষদের মেয়র আহসান হাবিব কামাল তার ইচ্ছেমতো ট্যাক্স কমিয়ে দিতেন। কিন্তু মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন পরিষদ দায়িত্ব নেয়ার পর নগর ভবনের রাজস্ব বাড়ানোর নানা তৎপরতা শুরু করেন। এতে আগের পরিষদের ট্যাক্স আদায়ের নানা অনিয়ম ফাঁস হয়ে যায়।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ৫২ হাজার হোল্ডিংয়ে (বসতি) বছরে ট্যাক্স আদায় হয় ৯ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৬ সালের বাড়ি ভাড়া অনুযায়ী ট্যাক্স আদায় করতে পারলে বছরে ৮০ থেকে ৯০ কোটি টাকার হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় করা সম্ভব বলে জানান সিটি কর্পোরেশনের এই সাবেক সচিব। এর অল্পদিন পরেই কর্পোরেশন এর এই কর্মকর্তা আচমকা স্বপরিবারে ঢাকা চলে যান এবং পরে অন্যত্র বদলী নেন বলে জানা গেছে। তার স্থানে পাওয়া গেল নতুন সিইও ফারুক আহম্মদকে। এ সময় মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর এর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইলে তিনি মেয়র এর পার্সোনাল সেক্রেটারী শান্ত এর নম্বর দেন।বেশ কয়েকবার ফোন করার পরও শান্ত তা রিসিভ করেননি। বাধ্য হয়েই প্রতিবেদন তৈরির প্রয়োজনে আমরা মেয়র এর ফেসবুক পেজ থেকে ও জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তার বক্তব্য থেকে তথ্য সংগ্রহ করি।
ইতিপূর্বে হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়নের বৈধতা নিয়ে ঢাকায় একজন নাগরিক আদালতের আশ্রয় নেন। আদালতের নির্দেশে এ কার্যক্রম স্থগিত করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। একইসাথে বিভাগীয় সিটি করপোরেশনও এ কার্যক্রম স্থগিত রাখে। এসব কারণে ২০১৬ থেকে ১৮ পর্যন্ত সাবেক মেয়র হোল্ডিং ট্যাক্স বিষয়ে কোনো ভুমিকা নেন নাই বলে জানালেন বিএনপির জেলা সহ সভাপতি এ্যাডঃ আক্তার হোসেন মেবুন।
তিনি বলেন, সর্বশেষ আদালতের আরেক আদেশে সেই স্থগিতাদেশ উঠে যায়। ফলে নতুন করে দেশের সব সিটি করপোরেশন মেয়রগন পুরোদমে হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়নের কার্যক্রম শুরু করেছে। বরিশালে যা একটি উপরি বাণিজ্যের বিষয় হওয়ায়, এখানে এটাকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে বর্ধিত হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ের নোটিশ পাঠাচ্ছেন তারা। করপোরেশনই প্রতিটি হোল্ডিংয়ের মালিকের ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়ে নতুন হোল্ডিং ট্যাক্সের পরিমাণ জানিয়ে দিচ্ছেন। এরফলে উৎকোচ বাণিজ্য আগের চেয়ে দিগুণ হারে শুরু হয়েছে।
এদিকে উৎকোচ বাণিজ্যের শিকার ভুক্তভোগীরা নাম জানিয়ে কিছু বলতে চাইছেন না। তারা মনে করছেন, এতে বরিশাল সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা নাখোশ হয়ে হোল্ডিং ট্যাক্স আরও বাড়াতে পারেন।
শহরের বগুড়া রোডের এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগে আমার হোল্ডিং ট্যাক্স ছিল ১০ হাজার টাকা। পুনর্মূল্যায়নের পর তা হয়েছে ৯৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ বাসার হোল্ডিং ট্যাক্স প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। তিনি বলেন- গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ছে। চাল ডাল মাছ মাংস সবকিছুরই দাম বাড়ছে। কিন্তু আয়তো বাড়ছে না। এভাবে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানো হলে শহরে বসবাসের উপায় থাকবে না।
একজন বাড়ির মালিক যখন এ কথা বলেন তখন নিম্ন আয়ের ভাড়াটিয়া যারা তাদের অবস্থা কি স্থানীয় প্রশাসনের তা বিবেচনায় আনার অনুরোধ জানান ভাড়াটিয়াদের কয়েকজন।
এ প্রসঙ্গে বিসিসির বর্তমান নির্বাহী কর্মকর্তা ফারুক আহম্মদ বলেন, হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোর চিঠি ইস্যু হওয়ার পর অনেকেই অফিসে আসছেন। তারা বেশি ট্যাক্স ধরার অভিযোগ করছেন। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাড়ির মালিকদের তর্ক-বিতর্কও হলেও তা মেয়র মহোদয় মুহুর্তে সমাধান করে দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, হোল্ডিং ট্যাক্স পর্যালোচনার জন্য কেউ মেয়র বরাবরে আবেদন করলে কপোরেশন ১৫ ভাগ পর্যন্ত কমাতে পারে। এরবেশী কিছুই করতে পারেনা।
তবে যদি আপনার মনে হয় যে আপনার কর ধার্য করা ঠিকমতো হয়নি সে ক্ষেত্রে বিভাগীয় কমিশনার আদালতে আপিল করা হলে আরও সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ মূল্যায়ন হ্রাস কর ধার্য করা হতে পারে। তবে বরিশালে এখন পর্যন্ত এর প্রয়োজন হয়নি বলে জানান সিইও।
হোল্ডি কর পদ্ধতি
হোল্ডিং কর আগে ভবনের আয়ের ১২ শতাংশ আদায় করা হলেও বর্তমানে তা ২৭ শতাংশ পর্যন্ত আদায় করা যাবে। ফ্ল্যাট, জমির মালিককেও একই হারে কর দিতে হবে।
ট্রেড লাইসেন্সের ফিও বাড়ানো হবে। সিটি করপোরেশনগুলোর আর্থিক সংকট কাটাতে ও নিজস্ব আয় বাড়াতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, ভবনের নতুন কর হার বাস্তবায়ন হলে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আয় ৪০০ কোটি টাকার বেশি বাড়তে পারে। অন্যান্য সিটি করপোরেশনের রাজস্ব আয় দ্বিগুণ হবে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, নতুন কর হার বিষয়ক ‘সিটি করপোরেশন আদর্শ কর তফসিল, ২০১৫’ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব সরোজ কুমার নাথ এতে স্বাক্ষর করেন। নতুন এই কর হার ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যখন ভবনমালিকেরা কর দেবেন, তখন জানতে পারবেন।
সিটি করপোরেশনের আদর্শ কর তফসিল, ২০১৫-এর প্রজ্ঞাপন জারির কথা সংসদীয় কমিটিকে জানানো হয়েছে।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভবনের করের ক্ষেত্রে বাড়ির আয়ের ওপর কর আগের মতো ৭ শতাংশ রাখা হলেও বর্জ্য নিষ্কাশন ও সড়ক বাতির ওপর কর বাড়ানো হয়েছে। বর্জ্য নিষ্কাশনের কর ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ শতাংশ ও সড়ক বাতির কর ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
আগে বাড়ির মালিককে কর দিতে হত এ তিন খাতে সব মিলে ১২ শতাংশ। নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ফলে এ তিন খাতে তাঁকে দিতে হবে মোট ১৯ শতাংশ কর।
এর বাইরে স্বাস্থ্য কর দিতে হতে পারে ৮ শতাংশ। অর্থাৎ নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ফলে একজন ভবনমালিককে ২৭ শতাংশ কর দিতে হবে।
আগে পানি ও স্বাস্থ্য কর ছিল না। এখন তা যুক্ত হয়েছে।
অর্থাৎ একজন ভবনমালিক যদি ভবন ও জমি ব্যবহার করে বছরে এক লাখ টাকা আয় করেন, তবে তাঁকে এখন ন্যূনতম ২৭ হাজার টাকা কর দিতে হবে। আগে দিতে হতো ১২ হাজার টাকা। আর যদি ওই মালিকের ওপর পানির জন্য কর প্রযোজ্য হয়, তবে তাঁকে আরও তিন হাজার টাকা দিতে হবে।