বরিশালের মুক্তিযোদ্ধা পার্কে সাহিত্যে- কিছুক্ষণ- স্মৃতিচারণ ও কবিতার আড্ডা
বিশেষ প্রতিবেদক
“স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে:
সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়!
অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?
কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ
মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!
মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!
শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!”
কবি জীবনানন্দ দাস!
রূপসী বাংলার ধানশালিকের কবির লেখা বোধের গভীরতায় কিছুক্ষণ হারিয়ে ছিলো কীর্তনখোলা নদীর জল ছলছল কান্না। সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আরিফ আহমেদ এর আবৃত্তি দিয়ে শুরু হয়েছিল ১২ আগস্ট শুক্রবারের সাহিত্যে – কিছুক্ষণ- নামের শোকগাঁথা স্মৃতিচারণ ও কবিতার আড্ডা। বাংলা সাহিত্য পরিষদ ও বরিশাল সাহিত্য সংসদ আয়োজিত এই আড্ডায় কোনো প্রধান অতিথি বা আনুষ্ঠানিক সভাপতি ছিলোনা। সাহিত্য বাজার পত্রিকার সৌজন্যে শ্রদ্ধা নিবেদন দিয়ে শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। লাখো মা বোন ভাইয়ের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের সব শহীদদের স্মরণে এবং বিশেষ করে ৭৫ এর ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের নিন্দা ও শোক জানিয়ে কিছুটা সময় নিরবতা পালন করে সবাই। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা বীরপ্রতীক মহিউদ্দিন মানিক যুদ্ধকালীন বাবুগঞ্জ রণাঙ্গন ও প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা ওহাব খানকে নিয়ে দীর্ঘ স্মৃতিচারণ করেন। নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেন অতীতের না জানা গল্প। তবে মুক্তিযোদ্ধা পার্কের ভিতরে নদী তীরবর্তী এলাকায় ড্রেজিং মেশিনের শব্দে চাপা পরে যায় তার কণ্ঠ। অনুরোধ করলেও ড্রেজিং থামানো হয়ন।
মুক্তিযোদ্ধা পার্কের পরিবেশ রক্ষা ও এখানে নিয়মিত সাহিত্য সংস্কৃতির আয়োজনসহ নামকরণের সার্থকতা নিয়েও কথা বলেন আলোচকদের সবাই। এই পার্কে একটি উম্মুক্ত মঞ্চ, পাবলিক টয়লেট ও সন্ধ্যার পর আলোর ব্যবস্থা দাবী করে কথা বলেন সামাজিক আন্দোলনের নেতা ও অর্থনীতি সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান। কবিতাপাঠ ও আলোচনা আড্ডা জমে ওঠে পথচারী সুমাইয়া আক্তার এসে কবিতা পড়তে চাইলে। তিনি কবিতা পড়েন তার শিশু কন্যাকে কোলে নিয়ে। কবিতাপাঠ ও আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপিকা ও কবি ফয়েজুন্নাহার শেলী, কবি শফিক আমিন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার বাহাউদ্দীন গোলাপ, বরিশালের অন্যতম নাট্য সংগঠন নাট্যম এর সাধারণ সম্পাদক ও গায়ক গোপাল কৃষ্ণ গুহ রিপন, কবি ও প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি অপূর্ব গৌতমসহ আরো অনেকে আলোচনা ও কবিতা পাঠে অংশ নেন। একইসাথে উপস্থিত সবাইকে প্রগতি লেখক সংঘের ঝালকাঠি সাহিত্য সফরে আমন্ত্রণ জানান কবি অপূর্ব গৌতম। ফাঁকে ফাঁকে সঞ্চালনা ও ভিডিও ধারনে ব্যস্ত বরিশাল সাহিত্য সংসদ এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক দক্ষিনাঞ্চল পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আরিফুর রহমান।
সঞ্চালক তখন রবীন্দ্রনাথ থেকে পড়ছিলেন –
“আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান!
না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।”
এই আবেগাপ্লুত আয়োজনের শুরুটা হয়েছিল গত ২৯ জুলাই ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ এর পাঠচক্র – বীক্ষণ এর আমন্ত্রণ থেকে। কবি ও সাংবাদিক বন্ধু স্বাধীন চৌধুরী তাদের ২৫০০ তম আয়োজনে নিমন্ত্রণ জানালে যেতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকতে বরিশালেই বীক্ষণ এর আদলে কিছুক্ষণ নামে সাহিত্য আড্ডা কার্যক্রম চালু করার ইচ্ছে শেয়ার করলাম বন্ধু স্বাধীন এর সাথে। সে তৎক্ষনাৎ ব্যানার ডিজাইন করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। বরিশালে বিষয়টি প্রথম জানালাম সাংস্কৃতিক সমন্বয় পরিষদের সভাপতি নজমুল হোসেন আকাশ ভাইকে। বলা যায় তার আন্তরিক উৎসাহ থেকেই এটি ছড়িয়ে পরলো। পরামর্শ ও সহযোগিতা চাইলাম বরিশালের বন্ধু সাংবাদিক আক্তার ফারুক শাহীন এর কাছে। তার নিরবচ্ছিন্ন নিরবতায় কষ্ট শুধু বাড়লো আবার। কেননা বরিশালে সে আমার প্রথম বন্ধু। দৈনিক আজকের পরিবর্তন পত্রিকার বার্তা সম্পাদক এর মাধ্যমে পরিচিত হলাম কবি অনিকেত মাসুদ এর সাথে। সবকিছু শুনে সে বেশ আন্তরিক আগ্রহ দেখালেও কার্যত তার বস আক্তার ফারুক শাহীন। অনেকটা অবহেলা ও প্রত্যাশাহীন ভাবনা নিয়ে বাংলা সাহিত্য পরিষদ ও বরিশাল সাহিত্য সংসদ এর নদী পাড়ে মুক্তিযোদ্ধা পার্কে সাহিত্য আড্ডা নিয়ে কথা বললাম দৈনিক দক্ষিনাঞ্চল পত্রিকার বার্তা সম্পাদক প্রিন্স তালুকদার ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আরিফুর রহমান এর সাথে। ওদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ আমি স্বচক্ষে দেখলাম মাত্র দু’দিনে কি চমৎকার গুছিয়ে দিল ওরা। চলে এলো সাউন্ড সিস্টেম এবং চেয়ার। যে চেয়ারে বসেই এই মুহূর্তে কীর্তনখোলার পাড়ে ধীরে ধীরে উন্মোচন হলো সাহিত্যের নতুন এক যাত্রাপথের।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হলো দৈনিক দক্ষিনাঞ্চল পত্রিকার বার্তা সম্পাদক প্রিন্স তালুকদারকে। প্রিন্স তুলে ধরলেন বাংলা সাহিত্য পরিষদ ও বরিশাল সাহিত্য সংসদ এর আগামী পরিকল্পনা। সবসময় যৌথভাবে এই আয়োজন নিয়মিত করার চেষ্টায় কি কি করতে চায় তার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরে সভাপতি আরিফ আহমেদ বলেন, আগামীতে কিছুক্ষণ নামের এই আয়োজনের বিষয়ভিত্তিক আলোচনা হবে বরিশালের উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও শিল্পায়নের জন্য করনীয় নিয়ে। নিমন্ত্রণ জানানো হবে সিটি মেয়র ও জেলা প্রশাসকসহ স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেও। আমরা এই আয়োজনটি নিয়মিত করতে চাই। শুধু সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্যিক নয়, নাট্যজন, সংগীতজ্ঞ ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনায় এখানে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানাতে চাই সংশ্লিষ্ট প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতাদেরও। উপস্থিত বরিশালের অতিথিদের মধ্যে থেকে নজমুল হোসেন আকাশকে (পদাধিকার বলে সাংস্কৃতিক সমন্বয় পরিষদের সভাপতি যখন যে থাকবে) সভাপতি ও তপংকর চক্রবর্তীকে প্রধান উপদেষ্টা (জীবীতকালে সবসময়) করে সাত সদস্যের কমটি গঠন করার প্রস্তাব ছিলো এই কিছুক্ষণের আড্ডায়। এস এম ইকবাল, বীরপ্রতীক মহিউদ্দিন মানিক, সামাজিক আন্দোলনের নেতা কাজী মিজানুর রহমান, কবি ও গবেষক অধ্যাপিকা ফয়েজুন্নাহার শেলী এবং সাহিত্যিক ও সাংবাদিক কাজী মকবুল হোসেন এর নাম প্রস্তাব করা হয় উপদেষ্টামণ্ডলী হিসেবে। যদিও প্রশাসন ও রাজনীতিকদের সম্পৃক্ত করা নিয়ে আপত্তি তোলেন সভাপতি নজমুল হোসেন আকাশ। তবে তিনি স্পষ্ট উচ্চারণে বলেন, মানবতার বিরোধী কোনো লেখক কবি ও রাজনৈতিক আমাদের সাথে থাকতে পারবে না। আর এখানটায় ঐক্যমত্য আমরা সবাই।
এরপর কথা বলেন ও ছড়াতে মাতিয়ে তোলেন বরিশাল সাহিত্য সংসদ এর প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় কবিতা পরিষদে বরিশালের সভাপতি কবি-ছড়াকার তপংকর চক্রবর্তী। তিনি জানালেন, এরপর থেকে নিয়মিত আগে পরামর্শ সভা হবে। আমরা প্রবীণরা পথ দেখাবো, তোমরা তরুণদের নিয়ে এগিয়ে যাবে। আয়োজক ও সংগঠন দুটোর সভাপতি এই বলে অনুষ্ঠান সমাপ্তির জন্য অনুরোধ জানান বরিশাল সাংস্কৃতিক সমন্বয় পরিষদের সভাপতি নজমুল হোসেন আকাশ এর প্রতি। নজমুল হোসেন আকাশ সাহিত্যিক ও নাট্যজন। তিনিই ছিলেন এই আয়োজনের অঘোষিত সভাপতি। সমাপনীর আগে এই আয়োজন নিয়মিত করা এবং সত্যিকারের সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চায় তরুণ প্রজন্মের যুবক যুবতীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।