“এই আইসক্রিম আছে ,আইসক্রিম-মালাই ,নারকুল,কুলফি আইসক্রিম। আসেন বারে আসেন আইসক্রিম খান” কিংবা “চুড়ি নিবেন চুড়ি? লাল,নীল,কালো,সাদা –যা চান তাই পাবেন”। কিংবা একহাতে ডুগডুগির শব্দ করতে করতে কাধের দুপাশে ভাড়ে করে তেল,নুন,সাবান,মশলা,জিলাপী,নই,সমপাপড়ী নিয়ে ফেরিওয়ালাদের বাড়িতে বাড়িতে হাক। কাচের ঢাকনা ওয়ালা কাঠের ফ্রেমের বাক্সে করে আলতা ফিতা,কানের ঝুমকা,স্নো-পাউডার,কাজলের পশরা সাজিয়ে মেয়েদের মন জোগানোর নানা কসরত।এমনই ছিলো আমাদের বিংশ শতকের শেষ দিককার চিরচেনা গ্রামের দৃশ্য।হাট- বাজার কিছুটা দূর-দূরান্তে আর সাপ্তাহিক হওয়ার কারনে সংসারের টুকটাক সদাইপাতি আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আবদার মেটাবার একমাত্র ভরসা ছিলো এসব ফেরিওয়ালা। কেউ বা মাথায় ঝাপিতে করে খুব সকাল সকাল গোল গোল ফুলানো গরম পাউরুটি বেচতে বেড়িয়ে পড়তো পাড়ায় পাড়ায়। এ পাড়া থেকে ও পাড়া দুপুর হতে হতেই ঝাপির সব পাউরুটি বেচা প্রায় শেষ। দাম যে খুব বেশি তা কিন্তু নয়।এই আট আনা ,এক টাকা কিংবা সর্বোচ্চ হলে দুই টাকা।ব্যাস – ওটুকুতেই ছেলেপুলে বেজায় খুশি।এখনকার মতো বার্গার,রোল,দামি দামি আইসক্রিম,কাবাব,স্যান্ডউইচ বা নুডুসে কোন মোহই ছিলো না সে সময়।
দু-এক টাকার বাদাম,প্লাস্টিকের বা লোহার ভাঙাচূড়া কুড়িয়ে জমিয়ে সেটা ফেরিওয়ালার কাছে দিয়ে একটু জিলাপী কিংবা কাগজের টুকরোতে একটু সমপাপড়ী-ব্যাস সকল তৃপ্তির স্বাদ ওটুকুতেই একেবারে ভরপুর। আর কপাল ভালো হলে এক টাকার মালাই বা নাড়কেল আইসক্রিম কপালে জোটে- তবে সেতো সাপে বর। খুশিতে একেবারে গদ গদ অবস্থা। কাচ আর টিনের ফ্রেমে দিয়ে কৌটার মতো বাক্সে গোলাপী রঙের হাওয়াই মিঠাই ছেলেপুলের সখের রসনা। বড়দের এই হাওয়াই মিঠাই কেনায় বড্ড আপত্তি।কেননা এক প্যাকেট হাওয়াই মিঠাই মুখে দিতে না দিতেই একেবারে হাওয়া। কিন্তু হাওয়াই মিঠাই ওয়ালার হাতে পিতলের ঘন্টার টুংটাং শব্দ শুনলেই ছেলে-এড়ে- বুড়ো সব হাজির। মুখে বলতে থাকে এটা কিনে শুধু টাকা নষ্ট ,কিন্তু বাস্তবেই হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার লোভ কেউই সামলাতে পারে না। দাম ও বেশি না এই আট আনা বা বারো আনা হলেই এক প্যাকেট হাও্য়াই মিঠাই পাওয়া যায়। আর এই এক প্যাকেট তিন চারজনে অনায়াসেই মুখে দিতে পারে। বাড়ির গিন্নীদের সাথে অবশ্য তেল,নুন,সাবান,মশলা ফেরিওয়ালাদেরই খাতির একটু বেশি থাকে।
পাড়ায় যেকোন একটা বাড়ির বড়ো কোন ছায়াযুক্ত গাছের তলায় বসে পাড়া সুদ্ধ গিন্নীদের জড়ো করা আর নানান গল্পের তালে তালে জিনিস বিক্রিই এসব ফেরিওয়ালাদের প্রধান কাজ। কারো একটু নুন,কারো এক কাপ তেল, কারো মশলা, আবার কেউ সাবান আনেনি বলে নিজের স্বামীর বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ শুনিয়ে ভালো দেখে গোসল করা সাবানের চাহিদা পেশ, আবার কেউবা নিজের ছেলের বউয়ের উপর যতো কথা সব ঝালিয়ে ফেরিওয়ালার কাছে মনের দুঃখ মেটানোর চেষ্টা সবই চলেই সারাদিন জুড়ে। ফেরিওয়ালারাও কম যান না, তারাও নিজেদের বেচা-কেনা বাড়াতে বাড়ির গিন্নীর এসব নানান অভিযোগের সাথে তাল মিলিয়ে তুষের আগুন আরো উস্কে দেয়।আর বাড়ির গিন্নীও সাময়িক আপন ভেবে গরগর করে মনের সব কথা বলে দেয় ফেরিওয়ালাদের কাছে। গপ্পে গপ্পে তার বেচা বিক্রিও বেশ ভালোই হয়।এ রকম দিনে কম করে হলেও নানা রঙের ,নানা জিনিস নিয়ে ফেরিওয়ালারা মাতিয়ে রাখতো গ্রামের গৃহস্থের ঘর দুয়ার থেকে এ পাড়া ও পাড়া হয়ে এ বাড়ির উঠোন থেকে ও বাড়ির উঠোন।
আবার কেউ কেউ এসব ফেরিওয়ালাদের মাধ্যমে দুরের নিকট আত্বীয়ের কাছে সংবাদাদি পাঠাতো, সংবাদ নিতো। আবার বেশি খাতির রত্তি জমাতে পারলে কোন কোন দিন গৃহস্থের বাড়িতে দুপুরের খাবারের বন্দোবস্তও হয়ে যেতো। মাঝে মাঝে আবার বাড়ির দরজায় হাক দেয় ভিক্ষুকের দল।কপাল আর গৃহস্থের গিন্নীর মন মেজাজ ভালো থাকলে জোটে দু-মুঠ চাল বা আরো বেশি কিছু ।আর যদি গিন্নীর মেজাজ ভালো না থাকে তো “ফকিরের বেটা/বেটি মাফ করো”। খাবার তো দুরের কথা এক মুঠ চাল ও কপালে জোটার সম্ভাবনা নেই।
এদিকে একের পর এক আসতে থাকে ফেরিওয়ালাদের দল।কখনো চানাচুর ওয়ালা,কখনো আইসক্রিম ওয়ালা, কখনো ভাঙ্গাচুড়া বদল দিয়ে নুন বা মিষ্টি আলু ওয়ালা, কিংবা কাধের দু-পাশে ভাড় ঝুলিয়ে তেল,নুন,সাবান,জিলাপী ওয়ালা। আবার কখনো মাটির হাড়িতে খাটি সরিষার তেল ওয়ালা, বা আলতা,ফিতা,স্নো,পাউডার ওয়ালা।এক সময় গামছা দিয়ে গিট্টু দেয়া খাটো করে লুঙ্গি পড়া এসব ফেরিওয়ালাদের চোখে পড়তো বেশ। এখন সময় পাল্টিয়েছে ।যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ফেরি করা মানুষগুলোও তাদের বেচাকিনির ধরন বদলিয়ে হয়েছে অনেকটা আধুনিক। তাদের আর বাড়িতে বাড়িতে ফেরি করে জিনিস বেচতে হয় না। আবার ঘরের গিন্নীরাও আজকাল ঘর সংসার নিয়ে বেজায় ব্যস্ত।তাদের সময় কোথায় ফেরিওয়ালাদের সাথে রসিয়ে রসিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প গুজব করার।ছোট্ট ছোট্ট ছেলে-মেয়েদের ও আর দু-চার আনার চানাচুর বা জিলাপী কিংবা হাও্যাই মিঠাইয়ে মন ভরে না। এখন তাদের চাই নানা স্বাদের বার্গার,কাবাব,রোল, পিতজা সহ নানা ধরনের আধুনিক খাবারের। চাই ভিন্ন স্বাদের বিদেশী ব্র্যান্ডের নানান নামের খাবারের। তাই ফেরি করা মানুষগুলোও আজ দেশীয় রীতি ছিকেয় তুলে আধুনিক হয়েছে।আর তাইতো প্রযুক্তির কল্যানে বিভিন্ন অনলাইন সাইট চালু করে দিয়েছে কেনাকাটার সব বাহারি নাম ।