পাবলো নেরুদার নোবেল-ভাষণ
ব্যাপারটি যদি এমন হয় যে একজন কবি, তাঁর কবিতা, তাঁর দেশ, মানুষ এবং পুরো পৃথিবীর মানচিত্র – এসব যদি এক জায়গায় জড়ো করা যায়, তবেই তার সঙ্গে তুলনা চলে পাবলো নেরুদার নোবেল-ভাষণের অসাধারণ প্রাঞ্জল ভাষার। গভীর দার্শনিক উপলব্দিতে মানবজাতির সমুদয় আবেগ তিনি ধারণ করেছেন তাঁর ভাষণে। এ ভাষণ বলে দেয় তিনি একক নন, তিনি সমগ্র। চিলি শুধু তাঁর দেশ নয়, তাঁর করতলের রেখাগুলো পৃথিবীর নদী এবং করতলের পুরো অংশ বিশ্বব্রহ্মান্ড। মানুষ সেই করতলের উপরে প্রবহমান অন্তহীন স্রোত। কবি নেরুদা সেই অন্তহীন স্রোতের মিশেলে দর্শনার্থী মানুষ।
তিনি যে বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন সে বছর বীর বাঙ্গালী স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে লড়াই করেছে। ১৯৭১ সাল। একইসঙ্গে বাঙ্গালীর মহান মুক্তিযুদ্ধের বছর। তিনি তো সেই মানুষ যিনি কবিতায় মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্নকে উজ্জীবিত করেন। যেমন রাশিয়ার বিপ্লবের সময় পুশকিনের কবিতা থাকতো বিপ্লবীদের পকেটে। স্বাধীনতার জন্য মানুষ পাহাড়ি পথে বন্দুক হাতে অনায়াসে প্রতিরোধ গড়ে তোলে- জঙ্গলের পথে নির্ভয়ে হেঁটে যায়, যুদ্ধকালীন সময়ে নদীগুলো মানুষের সঙ্গী হয়। ধানক্ষেতে ধানের শীষগুলো প্রবল বাতাসেও স্থির হয়ে যোদ্ধার শরীরকে আড়াল করে রাখে শক্রর দৃষ্টি থেকে। অবিস্মরণীয় একাত্তর সালে, অবিস্মরণীয় ভূখন্ডে, অবিস্মরণীয় মানুষেরা স্বাধীনতার জন্য উচ্চারণ করেছিল ঐশী বাণী। কবি তাঁর কবিতার আবেগে মথিত করেন মানুষের স্বপ্ন।
১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর পাবলো নেরুদা নোবেল ভাষণ প্রদান করেন। এর পরদিনই বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ সম্পন্ন করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। তারা জানতো একটি দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় দেশ ও জাতির আলোকিত অংশ। তাদের ধ্বংস করলে ধ্বংস করা হয় জাতির মেধা, মনন ও বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার ক্ষেত্র। যে জ্ঞান জাতিকে সমুন্নত করে তার অবসানে জাতি তার মৌলিকত্ব হারায়। কবি নেরুদার ভাষণে বিধৃত হয়েছে দেশ ও জাতি সম্পর্কে তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা-বিধৃত হয়েছে দেশ ও জাতির প্রতি তাঁর গভীর অঙ্গীকারের প্রত্যয়।
বর্ণনার ব্যাপ্তি, গভীরতা এবং নিসর্গের সৌন্দর্যের দ্যুতি এই ভাষণের প্রতিটি শব্দে বিচ্ছুরিত। ভাষণে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে চিলির জনগণ, একইসঙ্গে চিলির সীমানার প্রতিবেশী রাষ্ট্র আর্জেন্টিনা কিংবা ইউরোপের ভূখন্ড সুইডেন-যে দেশ নোবেল পুরস্কারের আয়োজক। সে দেশ সম্মানিত করেছে একজন কবিকে, যে কবির দিকে তাক করা থাকে শক্রর বন্দুকের নল। সে শক্র দেশের ভেতরে কিংবা বাইরেরও হতে পারে। সৃজনশীল মানুষের শক্র তার লেখনীর শক্তি। তাই লেখনীর নিধন চায় ফ্যাসিষ্ট বাহিনী। এই ধারাবাহিকতায় জীবন দেয় স্বাধীনতার একদিন আগে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা। তাদের স্বপ্নেও নিজ মাতৃভূমিকে এই গ্রহের একটি উজ্জ্বলতম নক্ষত্র দেখার ছায়া আছে।
কবি শুরু করেছেন এভাবে, “আমি যা বলতে চাই তার জন্য আমাকে অনেক দূরে যেতে হবে। এ আমার নিজস্ব ইচ্ছার যাত্রা – যেতে হবে দূরে – দূরান্তে – পার হতে হতে যেতে হয় ভূ-নিসর্গ এবং আলোকিত উত্তরের নৈঃসঙ্গ পেরিয়ে। আমি আমার দেশের দক্ষিণতম ভূখন্ডের কথা বলছি। আমরা চিলিবাসীরা, সরে যেতে যেতে প্রত্যন্ত প্রান্তে পৌঁছে যাই। আমাদের দেশের সীমানা স্পর্শ করে দক্ষিণ মেরুর প্রান্তে। এ দৃশ্যে ডুবে যাই সুইডেনের ভূগোলের চিত্রে, যে দেশের মাথা এ গ্রহের তুষারাবৃত্ত উত্তর মেরুর শীর্ষ ছুঁয়ে থাকে।”
ভাষণের এই শুরু কবির অনুভবের প্রগাঢ় ব্যঞ্জনা দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে চলে যায়। কবি আর চিলিতে আটকে থাকেন না। তিনি সময়কেও অতিক্রম করেন। গ্রন্থিত করেন অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। জেগে ওঠে মানুষের রূপ-উজ্জল মুখচ্ছবি। যে মানুষ অপরিমেয় শক্তি নিয়ে জীবনের পক্ষে পথ দেখায়।
নেরুদা ভাষণে বলেছেন, We had to cross a river. ঘোড়াসহ এই নদী পার হওয়ার কথা বলেছেন কবি। এটা কি জীবন নদী? পার হওয়া ভীষণ কষ্টের, পার হওয়ার সময় প্রবল জলের ভেতরে অতি কষ্টে নাক জাগিয়ে রাখে কবির ঘোড়া। কবি নিজে টাল সামলাতে সামলাতে পা আছড়ান জলের ভেতর। নদীর অপর পাড়ে পৌঁছুতে হবে? শেষপর্যন্ত সব বাধা অতিক্রম করে কবি অপর পাড়ে পৌঁছে যান। সেখানে অপেক্ষা করে দেহাতী মানুষেরা। তাদের ঠোঁটে মৃদু হাসি। ভাষণের এই জায়গায় কবি সংলাপ ব্যবহার করেছেন। দেহাতী মানুষেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করে- “ভয় পেয়েছিলেন কি?”
‘বলি : পেয়েছিলাম তো বটেই। ভেবেছিলাম আজই বুঝি আমার বেঁচে থাকার শেষ দিন।
তারা বলে : আমরা তো আপনার পেছনে ল্যাসো হাতে দাঁড়িয়ে আছি। তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা।
আর একজন বলে : আমার বাবা ঠিক ওই জায়গায় পড়ে গিয়েছিলো। তারপর স্রোতের টানে ভেসে যায়। আমরা দ্বিতীয়বার এমন একটি ঘটনা ঘটতে দিতাম না।’
এই মানুষ কারা? কারা এমন সাহসের কথা বলেন? এমন নির্ভয়ে? কবি তাদের চেনেন। ১৯৬৬ সালের পি.ই.এন. কংগ্রেসে পাবলো নেরুদা বলেছিলেন- “Speak in the name of those who cannot write, if the poet did not make himself the spokesman of the human condition, what else was there for him to do.” যারা লিখতে পারে না, জীবন যাদের কাছে বোঝা হয়ে যায়, সেইসব মানুষদের নিয়ে তিনি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন, যেসব মানুষেরা তাঁকে হারাতে চায় না, যেসব মানুষেরা তাঁকে রক্ষা করার জন্য তৈরি হয়ে ওঠে।
ভাষণে তিনি লিখেছেন, এইসব মানুষেরা তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া বিশাল সুড়ঙ্গ পথে। নিয়ে গেছে এবড়ো-থেবড়ো পাথুরে পথে- যেখানে পা ফেললে প্রতি মুহূর্তে পরে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে। তবু ঘোড়াগুলো এগুতে থাকলে খুরের ঘর্ষণে আগুনের ফুলকি ছোটে, ওদের পা রক্তাক্ত হয়, নাক দিয়ে রক্ত পড়ে। কিন্তু তারপরও তিনি একগুয়ের মতো অপূর্ব অথচ দুর্গম পথ অতিক্রম করতে থাকেন।
তিনি লিখেছেন- এমন গভীর অরণ্যসংকুল পথের মধ্যে অকস্মাৎ দৈববাণী পাওয়ার মতো পেয়ে যান অসাধারণ সুন্দর ছোট তৃণভূমি, যেন পাথরের আদুরে কন্যার মতো তার কোল ঘেঁষে শুয়ে আছে। তারা সেখানে দাঁড়িয়ে পরেন। তৃণভূমির পাশ ঘেঁষে পাথরের মধ্যে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছতোয়া ধারা, সবুজ ঘাস সুস্থির, অরণ্যকুসুম, স্রোতাস্বিনীর কলধ্বনি, সুনীল আকাশ এবং পাতার ফাঁকে গড়িয়ে পড়া আলোর বর্ণিল নক্সা দেখে তিনি নড়তে পারেন না। যেন তার চারদিকে জাদুর বৃত্ত তৈরি হয়েছে। যেন তিনি কোনো পবিত্র অনুষ্ঠানে ঢুকে পড়েছেন। ঘোড়সওয়াররা ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পরেছে। ফাঁকা জায়গায় রাখা ছিল ষাঁড়ের মাথার খুলি। তাঁর সঙ্গীরা সারি বেঁধে নিঃশব্দে এগিয়ে যায়। খুলির চক্ষুকোটরে তারা রেখে দেয় কয়েকটি ধাতব মুদ্রা ও সামান্য খাদ্য। তিনিও তাদের সঙ্গে পবিত্র অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে অর্ঘ্য নিবেদন করেন। এসব তারা রেখে দেন ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো পথিকদের জন্য যারা মৃত ষাঁড়ের চক্ষুকোটর থেকে এসব খুঁজে বের করে নিজেদের প্রয়োজনে লাগাবে।
কবির ভাষণের এমন বর্ণনা শুধু চমকিত করে না, তাঁর দার্ঢ়্য মানসভূমির পাটাতন উন্মোচন করে খুঁজে পাওয়া যায় পৃথিবীর মানচিত্রের অতল ছবি, যার সবটুকু তাঁর শিল্পের উপাদান। তার ভাষণের পথ-ভ্রমণের বর্ণনা নিছক কাব্য নয়, জীবনের দিকদর্শন। কোথায় থেকে খুঁজতে হবে ইতিহাসের উপকরণ, কিভাবে তৈরি করতে হবে শিল্পভুবন তাঁর সবটুকু বিম্বিত হয় প্রতিটি শব্দের স্ফটিক শিশিরবিন্দুতে। এ এক অসাধারণ ভাষণ। পূর্ণ জীবনের পূর্ণকথা। কবির অভিজ্ঞতার এবং জ্ঞানের সংশ্লেষে তৈরি হওয়া দিগন্তজোড়া কাব্যকথা, যা পৃথিবীর যাবতীয় মানুষের উত্তরাধীকার হয়ে ওঠে।
তিনি বলেছেন- I did not learn from book any recipe for writing a poem… তাঁর ভাষণই প্রমাণ করে যে কবিতার ফর্মূলা দিয়ে কবিতা লেখার জন্য তাঁর জন্ম হয়নি। নিজের পারিপার্শ্বিকের খড়কুটা, ইটের দালান, পনির, আগুন, পাথর, ঘোড়া, নদী, গেঁয়ো মানুষেরা এতই শক্তিশালী যে কবিতার কলসটি উপচে ফেলার জন্য যথেষ্ট। তিনি কেন বই পড়ে লিখবেন? তাঁর রচনাইতো অন্য বইয়ের উপাদান হবে। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন একজন কবির সবচেয়ে বড় শক্র তাঁর অক্ষমতা। অক্ষমতা সমকালের অবুঝ ও নির্যাতিত মানুষদের নাড়ির স্পন্দন বুঝতে না পারার। এই ভাষণে ও যেন ধ্বনিত হয় ’৬৬ সালের সেই কথাগুলো, শুধু শব্দগুলো ভিন্ন … no poet has any considerable enemy other than his own incapacity to make himself understood by the most .forgotten and exploited of his contemporaries, and this applies to all epochs and in all countries…সব সময়ের, সব জাতির জন্য একথা প্রযোজ্য। লেখকের দায় এভাবে চিহ্নিত করছেন কবি।
তিনি লিখেছেন- poet is not a `little god’ না, কবি কখনো ক্ষুদে ঈশ্বর নন। সবচেয়ে বড় কবি তিনি, যিনি সবার জন্য প্রতিদিনের রুটি বানাতে পারেন। তিনিই বড় যিনি মানুষের কর্মযজ্ঞের মাঝ থেকে শিল্পের প্রজ্ঞা খোঁজেন। তাকে অংশ নিতে হয় জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার উপকরণে অর্থাৎ সমাজের সরল অথবা জটিল নির্মাণ কৌশলে, মানুষের অবস্থার পরিবর্তনে, ঘরগেরস্থির প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদনের কার্যক্রমে- যেমন রুটি, সততা, সুরা এবং স্বপ্ন। কত চমৎকারভাবে কবি মানুষের বেঁচে থাকার বস্তু রুটি এবং সুরার সঙ্গে সততা এবং স্বপ্নকে এক করেছেন। কোনো কিছুই জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন অংশ নয়। রুটি যেমন বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য সততা তেমনি; সুরা যেমন দিনযাপনের একটি উপাদান স্বপ্নও তেমনি। কোনোটাকে বাদ দিয়ে বেঁচে থাকা অর্থহীন।
যে জন্য কবি অনায়াসে লেখেন- bread, truth, wine, dreams.
কবিই মানুষের অনিঃশেষ লড়াইয়ের নিরন্তর সঙ্গী। তিনি লিখেছেন মানুষের প্রতিদিনের কাজের প্রতি কবির অঙ্গীকার ও মমতা সমুন্নত থাকবে। কবি তার অস্তিত্বের খানিকটা অংশ রেখে দেবেন এইসব কাজের জন্য। তাঁর মানবিক বোধকে সংশ্লেষ করবে মানবতার গভীরতম বৃহত্তম সর্বত্রগামী স্রোতের সঙ্গে। কবিইতো সেই মানুষ যিনি সমগ্র মানবতার শ্রমের স্বেদবিন্দু, অন্নের অধিকার, সুরার স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বপ্নের দিগন্ত- …the poet will take part, in the sweat, in the bread, in the wine, in the whole dream of humanity.
তিনি আবার পেছনে ফিরে গেছেন। লিখেছেন- দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বয়ে আসা মানুষের দুর্দশাগ্রস্ত জীবন। অথচ এইসব মানুষের অমিত শক্তি ছিল, জ্ঞানের তেজ ছিল-তারা ধাতু ও পাথর দিয়ে নির্মাণ করেছিলো অপরূপ অবিস্মরণীয় মিনার, চোখ ঝলসানো কত রত্নরাজি-এইসব মানুষেরা একদিন নিজেদের দেখতে পায় ঔপনিবেশিকতার ভয়াবহ বোবা প্রাণী। এসবের মাঝে কবির কাছে সংগ্রাম ও আশা ধ্র“বতারার মতো জ্বলজ্বলে আলো, যা মানুষকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে- our original guiding stars are struggle and hope. তারপরও সংগ্রাম ও আশা অনেক কিছুর সমন্বয়। মানুষকে এই সমন্বয়ের ভেতরেই নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করতে হয়।
তিনি আরও লিখেছেন- আমার নিজের দেশে যে সমস্ত পরিবর্তনসমূহ সাধিত হয়েছে তার মধ্যে আমার সামান্যতম ভূমিকা নিয়ে যদি গর্ব করতে না পারি, তাহলে সুইডেনের মাটিতে দাঁড়িয়ে যে সম্মানে ভূষিত হয়েছি সেজন্য কি নিজের মাথা সোজা রাখতে পারবো?
এভাবে স্বদেশের চিন্তায় তাঁর গভীর অন্বয় এবং সম্পৃত্ততা বিপুল আঁধার তৈরি করে, যা মানবজাতির কল্যাণের জন্য অবিনাশী পংক্তি। একজন কবির এই অনুরাগ, অঙ্গীকার, স্বপ্ন, অক্ষমতার গ্লানিবোধ, দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকদের বিবেকের জন্য প্রবল তাড়না। এই বৃশ্চিক দংশন ক্ষমতায় আসীন দূর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদরা অনুভব করে না বলেই সাধারণ মানুষের জীবনের দুর্ভাগ্যের অবসান হয় না।
নেরুদা তাঁর ভাষণে র্যাঁবোর কথা স্মরণ করেছেন। ফরাসী কবি র্যাঁবো। শতবর্ষ আগে দুর্ভাগ্যপীড়িত অথচ শ্রেয়কল্প সত্যদ্রষ্টা এই কবি যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তিনি তা গভীরভাবে বিশ্বাস করেন। তিনি বলেছেন- আমি এক অন্ধকার এলাকা থেকে এসেছি, এমন এক দেশ থেকে যার নির্মম ভৌগোলিক সীমানা তাকে অন্যদের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। কবিতার সাম্রাজ্যে আমি একজন পরিত্যক্ত কবি, আমার কবিতা আঞ্চলিক, বর্ষণসিক্ত দিনের মতো বিষাদাচ্ছন্ন। কিন্তু আমি সর্বদা মানুষের প্রতি বিশ্বাস রেখেছি। কখনোই নিরাশ হইনি। আশা হারাইনি। এজন্যই হয়তো আমার কবিতা এবং পতাকা নিয়ে এখানে উপস্থিত হতে পেরেছি। ভাষণের শেষে তিনি আবার র্যাঁবোকে স্মরণ করেছেন। স্বপ্নদ্রষ্টা কবির স্বপ্নের ভেতর নিজের, শুভার্থী মানুষদের, শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ অবলোকন করেছেন।
র্যাঁবো বলেছেন- একমাত্র আত্মপ্রত্যয়-ই অদম্য আকাঙ্খার জিয়নকাঠি যা দিয়ে আমরা জয় করতে পারি একটি অপরূপ নগরী-যা মানবজাতিকে আলো দেবে, ন্যায় দেবে এবং আত্মমর্যাদা দেবে- only with a burning patience can we conquer the splendid city which will give light, justice and dignity to all mankind.
র্যাঁবোর এই বাক্যের পরে নেরুদা তাঁর ভাষণ শেষ করেছেন এই বাক্য দিয়ে- In this way the song will not have been sung in vain. সৃজনশীল মানুষের সঙ্গীত অনিঃশেষ এবং তা কখনো বৃথা যায় না।
একজন মহান কবির এই দীর্ঘ ভাষণ নিজের মধ্যে ধারণ করা দুঃসাধ্য কাজ। আমার মতো আকারে এবং মেধায় ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে সেটা আরো অসম্ভব ব্যাপার। হিমালয় সমান এই র্দীঘ ভাষণের সামনে আমি একজন অকিঞ্চিৎকর ব্যক্তি। তবে সর্বত্র কবি শব্দটি ব্যবহার করে তিনি সৃজনশীলতার নিঃসরণকে গভীর জলাশয়ে মিলিত করেছেন। এই ভাষণে আমি কবিকে বুঝেছি সৃজনের শক্তি হিসেবে। কবি এখানে শিল্প মাধ্যমের একক নয়, কবি এখানে সমষ্টি। এই সমষ্টি দিয়েই তৈরি হয় মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রা। যে অগ্রযাত্রার কথা ভাষণের প্রতিটি শব্দের ভেতরে সমগ্রের ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত।