অনেকদিন আগের কথা। বরিশাল জেলার সদর থানার চাঁনপুরা ইউনিয়নের তালুকদার বাড়িতে সেদিন ছিল বিয়ের উৎসব। বাড়ির সামনেই ছিল তালুকদারহাট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। সেই কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন তালুকদার বাড়ির সেজছেলে জাহাঙ্গির তালুকদার। আর বড়ছেলে আনিস তালুকদার ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তারা সবসময় ছাত্রদের শিখাতেন, কীভাবে মানুষকে ভালবাসতে হয়, কীভাবে মানুষের উপকার করতে হয়। সে সাথে তারা বলতেন, বনের পশু-পাখিদের কথা, এরা নাকি উপকার করলে প্রতিদান দিতে ভুল করে না। তালুকদারদের এসব কথা শুনে কলেজ পড়–য়া ছেলে মেয়েরা হেসে খুন হতো। আর একে অপরের সাথে বলতো, হেডমাস্টার আর প্রিন্সিপাল বুড়ো হয়ে গেছে।
সে যাই হোক। তালুকদার বাড়ির বিয়ে বলে কথা। পুকুরের বড় বড় মাছ ধরা হয়েছে। গরু জবাই হয়েছে। আশেপাশের দু’দশ গ্রামের সব আত্মিয়-স্বজন-প্রতিবেশি এসে জড়ো হয়েছে এ বাড়িতে। বাচ্চাদের মধ্যে হৈ হুল্লোর চলছে। অনেক বাচ্চারা একসঙ্গে গিয়ে বসে আছে স্কুলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি খালের পাশে। এটি কীর্তোণখোলা নদীর একটি শাখা নদ। বর ও কনে লঞ্চযোগে এইপথে বাড়িতে আসবে। তাই বাচ্চাদের এ অপেক্ষা। এদিকে বিবাহ উপলক্ষে বাড়িতে আসা মেহমানদের একজন বন্দুক নিয়ে বের হয়েছে পাখি শিকারে। তারা ঘু ঘু পাখির ডাক শুনে শুনে ছুটছে শিকারের জন্য। এভাবে তারা গিয়ে পৌছেছে বরিশালের ঐতিহ্যবাহী একটি পর্যটন স্পট গজনীর দিঘি নামের স্থানে। নদের পার থেকে তাদের যেতে দেখে কৌতুহল বশে স্কুলের একজন ছাত্র সমীর তাদের পিছু নিয়েছে। শিকারী ও তার সঙ্গের ৪জন ওকে দেখে বলে, এই তুই আসিছ না। যা ভাগ।
তখন কেউ একজন শিকারীর কানে কানে বলে এ তালুকদারদের সবার ছোটভাই। আর সকলের খুব আদরের। এ কথা শুনে শিকারী লজ্জাপায় এবং আপনি করে কথা বলে। অন্যরা তখন খুব খাতির করতে থাকে এবং ওকে ঝোলা থেকে একে একে পাঁচটি পাখি বের করে দেখায়। বলে এগুলোর দুটো আপনার। গুলি খেয়ে মারা যাওয়া পাখিদের দেখে সমীরের চোখ ছলছল করে ওঠে। ওর বড়ভাইরা ওকে শিখিয়েছে পাখিরা কত উপকারী। কখনো কারো কোনো ক্ষতি করে না।
তখন ও চিন্তা করে এ শিকারীদের শিক্ষা দিতে হবে। ও বলে, গজনীর দিঘিতে অনেক পাখি আছে। ডাহুক আছে। শিকারীরা তখন ওকে সাথে নিয়ে গজনীর পাড়ে যায়। সেখানে গিয়ে একসঙ্গে অনেক পাখির কোলাহল শুনে শিকারীরা খুব অবাক হয়। তারা পাখির ডাক লক্ষ্য করে বন্দুক বাগিয়ে ছোটে। গজনীর পাড়ে জঙ্গল তখন খুব ঘন ছিল। আশেপাশের এলাকার মানুষেরা সেখানে যেত না। এ পাড় নিয়ে আজো অনেক লোককাহিনী প্রচলিত আছে। এখনো নাকি এ দিঘির জলে স্বর্নের নৌকা ভাসে। মানুষ কোনো মানত করে পুকুরের পাড়ে ডাল ছিটিয়ে গেলে তার ইচ্ছা পূর্ণ হয় ইত্যাদি।
যাই হোক, শিকারীরা সে জঙ্গলে ঢুকে গেল। পাখিদের ডাকে তারা সমীরের কথাও ভুলে গেল। গজনীর জঙ্গলে আলো খুব কম। আর বছরের সবসময় এখানের একটা জায়গায় কোমড় পর্যন্ত কাঁদা থাকে। দিনের বেলাতেও কেউ ভুলে সেখানে যায় না। তারওপর রয়েছে বাতাস ফকির নামের কোনো এক সাধুর কবর। সে কবর পাহারা দেয় ভয়াল কালো দুটো বিড়াল। ঐ বিড়ালের চোখ নাকি বাঘের চেয়েও ভয়ংকর। কোনো মানুষ ঐ বিড়ালের চোখে তাকালেই সে পথ হারিয়ে একই জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। যেমনটি বন্দুকের গুলির শব্দে এ মুহূর্তে পাখিরা ভয় পেয়ে একই জায়গায় ঘুরছে। সমীর জঙ্গলের বাহিরে দাঁড়িয়ে পরপর দুটো গুলির শব্দ শুনতে পেল। দেখলো ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি ভয় পেয়ে ওর মাথার ওপর দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ আর কোনো শব্দ নেই। তখন ও বাড়ির পথ ধরলো। পথে এক জায়গায় দেখে কি একটা ঝোপের ভিতর কিছু একটা লড়ছে। ঝোপ ফাঁক করে দেখে একটি ঘুঘু পাখির বাচ্চা ভিতরে ছটফট করছে। পাখিটার গায়ে কাটাও বিধেছে। ও পাখিটা হাতে নিল ও কাটা খুঁজে বের করে দিল। ভালো করে খুটিয়ে দেখলো, না কোথাও গুলি লাগেনি। তখন বুঝলো পাখিটা অল্প অল্প উড়তে পারে। গুলির শব্দে ও ভয়ে পালিয়েছে। পাখিটাকে নিয়ে আবার গজনীর পাড়ে গেল, সেখানে পাখিটাকে একটু পানি খেতে দিয়ে এ গাছ-ও গাছে উকি দিয়ে ওর বাসা খুজল। কিন্তু কোনটায় যে পাখিটার বাসা তা বুঝতে না পেরে একটা বড় গাছে চড়ে সেটার নিরাপদ একটা ডালে পাখিটাকে বসিয়ে দিলো। ততক্ষণে বাচ্চা পাখিটার ডাকশুনে চারপাশে মা পাখি ও বাবা পাখি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। উঁচুডাল থেকে উঁকি দিয়ে সমীর দেখতে পেল শিকারী ও তার সঙ্গের লোকেরা কোমড় সমান কাঁদার ভিতর দাঁড়িয়ে কি যেন খুঁজছে। তারা কাঁদা থেকে মুক্ত হবার জন্য লড়াই করছে। এ দেখে ও বাড়ি চলে এলো। এদিকে বিয়ে বাড়িতে তখন সবাই এসে গেছে। কিন্তু সমীরকে খুঁজে না পেয়ে বর-ও কনে লঞ্চ থেকে নামছে না। অবশেষে গায়ে কাঁদা মাখা অবস্থায় যখন ও গিয়ে হাজির হল লঞ্চঘাটে। বর ও কনে দু-জনই ওকে প্রথমে বকলো তারপর জড়িয়ে ধরল। এতে তাদের গায়ে কাদা লেগে যাবার ভয়ে ও সরে যেতে চাইলেও বর-ও কনে কেউই ওকে ছাড়লো না। ফলে তাদের গায়ে কাদা লেগে গেল। আর কনে ওর কান ধরে জানতে চাইলো কোথায় হারিয়ে গেছিলি? ও তখন কনের কানে কানে বলে দিল শিকারীদের ফাঁদে ফেলার গল্প। শুনেতো বর ও কনে দুজনেই হেসে খুন।
সন্ধ্যার অনেকপরে শিকারী ও তার সঙ্গীরা খালিহাতে এসে হাজির। তাদের সারাগায়ে কাদার প্রলেপ। জানা গেল কাদার ভেতর বন্দুক, জুতো সব ফেলে এসেছে। আরও জানা গেল শিকারী আর কেউ নয় সম্পর্কে কনেরই মামা। এ শুনে বাড়ির চাকর বাকর ছুটে গেল কাদা থেকে তাদের বন্দুক ও জুতো উদ্ধারে। আর কনে গেল সমীরের হয়ে তার মামার কাছে ক্ষমা চাইতে।
পরদিন সকালে চারিদিকে গুজুব ছড়িয়ে পড়লো যে কনের নাকফুল হারিয়ে গেছে। কীভাবে হারালো। বর কনে রাতে শর্শেক্ষেতে শিশির ধরতে গিয়েছিল। সেখানে বরের হাত লেগে নাকফুল পরে গেছে। এ নিয়ে মুরুব্বিরাতো না অমঙ্গলের কথা রটাতো লাগলো। মুরুব্বীদের কথাশুনে নতুন বৌ কাঁদছে। সমীর তখন ছুটে গেল শর্ষে ক্ষেতে। অনেক সময় ধরে ও নাকফুল খোঁজে। কিন্তু খুজে পায় না। জমির মাঝের যে আইল (পায়েচলা পথ বা শিল্লা ) সেখানে ও বসে বসে খোজে। এমন সময় দেখে কি দুটো ঘুঘু ক্ষেতের ভিতর হাটছে আর ঘু ঘু ঘু ডাকছে। একটা ঘু ঘু আইলে ওপর উঠে ঘাসে ওর মুখ ঘষলো। আর তখনই কিছু একটা ঝিলিক দিয়ে উঠলো সেখানে। সমীর কাছে গিয়ে দেখে ফুলের বোটার মতো কিছু একটা। ও হাতে নিয়ে বুঝলো এটাই ওর ভাবীর নাকফুল। ও দৌড়ে বাড়িতে গেল এবং এটি ভাবীর হাতে দিয়ে বললো, দেখতো এটা তোমার নাকফুল কি না। ভাবীতো অবাক। বলে হ্যাঁ।
সবশুনে ভাবী বললো, তুমি যে কাল পাখিদের উপকার করলে, তাই আজ ওরা তা শোধ করে গেল। তখন পুরো চাঁনপুরা গ্রামে রটে গেল এ ঘটনা। এরপর থেকে এ গ্রাম ও এর আশেপাশের গ্রামে কেউ আর কখনো পাখিদের শিকার করে না। এমনকি ছোটবাচ্চারাও গুলোই নিয়ে কোন পাখি মারে না। তালুকদার বাড়ির বড়ভাইয়েরা যে স্কুলে ভুল শেখায় নাÑ গ্রামের সবাই সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করলো। আর কলেজ পড়–য়া যে ছাত্ররা অবিশ্বাস করছিল তারা খুব লজ্জা পেল। এই সমীর তালুকদার পরে এই তালুকদারহাট স্কুল থেকেই মেট্টিকে যশোর বোর্ডে অস্টম প্লেস পেয়েছিল এবং সে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিলাতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। তার যে আরও একটি ছোটভাই আছে, আর সে এখনো ইমিডিয়েট বড় ভাইটির প্রতিক্ষায় দিন গুনে যায়।