পদ্মা সেতুর সুফলঃ উন্নয়নের বরিশাল (সমস্যা ও সম্ভাবনা)
নদী তীরের শহর বরিশাল হতে পারে উৎপাদনশীল ও বাণিজ্যিক একটি শহর। পর্যটন শিল্পকে বাদ দিলেও এখানের নদী তীর এলাকা হতে পারে উইন্ডমিলের নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। পেয়ারা, কাঠাল ও নারিকেল হতে পারে শিল্পকারখানা স্থাপনের উপকরণ। অথচ রাজনৈতিক অবিবেচনা ও দূরদর্শিতার অভাবে বিভাগ ঘোষণার ২০ বছর পরও গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়েই এখনো পরনির্ভরশীল জাতি আমরা বরিশালবাসী। কথাগুলো আমার নয়, বলেছেন বরিশালের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি অনেকেই।
পায়রা ও পদ্মা সেতু চালু হবার কারণে বদলে গেছে এ অঞ্চলের যোগাযোগ প্রেক্ষাপট। মাত্র ছয়ঘন্টায় আমরা এখন পৌঁছে যেতে পারি ঢাকা থেকে কুয়াকাটা। বরিশাল থেকে ঢাকা এখন সাড়ে তিনঘণ্টার পথ। আর নদী পথেও বাড়ছে এই দূরত্ব কমানোর প্রতিযোগিতা। তারপরও নদী নির্ভরতা কাটেনি কিন্তু। কখনোই কাটবেনা তা। এখনো ৪০ ভাগের বেশি মানুষ এ অঞ্চলে নদী নির্ভর। এদের অনেকেরই আবার নদী তীরবর্তী এলাকায় বসবাস। প্রতিনিয়ত ভাঙনের ঝুঁকি নিয়ে আতঙ্কিত জীবন তাদের।
স্যাটেলাইটে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর গবেষণা করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএস ২০১৭ সালের আগস্টে দেশের ২৯টি স্থানকে নদী ভাঙনের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো। পরবর্তীতে টেকসই বাঁধ ও প্রকৌশলী দক্ষতায় চলতি বছর তা কমে এসেছে। চলতি বছর সিইজিআইএস পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ১৩ জেলা ভয়াবহ নদীভাঙনের কবলে পড়তে পারে। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদীর ভাঙনে এসব জেলার প্রায় ২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিলীন হতে পারে। এছাড়া নদীতে পৌনে চার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, ২৪১ মিটার মহাসড়ক, সাড়ে তিন কিলোমিটার জেলা ও দেড় কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক চলে যেতে পারে। ভাঙনে দোকানপাট, বসতবাড়ি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাটবাজার এমনকি হাসপাতালও বিলীন হতে পারে। প্রধান তিনটি নদীকে ঘিরে এ পূর্বাভাস দেওয়া হলেও বাস্তবে মেঘনা, সুরমা-কুশিয়ারাসহ অন্যসব নদীতেও প্রতি বছর তীব্র ভাঙন দেখা দেয়। বর্ষা মৌসুম শেষে বা বন্যার পর বঙ্গোপসাগরে হু হু করে পানি নামতে থাকায় মেঘনার নিম্নাংশ বা চাঁদপুর থেকে একদিকে বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর; আরেকদিকে ভোলা, লক্ষ্মীপুরেও প্রতিবছর ব্যাপক ভাঙন দেখা দেয়। বিশেষ করে তেঁতুলিয়ার কারণে পটুয়াখালীর বাউফল, ভোলার বিভিন্ন স্থানে, লোহালিয়ার কারণে বাউফলের কালিশুরী, দুমকীর চরগরবদী, বরিশালে সন্ধ্যা ও সুগন্ধা নদীর কারণে ভয়াবহ ভাঙন চলছে। এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক পর্যালোচনা খুব কমই হয়। সিইজিআইএসও এ নিয়ে কাজ না করায় প্রকৃত চিত্র হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে। যদিও বরিশালের সন্ধ্যা ও কীর্তনখোলা নদীর ভাঙন রোধে টেকসই বাঁধ তৈরির কাজ করছে পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। তবে তা কতটা টেকসই হচ্ছে সংশ্লিষ্টরাই ভালো বলতে পারবেন। সরেজমিনে চরকাউয়া অংশের বাঁধ প্রশংসনীয় বলতেই হবে। তবে কীর্তনখোলা নদী তীরবর্তী নগরীর ডিসি ঘাট থেকে ত্রিশ গোডাউন পর্যন্ত বনায়ন ও পায়েচলা পথ নগরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবী। এপথে মুক্তিযোদ্ধা পার্ক পার হলেই বস্তিবাসীর অবৈধ স্থাপনা দোকানপাট কেডিসি ঘাট পর্যন্ত বাবা হয়ে দাড়িয়ে আছে। সড়কের প্রশস্ততা বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে দাবী নগর চিন্তাবিদদের।
পদ্মা সেতুর সুফল ভোগ করতে হলে বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে সবার আগে অবশ্যই ফোরলেনের সুবিধা পেতে হবে। এ বিষয়ে একমত সরকার সয়ং। অথচ স ও জ কতৃপক্ষ জমি অধিগ্রহণ করতে না পারায় চারবার বরাদ্দকৃত অর্থ ফেরত দিতে হয়েছে বলে জানা গেছে। এ সংকট দূর করতে নাগরিক মতবিনিময় জরুরী। শুধু ফোরলেনেই যে সমস্যার সমাধান হবে তা কিন্তু নয়, বরিশাল মহানগর ট্রাফিক সুত্র বলেছে, অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে আগামী চার বছরে বরিশাল সিটি ঢাকার গুলিস্তানের মতো যানজটে পড়বে।
বরিশাল সিটি করপোরেশন (প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হীরন এর সময়ের পরিসংখ্যান ও ২০১৫ সালে তথ্য অনুযায়ী ১৮৬৯ সালে বরিশাল টাউন কমিটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ও ১৮৭৬ সালে বরিশাল মিউনিসিপ্যালিটিতে উন্নীত হয়। ১৯৮৫ সালে একে একটি প্রথম শ্রেনীর পৌরসভা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ২০০২ সালে “বরিশাল সিটি কর্পোরেশন (সংশোধন) আইন ২০০২” এর মাধ্যমে পৌরসভা বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত হয়। বর্তমানে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বসবাসকারী জনসংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ ও আয়তন ৫৮ বর্গ কিলোমিটার। ৩০টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত সিটি কর্পোরেশনে ৩০জন সাধারণ আসনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত আছেন এবং ১০ জন সংরক্ষিত আসনে মহিলা কাউন্সিলর নির্বাচিত রয়েছেন। সীমানা: উত্তরে কাউনিয়া ও এয়ারপোর্ট থানা, দক্ষিণে বন্দর থানা এবং নলছিটি ও বাকেরগঞ্জ উপজেলা, পূর্বে কাউনিয়া ও বন্দর থানা, পশ্চিমে এয়ারপোর্ট ও কোতোয়ালী থানা এবং নলছিটি উপজেলা।। বর্তমানে ৩ টি থানা, ৩০ টি ওয়ার্ল্ড এবং ১২৫টি মহল্লা নিয়ে গঠিত বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকা। রাজধানী ঢাকার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে এখানের হাউজিং ট্যাক্স ও বাড়ি ভাড়া। প্রধান তিনটি সড়কেই এখানে পাশাপাশি দুটি বড় গাড়ি চলতে পারেনা। তাহলে অলিগলির কি অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। ঢাকার সাথে পাল্লা দিয়ে বাজার দর বাড়লেও কিন্তু পাল্লা দিয়ে বাড়েনা মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন। গত বিশ বছরের উন্নয়ন চিত্রে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আজ পর্যন্ত এখানে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তৈরি হয়নি। তাহলে উন্নয়নটা হবে কি করে বলতে পারেন?
সম্প্রতি পায়রা বন্দর ও পায়রা সেতু, পদ্মা সেতু, বেকুটিয়া সেতু এবং চলমান সড়কে ব্যবস্থা একমাত্র উন্নয়ন দর্শন। যা কর্মসংস্থান হিসেবে মোটেই ভূমিকা রাখেনা। তবে সড়ক দূর্ঘটনার পরিমাণ বৃদ্ধিতে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করছে। হয়তো ফোরলেনের সড়ক তৈরি সম্পন্ন হলে সড়কের ঝুঁকি কিছুটা কমবে এবং কর্মক্ষেত্রে সম্ভাবনা তৈরি হবে এটা নিশ্চিত। কিন্তু তার আগে কাটাতে হবে আমাদের পরনির্ভরশীলতা। খুলনা নির্ভর সব সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বরিশালে সয়ং সম্পূর্ণ হতে হবে। ভোলা থেকে পাইপলাইনে গ্যাস আসা বিষয়টি কেন অনিশ্চিত হলো? এ প্রশ্ন বরিশালের সুশীল সমাজের অনেকেই করেছেন। উত্তর খুঁজতে যেয়ে রাজনৈতিক অনৈক্য স্পষ্ট হয়েছে। আমরা যে যার মতো রাজনৈতিক দর্শন ধারণ করতেই পারি। কিন্ত দেশ মাটি ও মানুষের তথা বরিশালের উন্নয়ন স্বার্থে আমাদের সবসময় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মনে রাখতে হবে “মোরা হগল বরিশাইল্যা।” এই শব্দে কোনো রাজনীতি নেই। মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, খান বাহাদুর হেমায়েতউদ্দিন, মাওলানা ভাসানী এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাটা জীবন এই ঐক্যবদ্ধ জাতি তৈরির চেষ্টা করেছেন। ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিলাম বলেই আজ আমরা স্বাধীন জাতি হতে পেরেছি। বিনম্র শ্রদ্ধা তাদের প্রতি। বিনম্র শ্রদ্ধা দেশের জন্য যারা এই স্বাধীনতা দিতে আত্মত্যাগী ও শহীদ হয়েছেন তাদের প্রতি।
ঘৃণা, নিন্দা ও তীব্র প্রতিবাদ ১৫ আগস্টের মতো জঘন্য সব হত্যাকাণ্ডের নায়কদের প্রতি। রাজনীতির মাঠ বরিশাল সবসময় সরগরম। দেশভাগের সময় থেকেই বিশ্ব তথা ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বরিশাল উল্লেখযোগ্য নাম। মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের পদধূলি মাখা এই ভূমির রাজনৈতিক ইতিহাস আমার জ্ঞানের চেয়েও অনেক অনেক বেশি সম্মৃদ্ধ। যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে এখন নিজের জন্য সবাই রাজনীতিতে ব্যস্ত। মানুষের জন্য রাজনীতি আছে কি? বর্তমান বরিশালের রাজনীতির মাঠ আপাতদৃষ্টিতে সম্পুর্ণ ই আওয়ামীলীগের দখলে। অন্য কোনো দল আছে বলে মনেই হয়নি গত চারমাস আগেও। তবে হাঃ বামজোট বাসদ এর ডাঃ মনীষা চক্রবর্তীকে দেখা গেছে বিভিন্ন ইস্যুতে রাস্তায় দাঁড়াতে। আর উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা বা অবদান না রেখেও আগাম মেয়রপ্রার্থী ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় পার্টি। তাদের প্রার্থী প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন তাপস এবং বাসদের প্রার্থী ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী।
বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গত নভেম্বরে দায়িত্ব গ্রহণের পর তারা ইদানীং বেশ সরব হয়েছেন। জেলা মহানগর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের চেষ্টা বেশ প্রশংসার দাবি রাখে। অন্যান্য রাজনীতির দলের তেমন ভুমিকা এখানে নেই, তবে চরমোনাই পীরজাদা ও তার ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলন কখনো সখনো হাতপাখার বাতাস বিলির চেষ্টা করেন গরমের সময়। এখানে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর হোসেন, সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়রও তিনি। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি স্যার আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এবং সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মোহাম্মদ ইউনুস। আওয়ামী লীগের এই মানুষগুলোর ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা বর্তমান আওয়ামী লীগের কর্মী সংখ্যা জেলার জনসংখ্যার সমান। যা অনেকটা জোঁকের বিস্তার বলা যায়। কেননা সবখানেই কর্মীদের খুশি রাখতে কিছু না কিছু ত্যাগ স্বীকার করতেই হয় নেতাদের। আর এই ত্যাগ যদি হয় সড়ক বা ব্রীজের কন্ট্রাক্ট তাহলেই ফুলেফেঁপে ওঠা কর্মী নিজেই বড় নেতা হয়ে ওঠেন। কাজের মান দেখে তখন সয়ং মেয়র সাদিক বলে উঠেন – এটা কি রাস্তা বানাইছো, এখানেতো আমিও ডুবাইতে পারমু। গত ২৭ মে সিটি করপোরেশন এলাকার ঠাকুরবাড়ি সড়ক পরিদর্শন করে মেয়র নিজেই এ কথা বলেছিলেন।
অন্যদিকে সদর উপজেলা সভাপতি ও চরকাউয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম ছবির এলাকার চিত্রতো বলাবাহুল্য। এখানে সড়ক ও সেতুর দাবীতে গত ত্রিশ বছর ধরে মানববন্ধন ও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে স্কুলের ছাত্র শিক্ষক ও গ্রামবাসী। পত্রিকার শিরোনাম হওয়ার পরও কারো টনক নড়েনি। সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়নের কর্ণকাঠী ও চরকরঞ্জী সড়ক আজো তার প্রমান বহন করছে। যদিও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও আমাদের সংসদ সদস্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল অবঃ জাহিদ ফারুক এবং জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন হায়দারকে ঐ সড়কের চিত্র ভিডিওসহ দেখানোর পর তারা ত্রিশ বছর পর চলতি বছর ঐ কাজের উদ্যোগ নিয়েছেন। সমস্যা এখানেও। একটি ৩ কিঃমিঃ সড়কের কাজের অনুমোদন হয় যদি ২ কিঃমিঃ তাহলে ঐ সড়কটি কি আদৌ কোনো কাজে লাগে? সম্মানিত প্রশাসন ভেবে দেখুনতো, পাশাপাশি দুটি ব্রীজের একটি করলেন, অন্যটি অকেজোই রয়ে গেছে। তাহলে ঐ যে ব্রীজটি করলেন তা কি কাজে আসবে বলতে পারেন?
বরিশাল সিটি করপোরেশন বিসিসি এর জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই উন্নয়ন বাজেটে। সব সিটি করপোরেশন এলাকায় বাজেট আছে, বরিশালে কেন নেই? এর উত্তরে প্যানেল মেয়র ১৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি নঈমুল হোসেন লিটু বলেছিলেন, বরাদ্দ নেই কথাটি ঠিক নয়। একনেক সভায় প্রায় ৬০০ কোটি টাকার বরাদ্দ পাশ হয়ে মন্ত্রী পরিষদে জমা আছে। সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ মেয়র নির্বাচিত হবার পরপরই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এটা অনুমোদন দিয়েছেন। হয়তো খুব শীঘ্রই এটা চলে আসবে। বছর পার হলেও বাজেট আর আসেনি। ১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ ভার্চুয়াল বাজেট পেশ করেছেন আবার। যা নিয়ে এই মূহুর্তে চলছে তুমুল বিতর্ক। বরিশালের মেয়র মহোদয় সম্প্রতি সড়কের বেশ উন্নয়নে হাত দিয়েছেন। তার কাছে সম্ভবত উন্নয়ন মানেই সড়ক নির্মাণ। আর একসপ্তাহ যেতে না যেতেই সেই সড়ক পুনঃনির্মাণের প্রয়োজন হয়ে ওঠে। আলগা হয়ে যায় সব পাথর। এটি শুধু সিটিতেই নয়, উপজেলা ইউনিয়ন সড়কেরও একই অবস্থা। এদিকে কিন্তু নগরীর খালগুলো পুনরুদ্ধার করা খুবই জরুরী মেয়র মহোদয়। শহরে, এমনকি আপনার বাড়ির আঙ্গিনায় যখন জোয়ারের পানি ঢুকে যায়, তা দেখে কি মনে হয়না এই শহরটির জন্ডিস হয়েছে? কালো কুচকুচে নোংরা পানির চেহারা দেখে কি মনে হয় স্যার? আপনার প্যারিস যদি জণ্ডিস হয়ে যায়, এ লজ্জা কার?
জীবনানন্দ ও নজরুলের শহর বলে দাবী করা এ শহরটিতে নজরুল সাংস্কৃতিক চর্চায় কিছুই নেই। লঞ্চঘাটে ও শহরের প্রবেশ পথে নজরুল ও জীবনানন্দের মুড়াল হতে পারতো। জীবনানন্দ কালচারাল একাডেমি আদৌ হবে কি আর? সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে যদি এতো বিভাজন থাকে, সাংবাদিক ও সম্পাদকদের মধ্যে যদি এতো অনৈক্য থাকে তাহলে সেই শহরের কপালে শুধু দুর্ভোগ লেখা থাকে আর কিছু নয়।
পুরো বরিশাল জেলার মোট আয়তন ২,৭৮৪.৫২ বর্গ কি.মি.। এখানে রয়েছে দশটি উপজেলা ও ছয়টি সংসদীয় আসন। বরিশাল সদর, বাকেরগঞ্জ, বাবুগঞ্জ, আগাইলঝাড়া, উজিরপুর, হিজলা, মেহেন্দিগঞ্জ, মুলাদী, বানারীপাড়া, গৌরনদী। এই দশটি উপজেলার রয়েছে ৮৭টি ইউনিয়ন এবং ১,১১৬টি গ্রামের লোকসংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। (বর্তমান আনুমানিক হিসাব) এই ১১১৬টি গ্রামের চিত্র কি ৬ টি সাংসদীয় আসনের প্রতিনিধি ঘুরে দেখেছেন কখনো? আগে তবু নির্বাচন সময়ে হলেও প্যাক-কাদা মেখে সাংসদপ্রার্থী ঘুরতেন গ্রামে, গ্রামে। এখনতো নির্বাচনে কারো আস্থাই নেই। লোকবল ও টাকাই এখন সব। কিন্তু এই গ্রাম যদি না বাঁচে বাঁচবে কি শহর?
এখানে ২০১২ সালে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। এটি আমাদের গর্বিত অহংকার। কিন্তু অহংকারই আবার ধ্বংসের বীজ বুনে দেয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘীরে ওপারে রীতিমতো ভূমিদস্যুতা শুরু হয়ে গেছে। উজার হচ্ছে মাইলের পর মাইল কৃষি জমি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাও নেমেছে হাউজিং ব্যবসায়। এই যে কৃষি জমি উজার হওয়াটা এটা আগামী ফসলের উৎপাদন ধ্বংস করছে। অথচ দেখুন কি অদ্ভুত বিষয় – ভোলা লক্ষিপুর সড়কে দিনারের পুল এলাকায় মাত্র দুই তিন শতক জমি অধিগ্রহণ করতে পারছে না সড়ক বিভাগ। ওখানে মামলায় আটকে আছে সাহেবের হাটের ৭/৮ কিঃমিঃ সড়কের কাজ।
করোনা মহামারী চাপে কর্মহীন মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামমুখী। গ্রামীণ জনপদে আয়ের উৎস তৈরি হলে এই সুযোগে শহরমুখী চাপ কমবে। বরিশাল বিভাগের রয়েছে প্রচুর সম্ভাবনা। নতুন নতুন উৎপাদনশীল শিল্পকারখানা তৈরির রয়েছে বিস্তর সুযোগ। বরিশাল বিসিককে শক্তিশালী করতে বাধা খানে সয়ং প্রশাসন? ডক ইয়ার্ড, অপসোনিন আর খানসন্স দখল করছে নদীর পাড় এলাকা। এগুলোকে নির্দিষ্ট একস্থানে নিতে সরকারি উদ্যোগ এখানে কি পথ দেখাতে পারেনা? প্রয়োজন সিটি মেয়র ও সংসদ সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ আন্তরিকতা ও উদ্যোগ।
পরিশেষে বলছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের পদ্মা সেতু দিয়ে ঋণী করেছেন। তার এই ঋণ শোধ করতে হলে পদ্মা সেতুর ব্যবহার বাড়াতে হবে। উৎপাদনশীল পণ্যের শিল্পকারখানা বরিশালে বাড়াতে হবে। আর এজন্য রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভাজন দূর করে বরিশালের স্বার্থে একতাবদ্ধ হতে হবে। দলীয় বা পেশী শক্তির আস্ফালন নয়, উন্নয়ন ও ভালোবাসা দিয়ে করুন বরিশালবাসীকে জয়। বরিশালের মানুষ ভালোবাসার কাঙাল, ক্ষমতা বা টাকার নয়।