দুপুর ও ছায়ার জ্যামিতিঃ  উমাপদ কর

অতিথি লেখক

Sharing is caring!

অনিন্দ্য জসিম এর কবিতার বই

দুপুর ও ছায়ার জ্যামিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন

  উমাপদ কর।

প্রিয় অনিন্দ্য জসিম


আপনার কবিতার বই ‘দুপুর ও ছায়ার জ্যমিতি’ পড়া হলো। ভালো লেগেছে বইটা। সামান্য প্রতিক্রিয়া। বইয়ের নামটা পড়েই চমকে গিয়েছিলাম। নামের মধ্যে যে বিমূর্ততা ধরা পড়ে আমি তাতে নিবিষ্ট হই। কবিতা বিমূর্ত শিল্প বলেই আমি মনে করি। কবিতা পাঠকালে সামান্য হলেও এই বিমূর্ততা রচনার প্রয়াস মাঝেমধ্যে দেখতে পাই। ভালো লাগে। যেমন, ‘কচ্ছপের পিঠের ওপর রোদ পোহায় চৈত্রের নদী’ (পৃ-১৯), ‘পাকা ধানক্ষেতের আল ধরে হাঁটে হেমন্তের রোদ,/ মৌ মৌ নাতিশীতোষ্ণ বাতাস’ (পৃ-২০), ‘পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে/ চাঁদ ডোবার আগে পথ ভুলে যায় ঘরের ঠিকানা’ (পৃ-২৫), ‘রোদে পিঠ রেখে বসে আছে শীত দক্ষিণের বারান্দায়’ (পৃ-২৯), ‘মৃত মাছের অপলক চোখে/ ঘোলাটে অজস্র জাগতিক বোধ/ নড়ে ওঠে পানপাত্রে।’ (পৃ-৩৫), ‘কারো প্রেমে পড়তে চাইলে বউ কথা কও চাষ করো।’ (পৃ-৪৪), ‘মেমথের চিৎকার দূরে, আরও দূরে/ খাদে পড়ে আছে চাঁদ’ ইত্যাদি। ভালো লাগে এই কারণেই, প্রকৃতপক্ষে এ-সবই ‘কল্পচিত্র’, চিত্র থেকে কল্পনা নয়, কল্পনা থেকে চিত্র নির্মাণ। এই কল্পনা বিস্তারেই বিমূর্ততা জেগে ওঠে। একটা আলাদা মাত্রা পায়। ভালো লাগে, এই যে জড়ে প্রাণ দেওয়ার প্রয়াস, যেখানে হেমন্তের রোদ আল ধরে হাঁটে, চৈত্রের নদী কচ্ছপের ওপর রোদ পোহায়, বা শীত নিজেই রোদে পিঠ দিয়ে বসে থাকে, তা আসলে জড়ে প্রাণ সৃষ্টি, ফলে বিমূর্ততার প্রতিচ্ছবি।
এই বইয়ে প্রায় সব কবিতাই ‘আমি’-কে কেন্দ্র করে, আমার দেখা, আমার অনুভব, আমার চিন্তা, আমার প্রেম, আমার অনুসন্ধান, আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সুখ-দুঃখ-বেদনা, নির্জনতা-নৈশব্দ, ইত্যাদি। অর্থাৎ এই নিসর্গ-প্রকৃতি-জড় ও জীব, মানুষ-মানুষী, সমাজ-সংসার, আমার দেখায়-অনুভবে-চিন্তায়-ভাবনায় কিভাবে উপস্থাপিত হতে পারে কবিতায়। এটা ‘আমি’ সর্বনামে কবিতা করার একটা তরিকা, যা আপনি গ্রহণ করেছেন এই বইয়ে। দেখা, আত্মস্থ করা, ভেতরে রাসায়ণিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় পরিশ্রুত হয়ে পরিবেশিত হয়েছে কবিতায়। এর ফলে একটা বিষয়-ভাবনা কবিতায় যেমন জড়িয়ে রয়েছে নানা অনুষঙ্গে, তেমনি অনেক সময়ই কিছু কবিতাকে করে তুলেছে একমুখী। পাঠকের ভাবনার পরিসর যেখানে কম। তবে এটা ঠিক কবিতায় তুলনামূলকভাবে বর্ণনা অনেক কম, গল্প বলার প্রবণতা নেই, খুব ভারী দার্শনিক কথা বলে ফেলার বা বাণী ছড়াবার ঝোঁক নেই, অনুভব ও ভাবনাই এখানে প্রধান চালিকা শক্তি। ভাবনাই কবিতা। ভাবনার কেন্দ্রিকতা থাকা সত্তেও কবিতা হয়ে উঠতে এই প্রয়াসের কোনো অসুবিধা হয়নি।

কবি অনিন্দ্য জসিম ও সাহিত্য বাজার সম্পাদক আরিফ আহমে।

বইয়ের যে কবিতাগুলো আমাকে বেশ স্পর্শ করেছে, আলোড়িত করেছে, ভাবিয়েছে, সেগুলো হলো—‘বনসাই’, ‘দৃশ্যচিত্র-১-২-৩’, ‘কানকথা’, ‘নামপুরুষ’, ‘পানপাত্র’, ‘অপেক্ষা-২’, ‘শিরোনামহীন’, ‘পাখিচাষি’, ‘গুহাচিত্রের দিনলিপি’, ইত্যাদি। ভালো লাগে এমন সব পঙক্তি—“ছেলেকে জোনাক ধরার কৌশল/ শেখাতে শেখাতে মনে পড়ে/ আহা প্রাণের দোয়েল/ তুমি কত দূরে থাকো!” (পৃ-২১), “অপেক্ষা ধারালো শিঙের কাজলা ষাঁড়/ আড়ঙের লড়াইয়ে যে কখনো পরাজিত নয়।” (পৃ-৪০), “হরিণের মাংসের ঘ্রাণে বার্ধক্য শিকারি/ পাথরগুহায় আঁকে যৌবনের দুরন্ত সময়।” (পৃ-৪৭), ইত্যাদি।
আপনার কবিতার ভাষা সহজ সরল গতিময় এবং আপনার ভাবনাকে বহন করার মতো উপযুক্ত। ভালো থাকুন। ভালোবাসা।
উমাপদ কর।
২৯ মে, ২০১৯।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!