তথ্য উপদেষ্টার বক্তব্য ও একজন সংবাদ কর্মীর অভিজ্ঞতা
সম্পাদকীয়
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মত দুভাগে বিভক্ত বাংলাদেশের সাংবাদিকতা। এটা যেন আর না হয় বললেন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। একইসাথে সব কালো আইনও বাতিলের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
তার এই বক্তব্যকে অবশ্যই সাধুবাদ এবং সাহসী বক্তব্য তা বলতেই হবে। কিন্তু কতটা কি তিনি পারবেন তা সময়ই বলে দেবে। আমি শুধু এখানে আমার কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো। আমি কোনো দলীয় রাজনীতি কখনোই করিনি এবং কোনোরকম দলীয় প্রভাব মুক্ত থেকেই দায়িত্ব পালন করছি বিগত ১৯৯৩ সাল থেকে। শিক্ষাগত যোগ্যতা কম হবার কারণে আর দশজন সাংবাদিকের মতন আমি কখনোই নিজেকে সাংবাদিক দাবী করে কথা বলিনা। বলি একজন সংবাদ কর্মী। যে কারণে অনেকের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছি বহুবার। তারপরও জনমানুষের পক্ষে কলম ধরেছি এবং প্রয়োজনটুকু আদায় করে নিয়েছি পছন্দ বা অপছন্দের নেতা-মন্ত্রীর কাছ থেকেও। কারণ মানুষের প্রয়োজনটুকু অস্বীকার করার সাধ্য সবচেয়ে খারাপ মানুষটির মধ্যেও নেই। সাংবাদিক চাইলে তার লেখনীর জোরে বহুজনের প্রয়োজন আদায় করে নিতে পারেন। এজন্য তার দলীয় সমর্থন কোনো গুরুত্ব রাখেনা। উদাহরণ হিসেবে সাবেক সড়ক সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাহেব এর কথাই বলবো প্রথমে। সিঙ্গাপুর থেকে সাঁতার কাটার ছবি দিয়েছিলেন তিনি তার ফেসবুকে। ইনবক্সে বললাম, দেশে কি পুকুরের অভাব স্যার? সাথে সাথে কিন্তু তিনি ছবিটি ডিলিট করে বা সরিয়ে দেন। তাকে বললাম, মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারের ইন্সুইরেন্স আদৌ কোনো উপকারে আসেনা। পরবর্তী মিটিং এ তিনি এই দুটো বাতিল করেন। একই ভূমিকা রাখেন বানিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশিও। ঘরে ঘরে রেশনিং পদ্ধতি পুনঃ বিবেচনার দাবীতে সাধারণ মানুষের ভিডিও বক্তব্য তার কাছে তুলে ধরলে তিনি টিসিবি কার্ড তৈরি করেন। আর সাংস্কৃতিক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বা প্রতিমন্ত্রী খালিদ হোসেনতো সাথে সাথে সাড়া দিতেন। যার প্রমাণ আমার অসংখ্য সংবাদে সাহিত্য বাজার এ আজো ভাসছে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলো বরিশালে আসার পর একটি এলাকার মানুষকে দেখলাম সাঁতার কেটে ও কলা গাছের ভেলায় খাল পার হচ্ছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুককে ছবিসহ নিউজটি দিতেই তিনি সাথে সাথে ছুটে আসেন ঐ এলাকায়। ২০২০ সালের শেষের দিকের কথা এটি। ২০১৮ সালে তিনি সংসদ সদস্য হয়েছেন। এরপরই করোনা মহামারী হওয়ায় সবাই গৃহবন্দী জীবন যাপন করেছেন। যাইহোক ভদ্রলোক তখন আমার পরিচয় জানতে চান। বলেন আমি কোন দল করি? উত্তর দিয়েছিলাম – যতক্ষণ আপনি সৎ ও সাধারণ মানুষের ভালোর জন্য কাজ করবেন, ততক্ষণ আমি আপনার দলের। যখনি আপনি দূর্নীতি করবেন, তখনি আমিও বিরোধী দল।
এরপর ভদ্রলোক আর আমার সাথে কখনো কথা বলেননি। তবে যখনই কোনো ভাংগা সড়ক, সেতু আর কোনো অসহায় মানুষের সংবাদ তৈরি করে তাকে লিংক পাঠিয়ে দিতাম, তখনি তিনি কাজটি করে ফেলতেন। বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ কখনোই ফোন রিসিভ না করায় তাকে দিয়ে জনগণের কোনো উপকার আমি করতে পারিনি। কিন্তু নবনির্বাচিত মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ সম্ভবত অনেকটা তটস্থ থাকতেন, কখন আমার মেসেজ চলে আসে তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে। এই খালের কাজ ঠিক হচ্ছেনা, পাড় ভাঙছে কেন কিম্বা সড়কে বাতি নেই, সড়কের ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি গেছে, ঠিকাদারের কাজে অনিয়ম স্পষ্ট। সাথে সাথে তিনিও ছুটে যেয়ে দেখে এসেছেন স্বাধীনতা পার্ক, ১৩ নং ওয়ার্ড সাগরদি খালের কাজ। তিন তিন বার দিয়েছেন জর্ডান রোডের সড়কের স্লাব।
এগুলো এজন্য বলছি যে, সাংবাদিকতা যদি নিজের জন্য না হয়, মানুষের জন্য হয়, তাহলে স্বৈরাচার থেকেও দাবী আদায় করে নেওয়া যায়।
বরিশালের এ দুজন প্রতিমন্ত্রী ও মেয়র আমাকে দেখেছেন মাত্র দুবার। প্রতিমন্ত্রী আমাকে চিনলেও মেয়র আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাকে চেনেন না।
নিজের ব্যক্তিগত (অপারেশন জনিত) বিপদে প্রতিমন্ত্রীর সাহায্য চেয়ে কিন্তু পাইনি আমি। সেজন্য সড়ক সেতু মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন করেছিলাম আমিও। যা এখানেই টাইমলাইনে আজো ঝুলছে। কেউ সাড়াটুকু দেয়নি আজ পর্যন্ত।
এগুলো সাম্প্রতিক উদাহরণ। বিএনপি শাসনামলেও কিন্তু মেয়র সাদেক হোসেন থেকে ঢাকার মিরপুর ১০ এ মুক্তমঞ্চ ও টাউনহল তৈরির প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিলাম। যে কারণে সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ আমাকে পছন্দ করতেন। এখনো ওখানে মুক্তমঞ্চ আছে তবে সিটি করপোরেশনের ভাগারখানার ভিতর।
সর্বশেষ পিরোজপুর মঠবাড়িয়া, বরগুনা বাকেরগঞ্জ মহাসড়কের কাজে নোটিশ করলে সড়ক সেতু মন্ত্রী তা দ্রুত করার আশ্বাসও দিয়েছেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামকে তার মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি কাজের অনিয়ম সংবাদ তুলে ধরলে তিনি ভিডিও কলে তা নিজেও দেখেন। একদিন পর সরাসরি বলেই বসলেন, আমরা এখন সচিবদের হাতে জিম্মি। আমাদের কোনো গুরুত্ব এখন আর নেই।
আসলে তখনই এ সরকারের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যায়। দেশ চালাচ্ছেন শুধু প্রধানমন্ত্রী আর সচিবরা। বাকী সবাই পুতুল।।
তাই অনেক বিষয়ে প্রতিবাদী কলম ধরে আর কোনো লাভ হয়নি এরপর। ২০২৪ এ দ্বাদশ জাতীয় সংসদে সরকার গঠনের পর সচিবরাই ছিলেন মন্ত্রী এমপিদের তুলনায় অনেকবেশি ক্ষমতাবান। যদিও এ ক্ষমতায়ন ২০১৮ তেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই সচিবসহ ডিসি, এসপি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব নেওয়া এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরী।
তাই বলছি, সাংবাদিক কোন দল করে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তার কলমটা যেন সত্য তুলে ধরে – এটা গুরুত্বপূর্ণ সবসময়।