গত ২৯ অক্টোবর ঢাকার জাতীয় শিল্পকলা একাডেমির মুল মিলনায়তনে মঞ্চায়ন হল নাগরিকের নতুন নাটক নাম গোত্রহীন। উর্দু ভাষার নন্দিত লেখক সাদাৎ হাসান মান্টোর গল্প অবলম্বনে নির্মিত নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন ভারতের নাট্য নির্দেশক উষা গাঙ্গুলী। ‘কালি সিলোয়ার’, ‘লাইসেন্স’ ও ‘হাতাক’ শিরোনামের মান্টোর তিনটি ছোট গল্পকে এক সূত্রে গেঁথে এগিয়েছে এ্ই নাটকের কাহিনি। গত ২৬ জুন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নাটকটির উদ্বোধনী মঞ্চায়ন দেখে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জয়ন্ত সাহা যে প্রতিবেদন করেছেন তা হুবহু তুলে ধরা হলো। (যদিও এ প্রতিবেদনে জয়ন্ত সাহা কিছু মন্তব্য যোগ করেছেন, যা কখনোই প্রথম মঞ্চায়ন দেখে করা উচিৎ নয় বলে মনে করেন সাহিত্য বাজার সম্পাদক আরিফ আহমেদ)।
এ ছাড়াও আমি সদানন্দ সরকার ২৯ অক্টোবরের প্রদর্শনীটি দেখেছি। একই সময় কথা বলেছি সমআপদক আরিফ আহমেদ এর ঘনিষ্টজন, নাট্যজন ই্উনিভার্সেল থিয়েটারের মাযহারুল হক পিন্টু, ঢাকা ড্রামা্র মুন্সি টিটো, চ্যানেল আইয়ের সাংস্কৃতিক প্রতিবেদক জাহিদ প্রমূখদের সঙ্গে। প্রদর্শ নী শেষে তাদের অভিমতে এ প্রদর্শনীকে অনেকটাই ত্রুটিমুক্ত দাবী করেছেন নাট্যজনেরা। তারপরও আমরা জয়ন্ত সাহার প্রতিবেদনটিকেই প্রধান্য দিলাম, কারণ তার লেখনী আমাদের ভালোলেগেছে। চেষ্টা করলেও তার চেয়ে ভালো আমরা মানে আমি সদানন্দ লিখতে পারতাম না।
জয়ন্ত সাহার প্রতিবেদন : ‘ কালি সালোয়ার’-এর সুলতানা, ‘লাইসেন্স’-এর নীতি, ‘হাতাক’ এর সুগন্ধী যেন ভারতীয় উপমহাদেশের নারীদের আলেখ্য। তিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন অপি করিম, শ্রিয়া সর্বজয়া এবং সারা যাকের। ‘নাম গোত্রহীন মান্টোর মেয়েরা’র প্রথম পর্ব ‘কালি সালোয়ারে’ অভিনয় করেছেন অপি করিম। গল্পের মুখ্য চরিত্র সুলতানা একজন দেহোজীবী। পাকিস্তানের আমবালা থেকে দিল্লিতে চলে আসা খোদাবক্সের সঙ্গ তাকে ঠেলে দেয় অন্ধকার জগতে। দুনিয়ার সবার ইচ্ছাই খোদা পূরণ করে, কিন্তু তার ইচ্ছাই কেন অপূর্ণ থাকবে- অভুক্ত সুলতানার এমন খেদোক্তি মনে করিয়ে দেয় সভ্যতার অন্তরালে এখনও কতটা অসহায় একজন নিগৃহিত নারী। সুলতানার খদ্দের শংকর মিথ্যা প্রেমের ফাঁদ পেতে হাতিয়ে নেয় সুলতানার মায়ের স্মৃতিস্বরূপ দুলজোড়া। সুলতানার বড় শখের কালো সালোয়ার হয়ত এনে দেয় সে, কিন্তু বিনিময়ে সে প্রেমের নামে ছল করে সুলতানার সঙ্গে। সুলতানা বুঝতে পারে, এভাবেই হয়ত খোদাবক্স আর শংকরদের পুতুল হয়েই বেঁচে থাকতে হবে তাকে। নিজেকে বিক্রি করে খোদাবক্সদের অন্ন যুগিয়ে যাবে সে। ‘সুলতানা’ চরিত্রের দাপুটে পার্শ্বচরিত্র ‘খোদাবক্স’ এবং ‘শংকর’ চরিত্রের ব্যাপ্তি ছিল কম। দুটি চরিত্রে পান্থ শাহরিয়ার এবং রাজীব দে ভালো অভিনয় করলেও পান্থ গোল বাঁধিয়েছেন সংলাপে। প্রথমে সংলাপে উর্দু টান থাকলেও পরে তিনি প্রমিত বাংলায় চলে যান। অপি নিজেই গেয়েছেন গানগুলো।
দ্বিতীয় পর্ব ‘লাইসেন্স’ –এর শুরু কোচোয়ান আব্দুল আর নীতির প্রেমের গল্প দিয়ে। ‘নীতি’র ভূমিকায় শ্রিয়ার অভিনয়ের দুর্বলতার কারণে তার ‘মুখ্য’ চরিত্রটিকে ছাপিয়ে প্রধান হয়ে ওঠেন ‘আব্দুলে’র ভূমিকায় মোস্তাফিজ শাহীন। শ্রিয়ার এটি প্রথম মঞ্চনাটক। ‘লাইসেন্স’ এর মূলকাহিনিও বুঝতেও নাট্যাংশটি অনেকদূর দেখতে হবে। গল্পের অর্ধেক জুড়ে – অনেকটা অপ্রয়োজনীয়ভাবেই – নীতি-আব্দুলের প্রেমকাহিনি। আব্দুলের মৃত্যুর পর নীতি সিদ্ধান্ত নেয় সে নিজেই ঘোড়া গাড়ি চালাবে। কিন্তু ‘লাইসেন্স নেই’ এমন অভিযোগে নীতিকে কোচোয়ান হতে দেবে না শহর কমিটি। নীতির এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে আসে আব্দুলের বন্ধুরা, যারা সবাই নীতিকে ভোগ্য বস্তু ভাবে। একপর্যায়ে স্বামীর স্মৃতিবাহী ঘোড়াগুলো বেঁচে দেয় নীতি। নিজেও হারিয়ে যায় অন্ধগলির পাঁকে। নীতির এই হারিয়ে যাওয়ার গল্পটি ঠিকমতো ফুটিয়ে তুলতে পারেননি নির্দেশক। আলোক প্রক্ষেপণেও অযত্লের লক্ষণ দেখা গেছে।
‘হাদাক’ এর কেন্দ্রীয় চরিত্র সুগন্ধী। মুম্বাইয়ের যৌনপল্লীর গল্প নিয়ে আবর্তিত এ কাহিনিতে দেখা যায় গতযৌবনা সুগন্ধীর বেঁচে থাকার লড়াই। রূপযৌবন হারিয়ে সুগন্ধী খদ্দের খুঁজে পায় না। ‘সুলতানা’র মতো ‘সুগন্ধী’ও প্রেমের নামে প্রতারিত হয়। সুগন্ধীর খদ্দের মাধব নামের হাবিলদারটি তাকে মিথ্যা প্রেমের প্রলোভন দেখায়। শহরের দারোগাটিও তাকে ঠকায়। ঠকতে ঠকতে একদিন নিজের নারীসত্তা অনুধাবন করতে পারে সুগন্ধী। সুতীব্র চিৎকারে সে বলে উঠে, ‘আমার ভিতরের আমিটাকে কেউ কোনোদিন নিতে পারবে না।’ বহুমুখী ‘মাধব’ ও ‘দারোগা’ চরিত্রের মাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিকৃষ্টরূপটি ফুটিয়ে তুলেছেন উষা। যৌনপল্লীর অন্ধকারে নারীর গুমোট কান্না ছাপিয়ে পুরুষের বিকৃত উল্লাস, ভদ্রতার মুখোশ পড়া পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতাকে ঘৃণার কথা ফুটে উঠেছে ‘হাদাক’ নাটকে। ‘সুগন্ধী’একই সংলাপ একাধিকবার আওড়ায়, যা বিরক্তির উদ্রেক করে। কিছু দৃশ্যে সারা যাকেরের অতি অভিনয়ও চোখে পড়ে। পার্শ্বচরিত্রগুলোর অভিনয়ও আহামরি কিছু হয়নি। প্রেক্ষাপটে সমসাময়িক বলিউডি গান বাজানোর পরিকল্পনায় অভিনবত্ব খুঁজে পাবেন কেউ কেউ। পোশাক পরিকল্পনায় সাজিয়া আফরিন লুবনা তার কাজটি যথাযথভাবে করেছেন।
সবকিছুর পরও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সমালোচনা হিসেবে ঢাকার মঞ্চে নাকটি একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। শুধু নারী জীবনের গল্পই নয়, ‘কালি সালোয়ার’ নাটকে দিল্লির মহররম উৎসবের অনুষঙ্গে সে সময়ের লোকজ সংস্কৃতির কথা বলেছেন উষা। ‘লাইসেন্স’ এ কোচোয়ান, ‘হাদাক’ এ ‘রামলাল’ চরিত্রের মাধ্যমে দুই ভিন্ন পেশার মানুষের কথা বলেছেন। তবে এই কৃতিত্বের অনেকটাই অবিভক্ত ভারতের সেরা গল্পকারদের একজন সাদত হোসেন মান্টোর।