‘দেশ ভাল চলছে না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। চলতে চলতে হোঁচটও খাচ্ছে এখানে সেখানে। জনজীবনে সমস্যা ছিল ও আছে। তবে, তা বাড়ছে ক্রমান্বয়ে প্রতিদিন। সময় সময় এগুলোর কোনো কোনোটি হঠাৎ করে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। জনজীবনে অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।
যেমন ধরা যায় জিনিসপত্রের দাম। এমনিতেই সব কিছুর উচ্চমূল্য। দ্রব্যমূল্য প্রতিদিন আরও ঊর্ধ্বপানে ধাবিত হচ্ছে। তার মধ্যে আচমকা এক একটি জিনিস যেমন পিঁয়াজের দাম, একলাফে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেল। কৃষকদের জন্যে গত কৃষি মওসুমে সার, কীটনাশক ইত্যাদি নিয়ে একই অবস্থার উদ্ভব হয়েছিল। বিদ্যুৎ ও পানি – এই আছে, এই নেই। এটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল বেশ কিছু দিন থেকে। মানুষও এ অবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল। হঠাৎ করে পরিস্থিতির অবনতি – ‘এই নেই, এই নেই’, অর্থাৎ বহু কিছুই নেই নেই পর্যায়ে পৌঁছলো। বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, কী যে একটা হাহাকার অবস্থা। এই হাহাকারের অবশ্য একটা সমাজতান্ত্রিক দিক ছিল, অর্থাৎ ধনী দরিদ্র উঁচু নিচু, সব মহলের সবাই এটার সমান ভাগ লাভ করেছিলেন। ঢাকা শহরের উচ্চস্তরে বসবাসকারী মানুষ যারা আকাশছোঁয়া বিশাল বহুতলবিশিষ্ট ভবনের বাসিন্দা, তারাও এ দফায় দুর্দশার হাত থেকে রেহাই পাননি। বরং অনেকের যে অবর্ণনীয় দুর্দশা হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা দুরূহ।
তারপর আসা যাক, দুর্নীতি ও আইন-শৃংখলার অবনতির প্রসঙ্গে। ঘুষ ছাড়া সরকারি অফিসে কোনো কাজ হবে না – এটা চলে আসছিল। বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্যার আইজ্যাক নিউটনের গতি বিষয়ক একটা সূত্র আছে, ‘শক্তি প্রয়োগ ছাড়া কোনো জড় পদার্থ গতিশীল হয় না এবং গতিশীল বস্তুর গতির ত্বরণ হয় না।’ নিউটনের সেই বিখ্যাত আবিষ্কার আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী ও তাদের ব্যবহার্য কাগজপত্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, এটা এখন আমাদের সমাজে স্বীকৃত। শক্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় জ্বালানি বা ঘুষ দেয়া বর্তমানে সরকারি মহলে দাপ্তরিক সংস্কৃতির একটা অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলা যায়।’
১৯৯৮ সালের ১৮ এপ্রিল দৈনিক জনতা পত্রিকায় প্রকাশিত বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের-এর এমনি কিছু অসাধারণ রচনা নিয়ে গাঁথা হয়েছে বইটি। বইটির নাম ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র সোনার পাথর বাটি’ ২৪০ পৃষ্ঠার এই বইটিতে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রায় ৫০টি রচনা বা প্রবন্ধ রয়েছে। যার বেশির ভাগই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সরকারের ভ’মিকা, সংবিধান, গণতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ৪ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত ডাকা টানা ৬০ ঘণ্টার হরতালের শেষদিন ছিল বুধবার। এদিন সকালে পত্রিকার কাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলা একাডেমি এলাকায় ভ্রমণকালে কাটাবন সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় মার্কেটের ২য় তলায় ৩৩০ কারুকর প্রিন্টার্স-এর বাধাঁইখানায় দৃষ্টি আকর্ষণ করল চমৎকার মলাটের একটি বই। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন মোমিন উদ্দীন খালেদ।
পৃষ্ঠা উল্টাতেই চোখ আটকে গেল ১৫৯ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘আওয়ামী লীগের ক্ষমতায়নের রাজনীতি ও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি’ শীর্ষক রচনাটিতে।
এরপর একে একে শিরোনামগুলো দেখলাম। বিকলাঙ্গ গণতন্ত্র ও জনগণের দুর্ভোগ, মুক্তির স্বপ্ন ব্যর্থতার ইতিহাস, রাজনৈতিক দলের জবাবদিহিতা ও তথ্য অধিকার আইন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি: গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে বাধা, যুদ্ধাপরাধীদেও বিচার নিশ্চিত করা জরুরী, বোমায় বেহাল বাংলাদেশ, রংপুর: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত, জতীয় সংসদ ও বাঙলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্র, বাংলাদেশের সংবিধানে দলত্যাগ বিরোধী অনুচ্ছেদ ইত্যাদি রচনাবলী বইটির নামকরণের চমৎকার সার্থকতা প্রমাণ করছে।
এ সব রচনা বা প্রবন্ধ জাতীয় দৈনিক প্রথমআলো, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক যুগান্তরসহ প্রায় সব পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। তাই ইচ্ছে করলেই এগুলো সাহিত্য বাজার ছাপতে পারে চিন্তা থেকে প্রকাশক কারুকর প্রিন্টার্সের সাথে যোগাযোগ করলাম। তারা জানালো – আমরা শুধু মুদ্রন ও বাধাইয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত। বইটির প্রকামক ভাষামুখ। ভাষামুখ থেকে জানা গেল – এটি একটি রাজনৈতিক বই, তারউপর বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রীর বই। খুব শীঘ্রই বইটির প্রকামনা উৎসব হবে জাতীয় প্রেসক্লাবে। সেখানে এসে বইটি সংগ্রহ করুন।
কিন্তু দেরিটা সহ্য হচ্ছিল না। বিএনপির সাবেক সাংসদ জহিরুদ্দীন স্বপন ও সাংবাদিক দুর্জয় রায়ের সহযোগিতায় কথা হল ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র সোনার পাথর বাটি’ গ্রন্থের লেখক জি এম কাদের ভাইয়ের সঙ্গে, তা-ও ফোনে। আমার ইচ্ছেটা জানাতেই, তিনি স্বানন্দে অনুমতি প্রদান করলেন। সেইসাথে শুক্রবার (৮ নভেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআপি লাউঞ্ছে এ গ্রন্থের মোড়ক উম্মোচন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র সোনার পাথর বাটি শীর্ষক গ্রন্থের ভূমিকায় লেখক জি এম কাদের লিখেছেন – সচেতনভাবে লেখক হবার বাসনা থেকে আমার লেখালেখি শুরু হয়নি। তবে পড়াশুনা এবং লেখা আমার অন্যতম প্রিয় কর্ম।
এখানের এক স্থানে তিনি লিখেছেন – ১৯৯০-এর শেষদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে আমার ব্যক্তিগত জীবনে কিছু বিপর্যয় নেমে আসে। অতিব্যস্ত জীবনের দৈনন্দিন ঘটনাপঞ্জিতে আকস্মিকভাবে দীর্ঘ ছেদ পড়ে, সেই অনভ্যস্ত অবকাশের মধ্যে আমি জীবন ও জগত সম্পর্কে নতুন চিন্তা করার সুযোগ পাই। সেই বিপর্যস্ত ক্রান্তিকালে আমার উপলব্দি হয় – গণমানুষের কল্যানের জন্য কাজ করার যে স্বপ্ন আমি আজীবন লালন করছি, তার সর্বোচ্চ বাস্তবায়নের জন্য সক্রিয় রাজনীতি একটি অন্যতম পন্থা। পূর্ববর্তী পেশা ছেড়ে জনসেবার আকাঙ্খা মাথায় নিয়ে আমি জাতীয় পার্টিও সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে যোগ দেই। পরবর্তী সময়ে প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হই।
এরপর জি এম কাদের ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২০০১ ও ২০০৮ সালে পরপর ২য় ও তৃতীয়বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জিএম কাদের। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বও তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গস্খহণ করেন।
বর্তমানে এই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনরত অবস্থায়-ই তিনি প্রকাশ করেছেন তার রাজনৈতিক দর্শন-ভাবনামূলক গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র সোনার পাথর বাটি’।
এ গ্রন্থটি শুধু সমস্যাকে চিহ্নিত করেনি। দেখিয়েছে সমাধানের পথও। আওয়ামী লীগের সরকারে অবস্থান করেও আওয়ামী বিরোধীতাও এ গ্রন্থের অন্যতম অধ্যায়। তবে এ বিরোধীতা, বিরোধীতার জন্য নয়। এখানে রয়েছে সমাধানের আন্তরিকতা।
যেমন, আওয়ামী লীগের ক্ষমতায়নের রাজনীতি ও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি – এ রচনায় তিনি সমাদানও দেখান – ‘সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের মধ্যে একজন প্রধানমন্ত্রী হবেন। তিনি সংসদ সদস্যদের (মন্ত্রিসভার মোট সদস্যদের কমপক্ষে ৯০% নির্বাচিত সংসদস সদস্য) নিয়ে তাঁর মন্ত্রিসভা গঠন করবেন ও যৌথভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মকা- পরিচালনা করবেন। সংসদের অন্য সদস্যদের দায়িত্ব হলো – সরকারি কর্মকা-ের খবরদারি করা। সংসদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাহায্যে সংসদ সদস্যরা সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবেন।
কিন্তু বাস্তবে, এখন সরকার গঠন পর্যন্তই কেবল সংবিধানের বিধান অনুসরণ করা হচ্ছে। সরকারি কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বিষয়ে সংসদের দায়িত্ব পালন সরকারের সহযোগিতার অভাবের কারণে সম্ভব হচ্ছে না। একথা আজ সর্বজন স্বীকৃত যে, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। গুরুত্বপূর্ণ কেন, রাষ্ট্রীয় কোনো কর্মকা- নিয়ন্ত্রণে জাতীয় সংসদকে কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। বিল, বাজেট ইত্যাদি যেগুলোকে সংসদে আনার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেগুলো বা অন্য কোনো বিষয়, প্রয়োজন হলে সংসদে আনা হয়। তারপর সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ভোটের মাধ্যমে পাশ করিয়ে নেয়া হয় হুবহু সরকারি ফরমাশ মোতাবেক। সে হিসাবে জাতীয় সংসদকে বর্তমানে সরকারি কার্যক্রম বৈধ করার রাবার স্ট্যাম্পও বলা যায়।
পরিশেষে বলা যায়, ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র সোনার পাথর বাটি’ গ্রন্থটি সুশীলজনের কাছে শুধু পাঠপ্রিয়ই নয় সমান সমাদৃত হবে এাঁই প্রত্যাশা।