জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতার দায়িত্বরত সম্পাদকদের প্রচণ্ড অবহেলার শিকার আমাদের মফস্বলে বসবাসরত সাহিত্যকর্মীরা। শুধু মফস্বলেরই নয়, ঢাকায় অবস্থানরত অনেক নবীন ও প্রবীণ সাহিত্যকর্মীদেরও প্রত্যাশা একটাইÑ জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদকদের উদারতা। তাদের মতে, সাহিত্য মানেই হচ্ছে সর্বান্তকরণে সুন্দর সৃষ্টির চেষ্টা। যারা মনে প্রাণে উদার হতে পারেন না তারা কী করে সুন্দর হবেন, আর সুন্দর কিছু সৃষ্টি করবেন?
সাহিত্যকর্মী ও সাহিত্যিকদের বেশিরভাগেরই অভিযোগ- সাহিত্যপাতার সম্পাদকরা আমাদের লেখা খুলেও দেখেন না। আচার আচরণে মনে হয় দেশে তারাই একমাত্র সাহিত্যিক। তাদের কাছে পরিচিত কয়েকটি মুখ ছাড়া আর কারো লেখাকেই সাহিত্য মানের বলে মনে হয় না। অন্যদিকে সাহিত্যপাতার আকারও দিনকে দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে, সপ্তাহে একদিন- দুটি কি তিনটি পাতা বের হয় সাহিত্য নিয়ে। কোন কোন দিন কবিতা থাকেই না। গল্পতো বলা যায় ছাপাই হয় না। সাহিত্যপাতা নিয়ে এ রকম অভিযোগ আরো অনেক। কেউ কেউ বলেনÑ সাহিত্য সম্পাদকরা বেশিরভাগই পক্ষপাত দুষ্ট। তারা নিজেদের মধ্যে একটা ঘরানা তৈরিতে ব্যস্ত। ইত্যাদি অসংখ্য অভিযোগ ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রায় সব জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতার বিরুদ্ধে। শুধু ঢাকা কেন মফস্বলের জেলা শহরের আঞ্চলিক দৈনিকগুলোর সাহিত্য সম্পাদকরাও মুক্ত নন এ অভিযোগ থেকে। খুলনার পূর্বাঞ্চল, চট্টগ্রামের পূর্বকোণ এবং বগুড়ার করতোয়া নিয়েও অভিযোগ কম নয়।
লেখকদের দাবি জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতায় প্রকাশিত নির্দিষ্ট সংখ্যক কবি ও সাহিত্যিকদের লেখনীর পাশাপাশি আলাদাভাবে মফস্বলের কবি-সাহিত্যিক ও তরুণদের জন্য সাহিত্যপাতার আয়োজন করা হোক এবং মিলিয়ে দেখা হোক সাহিত্য মানের স্থানে মফস্বল ও তরুণদের অবস্থান আছে কী নেই। ময়মনসিংহ, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলার অধিকাংশ সাহিত্য সংগঠক, কবি, লেখক ও সাহিত্যকর্মীদের অভিযোগ মফস্বলে থেকে সাহিত্যকর্ম করেন বলেই জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকরা তাদের মূল্যায়ন করছেন না। কিন্তু তাদের এ অভিযোগ ভিত্তিহীন বলেই দাবি করেন জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতার দায়িত্ব পালন করতেন কিম্বা এখনও করছেন এমন কয়েকজন সাহিত্য সম্পাদক। তাদের ভাষায় শ্রদ্ধেয় স্যার ইতিহাস গবেষক যতীন সরকার, কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, মোহাম্মদ জাফর ইকবালসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভালো সাহিত্যকর্মী নিয়মিত ঢাকার বাহিরে থেকেই সাহিত্যকর্ম করে আসছেন এবং তাদের লেখা প্রকাশ হচ্ছে। মানসম্পন্ন লেখা না পেলে আমরা কী করতে পারি? আমরা ভালো লেখা পেলে আরও খুশি হই।
কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক এর ভাষায – জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতার মান আমার মনে হয় দিনকে দিন দর্শনের দিক থেকে বেশ উন্নত হচ্ছে তবে সাহিত্য মান হারাচ্ছে। সে সাথে পাতার আকারও বুঝি ছোট হয়ে আসছে। আগে দেখতাম ১০/১২টি কবিতা ২/৩টি গল্প ছাপা হত। এখন সেখানে ২/৩টি কবিতা কখনো কখনো ছাপা হয়। তরুণ কবি ও লেখকদের জন্য বিশেষ করে মফস্বলে থেকে যারা লেখা পাঠাচ্ছেন তাদের জন্য জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতায় প্রয়োজনে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। তবে মফস্বল শব্দটা ব্যবহার না করাই উচিত। আবার এমন লেখাও ছাপা ঠিক হবে না যা পাতার মানই নষ্ট করে।
কবি ও গল্পকার জুলফিকার মতিন – জাতীয় দৈনিকে লেখা ছাপা হলে একজন লেখক বা কবি প্রচণ্ড উৎসাহিত হয়। এটা স্বভাবগত। কাজেই সাহিত্য হলো কিনা সেটা বিচার করার দায়িত্ব পাঠকের হাতেই ছেড়ে দেয়া উচিত। তবে এমন লেখাও ছাপা ঠিক হবে না যা একেবারেই পত্রিকার মান খর্ব করে।
কবি ও গল্পকার মুশাররাফ করিম বলেন – সাহিত্যটাকে সমৃদ্ধ করতে পারতো জাতীয় দেনিকগুলো। ঠিক আজকে ‘সাহিত্য বাজার’ যেটা করছে, এই একইকাজ কিন্তু জাতীয় দৈনিকে হতে পারতো। কিন্তু সেখানেও তারা পরস্পরের পিট চুলকানোর কাজে ব্যস্ত। প্রথম আলো গ্র“প, সমকাল বা জনকণ্ঠ গ্র“প। এ রকম একটা ভাগ তারা করে নিয়েছেন। দৈনিক ইত্তেফাকে নিয়মিত কবিতা লিখছে অথচ প্রথম আলোতে তার কবিতা ছাপছে না-এমন অভিযোগও অনেক। আসলে ঘুরে ফিরে নিজেরাই নিজেদের সাহিত্যপাতার লেখক বা কবি তারা। যে কোন দৈনিকের সাহিত্যপাতার কোন বিশেষসংখ্যা হাতে নিলেই ঘুরে ফিরে গুটিকয়েক নামই দেখা যায়। যেন এদের বাহিরে দেশে আর কোন কবি নেই, আর কেউ কবিতার চর্চা করে না। তাদের আচরণে মনে হয় সাহিত্যপাতার সম্পাদকরাই একমাত্র সাহিত্যিক।
যশোরের প্রবীণ সাহিত্যিক ও গবেষক তারাপদ দাস বলেন – ঢাকা থেকে প্রকাশিত বা ঢাকার বাহিরের বিভিন্ন দৈনিকে আমি নিজে বহুবার লেখা পাঠিয়েছি। জনকণ্ঠ দু’একটি লেখা ছাপলেও ঢাকার অন্যকোন দৈনিকে লেখা ছাপেনা। যে কারণে আমি আর পাঠাই না। আমাদের যশোরের সাহিত্য সংগঠনগুলোর সাথে সম্পৃক্ত অনেক তরুণরা নিয়মিত লেখা পাঠায়। এদের অনেকের লেখাই মানগত দিক থেকে একেবারে ফেলে দেয়া যাবে না। কিন্তু ছাপে না। কাসেদুজ্জামান সেলিম, তোহিদ মনি, পদ্মনাভ অধিকারী এরকম বেশকিছু তরুণ ভালো লিখছেন। তাদের কারো কারো লেখা ভোরের কাগজ, সংগ্রাম, সংবাদে ছাপাও হয় কিন্তু অন্য কোথাও বিশেষ করে প্রথম আলোতে কখনো ছাপা হয়েছে চোখে পড়েনি বা শুনিনি। তাই আমি সাহিত্য সম্পাদকদের প্রতি অনুরোধ জানাবো, আপনারা তরুণদের জন্য বিশেষ করে মফস্বলে থেকে যারা সাহিত্যচর্চা করছেন তাদের জন্য আলাদা একটা পাতা করুন। প্রয়োজনে মফস্বলের সাহিত্য নামেই বিভাগ চালু করে মিলিয়ে দেখুন আপনাদের তুলনায় কতটা মানহীন আমাদের সাহিত্য?
সাংবাদিক ও সাহিত্যকর্মি আরিফ আহমেদ
জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতার দায়িত্বরত সম্পাদকদের বেশিরভাগই আচার-আচরণে ও কথাবার্তায় প্রচণ্ড বিনয়ী ও জ্ঞানী। সাহিত্যিক মানে সর্বান্তকরণে সুন্দর একজন মানুষ। যার কাজই হচ্ছে সুন্দরের চর্চা করা। সেদিক বিচারে আমাদের সাহিত্য সম্পাদকরা অনেক এগিয়ে। তারপরও লেখা বাছাই ও ছাপার বিষয়ে তারা অনেক সময় এমনভাব করেন যেন তারা সবাই শুধু পড়াশুনা করেই সাহিত্যিক হয়েছেন। প্রায়শই শুনি, আমাকেও বহুবার তারা বলেছেন – ‘আপনাকে আরো পড়তে হবে। ভালো বই পড়–ন, গ্রামার জানুন, তবেই ভালো লেখক হতে পারবেন’। তারা হয়ত ভুলে গেছেন- পড়াশুনা করে গবেষক ও পণ্ডিত হওয়া যায় সাহিত্যিক নয়। প্রকৃতিগত মেধা না থাকলে গ্রামার ধরে ধরে যে সাহিত্যচর্চা হয়, তা আর যাইহোক বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারে না। যে কারণেই বলতে হয়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মাইকেল, জীবনানন্দ ও সুকান্তের পরে দেশে আজ পর্যন্ত কোন নির্ভরযোগ্য কবি সাহিত্যিক সেভাবে সর্ব সাধারণের মনে স্থান করে নিতে পারেন নি।
অবশ্য এ জন্য এ সময়ের লেখকদের অনেকেই বলেন – ‘আমরা সবার জন্য লিখি না।’
বলি দাদা, সবার জন্যই যদি না লেখেন তাহলে আপনারা কাদের জন্য লেখেন? এ বিষয়টিই স্পষ্ট করুন। সামাজিক দায়বদ্ধ লেখনী সবসময় সবার জন্যই তৈরি হয়। তবে কি আপনারা দেশ তথা সমাজের কাছে দায়বদ্ধ নন? অনেকটা ক্ষোভের সাথেই কথাগুলো বললেন সাহিত্য বাজার পত্রিকার সম্পাদক আরিফ আহমেদ।
আরিফ আহমেদ আরও বলেন – কবিতা হচ্ছে কবুতর, যার ওড়ার কোন নিয়ম থাকবে না। উড়তে অভিজ্ঞ হয়ে গেলে তবেই তার উপর বিভিন্ন কলাকৌশল প্রয়োগ করা যায়। আর গল্প বা উপন্যাস বহমান নদীর মতই সাগরে মিশে যাবে, যেদিকে সে গতি পাবে। প্রয়োজনে বাড়ি-ঘর, হাটবাজার ভেঙ্গে দিয়ে সে এগিয়ে যাবে। এখানে গ্রামারের নিয়ম অনেকটাই ক্যানেল কেটে মাঠে সেচের ব্যবস্থা করার মত। এটা তখনই সুন্দর হবে যখন নদীর টগবগে যৌবন থাকবে। অর্থাৎ ভরা নদী না হলে ক্যানেলে পানিও যাবে না সেচও হবে না। একইরকম প্রকৃতিগতভাবেই সাহিত্য সৃষ্টি না হলে গ্রামারের ব্যবহারের ফলে সৃজনশীলতাই নষ্ট হয়ে যাবে। একজন সৃজনশীল ভালো লেখক সৃষ্টি করতে জাতীয় দৈনিকের ভূমিকা অপরিসীম। তাই পড়–ন, পড়–ন না বলে ভুলটা ধরিয়ে দিতেই Ñ লেখকের লেখাটি দায়িত্ব নিয়ে শুধরে দিন এবং ছেপে দিন। যদি একদম না-ই পড়তো, তার থেকে কোন লেখাই বের হতো না।
জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতা সম্পর্কে ঢাকার শাহবাগ এলাকার আজিজ সুপার মার্কেট কেন্দ্রিক তরুণ কবি ও সাহিত্যকর্মীদের ভাবনা
কবি সিদ্ধার্থ শংকর ধর
সমকাল সাহিত্যে মানবিক মূল্যবোধের ক্রমশ অনুপস্থিতি বড় হয়ে উঠছে দিন দিন। এই সংকটটি কাটিয়ে ওঠার জন্য বিভাগীয় সম্পাদক দায়িদ্ব গ্রহন করতে হবে। পলেসি দূর্বলতা যেন কাটিয়ে উঠতে পারছে না। এটা দুঃখজনক। মিডিয়াতে সাহিত্য পাতা জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও নিয়োগ গুনবিচারী ও বিনিয়োগ যথেষ্ট উদাষসীনতার পরিচয় ফুটে উছঠে। সাহিত্যের পাঠকেরা যেহেতু শিক্ষিত অতএব ওদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব প্রদর্শন করলে লাভ ছাড়া ক্ষতির কারণ নেই।
সাংবাদিক ও কবি কাফি কামাল
প্রায় প্রতিটি দৈনিকের বহু বহু সাহিত্যপাতা পড়েছি, চোখ বুলিয়েছি, বাসায় করেক মন জমে ওঠেছে। সাহিত্য পাতার দায়িত্বপ্রাপ্তদের অভিরুচি, দায়িত্বশীলতা এবং সত্যিকার অর্থে যোগ্যতা সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এ জন্য আমি দুঃখিত। কিছু সাহিত্য সম্পাদক বহিঃরা আচরণে উদার, বাস্তবে পক্ষপাতদুষ্টো। বাংলা সাহিত্যের তাবৎ পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে এ উপলব্ধি উন্মুক্ত করি।
কবি মাসুম মোকারররম
‘সাহিত্য’ প্রকাশের জন্য নানা মাধ্যম প্রয়োজন। তার মধ্যে দৈনিকের সাহিত্য পাতা একটি অনন্য মাধ্যম। রুচি ও অরুচি রয়েছে। তাতে কী? দ্রুত এবং অনেক পাঠক পাতাগুলি তো পাঠ করছেন। তাই বেঁচে থাকুক দৈনিকের সাহিত্য পাতা।
সাহিত্যকর্মী মাদল হাসান
প্রতিষ্ঠানের দৈারাত্ম্যক ঘৃনা করা সত্ত্বেও মনে হয় দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা থাকাটা মন্দ না। বরং মন্দের ভালো। যদি ছোট কাগজগুলো সামান্য হলেও সম্মানী দিতো তাহলে এ প্রশ্ন হয়তো অনেকটা অবান্তর হতো। যেহেতু দৈনিক পত্রিকার বিস্তার বেশি এবং অনেক পাঠকের কাছে পৌছায় কাজেই প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ঢুকেই প্রতিষ্ঠানের অচলয়েতন কিছুটা হলেও হয়তো ভাঙার চেষ্টা করা যায়। সর্বোপরি দৈনিক পত্রিকার সাময়িকী থাকাটা খারাপ না। বরং যদি সম্মানীর পরিমাণ সত্যিই সম্মানজনক হয় তাহলে মন্দ কী?
কবি ও গল্পকার শওকত হোসেন
সাহিত্য পাতার কাছে প্রত্যাশার কিছু নেই। প্রথম আমাদের দেখা প্রয়োজন, দৈনিক পত্রিকাগুলোর মালিক হয়ে থাকেন কোন শ্রেণীর ব্যক্তি; সেই ব্যক্তির পত্রিকা করার পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য কী; তিনি কোন শ্রেণীর মানুষের প্রতিনিধিত্ব্ করেন, অথবা কা’র স্বার্থ রক্ষার জন্য তিনি বা তারা দৈনিক পত্রিকা করেন। এসব প্রশ্নের জনাব পাওয়া কঠিন কাজ নয়; জবাব যা আসবে, তার সঙ্গে এবার সাহিত্য বা শিল্পের উদ্দেশ্য কী এ দুয়ের সম্পর্কের মধ্যে আমরা যা খুঁজে পাব সেটা ভালো কিছু নয়। আমরা যদি সেভাবে তলিয়ে বিষয়টিকে না দেখি তাহলে শুধু উপরি কাঠামোগত মন্তব্য বা আলোচনা করে সমস্যা আবিস্কার করা যাবে না। তাহলে প্রশ্ন আসে, সমস্যাটি কোথায়? সমস্যা নানা জন নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে চাইলেও নানাভাবে ব্যাখ্যা করার কিন্তু সুযোগ নেই। কেননা এই দৈনিক পত্রিকার রাজনীতি কী সেটা আমরা প্রায় সবাই জানি। সুতরাং দৈনিকে যে সাহিত্য প্রচার করা হয়, তার দু’ধরনের উদ্দেশ্য আছে। এক দৈনিকের উদ্দেশ্যকে হুমকীর মুখে ফেলবে না এমন সাহিত্য এবং দুই নিজেদের স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে এমন সাহিত্যি। ফলে বলা যেতে পারে, দৈনিক পত্রিকার কাছে আমরা এত প্রত্যাশা করি কেন? পাল্টা প্রচার ও প্রকাশ মাধ্যম সৃষ্টি করতে আরও কত কাল সময় লাগবে আমাদের?
সাহিত্য সম্পাদকদের ব্যাখ্যা
দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার সাবেক সাহিত্য সম্পাদক কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেন – ইদানিং কবিতার চর্চা যারা করছেন, তারা পড়ছেন না। ভালো কবিতা না ছাপার কোনো কারণ নেই। লেখনী ভালো হলে, সে লেখনী কথা বলবেই। তাই তরুণদের বলবো হতাশ হবার কিছু নেই।
পাক্ষিক অন্যদিন পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক নাসরিন জাহান বলেন – প্রথমে বাংলাবাজারে পরে পাক্ষিক অন্যদিন পত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। প্রায দুই যুগ ধরে এ কাজ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, আমাদের দেশে যারা সাহিত্যচর্চা করছেন তাদের অনেকেই স্বভাবগত। একটা কি দুটো লেখা ছাপা হতেই তারা বিশেষ সংখ্যায় লেখা ছাপার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। আমরা যখন সাহিত্যচর্চা শুরু করি তখন দশ বারো মাইল পথ হেঁটে গিয়ে নতুন কি বই এসেছে সেটা সংগ্রহ করতাম এবং পড়ে ফেলতাম। এখনকার তরুণ কবি সাহিত্যিকরা পড়তেই চায় না। অসংখ্য কবি এখন। এত কবিদের লেখা ছাপাটাও দূরহ কাজ। আমি সবসময়ই মফস্বলের কবি বা সাহিত্যিকদের প্রাধান্য দিয়ে আসছি। তবে আমার পাতায় কবিতার ক্ষেত্রে ছন্দটা বেশি গুরুত্ব পায়। সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমি সিরিয়াস সাহিত্যের প্রতি দূর্বল। তাই বাছাইটাও সেরকম।
জাতীয় দৈনিক বিশেষ করে আমি যদি প্রথম আলোর সাহিত্য সম্পাদক হতাম তাহলে আমি নতুন ও পুরাতন মানসম্পন্ন লেখেন এমন, সকলের সাহিত্যই প্রকাশ করতাম। তবে অবশ্যই নাম ছাপতাম না। নামটা তখনই প্রকাশ করা হত যখন পাঠক জানতে আগ্রহী হতেন যে – এ লেখাটি কার? কারণ প্রথম আলো খুবই জনপ্রিয় একটি দৈনিক। এখানে দু’চার জনই কেবল জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন আর তাদের লেখাই বারবার ছাপা হলে এটা নিয়ে কথাতো উঠবেই। অনেক ভালো মান সম্পন্ন লেখক আছেন যাদের লেখা জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয় না। আমি হলে আগে তাদেরই খুঁজে বের করতাম।
মফস্বলের অনেক সাহিত্যিকদের দাবি তাদের জন্য প্রয়োজনে আলাদা সাহিত্য পাতা হোক, আমি এটা সমর্থন করি না। তাহলে তারা চিরদিনই আলাদাই চিহ্নিত হবেন। তাদের উচিৎ নিয়মিত পত্রিকাগুলো দেখা, কোন মানের লেখা ছাপা হচ্ছে তা বোঝা ও নিয়মিত লেখা পাঠিয়ে সাহিত্য সম্পাদকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা। আপনার লেখা মান সম্পন্ন হলে- একদিন, দু’দিন তিনদিন সাহিত্য সম্পাদক সেটা এড়িয়ে যেতে পারবেন, কিন্তু চারদিনের দিন ঠিকই ছাপতে বাধ্য হবেন।
দৈনিক সংবাদ এর সাহিত্য সম্পাদক ওবায়েদ আকাশ বলেন – শুধু মফস্বল কেন এ অভিযোগ ঢাকায় যারা সাহিত্যচর্চা করেন তাদেরও। সাহিত্যকর্মীর পরিচয় তার সাহিত্যে। এখানে মফস্বল আর ঢাকা বলে আমি কিছু দেখিনা। একজন সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে আমি আমার পাতার মান রক্ষার্থে কিছু লেখা সংগ্রহ করি। যাদের লেখা সংগ্রহ করি তারা পরীক্ষীত লেখক। তাই মান বিচারের প্রয়োজন হয় না। তরুণদের ক্ষেত্রে লেখা পেলে সেটা আগে পড়ি, মানসম্পন্ন হলে ছাপি। তরুণদের লেখা ছাপার সুবিধা-অসুবিধা দুটোই আছে। কোন একটা লেখার মান তেমন ভালো নয়, কিন্তু কিছুটা শুধরে ছাপলাম, অমনি সে নিজেকে বড় ভাবা শুরু করে দিল। এ বোধটাই যেন ইদানিং বেশি দেখা যায়।
আমার কাছে গড়ে প্রায় শ’দেড়েক লেখা পোষ্টে আসে। সবই খুলে দেখি। শতকরা দু’একটি ভালো লেখা থাকে। সেটা ছাপাও হয়। ভালো লেখা পেলে আমি আরও খুশি হই, কারণ আমার সংগ্রহ করার ঝামেলা কমে যায়। তরুণদের যারা লেখা ছাপা না হওয়ার কারণে বিভিন্ন অভিযোগ তুলছেন তাদের বলবো আপনারা আগে নিজেদের সংশোধন করুন। কবিতা-সাহিত্যের ভাষার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আধুনিক ভাবধারার সংগে নিজেদের পরিচিত করুন। পড়ুন, পড়ুন আর পড়ুন।
খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বাঞ্চল’-এর সাহিত্য সম্পাদক শামীমা সুলতানা শীলু বলেন – আমি চেষ্টা করি নীরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাহিত্যপাতা করতে। আসলে পারিনা। কাউকে না কাউকে ছাড় দিতেই হয়। পরিচিত একজন কবিতা লেখেন, হয় না, তারপরও সেটা একটু কেটে ছেটে আমাকে ছেপে দিতে হয়। এতে সে উৎসাহিত হলেও অনেক সময়ই সিনিয়র কবি বন্ধুরা কিন্তু রুষ্ট হন। অনেকে ফোন করে আমাকে মন্দও বলেন। আবার স্থান অভাবে ছাপা সম্ভব হলো না সেজন্য কিনা আমার গ্র“পেরই কোন সদস্য মন ভার করল। সত্যি বলতে একটু কম মানের হলেও যাদের ব্যক্তিগতভাবে চিনি জানি তাদের লেখাই প্রাধান্য পেয়ে যায়। যেহেতু আমারটি আঞ্চলিক কাগজ তাই এর প্রভাব খুব একটা পড়ে না। জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতার গুরুত্ব অপরিসীম। সেখানে প্রকাশিত প্রতিটি সাহিত্যকর্মই মানসম্পন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাই বলে মফস্বলে যে ভালো মানের সাহিত্য হয় না এটা কিন্তু ঠিক কথা নয়। এই খুলনাতে এমন অনেক কবি ও গল্পকার আসেন যারা নগরীর কবি সাহিত্যিকদের তুলনায় কোনদিক থেকে কম মানের লেখা লেখেন না। আমাদের কবি ও গল্পকার অচিন্ত কুমার ভৌমিক তার লেখা ভারতের কাগজে নিয়মিত ছাপা হয়। অসীত বরণ ঘোষ, বিষ্ণুপদ, তারপরে অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির, নারীনেত্রী মাজেদা আলী, নাসরীন হায়দারসহ আরো অনেকেই ভালো লিখছেন।
যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক আমার জমিনসহ বেশ কয়েকটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক তৌহিদ মনি জানান – সাহিত্য হলো কি হলো না, সেটা বিচারের ভার পাঠকের হাতেই ছেড়ে দেয়া উচিৎ। পাঠক এখন অনেক সচেতন। মোটামুটি লেখা হয়েছে, ছন্দ, ভাব ঠিক আছে, এমন লেখাটি আমি ছেপে দেই। এতে হয়তো জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকরা ক্ষুব্দ হতে পারেন বা বলতে পারেন Ñ তুমি কে হে বাপু?
আমি আমার দায়িত্বে সাহিত্যপাতা এভাবেই প্রকাশ করি। তারপরও আমার বিরুদ্ধেও অভিযোগ আসে, অনেক বন্ধুও লেখা ছাপা না হওয়ার কারণে ক্ষুব্দ হন। আমার সীমাবদ্ধতা স্থানাভাব।