‘সাহেবি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন জসীমউদ্দীন’- জসীমউদ্দীন সম্পর্কে সমিলউল্লাহ খান-এর এই বক্তব্য অনুসারে আমরা নিঃসন্দেহে এ-কথা বলতে পারি। কিন্তু সাহেবি সংস্কৃতির চেতনার সঙ্গে আমাদের জাতীয় চেতনার যে পার্থক্য রয়েছে তা যে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য থেকেই উঠে এসেছে এই বোধও কিন্তু জসীমউদ্দীন অনুভব করতে শিখেছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষা থেকেই। সুতরাং জসীমউদ্দীন যে জাতীয় সাহিত্যের চর্চা করেছেন তার সঙ্গে সলিমউল্লাহ খান কথিত জাতীয় সাহিত্যের নিবিড়-গভীর সম্পর্ক থাকলেও তা পরিপূর্ণভাবে জাতীয়-সাহিত্য নয়, ভিন্ন অর্থে সাহেবি চেতনাপ্রাণিত সাহিত্যই। তবে আমরা যে সাহিত্যকে আধুনিক সাহিত্য বলে থাকি – যাকে খান সাহেব গাল দিচ্ছেন – সে সাহিত্য সলিমউল্লাহ খান কথিত জাতীয় সাহিত্যের যে রূপকে অপরিশীলিত বলে চিহ্নিত করা হয় তাকে বর্জন করে এগিয়ে চলে। কিন্তু জসীমউদ্দীন আধুনিকতার সেই পথে চলেন নি। তিনি চলেছেন তার থেকে একটু ভিন্ন পথে। তিনি গ্রামীণ জীবনযাত্রা ভিত্তিক শিল্পরূপের সৌন্দর্যকে খুঁজে বের করে এবং ঐ সৌন্দর্যকেই প্রধান হিসাবে বিবেচনায় রেখে পরিশীলিততর ভাবে উপস্থাপন করেছেন। যদিও এই পরিশীলনের শিক্ষা তিনি নিয়েছেন সাহেবি সংস্কৃতির কাছ থেকেই। কিন্তু গ্রামের জনজীবনকে অবলম্বন করায় তাঁর আধুনিকতাকে আমাদের সাহেবি সাহিত্যিকেরা ভুল বুঝেছেন। তাঁকে অনাধুনিকদের দলে ফেলে দিয়েছেন। কিন্তু জসীমউদ্দীনের সাহিত্য যাঁরা মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন তাঁরা কি লোক কবিদের সঙ্গে জসীমউদ্দীনকে গুলিয়ে ফেলতে পারবেন? তাঁদের চোখে জসীমউদ্দীনের পরিশীলন কি চোখে পড়বে না?
নিশ্চয়ই পড়বে। পড়েছিল আবু হেনা মোস্তফা কামালের চোখে। জসীমউদ্দীন-এর কবিতা বিষয়ক এক প্রবন্ধে তিনি বলেছেন – ‘তিনি (জসীমউদ্দীন) কাব্যের বস্তুসম্পদ আহরণ করেছেন লোক-ঐতিহ্য থেকে। গ্রামীণ জীবন তিনি খুব কুশলী হাতে আঁকতে সক্ষম কিন্তু এই অঙ্কনরীতিতে আধুনিক শিক্ষার ছাপ স্পষ্ট। রাখালী অথবা বালুচর কাব্যের খণ্ড কবিতাগুলিতে কৃষক, জেলে, মাঝি, বৈরাগী প্রভৃতির জীবনের পটভূমিতে প্রেমের অনুষঙ্গ লিরিক্যাল পরিচর্যায় বিকশিত হয়েছে। নকসীকাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট-এর কাহিনী বিন্যাসের মূলে মৈমনসিংহ গীতিকার অনুসৃতি অস্পষ্ট নয় – কিন্তু এখানে কবির লিরিক অনুভূতির সঙ্গে যুক্ত হলো নিবিড় নাটকীয়তা। গ্রামজীবন ও গ্রামীণ সংস্কৃতির অযতœ-রক্ষিত অনুজ্জ্বল উপকরণ জসীমউদ্দীনের কবিতায় দ্যুতিমণ্ডিত অলঙ্কারে রূপান্তর লাভ করল। এই রূপান্তর এতই বৈপ্লবিক যে তাকে জন্মান্তর বললে অত্যুক্তি হয় না। অতএব জসীমউদ্দীনকে যাঁরা ইঙ্গিতে লোকসাহিত্য রচয়িতা বলে কটাক্ষ করেন তাঁদের শিল্পবোধ সম্পর্কে সংশয় জাগে। ’
আবু হেনা মোস্তফা কামাল ঐ প্রবন্ধেই আর এক জায়গায় বলেছেন – ‘বৃহত্তর বাংলার কৃষক সমাজ ও তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে জসীমউদ্দীনের পরিচয় ঐতিহাসিক কারণেই প্রত্যক্ষ ও নিবিড়। গ্রাম-বাংলা ও তার সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য তাঁর কবিতার শুধু উপকরণ নয়; প্রেরণারও বটে। গ্রামীণ গাথা ও পুঁথি সাহিত্যের আবহাওয়ায় পুষ্ট জসীমউদ্দীনের কাব্য সাধনায় যে আবহমান বাংলার পরিণয় উদ্ভাসিত-তা কোনো সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিতে অসম্পূর্ণ অথবা খণ্ডিত নয়। সম্প্রতি নজরুল ইসলাম সম্পর্কে এ রকম বলা হচ্ছে যে, তিনিই বাঙালির জাতীয় সত্তাকে প্রথম কাব্যে রূপান্তরিত করেছেন। সম্ভবত জসীমউদ্দীন সম্পর্কে এই মন্তব্য সমানভাবে প্রযোজ্য।’
ঐহিত্য বিষয়ে এই যে আমরা সচেতন হয়ে উঠছি – এটাও তো ইয়োরোপীয় চেতনারই আলোক-উজ্জীবন। আমাদের দেশের প্রকৃতিই এই যে, সবকিছু সরল ও সাদামাঠা। কোন বস্তুই বেশিকাল স্থায়ী হয় না। নদীমাতৃক দেশ বলেই হয়তো এটা হয়। যেমন আমাদের ভূখণ্ডটার নকশাও নদীর ভাঙ্গাগড়ার কারণে দ্রুত পরিবর্তনশীল। ফলে এই দেশে ঐতিহ্য সংরক্ষণের চেতনা গড়ে উঠতে পারে নি। কিন্তু এই দেশের মানুষের মধ্যেও এই যে ঐতিহ্যের চেতনা একসময় এসেছে তার খানিকটা আমার মনে হয় এসেছে আরব থেকে আসা ইসলাম ধর্মের প্রসারের মধ্য দিয়ে। ইসলাম মানুষের জীবনাচরণে কী অনুমোদন করে বা করে না তার পরিচয় আছে শরীয়তে। শরীয়তের বিধিনিষেধ বা নির্দেশনা আসলে কোরান ও হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবন ও কর্মভিত্তিক। এই ভিত্তিকে অনুভব করার মধ্যে দিয়ে হয়তো ঐতিহ্যচেতনা বাঙ্গালী মুসলমানের মধ্যে এসেছে। কিন্তু বাঙ্গালী হিন্দুদের মধ্যে ঐতিহ্যের বোধ এসেছে বহিরাগতদের আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে। সুতরাং বলা যায় বাঙ্গালী সমাজের প্রধান দৃষ্টিভঙ্গিগুলো বিকশিত হয়েছে বাইরের চেতনার সংস্পর্শে-সংঘর্ষে। এমনকী অনেক বিষয়ে আমাদের স্বভাবগত ঔদাসীন্য ও অসচেতনতা থেকে বের হয়ে আসার উৎসেও রয়েছে বিদেশীদের শাসন-শোষণ। সুতরাং বলা যায় জসীমউদ্দীন যে আমাদের জনজীবন সম্পর্কে এতটা সচেতন ছিলেন, আধুনিক সাহেবি সংস্কৃতির বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন এবং শুধু উঠেছিলেনই নয় সারাজীবন এই পথ থেকে সরে আসেন নি এই অনুভব করতে পারাটাও আসলে ইয়োরোপীয়দের কাছ থেকেই তিনি শিখেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশচন্দ্র সেনের ব্যক্তিত্বের প্রভাবও তাঁর মধ্যে নিশ্চয়ই কাজ করেছে। তাঁদের মধ্যেও জাতীয়তা বোধের জাগরণ পাশ্চাত্য শিক্ষা থেকেই প্রধানত গড়ে উঠেছিল। অবনীন্দ্র-নন্দলালরা চিত্রকলায় ভারতীয় চিরায়ত সাহিত্যকে তাদের সৃষ্টিকর্মের ভিত্তি ধরেছিলেন, জসীমউদ্দীন ভিত্তি হিসেবে ধরেছিলেন বাংলাদেশের গ্রামীণ জনজীবনের দীর্ঘকাল চর্চিত সংস্কৃতিকে।
সামগ্রিকভাবে আমাদের নগরায়ণ যে ইশারা অনুসরণ করে সুদীর্ঘকাল ধরে সম্প্রসারিত হয়ে উঠছে তা গ্রামের জনজীবনের সংস্কৃতিকেই ধ্বংস করে ফেলছে। এই ধ্বংস প্রক্রিয়ার কারণকে প্রশ্ন না করে শুধু সাহেবি সাহিত্য সমালোচকদের গাল দিলে আমার মনে হয় না আমরা জসীমউদ্দীনের কৃতিত্বকে যথেষ্ট মূল্য দিতে পারব। আমার তো মনে হয় যে জসীমউদ্দীন কবিতায় বা গদ্যে যে ভাষাভঙ্গি ব্যবহার করেছেন – যাকে সলিমউল্লাহ খান বলেছেন ‘খাটি বাংলা’- তাও খাঁটি নয়; সেটাও ভেজাল মিশ্রিত বাংলাই। এতেও সংস্কৃত, আরবি-ফারসি, খাঁটি দেশি শব্দের সহজ-স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি রয়েছে। তবে জসীমউদ্দীনের শক্তি এখানে যে, আমাদের দেশের জনজীবনের যে সহজিয়া গতি আছে তাকে আন্তরিকভাবে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তিনি ধারণ করতে পেরেছিলেন। এটা তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিণাম। এই রকম অন্তর্দৃষ্টি ছিল নজরুলের, জয়নুলের, আব্বাসউদ্দীনের, সুলতানের, কামরুলের। যে-কারণেই এঁদের সকলের নাম একসঙ্গে আমাদের মনে আসে। এঁরা সকলেই বাঙ্গালীত্বের বোধের সম্পন্নতা দিয়েছেন। বাংলার সাহিত্য ও শিল্প-জগতে এঁদের আগমন না ঘটলে হয়তো বাঙ্গালীত্বের সম্পন্নতা ঘটত আরও অনেক দেরিতে। বাঙ্গালীত্ব বোধ হতো শুধু বাংলার হিন্দুর, মুসলমানের হতো না; কেবল তাই নয়, বিশ্ববোধের অংশীদারিত্ব হিসাবে বাঙ্গালীত্বের অনুভব থাকতো কম সম্পন্ন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমি এইটুকু বলতে পারি যে, নজরুল, জসীমউদ্দীনকে বাদ দিয়ে এমনকি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি থাকলেও বাঙ্গালীত্বের বিশ্বচেতনা থেকে যেতো তুলনায় কম সম্পন্ন। জসীমউদ্দীনের মহত্ত্ব এখানে যে, তাঁর আগমনের কারণেই আমরা আজ এটা অনুভব করতে পারছি। শুধু তাই নয়, আমাদের গ্রামীণ জনজীবন, জনমানস এবং তার সংস্কৃতির চলমান রূপ হয়তো একেবারে হারিয়েই যেত যদি কবিসাফল্যে ও আধুনিকতায় [সলিমুল্লাহ খান যাকে সাহেবি সংস্কৃতি বলেছেন] জসীমউদ্দীন সফল না হতেন। সুতরাং নিঃসন্দেহে বাংলার চিরায়ত জীবনকে আধুনিকতায় বেঁধে রাখায় আমরা জসীমউদ্দীনের নামে বিজয় পতাকা উড়িয়ে দিতেই পারি।
* জসীমউদ্দীনের কবিতা : জীবন ও শিল্প, শিল্পীর রূপান্তর, মুক্তধারা, ঢাকা, ১৯৭৮