চাঁদপুর তিনঃ পেটমীতি নিয়ে ব্যস্ত সাধারণ মানুষ চায় রেশনিং
ইলশেবাড়ি খ্যাত চাঁদপুর তিন আসনের রাজনীতি নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই সাধারণ মানুষের। রাজনীতির নাম শুনলেই তাদের গাঁ ঘিনঘিন করে বলে দাবী করেন এখানের বেশিরভাগ খেটে খাওয়া মানুষ। তারা বলেন, পেটনীতি কইরা বাঁচিনা আবার রাজনীতি। পারলে আমাগো রেশনিং ব্যাবস্থা দিন, খাইয়া পইরা বাঁচি।বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে বলেন সরকারকে। তারপরও সাংসদ দীপু মনির পক্ষে তাদের যুক্তি হচ্ছে – আমাগো সাংসদ, শিক্ষামন্ত্রী সে। এই এলাকার এখন যেটুকু উন্নয়ন সবটাই তার করা। সে খুব ভালো। রাস্তায় দেখা হলেই কথা বলা যায়। কিন্তু হের লগে কিছু শয়তান থাকে, ঐগুলোয় দেখা করতে দেয়না। ঐগুলোর কাজের কারণে আজ মন্ত্রীর দূর্নাম হইতেছে।
এভাবেই চাঁদপুর তিন আসনের সাংসদ দীপু মনি সম্পর্কে মন্তব্য করেন হাইমচর আলগীবাজার, গাজীপুর, কাটাখালী ও লহ্মিপুর ইউনিয়নের বাসিন্দারা। এমনকি ৩ নং আলগী বাজার ইউপি চেয়ারম্যান জলিল মাষ্টারও বলেন একইকথা। তিনি বিএনপির সমর্থক হয়েও গত দশবছর এখানে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জলিল মাষ্টার বলেন, সাংসদ দীপু মনির সহযোগিতা না পেলে কি এলাকার উন্নয়ন করা যায়। মোটামুটি সহযোগিতা পাচ্ছি বলেই টিকে আছি। তবে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যানদের তুলনায় কিছুটা কম। তবুও পাচ্ছি।
জেলার মোট জনসংখ্যার ৬০ ভাগ মানুষের প্রধান জীবীকা নদী থেকে ইলিশ ধরা ও বিক্রি করা। যদিও লহ্মিপুর গ্রামের মেঘনা পারের ৪৯০ গুচ্ছ গ্রাম ও আশেপাশের জেলে বসতীর কয়েকজন জানান, মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা সময়ে তাদের খুব কষ্ট হয় জীবীকা চালাতে। তাদের সন্তানরা তাই এই পেশা ছাড়তে শুরু করেছে। অটোরিকশা ও ইজিবাইক চালক হচ্ছে কেউ, কেউ কেউ পড়াশুনা করে বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। চাঁদপুরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া নিয়েও তাদের অনেক স্বপ্ন এখন। তাই সাংসদ ও শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির প্রতি কৃতজ্ঞতা তাদের।
চাঁদপুর সদর ও হাইমচর নিয়ে গঠিত এই আসনে পরপর চারবার দীপু মনি সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। দীপু মনি ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে চাঁদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়- প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে তিনি কমনওয়েলথ মিনিস্ট্রেরিয়াল অ্যাকশন গ্রুপ-এর প্রথম নারী এবং দক্ষিণ এশীয় চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন। এছাড়া তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সমুদ্র জয় করে। এতে করে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার এবং ভারতের সাথে প্রায় চার দশকের সমুদ্র সীমা সংক্রান্ত অমীমাংসিত বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় চূড়ান্ত ভাবে নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করে । সামাজিক উন্নয়ন এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাঁর অনন্য অবদানের জন্য তিনি মাদার তেরেসা আন্তর্জাতিক পুরষ্কারে ভূষিত হন। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে পুনরায় চাঁদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। একই সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ২০তম কাউন্সিলে তিনি পুনরায় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। ৬ জানুয়ারী ২০১৯ এ তিনি একাদশ জাতীয় সংসদের অধীনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
গত বছরের শেষ দিকে চাঁদপুরে বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে তার আত্মীয় স্বজনদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল ওঠে এবং এতে বিব্রত বোধ করেন তিনি নিজেও। ফলে কাজটি এখন স্থগিত অবস্থায় রয়েছে। আর যে কারণে চাঁদপুর আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব খুঁজছেন অনেকেই। তবে এ দ্বন্দ্বে সুত্রপাত আসলে সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাসির উদ্দিন আহমেদ কে নিয়ে বলে দাবী চাঁদপুর সদর ও হাইমচরের দীপু মনি সমর্থকদের। তাদের কেউ কেউ বলেন, গত বছর চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে ক্ষুব্ধ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তার সমর্থকরা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন কীভাবে হেনস্তা করবেন দীপু মনিকে। বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে লহ্মিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সেলিম খানকে মন্ত্রীর সাথে জড়িয়ে তারাই অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে দাবী নেতাকর্মীদের একাংশের। যদিও এ বিষয়ে প্রথমে কথা বলতে রাজী হননি হাইমচরের উপজেলা চেয়ারম্যান নূর হোসেন পাটোয়ারী।
পরে বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চাঁদপুরে এসেছে এটা আমাদের শিক্ষামন্ত্রী ও সাংসদ দীপু মনির কৃতিত্ব। প্রধানমন্ত্রী তাকে এটা দিয়েছেন। চাঁদপুরবাসীীর এজন্য গর্বিত হওয়া উচিত। এছাড়াও অনেক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম তিনি করেছেন। আগেতো কখনো এমন কোনো অভিযোগ আসেনি। তার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র চলছে এটাতো এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। একটা মহল সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন কীভাবে হেনস্তা করবেন দীপু মনিকে। তিনি আরো বলেন, এ বিষয়টি ছাড়া আর কোথাও কোনো সমস্যা নেই চাঁদপুরে। গত ১৩ বছর দীপু মনি এখানে এমপি ও মন্ত্রী। এর আগে কি শুনেছেন তার বিরুদ্ধে কখনো কোনো অপবাদ?
এর আগে গত ২৫ জানুয়ারী মঙ্গলবার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাসির উদ্দিন আহমেদ নিজ বাসায় নেতা-কর্মীদের নিয়ে এক সভায় বলেছেন, নদীর পারে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। এই সুযোগে শিক্ষামন্ত্রীর লোকজন জায়গাজমি কিনে বড় অঙ্কের টাকা লোপাটের পরিকল্পনা করেছেন।
প্রায় একই অভিযোগ চাঁদপুর জেলা বিএনপির। জাতীয়তাবাদী কৃষকদলের সভাপতি এনায়েতউল্লাহ খোকন বলেন, নিজ আত্মীয় স্বজনদের সুবিধা দিয়েছেন দীপু মনি। তার সহযোগিতায় এই ভূমি বাণিজ্য, বালু উত্তোলন ইত্যাদি করছে সেলিম খান। এর দায়তো তাকে নিতেই হবে। আমরাও চাই প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টি হোক। তবে বিতর্কিত স্থানে যেন না হয়।
অভিযোগ শুনে স্পষ্ট উত্তরে চাঁদপুর তিন আসনের সাংসদ ও বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, আমার পরিবারের কেউ আমার জানামতে কোন অপরাধ করলে আমার দায় আমি এড়াতে পারিনা। কিংবা আমার কাছের কেউ আমার প্রশ্রয়ে বা সহযোগিতায় কোন অপরাধমূলক কাজ করলে তার দায়ও আমি এড়াতে পারিনা। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এরকম কোন দায় নেবার মত কোন অপরাধমূলক কাজ আমার পরিবারের কেউ করেনি বা আমার কাছের কাউকেও আমি কখনো এরকম কোন কাজে কোনদিন কোনরকম প্রশ্রয় বা সহযোগিতা দিইনি। অতএব আমার ক্ষেত্রে দায় না নেয়ার বিষয়টিই অবান্তর।
এলাকার উন্নয়নে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছেন দীপু মনি। তারমধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে হরিনা ফেরিঘাটে মেঘনা নদীর উপর সেতু নির্মাণ। এ কাজটি শুরু হলে বদলে যাবে পুরো চাঁদপুরের চিত্র। এখানে বিএনপির হাল ধরে আছেন জেলা সভাপতি শেখ ফরিদ আহম্মেদ মানিক। তবে সাধারণ নেতাকর্মীদের মাঝে চলমান কমিটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে বলে জানা গেছে। চাঁদপুর জেলা সদরের যে বিষয়টি প্রতিবেদনে উল্লেখ না করলেই নয়, তা হচ্ছে এখানের ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের সৌহার্দ।। একই পরিবারের চাচাত দুই ভাই একজন ছাত্রলীগ ও অন্যজন ছাত্রদলের নেতা।। দুজনে একসাথে বসেই জেলার রাজনীতি ও বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা বলেন প্রতিবেদকের সাথে। চা খেতে খেতেই জানা হয় এখানে ছাত্র সংগঠন ও যুব সংগঠন মিলেমিশে থাকে এবং কাজ করে। বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চাঁদপুরে চায় এরা দুজনেই। সেসাথে এবিষয়ে জড়িত অপরাধীদের শাস্তির দাবী তাদের। তাই মূল প্রতিবেদনে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, যুবলীগ ও যুবদলকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।