চলে গেলেন সত্যসন্ধানী গবেষক দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী
সাঈদ চৌধুরী
খ্যাতিমান গবেষক ও সাবেক সচিব দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী আজ (২৮ জুলাই ২০২১) সকালে চলে গেছেন তার স্থায়ী ঠিকানায়। ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রা-জিউ‘ন।
বাংলাদেশে সিভিল সার্ভিসে শিষ্টাচার, সততা, যোগ্যতা ও ন্যায়পরায়ণতায় ‘আইকন‘ হিসেবে পরিচিত দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী ছিলেন সত্যসন্ধানী গবেষক। জালালাবাদ অঞ্চলের ইতিহাস ও সমাজ-সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষণা করে বিশাল ঐতিহাসিক কাজ তিনি করে গেছেন। ইতিহাসের বর্ণনায় তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটের জটিল বিষয় বিশেষ নৈপুণ্যের সঙ্গে তিনি খুলে দিয়েছেন।
হযরত শাহ জালাল (র.) সহ সিলেটরে ইতিহাস নিয়ে যারা গভীর গবেষণা করেছেন, পুরানো কাগজপত্র ও দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে অনুসন্ধান করেছেন, দেওয়ান নূরুল আনোয়ার তাদের মধ্যে শীর্ষ স্থান অধিকার করে আছেন। শাহ জালালের (র.) সিলেট আগমন, ইবনে বতুতার সফর থেকে শুরু করে সিলেটের সাথে আরব জাহানের যোগসূত্রের সন্ধান, প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক কীর্তি, শিলালিপি ও নিদর্শনের বিবরণ, সিলেটি নাগরি ভাষা, মুসলমান সমাজের লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান, লেখক-সাহিত্যিকদের পরিচিতি ইত্যাদি নির্মোহ ভাবে দলিল সহকারে তুলে ধরেছেন।
দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর লেখায় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে পড়তে হয়না। তার গবেষণায় অতীতের সামগ্রিকতা সম্বন্ধে যাথানুপাতিক ধারণা মিলে। সহজ ভাষায় সমকালের সব রকমের রূপ-রেখা-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শ সহ বর্ণিত হয়েছে। দেশ-বিদেশের উপাদান ও উপকরণ সংগ্রহ করে তিনি ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করেছেন। তিনিই প্রমাণ করেছেন, সিলেট থেকে ভাষা আন্দোলন সহ বাংলাদেশের জাতীয় চেতনা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা সঞ্চারিত হয়েছে। বিখ্যাত ইতিহাসবিদরা তার তথ্য মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি নিজেদের ভুল শুধরে নিয়েছেন।
দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর সাথে যখনই মিলিত হয়েছি, সিলেট অঞ্চলের ইতিহাস নিয়ে কথা বলতেন। তিনি মনে করতেন, তুচ্ছ ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মিলেই ইতিহাসের সামগ্রিকতা গড়ে ওঠে। আর প্রতিটি ঘটনাই ইতিহাসের প্রক্রিয়ায় কারণিক প্রভাব বিস্তার করে। এজন্য ইতিহাসের প্রক্রিয়াকে নিবিড়ভাবে বুঝতে হলে সব রকমের ঘটনারই বিশ্লেষণ নিতান্ত প্রয়োজন।
দেওয়ান নূরুল আনোয়ার ইউরোপে সিলেটিদের ছড়িয়ে পড়ার ইতিহাস সম্পর্কে নানা রকম প্রশ্ন করতেন। এখানকার প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের সাথে সিলেটের ঐতিহাসিক বন্ধন আবিষ্কার করতেন। এর স্বপক্ষে অনেক নতুন তথ্য তিনি প্রমাণসহ পেশ করতেন। তিনি গর্ব করে বলতেন, সিলেটের মত বিশ্বের অনেক অঞ্চল এতোটা ইতিহাস সমৃদ্ধ নয়।
বাংলা একাডেমি থেকে দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর অনেকগুলো মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। জালালাবাদের কথা, সিলেট বিভাগের ইতিহাস ও স্বাধীনতা সংগ্রামে সিলেট সহ অসংখ্য মূল্যবান গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন তিনি। আমাদের ইতিহাস তার রচনায় বিপুল ভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে।
দেশ বরেণ্য এই কৃতি ব্যক্তিত্ব ১৯৩৯ সালে সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার সদরঘাট গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন ৷ তার কর্ম জীবন শুরু হয়েছিল সিলেট জজ কোর্টে আইন পেশার মাধ্যমে। ১৯৬৯ সালে তিনি ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন৷ সমৃদ্ধ কর্মজীবনে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, শ্রম ও কর্মসংস্থান, সংস্থাপন ও ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের উপসচিব, দুর্নীতি দমন ব্যুরোর ডাইরেক্টর এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ছিলেন৷ ১৯৯৭ সালে যুগ্ম সচিব হিসেবে অবসর গ্রহন করেন ৷
দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী তার বিশাল কর্মগুণে আমাদের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন। মৃত্যুকালে ৩ পুত্র, নাতি-নাতনি সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তার স্ত্রী সৈয়দা তাহেরা খাতুন চৌধুরী ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হুসেন সাহেবর কন্য৷ সৈয়দা তাহেরা গত বছর ইন্তেকাল করেছেন।
মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি ৷ মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন।