Sharing is caring!
চর্যাপদ সাহিত্য পুরষ্কার পেলেন কীর্তনখোলার কবি হেনরী স্বপন
“কই দেখি তো ? কেমন রূপের পান-সুপারি ?
পানের ঝালে ক্লান্ত।
খাঁচায় পাখির বন্দি মায়া ; ছোট্ট ঘরে– দুয়ার খোলা পাইয়া,
শিরীষ গাছের, ঝরে শীতল ছায়া…
বাঘের ছায়া কা-কা গর্জায়, কাউয়া কি তা শুনতে পায় ?
তরীর বৈঠা ইঞ্জিন ছাড়া চলে…
কেমনে হরি, প্রেমের তুষ-বিচালি– জ্বালানি ছাড়াই জ্বলে…?”
কবি হেনরী স্বপন এর কবিতার এই স্বাদ ও গন্ধে ছন্দের ঝাঁঝ বাজলেও তার বেশীরভাগ কবিতাই কিন্তু অমিত্রাক্ষর। ভিন্ন ধারার, ভিন্ন রূপ অনুরূপে তিনি কখনো মাইকেল মধুসূদন, কখনো জীবনানন্দ দাশ, আবার কখনো সুরেন্দ্র নাথ হয়ে ওঠেন অবলীলায়। আর সবকিছুকে ছাড়িয়ে তিনি মেতে ওঠেন কীর্তনখোলা নদী সাথে জলকেলি খেলায়। তার এ খেলা কবিতায়, আর ভাষায় তার বিচরণ নিত্য নতুন শব্দের সন্ধানে।
“বিহঙ্গেও স্নিগ্ধডানা লেগে ছড়িয়ে পড়লে—
উপদ্রুত কূলে এসে ট্যুরিস্ট উল্লাসে ঝাঁপ দেয়
সোনালি কর্কট উপমা লুকিয়ে;
ঈানীয় বোতলগুলো ভাসতে ভাসতে
তীরে আসে নাবিকবিহীন”।
এই যে ঈানীয় শব্দের অর্থ উদ্ধার করতে হলে সয়ং কবিকেই করতে হবে স্মরণ। তবে পানীয় বা পানিয় থেকেও হতে পারে এই ঈানীয়! তার কবিতায় এমন জটিলতা যেমন আছে তেমনি আছে সারল্যের চাষাবাদও। কবি হেনরী স্বপন যখন লেখেন –
আঁচলে জড়াবে ভোর
বাইরে এখনো চাঁদকে সজাগ রেখেছি ভুলিয়ে,
ঘরের আলোটা এক্ষুনি নিভিয়ে দিতে হবে—
ফিনাইল জলে
ভিজিয়ে রাখতে হবে ছোলা আর কাজু বাদামের শাঁস
ফুলে উঠবে স্তনের বোঁটা বুকের পাঁজরে
ভরে উঠবে বাগানবিলাস আনছান করা রজনীগন্ধার ডালপালা
ছড়াবে শাড়ির হোলিখেলা—
আঁচলে জড়াবে ভোর !
স্বপ্ন দেখবে হাঙর সাঁতার কাটছে হাইওয়ের জোছনায় ড্রাইভিং কোর্স…।
তখন তাকে নিয়ে নতুন করে বুঝতে হয়। মনে হয় কোথাও ভীষণ একা কবি। যদিও এটাই সত্য যে কবি মানেই আত্মভোলা ও একা সবসময়। তার আরেকটি কবিতায় কবি লিখেছেন –
কালোকে কালো বললে, কোলাহল হবে
সানগ্লাস ছাড়াই চোখের উপর চৈত্রের রোদ্দুর ছড়াবে,
দুর্ভিক্ষের গম খেয়ে আফ্রিকার মেয়েরা কৃষ্ণাঙ্গ
হয়েছে র্যাবের পোশাক খুলে…
এখানে কি প্রতিবাদী কবি? সত্যবাদী হতে হলে ঝুঁকি থাকে জীবনের এমন আভাস বলে দেয় হেনরী স্বপন জীবন, সংসারকে দেখেছেন দার্শনিকের চোখে। কখনো বড় অবজ্ঞার ছলে। আবার কখনো উদাসীনতায়। আর তখনই নিজেকে যেন কিছুটা সমাজ থেকে আলাদা করে দূরে স্থাপন করেছেন। অনেকে তাকে রাবীন্দ্রিক ও জসীমউদদীনীয় ঘরানার কাছাকাছি নিয়ে লিখেছেন – ” এই দুজনের সঙ্গে তাঁর কোনোভাবেই মেলে না। কিন্তু দর্শন মেলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে, আখ্যান যায় জসীমউদ্দীনের সঙ্গে। তবু শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র হেনরী স্বপন। কীর্তনখোলার ধ্যানমগ্ন এই কবির নাম ঘোষণা করা হয়েছে চর্যাপদ সাহিত্য পুরষ্কারের জন্য। গত ১২ নভেম্বর চাঁদপুর জেলা শহরের কস্তুরি চাইনীজ রেষ্টুরেন্টে আয়োজিত আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির মহাপরিচালক রফিকুজ্জামান রনি আটজনের মধ্যে কবিতায় কবি হেনরী স্বপন এর নাম ঘোষণা করেন। বরিশালবাসীর পক্ষে বরিশাল সাহিত্য সংসদ এর উপদেষ্টা ও জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক তপংকর চক্রবর্তী চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমিকে এজন্য ধন্যবাদ জানান। কবি হেনরী স্বপনকে জানান অভিনন্দন। তিনি বলেন, কবি হেনরী স্বপনের কবিতার রূপ রস ভিন্ন। প্রত্যেক মানুষের মাঝেই স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। হেনরীর কবিতা সবসময় স্বতন্ত্র ও কিছু কিছু কবিতা দূর্ভেদ্যও বটে।
কবি হেনরী তার সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধূলিতেও জং ধরতে দেখেন। তাই কাব্যের নাম হয়, ‘জংধরা ধূলি’। আবার মৃতের মুখেও হিংস্রতা খুঁজে পান বলেই হয়তো তার কবিতার শিরোনাম হয় ‘জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় আক্রোশ’।”
এগুলো আসলে কবিকে মূল্যায়নের চেষ্টা আমাদের মতো করে। তবে সাধারণ মানুষের কবি কিন্তু হেনরী স্বপন নিজেকে কখনোই দাবী করেননি। তার কবিতার বেশীরভাগই আসলে কবিদের জন্য। তাই কবিদের কবি তিনি হেনরী স্বপন।
জন্মান্তর গেছে শিকারীর দলে। মুখস্ত রেখেছে বহু—
প্রস্তর প্রাচীন হাতিয়ার—
পোড়ামাংস মুখরিত হবে—ধান উড়ানী উড়ন্ত ডানা;
ঝলমলিয়ে উঠবে প্রস্তরীয় জীয়নকাঠির ছোঁয়া।
সাধারণ পাঠকের কাছে নিঃসন্দেহে এটি দুর্বোধ্য। তবে যারা আধুনিক কবিতা পড়েন ও কবিতা নিয়ে ভাবেন সেসব কবিদের কাছে নয়।
কবিদের এই কবি হেনরী স্বপনকে চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরষ্কার প্রদান করায় সংগঠনটির নিকট কৃতজ্ঞতা বরিশাল সাহিত্য সংসদ ও সাহিত্য বাজার পত্রিকার পক্ষ থেকেও।
জীবনানন্দের বরিশালে জন্ম কবি হেনরী স্বপনের প্রথম কবিতার বই একফর্মা বা ১৬ পৃষ্ঠার কীর্তনখোলা। একটিমাত্র দীর্ঘ কবিতা বইটির সুত্রেই জানা গেছে ১৯৬৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কবি হেনরী স্বপন বরিশালের কাউনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জন হাওলাদার একজন ধর্মভীরু ব্যবসায়ী মানুষ ছিলেন। মা লীলাবতী হাওলাদার ছিলেন কবির প্রথম শিক্ষক। মায়ের আদরে বরিশালের জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা কবির গভীর বন্ধন কীর্তনখোলা নদীর সাথে। যে কারণে অনেক সুযোগ তৈরি হলেও বরিশালের নদীজলের লোনা স্বাদ ও মাটি কামড়ে পরে আছেন আজো। একটি এনজিওতে কর্মরত ছিলেন। অবসর নিয়ে এখন লোকাল পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক তিনি। স্ত্রী মারিয়া লাকী সরকার ও একমাত্র কন্যা কসটিকা চিনতী। এ-পর্যন্ত কবি হেনরী স্বপন এর ৮টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে—’কীর্তনখোলা’, ‘মাটির বুকেও রৌদ্রজ্বলে’, ‘বাল্যকাল ও মোমের শরীরে আগুন’, ‘জংধরা ধুলি’, ‘ কাস্তে শানানো মোজার্ট’, ‘ঘটনার পোড়ামাংস ‘, ‘হননের আয়ু’, ‘উড়াইলা গোপন পরশে’। সম্পাদনা করছেন বিখ্যাত জীবনানন্দ কবিতাপত্র।
Sharing is caring!